পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড— পাওলো ফ্রেইরি

  • পাওলো হায়াগ্লুস ন্যাভিস ফ্রেইরি হলেন ব্রাজিলের মানবতাবাদী শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি যথেষ্ট অভাবের মধ্যে বস্তিতে বড় হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বলেন "ক্ষিদের কারণে কোনো পড়াশোনাই আমার মাথায় ঢুকতো না। এমন না যে আমি বোকা ছিলাম, অথবা আমার আগ্রহের কোনো অভাব ছিল। আমার সামাজিক অবস্থা আমাকে শিক্ষা নিতে দেয়নি।" প্রবল দারিদ্রতা আর ক্ষিদে তার শেখার ক্ষমতাকে আরো গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ভীষণ অভাবের দিনগুলোই পরবর্তীতে তাঁকে দরিদ্র ও শোষিতদের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। দর্শন এবং মনোবিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে সাও পাওলো তে শিক্ষা অধিকর্তা হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানেই তিনি শিক্ষা সম্বন্ধীয় নিজস্ব তত্ত্ব প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে তিন শত নিরক্ষর আখ চাষীদের মাঝে কাজ শুরু করেন। ব্রাজিলে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর তিনি গ্রেপ্তার ও নির্বাসিত হন। এরপর লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গ্রামে গ্রামে দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করতে থাকেন। মূলত জঁ-পল সার্ত্র, এরিক ফ্রম, লুই আলত্যুসের, হার্বাট মার্কুস, কার্ল মার্ক্স প্রমুখ দার্শনিকের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। বলতেন, ‘‘যীশু আমায় গরিবদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, গরিব মানুষ আমাকে পাঠিয়ে দিল মার্ক্সের কাছে।’’ শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষা সম্বন্ধীয় বিষয়ে তাঁর বহু উল্লেখযোগ্য বৈপ্লবিক কাজ আছে। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত বই পেদাগোজিয়া দো ওপ্রিমিদো / পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড গোটা বিশ্বে সমাদৃত হয়। আজ ১৯শে সেপ্টেম্বর পাওলো ফ্রেইরির ১০০তম জন্মদিনে তাঁর এই অন্যতম বিখ্যাত আলোড়ন সৃষ্টিকারী বইটি নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমরা করবো।
পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড, শোষিতের শিক্ষাতত্ত্ব পাওলো ফ্রেইরির লেখা একটি অন্যতম বিখ্যাত ও বিতর্কিত বই যা ব্যান করা হয়। বইটিতে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে শোষকের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এক ব্যাঙ্কিং শিক্ষাপদ্ধতির কথা বলা হয়েছে যেখানে শোষকের স্বার্থরক্ষিত হয়। এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান মুখস্থ করে মেমোরিতে জমা রাখে, যেভাবে ব্যাংকে অর্থ ডিপোজিট করা হয়। মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করা এই ধারণায় ডিপোজিটার (শিক্ষক) হলেন এক্টিভ এজেন্ট এবং রিসিভার (শিক্ষার্থী) হলেন প্যাসিভ এজেন্ট যেখানে লেনদেনের ডেবিট ক্রেডিট হিসাব। ফ্রেইরি দেখাচ্ছেন এই শিক্ষা পদ্ধতি মানুষের চেতনা, বিচার বুদ্ধির বিকাশকে ও তার সৃজনশীলতাকে ক্রমশ মেরে ফেলে, ফলে শিক্ষার্থী ক্রমশ এক যান্ত্রিক বস্তুতে পরিণত হয়। ফ্রেইরি বলেছেন- “ব্যাঙ্কিং পদ্ধতির মানবতাবাদের মুখোশের আড়ালে প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা রয়েছে মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করার”।

এর পাল্টা হিসেবে মূল সমস্যা গুলি সনাক্ত করে ফ্রেইরি দেখানোর চেষ্টা করেছেন এক বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতির যা মূলত শিক্ষার্থী - শিক্ষক "ডায়লগ" ভিত্তিক। যে শিক্ষায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই দাতা ও গ্রহীতা। একপাক্ষিক না। উভয়ের মধ্যেকার জ্ঞানগত দ্বন্দ্ব বিরাজমান থাকবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের অংশগ্রহণ থাকবে। জ্ঞানের চর্চা অনেক বেশি ফ্লেক্সিবেল হবে। ফ্রেইরির মতে, "ব্যাঙ্কিং শিক্ষা পদ্ধতি সৃজন ক্ষমতাকে অসার করে, বাধাগ্রস্ত করে। অপরপক্ষে, সমস্যা শনাক্তকারী শিক্ষা প্রতিনিয়ত বাস্তবতার উন্মোচন করে। ব্যাঙ্কিং শিক্ষা চেতনা কে ঘুম পারিয়ে রাখে, আর সমস্যা শনাক্তকারী শিক্ষা চেতনার উদ্ভব ঘটায় এবং বাস্তবতাকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে”। এই রকম শিক্ষা মানুষকে বিপ্লবী করে, অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করতে শেখায়, ফলে এই শিক্ষা শোষকের স্বার্থ রক্ষা করে না। ফ্রেইরির মতে শিক্ষা মানুষের এমন এক ক্ষেত্র যা মানুষ নিজের সচেতনায়নের মাধ্যমে বৈষম্যহীন নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে সক্ষম। কিন্তু জ্ঞান সবসময় একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় জ্ঞানের প্রয়োগ, জ্ঞান অর্জনে মানুষের প্রবেশাধিকার এবং বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে তুলনামূলক নিপীড়িত ও শোষিত মানুষেরা বঞ্চিত। পাওলো ফ্রেইরি তার পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড বইতে একদিকে যেমন বিশ্বজুড়ে এই ব্যাঙ্কিং শিক্ষানীতির মাধ্যমে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তারের স্বরূপ উন্মোচন করেন, তেমনই শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত অংশের মানুষের শিক্ষায় ব্যাপক অংশগ্রহণ, প্ৰকৃত ক্ষমতায়ন ও সর্বোপরি সমাজ বদলের রাজনীতির কথা তত্ত্বের মাধ্যমে প্রয়োগে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।

Post a Comment

2 Comments

  1. পাওলো ফ্রেইরি সম্পর্কে এই ছোট্ট নিবন্ধটি তাঁকে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল।এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

    ReplyDelete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)