মেহনতি ওয়েবডেস্কঃ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান শিল্প পাটকল। চারটি জেলায়, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি গঙ্গা নদীর দুই তীরে প্রায় ৮০ খানা মত জুটমিল রয়েছে। যদিও তার মধ্যে প্রায় ২৫ টি বন্ধ পড়ে আছে। জুটমিল গুলোতে কাজ করেন প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক। কাজের পরিবেশ, শ্রমিক শোষণ, মজুরি এখনও মধ্যযুগীয়। নিয়মিত অশান্তি, গন্ডগোল, দূর্ঘটনা লেগে থাকে জুটমিলগুলোতে। প্রতিষ্ঠিত প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতি রয়েছে বিভিন্ন জুটমিলগুলোতে। এছাড়াও ছোট ছোট দলগুলোর ট্রেড ইউনিয়নও আছে কোন কোন মিলে। শ্রমিকদের ওপর মালিকের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য কোন ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নগুলো পালন করে না। শ্রমিকদের কাছে তাদের পরিচিতি মালিকদের দালাল রূপেই। যদিও ভয়ে হোক বা ভক্তিতে অধিকাংশ শ্রমিকরা এই সকল ইউনিয়নগুলির সাথেই আছে। প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নগুলি নিয়মিত মালিকদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পায়। বদলে শ্রমিক বিক্ষোভ সামাল দেওয়া, বেয়াড়া শ্রমিকদের টাইট দেওয়া, যে কোন অজুহাতে মালিক মিলে লক আউট ঘোষণা করলে তাকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করা, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকগুলোতে বসে শ্রমিক অধিকার খর্ব করার বিভিন্ন সিদ্ধান্তগুলো বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া, এই হল এদের কাজ। আর শ্রমিক আন্দোলন বলতে মাঝে মাঝে একদিনের ধর্মঘট ডাকা, কিছু দিবস পালন করা, মিছিল বের করা, শ্রমিকদের থেকে চাঁদা আদায় করা আর গেট পাস বিক্রি করে টাকা কামাই করাতেই এদের আন্দোলন শেষ। শ্রমিকদের স্বার্থের সাথে এইভাবে বেইমানি করতে করতে জুটমিল গুলো থেকে পার্মানেন্ট শ্রমিক শব্দটাই মুছে গেছে। এখন প্রায় ১০০ শতাংশ শ্রমিকই কনট্রাক্টে কাজ করে। প্রসঙ্গত, মিলহ্যান্ডস বলে পরিচিত শ্রমিকরাও কেউ পার্মানেন্ট নয়। শুধু জব সিকিউরিটি আর অন্য কিছু ফেসিলিটি অন্যান্য অংশের কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের থেকে বেশি। ঠিকা, ভাউচার শ্রমিকদের এবং লার্নারদের যে মজুরিতে কাজ করানো হয় তা নূন্যতম মজুরিরও কম। বিভিন্ন মিলে লার্নারদের ৮০ টাকা দৈনিক রোজ দেওয়া হয়, অথচ কাজ করানো হয় পূর্ণ মাত্রায়। বন্ধ মিলের শ্রমিকদের ভাতা নিয়েও চলে এক বড় দূর্নীতি, ভাতার একটা অংশ ইউনিয়নের ফান্ডে না দিলে ভাতা পাওয়া যায় না। পি এফ, গ্রাচুইটি, ডেথ বা অ্যাক্সিডেন্ট বেনিফিটের টাকা পেতে শ্রমিকদের কি পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয় তা ভুক্ত ভোগীরাই জানেন। নামে পি এফ ট্রাস্টির একটা ভোট হয় এবং সেখানে যে ইউনিয়নই জিতুক না কেন, আসলে ওটা টাকা কামানোর আর একটা জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়। ই এস আই চিকিৎসার সুবিধা পাওয়ার প্রক্রিয়াকে দিন দিন আরও জটিল এবং কঠিন করা হয়েছে, সে নিয়েও ইউনিয়নগুলো নড়েচড়ে না। লকডাউনের সময়কালের বেতন কোন শ্রমিক পায় নি, সে নিয়েও সরকার বা ইউনিয়নগুলো কোন পদক্ষেপ করল না। এখন আবার করোনা কে অজুহাত করে কাটা শিফটের বদলে বিভিন্ন মিলে মালিক পক্ষ টানা শিফট চালু করছে, বড় বড় ইউনিয়নগুলোর তরফ থেকে কোন প্রতিবাদ নেই।
ইউনিয়নগুলো প্রতিবাদ না করলেও শ্রমিকরা কিন্তু বিভিন্ন মিলে লাগাতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মত করে স্বতস্ফূর্ত ভাবে বা কোথাও কোথাও সংগঠিতভাবে বিক্ষোভ আন্দোলন জারি রেখেছেন। ছোট ছোট বিভিন্ন দাবীও তারা আন্দোলনগুলো থেকে অর্জন করছেন। এইরকম পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নগুলোর বাইরে বেরিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব ইউনিয়ন গড়ে তোলার বিভিন্ন উদ্যোগও সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এইরকমই একটি ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে, জুটমিল মজদুর মোর্চা, যার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল গত ১৫ ই আগস্ট হাওড়ার উলুবেড়িয়া মহকুমায়। উলুবেড়িয়া মহকুমার চারটি জুটমিলের প্রায় ৭৫ জন শ্রমিক প্রতিনিধির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন সম্পন্ন হয়, গড়ে ওঠে ৯ সদস্যের কার্যকরী কমিটি। জুটমিল মজদুর মোর্চা তাদের কর্মসূচি ও গঠনতন্ত্রে বলছেন, "জুটমিল শ্রমিকদের আন্দোলনের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভাসে কানোরিয়া জুটমিল আন্দোলনের কথা। দীর্ঘদিন ধরে সারা রাজ্যে সাড়া জাগানো সেই আন্দোলন আজ নানা কারণে স্তিমিত। ১৯৮০ এর দশকে কয়লা খনির মতো জুট শিল্পকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণের দাবিও তুলেছিল জুট শিল্পে সক্রিয় কিছু ইউনিয়ন। আজ কয়লা খনিও চলে গেছে বেসরকারি কোম্পানিগুলির হাতে, আর জুট শিল্পকে অধিগ্রহণের দাবিও হারিয়ে গেছে। শুধু কানোরিয়া নয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জুটমিলেই শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা গেছে। জুটমিল শ্রমিকরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ধারাটি বজায় রেখে গেছেন আগাগোড়া। কখনো তা সংগঠিত আকারে তো কখনো স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে। আর সেটা হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। আজও একজন জুটমিল শ্রমিক মাসে আট থেকে বারো হাজার টাকার বেশি রোজগার করতে পারেন না!!! এর সাথে আছে অমানুষিক পরিশ্রম। দিনের পর দিন উৎপাদনের চাপ বাড়িয়েই যাওয়া হচ্ছে জুটমিল শ্রমিকদের ওপরে। একের পর এক মিলে তার চেহারা এক একরকম। পার্মানেন্ট শ্রমিক প্রায় নেই বললেই চলে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির সাথে রাজ্য সরকারের মিটিং এ ঠিক হয়েছিল সমস্ত জুটমিল মিলিয়ে মোট হাজার জন শ্রমিক হবেন পার্মানেন্ট!!! যেখানে জুটমিলে শ্রম দেওয়া শ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি!!! তার ওপরে মাঝেমধ্যেই হয় শ্রমিক অসন্তোষ নয়তো কাঁচা পাটের অভাবের অজুহাতে বন্ধ হয়ে যায় কিছু কিছু জুটমিল। বন্ধ জুটমিলের শ্রমিকদের ভাতা, মিল বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের মজুরি-পিএফ-গ্রাচুইটির টাকা নিয়ে নয়ছয়ের ঘটনাও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। সিপিএম হোক বা তৃণমূল কংগ্রেস, যে পার্টিই রাজ্য সরকারে থাকুক সে জুটমিল মালিকদের সমস্ত অপরাধ এবং বেআইনি কার্যকলাপ রুখতে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেয় না। তার ওপরে এখন চালু মিলগুলির শ্রমিকদের মাথার ওপর ঝুলছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের আনা 'শ্রমকোড ২০১৯-২০' এর খাঁড়া। যার ফলে পার্মানেন্ট শ্রমিক স্তরটিই মুছে যাবে, শ্রমিক শ্রেণী কার্যত ধর্মঘট করার অধিকার, নিজের ইচ্ছেমতো ইউনিয়ন গড়ে তোলার অধিকার হারাবে, সপ্তাহে ৬ দিন ৮ ঘন্টা করে কাজের বদলে সপ্তাহে ৪ দিন ১২ ঘন্টা করে কাজ করতে হবে!!
বিদেশে রপ্তানি থেকে খাদ্যশস্য প্যাকিং, পরিবেশবান্ধব জুট সামগ্রীর চাহিদা যেখানে বাড়ার কথা সেখানে জুটমিল বন্ধ হয়ে যাওয়া এক অস্বাভাবিক বিষয় বলেই আমাদের মনে হয়। এই পরিস্থিতিতে জুট শিল্পে সক্রিয় বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে খুব একটা সদর্থক ভূমিকাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কয়েকদিন আগেই রেকর্ড হারে শ্রমিকদের ডিএ কমে যাওয়ার পরেও কোনো আন্দোলনের চেষ্টা আমাদের চোখে পড়েনি। বা জুটমিল বন্ধ হয়ে গেলে তা খোলার ব্যাপারে সামান্য অনুরোধ করেই দায় সারা হয়েছে। চালু থাকা মিলগুলিতে শ্রমিকশোষণ ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলির কোনো মিলভিত্তিক নড়াচড়াও নেই বললেই চলে। এই অবস্থার মুখোমুখি হয়ে সমস্ত প্রতিষ্ঠিত এবং বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলির বাইরে গিয়ে আমরা নিজেরা সংগঠিত হতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের নিজেদের ইউনিয়নে। জুটমিল মজদুর মোর্চা এর গড়ে ওঠার একমাত্র উদ্যেশ্য শ্রমিকবিরোধী সমস্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সচেতন করা, প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করা। জুটমিল মজদুর মোর্চা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কে এইভাবে বিবৃত করেছেন,
১) জুটমিল শ্রমিকদের ওপর চলা শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য শ্রমিকদের উৎসাহিত করবে,
২) জুটমিলের শ্রমিকদের ওপর কোম্পানির নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করবে এবং সমর্থন করবে,
৩) কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের সমস্ত শ্রমিকবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা,
৪) শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন তৈরির চেষ্টাকে বিরোধীতা করবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া,
৫) শ্রমিকদের ওপরে এবং শ্রমিকদের মধ্যেও কোনোরকম উঁচু জাত-নিচু জাত বা ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য-অপমানসূচক আচরণকে বিরোধীতা করা এবং আন্দোলন গড়ে তোলা,
৬) মহিলা শ্রমিকদের সমান মর্যাদা এবং সমান মজুরির প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তোলা,
৭) শ্রমিকদের স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশের উন্নতির দাবিতে সচেতনতা প্রচার ও আন্দোলন গড়ে তোলা,
৮) বাজারদর, পরিবারের ভরনপোষণ-চিকিৎসা, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা খরচখরচার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকদের অভিন্ন নূন্যতম মজুরি স্থির করার দাবিতে প্রচার ও আন্দোলন গড়ে তোলা,
৯) শ্রমিক বিরোধী 'লেবার কোড ২০১৯-২০' বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং আন্দোলনে সামিল হওয়া,
১০) শ্রমজীবী জনতাকে সস্তা শ্রমিক বানানোর চক্রান্ত NRC-NPR-CAA বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে সামিল হওয়া,
১১) কোভিড বিধির নামে শ্রমজীবী জনতার জীবিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে আন্দোলনে সামিল হওয়া।
১৫ ই আগস্ট, "স্বাধীনতা দিবস" কে সামনে রেখে বিভিন্ন মিলগুলোতে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নগুলো যখন শ্রমিকদের ভুলিয়ে রাখতে ফিস্টের আয়োজন করছে, তখন অন্ততপক্ষে কিছু শ্রমিকরা যে নিজেদের অবস্হার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন এবং নতুন কিছু করার জন্য চেষ্টা করছেন, এটা একটা আশাজনক দিক। এখন দেখার বিষয় হল, ইউনিয়নগুলোর দাদাগিরি এবং রক্তচক্ষুকে প্রতিরোধ করে এই প্রচেষ্টা কতদূর এগুতে পারে এবং জুটমিল শ্রমিকদের আন্দোলনে নতুন কোন সমীকরণ তৈরি করতে সফল হয় কিনা।
0 Comments