মাইকেল মধুসূদন দত্ত: রেনেশাঁসের কাব্যদূত!

অশোক মুখোপাধ্যায়

     মাইকেল মধুসূদন দত্ত:     রেনেশাঁসের কাব্যদূত!


[১] দাঁড়াও পথিকবর . . .

আসুন, পরিণাম কবিতা দিয়েই তাঁর স্মরণালেখ্য শুরু করা যাক। ২৯ জুন ১৮৭৩ মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি ঊনশতার্ধ আয়ুষ্কাল শেষের আপন সমাধি-বাণী (epitaph) রচনা করে রেখেছিলেন:

“দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে

(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি

বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত

দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!” . . . 

সেই মধুসূদন দত্তের জন্মদ্বিশততম বর্ষ সমাগত। তাঁর পরিচয়, বাংলা কাব্যজগতে অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়ে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের ভাষা সরণিতে বলিষ্ঠ কদম ফেলে ফেলে এক ঝড় তুলেছিলেন। তিনি সমকালীন সভ্যতার সস্তার ক্যারিকেচারকে—নব্য ও প্রবীন উভয়কে ধরেই—নাটকীয়ভাবে চরম কষাঘাত করতে পেরেছিলেন। তিনি, শোনা যায়, এক সঙ্গে চারজনকে বসিয়ে নাকি চারটি আলাদা আলাদা রচনার শ্রুতিলেখ (dictation) নির্দেশ দিতে পারতেন। তিনি তাঁর রচিত মহাকাব্যে সনাতন মনে পূজ্য “আর্য” রাঘবকে মধ্যমঞ্চ থেকে সরিয়ে রাক্ষসকুলের রাবণকে এবং ইন্দ্রজিৎকে সেখানে তুলে আনতে পেরেছিলেন। যা ছিল সেদিনের বাংলার বুকে রেনেশাঁসের এক অমোঘ সঙ্কেত। 

বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ নিয়ে প্রথম দিকে সামান্য দ্বিধা থাকলেও বিদ্যাসাগর অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁর এই অনুজ বন্ধুকে। কত ভাবে তাঁকে সাহায্য করেছেন নীরবে। একটাই কারণে। বাংলা সাহিত্যের আর এক দিক্‌পাল কিছু কাল পরে এসে সংস্কৃতির মঞ্চে তাঁর প্রতিটা সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার কর্মে কার্যত ভেটো দিয়ে রক্ষণশীল সমাজপতিদের হাত শক্ত করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এই ধূমকেতু সদৃশ কবি এসে প্রথম দিন থেকেই সাড়ম্বরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর পাশে। নৈতিক সমর্থন নিয়ে। সেই দুই মহান মুক্তমনার মোহানায় বাংলার সাহিত্যাকাশ অন্তত দশ বছরের জন্য তাঁর কাব্যসম্ভার থেকে এক সামুদ্রিক মুক্তির গর্জনধ্বনি শুনেছিল। 

আজ হয়ত সেই ধ্বনি থেমে গেছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তা থামেনি। গণসাহিত্য চর্চায় মধুকবি খানিক পিছন সারিতে চলে গেলেও বারবার তাঁকে প্রগতিশীল সাহিত্যপথিক যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তকের সেনাদল ফিরিয়ে আনেন ধর্মীয় কচকচির শোনিতপিপাসুদের মাঝখানে। স্মরণ করিয়ে দেন বিভীষণের উদ্দেশে বলা ভ্রাতুষ্পুত্র মেঘনাদের ধারালো সংলাপ। আজও যারা গৈরিক হিংস্র দুর্বৃত্তদের পথ দেখিয়ে বাংলায় নিয়ে আসছে, তাদের উদ্দেশে চরম ঘৃণায় যাঁর লেখনীতে ঝলসে ওঠে—“নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?” যে কলমে বিভীষণদের সর্দার পরিচিতি সমেত স্পষ্ট উচ্চারণে তাদের স্বরূপ চিনিয়ে দেন তিনি—

“তুমি; − কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,

জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,−এ সকলে দিলা

জলাঞ্জলি? . . .

কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,

হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে?

গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।”

গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ সেই মধুকবির ২০০-তম জন্মদিন পার হয়ে গেল। 

জন্মদ্বিশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে ভারি-চর্চার প্রারম্ভ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে! তাঁকে ঘিরে আমাদের কাজ কিঞ্চিৎ কঠিন, কেন না, শুধু তাঁর অতুল প্রতিভার সারতত্ত্ব সন্ধান করলেই তা সমাপ্ত হবে না, খুঁজতে হবে তাঁর অকালে ফুরিয়ে যাওয়ার কার্যকারণকেও।  

[২] ভাঙা নৌকার সওয়ারি

মধুসূদনের জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়িতে, কবোতাক্ষী নদীর ধারে। তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর উকিল পিতার হাত ধরে কলকাতায় আসেন এবং তদানীন্তন হিন্দুস্কুলে ভর্তি হন (যেটা তখন হিন্দু কালেজ নামেই পরিচিত ছিল)। সেখানকার পাঠ সাঙ্গ করে যখন তাঁর স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার কথা, তখনই তিনি হিন্দু ধর্মের পরিচয় পরিত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন। ফলে হিন্দু কলেজে তাঁর আর পড়া হয় না, তিনি হাওড়ার বিশপ’স কলেজ থেকে স্নাতক পর্ব সমাপ্ত করেন। 

মধুসূদন বাংলার নবজাগরণের এক আশ্চর্য ফসল। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় বাংলা কাব্যের জগতে একজন কলম্বাস। একে তো সবে অক্ষয়কুমার দত্ত আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা গদ্য ভাষা নির্মাণের একেবারে গোড়ার পর্বে তাঁর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সদরে প্রবেশ। তাঁর মধ্যে আবার কাব্য এবং নাটক—যে দুটি জায়গায় তিনি হাত দিলেন—তা তখনও মঙ্গলকাব্যের ছায়াচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেই অর্থে তাঁর কোনো পূর্বসূরি নেই। অনুসরণীয় কোনো উদাহরণ তাঁর সামনে সেদিন উপস্থিত ছিল না। অক্ষয় দত্তের চাষ ছিল কঠোর গদ্যে, প্রবন্ধ সাহিত্যে। যদিও তা ছিল এক অনুপম শৈলীর প্রকাশ। একটু পরে বিদ্যাসাগর যে গদ্য রচনায় হাত দিয়েছিলেন, তাও ছিল প্রধানত অনুবাদ সাহিত্য। তাঁর মৌলিক কাজগুলি প্রধানত বিতর্কমূলক ও রম্য রচনা। আর সংস্কৃত সাহিত্য বিচার বিষয়ক একটি মাত্র রচনা ছিল তাঁর আদ্যন্ত মৌলিক প্রবন্ধ। তারও কোনোটার থেকেই মধুকবির নেবার মতো রসদ সরাসরি কিছু ছিল না—এক ভাষা শৈলী ছাড়া। 

আরও আশ্চর্য এইখানে যে যে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের শিক্ষানীতি নিয়ে আমাদের দেশের সরোজদত্তপন্থী এবং উপনিবেশোত্তর দেশজপন্থী এক দল তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীর এত মাথাব্যথা, যে অনপনেয় বেদনায় তাঁরা উনিশ শতকের জাগরণের সমগ্র বাস্তবতাকে খারিজ করতে মরিয়া প্রয়াস চালাতে থাকেন, মধুসূদনের জীবনের সিংহভাগ সেই মেকলান্ত অভিমুখে ধাবিত হয়েও তাঁর অমর কাব্য ও সাহিত্য কৃতি জীবনের শেষ এবং ঝোড়ো যুগটাতে তাকে একেবারে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছিল। তিনি দেহেমনে সত্যিই ছিলেন একেবারে ইংরেজ সাহেব, শুধু চামড়ায় ভারতীয়। তথাপি শেষ পর্যন্ত তিনি মেকলের সন্তান হলেন না। অন্য দিকে মধুসূদনের হিন্দু কালেজের সহপাঠী ও সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে যাঁরা ছিলেন বন্ধুস্থানীয়, তাঁরা সাহেব না হয়েও এবং স্বদেশপন্থী ঐতিহ্য ও সংস্কারের অনুসারী হয়েও কার্যত মেকলের ইচ্ছাপূরণ করে গেছেন; যথা, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কুবিহারী দত্ত, গৌরদাস বসাক, রাজনারায়ণ বসু, প্রমুখ। পরবর্তী জীবনে নানা কৃতীর অধিকারী হলেও তাঁরা কেউই মধুসূদনের মতো প্রগতি পথিক হয়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এতটা সফল হননি। সেদিক থেকে উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে মেকলের সত্যিকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা বোঝার জন্য মধুকবি আমাদের একালের সাহিত্য ও সমাজ বিশ্লেষকদের কাছে একটা জাজ্জ্বল্যমান কষ্টিপাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদি আমরা চিনতে পেরে থাকি। কিংবা, যদি আমরা সত্যটা জানতে চাই। 

হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই মধুসূদনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য আয়ত্ত করতে হবে, ইংল্যান্ডে যেতে হবে, গ্রিক ও লাতিন ধ্রুপদী সাহিত্যের সুর ও ধ্বনি আত্মস্থ করে নিতে হবে, আর অবশেষে শেক্সপিয়র মিলটনের ধারাবাহিকতায় ইংরেজি কবিতা লিখে কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব অর্জন করতে হবে। তাঁর পিতা যখন এক জমিদার কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্বন্ধ ঠিক করে ফেললেন, মধুসূদন তার মধ্যে দেখলেন এক বনেদি অন্ধ ও খঞ্জ ঐতিহ্যের বন্ধনের পাকে চিরকালের জন্য জড়িয়ে যাওয়ার বিপদ। সেই বিপদ থেকে নিষ্কৃতি এবং মুক্তি পেতে তিনি চার দিক না ভেবে তাড়াহুড়ো করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে বসলেন। 

আর আসলে সেই তখনই তিনি গরম তাওয়া থেকে সিধা এক বহ্নিমান চুল্লির মধ্যে গিয়ে পড়লেন। এক বিপদের কবল থেকে বেরতে গিয়ে আর এক আরও ভয়ানক বিপদের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

তবে সে কথায় আমরা পরে অন্যত্র কোথাও আসব। এই লেখায় মধুকাব্যই আমাদের একমাত্র বিচার্য। 

[৩] রতনের লোভ

উপযুক্ত কাজের এবং রোজগারের ব্যবস্থা না হওয়ায় তিনি চলে গেলেন মাদ্রাজে। সেখানে মধুসূদন একটি খ্রিস্টান মেয়েকে (রেবেকা ম্যাকভিস্টা) বিয়ে করে ফেললেন এবং চাকরির সন্ধান করতে লাগলেন। ইংরেজি তিনি ইতিমধ্যেই খুব ভালো করে রপ্ত করেছেন। সেখানে গিয়ে অন্য একাধিক ভাষা শিখলেন। সংস্কৃত তামিল তেলুগু গ্রিক লাতিন ও হিব্রু। লক্ষ্য ওই সব ভাষায় লিখিত ঐতিহাসিক ক্ল্যাসিক্স যত দূর পারা যায় পড়ে ফেলা। বরাবরই তিনি পড়াশুনোয় তুখোড়। আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। একটা অনাথ শিশুদের স্কুলে পড়িয়ে, একটা স্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্রে কাজ করে এবং এদিক ওদিকে অনুবাদের কাজ করে সামান্য আয় করলেও তাঁর ব্যয়ের তুলনায় তা কিছুই নয়। তার মধ্যেই তিনি ইংরেজিতে কাব্য রচনা শুরুও করলেন। মিলটনের অনুসরণে লিখে ফেললেন Captive Lady এবং Visions of the Past; নারীমুক্তি আর স্বদেশ চেতনার ভ্রূণ ঋদ্ধ এক অসাধারণ কাব্য। কোনো এক সমালোচক তাতে দেখতে পেলেন স্কট আর বায়রনের ছায়া। আর এক বাঙালি একে “অন্ধকারের মধ্যে অরোরা বোরিয়ালিস” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু তার সুবাদে ইংরেজি ভাষার কবি হিসাবে তিনি তেমন কোনো স্বীকৃতি পেলেন না। অন্তত কলকাতায় তার তেমন কোনো প্রভাব পড়ল না। বরং তাঁর পাঠানো রচনার কপি পাঠ করে শিক্ষা বিভাগের সচিব ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন বন্ধু গৌরদাস বসাকের মাধ্যমে পরামর্শ দিলেন, দত্ত যেন ইংরেজির বদলে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন।

জীবনে এই প্রথম তিনি একটি সুপরামর্শ মেনে নিলেন। পিতৃদত্ত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা করতে কলকাতায় ফিরে এসেই তিনি বাংলায় নাটক এবং কাব্য চর্চায় মন দিলেন। 

কিন্তু মধুসূদন যে! তাই তাঁর প্রথম নাটক, এবং বাংলা সাহিত্যেরও প্রথম আধুনিক মৌলিক নাটক, রচিত হল এক নাটকীয় ঘটনাচক্রে। কলকাতায় তখন এক জমিদার পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেলগাছিয়ায় নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছে, সেখানে রামনারায়ণ তর্করত্নের সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা “রত্নাবলী” শীর্ষক এক নাটক পরিবেশিত হবে। সেই জমিদারদের সঙ্গে তখন আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্তাদের দারুণ খাতির! কেন না, ইংরেজ বণিকদের সৌজন্যেই তাঁরা জমিদার। সেই সুবাদেই তাঁদের জমিদারি সম্পত্তি। তো সেই সব সাহেব সুবোরা আসবেন বাংলা নাটক দেখতে। তার জন্য নাটকের পাণ্ডুলিপির ইংরেজি অনুবাদ চাই। বন্ধু গৌরদাস বসাকের সুবাদে পয়সার বিনিময়ে অনুবাদের কাজটা পেলেন মাইকেল। কিন্তু অনুবাদ করার সময় সেই নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়ে মধুর মন ভরছিল না। এক পত্রে তিনি বন্ধুকে লিখলেন, এসব কী যা-তা নাটক হচ্ছে? তাঁর মনের ভাব তিনি চেপে রাখতে পারলেন না। স্বরচিত ভাবী নাটকের প্রস্তাবনা অংশের এক কবিতায় এক জায়গায় লিখেই ফেললেন:

“অলীক কুনাট্য রঙ্গে    মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,

      নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।”  

নাটকটির পরবর্তী সংস্করণের প্রস্তাবনায় তিনি অবশ্য এই কবিতাটি বর্জন করেন। কিন্তু তাঁর এই পংক্তিটি এক প্রবচনের আকার ধারণ করে বাংলা বাগ্‌ধারায় অমরত্ব লাভ করে বসে আছে। 

রত্নাবলী অনুবাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়ে এল “শর্মিষ্ঠা” নাটক। ১৮৫৮ সালে। পাত্রপাত্রী পুরাণ থেকে সংগৃহীত, কিন্তু তারা কথা বলে উনিশ শতকের (সাহিত্যিক) ভাষায়, তাদের আচরণ আর গুপ্তযুগের প্রতিচ্ছবি নয়, একেবারে আধুনিক।

আমাদের যেটা বিস্মিত না করে পারে না, ১৮৪৭ সালে মাদ্রাজ চলে যাওয়া, সেখানে বসে নানা দুর্দশার মধ্যেও ইংল্যান্ডে বা ইউরোপে যাওয়ার পরিকল্পনার চাপে ক্রমাগত ইংরেজি লাতিন হিব্রু সংস্কৃত ও তেলুগু ভাষার চর্চা এবং সারা জীবন সমস্ত চিঠিপত্র ইংরেজিতে লেখার অভ্যাস করতে করতেও, তিনি আট বছর বাদে কলকাতায় ফিরে এসে বাংলা ভাষায় যে দখল ব্যক্ত করলেন, তা কী করে সম্ভব হল! এর অর্থ হল, ইংরেজিতে কাব্য রচনার প্রবল আগ্রহের মধ্যেও তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন চালিয়ে গেছেন, বাল্মীকি ব্যাস কালিদাস ভবভূতি জয়দেব বিদ্যাপতি কৃত্তিবাস কাশীরামদাস ভারতচন্দ্রের খবরাখবর বেশ ভালো মতো সংগ্রহ করেছেন, এবং তার ফলে, সুযোগ আসতেই সেই প্রস্তুতির ফসল উৎপাদন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এটা কোনো ম্যাজিক নয়, এ ছিল এক দিকে তাঁর প্রতিভার বিপুল ঊর্মিমালা; আর অন্য দিকে তাঁর সুপ্রশস্ত জ্ঞানের নির্বিচার অনপেক্ষ পরিচর্চা। “হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন . . .” তিনি লিখেছেন প্রায় দশ বছর পরে। সেই রতনে অবহেলার কাল বলে পরিচিত সময়েও তিনি দুহাত ভরে বাংলা তথা সংস্কৃত খনি থেকে অসংখ্য মণিমুক্তা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। অবহেলার ঢাকঢোল বেজেছে। কুড়োনোর সংবাদ প্রচারিত হয়নি।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়, হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ই তিনি তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভার এক অসাধারণ প্রমাণ দিয়েছিলেন। এক বিতর্কের জন্ম হয়েছিল সহপাঠীদের মধ্যে—শেক্সপিয়র আর নিউটনের মধ্যে কে বড়। স্বভাবতই মধু ছিল সাহিত্যিকের পক্ষে। অন্য কেউ কেউ ছিল নিউটনের দিকে। ক্লাশে এর মধ্যে এক দিন অঙ্কের স্যর একটা কঠিন অঙ্ক দিলেন কষতে। ভালো ভালো ছাত্ররা কেউ পারছিল না। এমন সময় মধু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যর, আমার হয়ে গেছে। স্যর তাঁকে বোর্ডে এসে সবাইকে করে দেখাতে বললেন। 

গোটা ক্লাশ এবং এমনকি অঙ্কের সেই শিক্ষকও অবাক। মধুর অঙ্কটঙ্ক তেমন ভালো লাগত না। সে ছিল সাহিত্যে কাব্যেই মশগুল। ইংরেজিতে কবিতা লিখতে ভালোবাসত। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক রিচার্ডসনের সৌজন্যে তার কোনোটা এদিক ওদিক ছাপা হত। সেই সে কী করে এমন ভালো অঙ্ক শিখে গেল! আসলে মধু ছোট বেলা থেকে অনেক কিছু চুপচাপ সেরে ফেলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। আকস্মিক স্ফূরণ নয়, সমস্তটাই ছিল প্রস্তুতির ফসল, কিন্তু সহজ লোকচক্ষুর অন্তরালে।

বিভিন্ন সময়ে বন্ধুদের উদ্দেশে লেখা তাঁর চিঠিপত্রগুলি পড়লে বোঝা যায়, কীভাবে নানা ব্যাপারে মধুর এরকম সব গোপন প্রস্তুতি চলত। সেকাল থেকে শুরু করে একালেও আমরা অনেকেই মধুচর্চা করতে বসেও এই সাজঘরের সলতে পাকানোর খবর নিইনি বা নেবার চেষ্টা করিনি। তাই আমরা সকলেই বিস্মিত বোধ করি। এবং ভুলে যাই যে প্রতিভার স্ফূরণও প্রয়াস নির্ভর। 

[৪] সৃষ্টিসুখের উল্লাস  

শীঘ্রই মধুসূদনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক। সমকালে। যিনি বাংলা প্রায় “না জেনে”-ই বাংলায় মঞ্চ সফল একটা মৌলিক নাটক লিখে ফেলতে পারেন, এবং তার পরেই আরও একটা—“পদ্মাবতী” (১৮৬০), ঠিক পরে পরে দুটো প্রহসন—“বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোঁ” এবং “একেই কি বলে সভ্যতা” (১৮৬০), এবং অনতিবিলম্বে একটা ঐতিহাসিক নাটক—“কৃষ্ণাকুমারী” (১৮৬১), তাঁর না হলে কার খ্যাতি হবে? মজার কথা হল, প্রহসন দুটোর একটাও সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত মঞ্চ পেল না। রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এসে বেলগাছিয়ার নাট্যশালার মালিকদের বোঝাল, তারা এই সামাজিক রীতিরেওয়াজ নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ মেনে নেবে না। আর ইয়ং বেঙ্গলদের তরফেও একজন বিশিষ্ট সদস্যের মাধ্যমে জানানো হল যে তাদের অতি-আধুনিকতা নিয়ে রস-রসিকতা তাদের মনঃপুত নয়। 

চিঠিপত্রের সাক্ষ্যে জানা যায়, মধুসূদন সেদিন খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। স্বাভাবিক। 

আমরা কিন্তু এতে আজ বেশ আনন্দ পাই। 

কেন?

কারণ, কার্যত নিজের অজান্তেই মধুসূদন দত্ত সেদিন এই দুই প্রহসনের মধ্য দিয়ে বাংলার নব জাগরণের দুই কাণ্ডারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্তের জাগৃতিমূলক কর্মকাণ্ডকে সাহিত্যে রূপদান করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁর দুটি তিরই সঠিক লক্ষ্য ভেদ করেছিল। সামাজিক রক্ষণশীলতাকে আঘাত না করে না ভেঙে সংস্কার না করে সেদিনকার বাংলার তথা ভারতীয় সমাজ এগোতে পারত না। সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর একটা তির নিক্ষিপ্ত হয়েছিল “বুড়ো শালিক”-দের অভিমুখে। আবার নিছক সাহেবিয়ানা ইংরেজি বুলি আর যথেচ্ছ মদ মাংস পান ভোজন দিয়ে যে এই সংস্কার সাধন হবে না, এই বার্তাও তিনি দিতে চেয়েছিলেন “সভ্যতাপন্থী”-দের উদ্দেশে। দুই পক্ষই যদি জানতে পেরেও এই প্রকল্পের বিরোধিতা না করত তাহলে বুঝতে হত, মধুর অবস্থান এবং কলমের শক্তিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। না, দত্তজার প্রতিভাকে খাটো করে দেখার সাধ্য সেদিন কারও ছিল না। এও মনে রাখা ভালো, দুটি নাটকই আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চা ও মননের বর্তমান প্রেক্ষিতে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে। 

দুটি নাটকের সাময়িক মঞ্চ প্রত্যাখ্যানের জেরে মধুসূদন এবার কাব্যরচনায় মন দিলেন। পর পর রচিত হয়ে চলল “তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য” (১৮৬০), “মেঘনাদবধকাব্য” (১৮৬১), “বীরাঙ্গনাকাব্য” (১৮৬২) এবং “ব্রজাঙ্গনাকাব্য” (১৮৬৩)। এর মধ্যে মেঘনাদবধ লেখা হয় আধুনিক মহাকাব্যের রূপে। তার আলোচনা আমরা আলাদা করে করব। আপাতত সব কটি সম্বন্ধে এক সঙ্গে ধরে দুচারটে সাধারণ কথা বলে নিতে চাই। 

প্রথমত, আঙ্গিকের দিক থেকে মধুসূদন দত্ত প্রথম তিলোত্তমাসম্ভব আখ্যানের মাধ্যমে বাংলা কাব্যের জগতে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেছেন। যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে। কাব্যগ্রন্থটিও পরে তাঁকেই উৎসর্গ করেন। ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে তিনি এই কাব্যশৈলী আয়ত্ত করেছিলেন এবং তারপর তাকে বাংলা ভাষায় চালান করে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত সুসমঞ্জসরূপে। সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যের আঙ্গিক থেকে এটা কতখানি যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়ে গেল এক ধাক্কায়। শুধু যে জোড়া জোড়া পদে অন্তে মিল আর এতে আবশ্যক রইল না তাই নয়, একই সঙ্গে যতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পংক্তির বাঁধন ছিন্ন করে ভাবের প্রয়োজন অনুযায়ী অবচ্ছেদের প্রকল্পনা সম্ভব হল। এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি বাংলা কবিতার গায়ে চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে গেল। 

এই আঙ্গিকের প্রয়োজন হল কেন মধুকবির? 

এইখানে আমরা দেখি তাঁর নতুন সৃষ্টির দ্বিতীয় মহিমাকে। তিনি যে কাব্যসৌধ নির্মাণ করতে চলেছেন, তার ভাববস্তু নতুন। পুরাণ থেকেই সে চরিত্র এবং উপাখ্যান খোঁজে। ভারতের ধ্রুপদী সংস্কৃত কাব্য নাটক থেকেই কাঁচা মাল সমূহ সংগ্রহ করেন তিনি। কিন্তু সেই চরিত্রগুলি হয়ে ওঠে উনিশ শতকের মানুষ। এমনকি মানুষীরাও। হ্যাঁ, নারী সম্পর্কেও তিনি যে চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ তা কিন্তু মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক প্রতিচ্ছবি নয়। তিনি যেমন বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতে বলেন, মেয়েদের আমরা এত কাল পুরুষের ভোগের পুতুল বানিয়ে রেখেছি, সেই মতো শাসন করেছি আর অনুশাসন তৈরি করেছি, সেই অবস্থা থেকে তাদের বের করে আনতে হবে, সেই ভাবেই তিনি একের পর এক কাব্যে তাঁর নারী চরিত্রদের চিত্র আঁকেন। তারা নারী স্বাধীনতার শ্লোগান দেয় না সত্যি কথা, কিন্তু তারা কথায় আচরণে নারী স্বাধীনতার দ্যোতক হয়ে ওঠে। নবজাগরণের কালের সুর তাদের মধ্যে বেজে ওঠে। কান পাতলেই তা শোনা যায়। বোঝার মন থাকলেই তা বোঝাও যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে সামাজিক মানসিক বন্ধন থেকে বাংলার নারীকে মুক্ত করতে চান তাঁর বিবিধ প্রকারের সংস্কার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে, অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে যে নরনারীর বিবাহ পূর্ব প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনের কথা উত্থাপন করে ফেলেন, মধুসূদনের নারী চরিত্ররা একে একে তারই নানা মাত্রিক প্রতিরূপ হয়ে উঠতে থাকেন। অনায়াসে। অবলীলাক্রমে। কবিতার বিবরণে। সংলাপনে। আচারে বিচারে। 

এই বিষয়টার সবিশেষ গুরুত্ব এইখানে যে তখনও বাংলা গদ্য সাহিত্য তত দূর পা ফেলে এগিয়ে আসতে পারেনি। বঙ্কিমচন্দ্র সার্থক উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী” লিখে নারীর প্রেমের স্বাধীনতা (ঘোষণা নয়) প্রদর্শন করতে আসরে নামবেন আরও কয়েক বছর বাদে, ১৮৬৫ সালে। তার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে (আসলে পিছিয়ে) যাবেন দশ বছরের মধ্যে “চন্দ্রশেখর” লিখে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে। মধুসূদন কিন্তু চেতনার জায়গায় আপস করেননি কখনও। এই প্রেক্ষিতটা মাথায় রাখলে তবেই উপরোক্ত চারটি কাব্যগ্রন্থের মূল সুরটির তেজ ও ব্যঞ্জনা বুঝতে সক্ষম হব আমরা। ধরতে পারব অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তনার আয়োজনকে। 

শুধু ব্রজাঙ্গনার কথাই প্রথমে ধরি। রাধা কৃষ্ণের প্রেম কাহিনি। মধুসূদনের রাধা গোপিনী নয়, কৃষ্ণের স্ত্রী। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন প্রেমিকা। এর ফলে এখানে প্রথমেই কোনো রকমের আধ্যাত্মিক লীলা জাতীয় বৈষ্ণব কল্পকথাকে তিনি কাব্যের আসর থেকে সবলে দুহাতে সরিয়ে দেন। বৃন্দাবনে কৃষ্ণের বহুনারীগামিতার রসালো সামন্ততান্ত্রিক পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় অনুমোদন এক ধাক্কায় তাঁর কাব্য সাম্রাজ্য থেকে বাতিল হয়ে নির্বাসনে চলে যায়। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে যখন তিনি উল্লেখ করেন Mrs Radha বলে, তাঁর সেই ধর্মনিস্পৃহ মানবপন্থী অধুনাবিহারী মানসলোক স্থায়ী ভাবেই নথিভুক্ত হয়ে থাকে উত্তর প্রজন্মের মধু-সংগ্রহকারীদের বোঝার জন্য। 

রাধার মুখে শুনি সরাসরি তার স্বীকৃতি—

“তবে যে সিন্দুরবিন্দু দেখিছ ললাটে,

সধবা বলিয়া আমি রেখেছি ইহারে! 

কিন্তু অগ্নিশিখাসম,          হে সখি, সীমন্তে মম 

জ্বলিছে এ রেখা আজি—কহিনু তোমারে—

গোপিলে এ সব কথা প্রাণ যেন ফাটে।” 

[যমুনাতটে/ ব্রজাঙ্গনা; গোপিলে = গোপন করিলে] 


কৃষ্ণের প্রতি প্রেম এখানে স্বামীর কাছে রাধার স্ত্রী হিসাবে ভালোবাসার দাবি। সামন্তী ব্যবস্থায় রাজা জমিদারদের স্ত্রী(রা) ঘর সামলায়, বৈধ সন্তান প্রসব করে; আর তাদের বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বারনারী(দে)র সঙ্গে। কিন্তু বুর্জোয়াদের যুগে এসে মানবতাবাদীর যাবতীয় প্রেম স্ত্রীর সঙ্গে—প্রাক্‌বিবাহ নায়িকা পর্ব থেকে বিবাহিত পত্নী পর্বাবধি। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থাকলে তা নিন্দনীয়। সমাজে আইনে গ্রাহ্য নয়। সেই অনুযায়ী মাইকেল তাঁর অবস্থান বদলে নিয়েছেন। তাই পুরনো কাহিনির ছবি এখানে আমূল বদলে গেল। বাংলার সমাজে বাস্তবে তখনও এরকম নায়িকার আগমন হয়ত ঘটেনি। কিন্তু সাহিত্যে মধুসূদন একে এনে উপস্থিত করে দিলেন। এই নবোত্থিত ভাবটি কম বা বেশি আয়ত্ত করার দ্বারাই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী” কিংবা নজরুলের শ্যাম-সঙ্গীত সমূহে শ্যাম আর রাইয়ের প্রেম এই খাতেই যেন অধ্যাত্মলীলার রঙ্গভূমি ছাড়িয়ে মানব প্রেমের ছদ্মবেশে শ্যামল পিয়ালতরুর ঝোপে ঝাড়ে আড়াল আবডালে উঁকিঝুকি মারে। শুধু সাহস করে আমরা কথাটা বলে উঠতে পারি না। কেউ যদি প্রমাণ চান, তাজা উদাহরণ দিতে পারি। 

রবীন্দ্রনাথের সেই পর্বের এক সুপরিচিত গানে শুনি— 

“শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা অঁধার যামিনী রে।

কুঞ্জপথে সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।।”


কিংবা আরও একটা গানের পদ শুনে নেওয়া যাক—

সজনি সজনি রাধিকা লো দেখ অবহু চাহিয়া, 

অলসগমন শ্যাম আও রে মৃদুল গান গাহিয়া। 

পিনহ ঝটিত কুসুম-হার, নীল নিবিড় আঙিয়া। 

সুন্দরি সিন্দুর দেকে সীথি করহ রাঙিয়া।

অনুরূপে, কাজী নজরুল ইসলাম যখন এক বাংলা গজলে গেয়ে ওঠেন—

“যে পথে নির্ভরনি যাও,

বসে রই সেই পথ পাশে।

দেখি নিতি কার পানে চাহি—

কলসী সলিল ছলকে”,


অথবা,

“এলো শ্যামল কিশোর তমাল-ডালে বাঁধে ঝুলনা।

সুনীল শাড়ি পরো ব্রজনারী পরো নব নীপ-মালা অতুলনা।।

ডাগর চোখে কাজল দিও,

আকাশী রং প'রো উত্তরীয়,

নব-ঘন-শ্যামের বসিয়া বামে দুলে দুলে ব'রলা, 'বঁধু, ভুলো না',”

আমরা চিনতে পারি এক অগ্রজ বিদ্রোহী কবির পথরেখা ধরে আর এক অনুজ বিদ্রোহীর হৃদয়পাঠের প্রয়াস।

যাঁরা মধুসূদনের এই কাব্যগ্রন্থকে প্রশংসা করেছেন আর যাঁরা বিরূপ সমালোচনা করেছেন, উভয় পক্ষই ধ্রুপদী বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যকে যাচকাঠি ধরে নিয়েছেন। প্রসংশকরা বলেছেন, বৈষ্ণব কবিদের মতোই রসধারা সৃষ্টি করতে পেরেছেন মধুসূদন। আর সমালোচকদের বক্তব্য ছিল, বিদেশি সাহিত্যের ভাবে আচ্ছন্ন থাকার কারণে তিনি আদতে বৈষ্ণব পদরচয়িতাদের মতো রাধাকৃষ্ণ প্রেমের অশরীরী মাহাত্ম্য ধরতেই পারেননি। দুই দলেরই যেটা নজর এড়িয়ে গেছে তা হল, তিনি আদৌ বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের খাতায় আর একটা কাব্যগ্রন্থ সংযোজন করতে বসেননি। পদাবলি থেকে তিনি শুধু কয়েকটা প্রয়োজনীয় উপকরণ ধার নিয়েছেন। শ্রীমতি রাধার চরিত্র আর তার প্রেমরসের কাহিনি। কৃষ্ণ তো মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনাতে দেখাই দেননি। বা মধুকবি কৃষ্ণকে তাঁর কাব্যকুঞ্জে দর্শক/শ্রোতৃমণ্ডলির সামনে তুলে আনার প্রয়োজন বোধ করেননি। শুধু এইটুকু লক্ষ করলেই বিশ্লেষকরা মধুসূদনের প্রকরণগত মৌলিকতার হদিশ পেয়ে যেতেন। মধুসূদনের পাত্রপাত্রীরা পার্থিব মানুষ—সে আভাসিত নায়ক রূপে কৃষ্ণই হোন আর চিত্রিত নায়িকা রূপে রাধা। পুরনো ধর্মীয় আবহ থেকে যাঁরা ব্রজাঙ্গনাকাব্যের সুর ধরতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে সেই সেকালেই রাজনারায়ণ বসুকে লেখা এক পত্রে (১৮৬১) মধুকবি সতর্ক করে দিয়ে গেছেন: “I think you are rather cold towards the poor lady of Braja. Poor man! When you sit down to read poetry, leave aside all religious bias.” 

হবে নাই বা কেন? এই মধুসূদনই তো মাদ্রাজে থাকতেই বিবাহিত স্ত্রী রেবেকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে (তার কারণ আজও অজ্ঞাত) হেনরিয়েটার সঙ্গে নতুন করে যে দ্বৈতজীবন বাঁধেন, তাতে বিবাহের কোনো প্রথা বা সংস্কার যুক্ত হয় না। আজকের দিনে আমরা যাকে এক-সঙ্গে-থাকা (live together) বলি, যাকে এই একুশ শতকের ভারতীয় সমাজও সুচোখে দেখে না, বিজেপি-র অমৃতকালে তাকেও সরকারি পঞ্জিকরণের খাতায় তোলার চেষ্টা ঘোষিত হয়, প্রায় দেড়শ বছর আগেই দত্ত তার নমুনা রেখে গেছেন। সত্যিকারের প্রেমিক যে!    

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে উৎসর্গীকৃত “বীরাঙ্গনাকাব্য” গ্রন্থটিও মধুসূদনের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এগারো জন পৌরাণিক সাহিত্যের খ্যাতনামা নারী তাদের স্বামী অথবা দয়িতাকে পত্র লিখে মনের কথা, নানা ভাবের ওঠাপড়া, কিছু অভিযোগ অনুযোগ জানাচ্ছে—উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে এটা সত্যিই অভিনব। ফলে মধু কবি যখন একে “অভিনবকাব্য” বলে দাবি করেন, তিনি একটুও বাড়িয়ে বলেন না। যে কালে নারীর মুখ ফুটে নিজের কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা কারও কাছে প্রকাশ করারই কথা নয়, সেরকম একটা সময়ে চিঠি লিখে মনের কথা জানানোর এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল দুরন্ত সাহস। আর মধুসূদনের যে সাহস ছিল এ কথা তাঁর অতি বড় নিন্দুকও স্বীকার করতে বাধ্য। 

এই সাহস আরও প্রবল ভাবে ব্যক্ত হয় গ্রন্থের দ্বিতীয় সর্গে বৃহস্পতির পত্নী তারা যখন স্বামীর শিষ্য সোমদেব (চন্দ্র)-কে প্রেম নিবেদন করে এক ব্যাকুল পত্র লিখে বসে। সেকালে অনেকেই এতটা বাড়াবাড়ি সহ্য করতে পারেননি। যেমন রামগতি ন্যায়রত্ন। তিনি এর মধ্যে ব্যাভিচার ছাড়া আর কিছু দেখতে সক্ষম হননি। শিষ্যের কাছে গুরুপত্নী হল মাতৃসম—এই সনাতনী শাশ্বত মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে ন্যায়রত্ন বেশ খানিক নিন্দামন্দ করেছেন কাব্যখানির। আমরা তাঁকে দোষ দিই না। মধুসূদনের আবির্ভাব কার্যত এক অকালে, তাঁর সাহিত্যকৃতি তো আরও অসময়ের ফসল। তখনও বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যযুগীয় ঘোর কাটেনি (এখনই যে কেটেছে জোর দিয়ে বলা যায় না)। সুতরাং মধুসূদনের চোখে নারীর পরিচয় যে সমাজ নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট আসন অবলম্বনে গৃহকোণ অলঙ্করণে সীমাবদ্ধ নয়, এটা বুঝবার জন্য যে বহুমাত্রিক ধীশক্তি এবং চক্ষুপ্রসারতা লাগে তা তাঁদের ছিল না। 

কিংবা কৈকেয়ী যখন রাজা দশরথকে চিঠি লিখে তার দেওয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ভরতের বদলে রামের রাজ্যাভিষেক নিয়ে প্রশ্ন তোলে আর বলে, “এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে”—সেই লব্জও চিরকালের জন্য বাংলা ভাষীর মুখে এক প্রবচনে পরিণত হয়। আমরা পাঠককুল না জেনে হলেও কবি মধুসূদনকে অমরত্ব দিয়ে ঘিরে রাখি। 

একই আধুনিক প্রতিবাদের কণ্ঠ শোনা যায় ঊর্বশী আর সূর্পনখার নামে লেখা দুই পত্রকাব্যে। ঊর্বশী ভারতীয় পুরাণ মতে স্বর্গের অপ্সরা এবং প্রকৃত পক্ষে দেবতাদের নাচ গানের মাধ্যমে শারীরিক মানসিক তৃপ্তি প্রদানের যৌন উপচার। অধ্যাত্মলোকের নটী। তারও যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা থাকতে পারে, ইচ্ছা অনিচ্ছা আশা আকাঙ্ক্ষা সাধ আহ্লাদ থাকতে পারে, সংস্কৃত পুরাণ সাহিত্য ঘেঁটে সেসবের নাগাল পাওয়া যাবে না। সেখানেই দৃষ্টি পড়েছিল মধুসূদনের মানবতাবাদী কবিমানসের। তাই ঊর্বশীর মন কেড়ে নেয় এক মর্ত্য রাজা পুরুরবা। অভিশাপে কাতর না হয়ে স্বর্গসুখ ছেড়ে সে হাসিমুখে নেমে আসে পুরুরবার আশ্রয়ে। কাহিনি পুরাতন। সংলাপ আধুনিক। 

সূর্পনখার কাহিনিতে লক্ষণের প্রতি প্রেম নিবেদনের মধ্যেও সেই একই মানবীর হৃদয়ের দক্ষিণ দুয়ার খোলার গান। আদি সংস্কৃত/বাংলা রামায়ণকারগণ যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন সূর্পনখার প্রতি আম পাঠকের মন বিষিয়ে দিতে। এত কাল সেইই ছিল আমাদের নির্প্রশ্ন পরম্পরা। মধুসূদনের হাত ধরে সেই ঐতিহ্য গেল খানখান হয়ে। এ এক অন্য আস্বাদন। 

ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে ১৮৬৭ সালে ভারতে ফেরার আগের বছর প্রকাশিত হয় মধুকবির ১০২টি সনেট সম্বলিত “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” কাব্যগ্রন্থ। এখানেও তাঁর নবতর উদ্ভাবন। বাংলায় তথা ভারতে আধুনিক বাংলা ভাষায় ইতালীয় সনেটের আদলে কবিতা রচনা। এই সনেটগুলিতেও তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছেন, কোথাও চরণান্তরে অন্তে মিল বজায় রেখে, আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্ত্য মিল বর্জন করে। তবে লক্ষণীয়, প্রায় সমস্ত সনেটেই তিনি পয়ার আঙ্গিক প্রয়োগ করেছেন। শুধু যে আট আর ছয় চরণের সমষ্টি রূপে কবিতা লিখেছেন তাই নয়, একই সঙ্গে প্রতিটি চরণে চোদ্দটি অক্ষর ব্যবহার করেছেন। 

প্রতিটি সনেটেই তাঁর কিছু একটা বাণী আছে। সে আত্মগত হোক কিংবা সামাজিক। আশায় সমৃদ্ধ অথবা হতাশার ঘোষণায় সম্পৃক্ত। পরের প্রজন্ম যখন সনেট লিখতে আগ্রহী এবং/অথবা সাহসী হয়েছেন, মধুকবির লেখনী তাঁদের পথ দেখিয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটিও তাঁর এক অমর সৃষ্টি।  

[৫] বাংলায় প্রথম ও শেষ মহাকাব্য

মধুকবির আলোচনায় “মেঘনাদবধকাব্য” নিয়ে কিছু বেশি কথা না বললে তা অসম্পূর্ণ মনে হতে বাধ্য। কেন না, আজও তাঁকে বাঙালি সাহিত্য রসিক যে মনে রেখেছেন তার প্রধান উৎস এই মহাকাব্য। আর খেয়াল রাখতে হবে, বাংলা সাহিত্যে এটাই প্রথম মহাকাব্য এবং কার্যত পাতে দেবার মতো শেষ মহাকাব্য। এর পরে এর অনুসরণে আরও কেউ কেউ দু একটা মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, একথা সত্য। কিন্তু আজ তাদের নাম কারও স্মরণে আছে বলে মনে হয় না। একমাত্র মধুসূদনের আলোচনা উপলক্ষেই তাদের নাম উল্লেখ করা হয়ে থাকে। 

কিন্তু কেন?  

এই কেন-র উত্তর দেবার সময় আসলে আমাদের দুটো কেন-র কথা মাথায় রাখতে হবে: 

বাংলা সাহিত্যে এটাই কেন প্রথম মহাকাব্য? এর আগে এরকম আর দু-একটা মহাকাব্য রচিত হয়নি কেন?

পরেই বা এরকম সার্থক মহাকাব্য রচনা আর সম্ভব হল না কেন? 

সকলেই জানেন, আমাদের দেশের সংস্কৃত ভাষায় প্রচলিত দুটি মহাকাব্য—রামায়ণ ও মহাভারত—এর কোনোটাই এক সঙ্গে রচিত হয়নি। পর্বে পর্বে নানা রকম সংযোজন হতে হতে এদের বর্তমানে প্রচলিত কলেবর নির্মিত হতে অন্তত হাজার বছর লেগেছে। প্রথম স্তরের কাব্য রচনা থেকে এই পর্বে পর্বান্তরে কলেবর বৃদ্ধির যে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ঔপনিষদিক কাল থেকে শেষ বৌদ্ধ কাল পর্যন্ত চালু ছিল, অর্থাৎ, এক দিকে কাহিনি নির্মাণ ও সংযোজন, অপর দিকে তার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধ্যান ধারণার প্রচার, তা বাংলার মঙ্গলকাব্যের যুগে বাস্তবে আর সম্ভব ছিল না। এক দিকে বিশাল কাহিনির সম্প্রসারণ আর মানুষের সাহিত্যরুচির সঙ্গে মিলত না, তারা চাইত ছোট কাহিনি ছোট পরিসরে শুরু হয়ে শেষ হয়ে যাবে, আবার অন্য এক কাহিনির জন্ম হবে। পাশাপাশি সামন্তযুগের ধ্যান ধারণাগুলি সমাজ মননে কম বা বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় তারও বারংবার বিস্তারের প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছিল। এই জন্যই যখন সংস্কৃত থেকে অনুবাদে কৃত্তিবাস রামায়ণ লেখেন আর কাশীরাম লেখেন মহাভারত, তারও বিস্তার মূলের তুলনায় কমে আসতে থাকে। যে কারণে উনিশ শতকে কালীপ্রসন্ন সিংহকে নতুন করে মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদে হাত লাগাতে হয়। মধুসূদন যখন বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করছেন, তখন এমনিতেই সামন্তযুগীয় মূল্যবোধের আবেদন কমে আসার পথে। রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, প্রমুখর হাত ধরে নবজাগরণের কালের রুচি, ধারণা, নৈতিকতা, জীবনবোধ আগত প্রায়। বাংলা গদ্য ভাষার ক্রমিক বিকাশের পথ বেয়ে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যও তখন নির্মাণের পথে। পাশাপাশি, ভারতচন্দ্রের কালের কাব্যধারা ঈশ্বর গুপ্ত প্রমুখ কবির হাতে তখনও ধিকি ধিকি করে চালু থাকলেও সে তখন পরিনির্বাণের অভিমুখে যাত্রা করেছে। 

রক্তে মজ্জায় চেতনার পরতে পরতে যিনি কবি সেই মধুসূদনের সামনে তখন একটা চ্যালেঞ্জ। একটা বড় কিছু সৃষ্টি করতে হবে। যা কাহিনি বিস্তারে সমস্যার কোলাজে গ্রিক বা সংস্কৃত ধ্রুপদী মহাকাব্যের মতো প্রসারিত অথচ চরিত্রের প্রকরণে যার মধ্যে থাকবে সামন্তী পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনা বর্জিত উনিশ শতকের সদ্য জায়মান মানবতাবাদী মূল্যবোধের প্রতিফলন। অঙ্গসজ্জায় থাকবে তাঁর নব আহরিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ। ওদিকে বাংলা গদ্য রচনায় উপন্যাসের হাতছানি তখন বাংলার আকাশে বাতাসে। তাঁর কবি মন সেই হাতছানিতে সাড়া দেবার জায়গায় তখনও নেই। আয়ু আর বিশ বছর বেশি হলে কী হত কল্পনা করা বৃথা! ফলে উপন্যাসের ক্যানভাস অবলম্বন করেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন হোমার অথবা বাল্মীকির রাজ্যে শেক্সপিয়রীয় মানসলোক থেকে। বাংলায় প্রথম মহাকাব্য রচনার এই হচ্ছে পশ্চাদ প্রেক্ষাপট।

আরও একটা কথা। সংস্কৃত ক্ল্যাসিক্স-এ ট্র্যাজেডির উদাহরণ নেই। কেন নেই সে এক আলাদা বিচার্য প্রশ্ন। অন্য দিকে গ্রিক পুরাণে এবং নাটকে ট্র্যাজেডি আস্বাদন করে মধুসূদন তখন বাংলা কাব্যে তার আবাহন ঘটাতে চান। নতুন উদাহরণ সৃজন করতে আগ্রহী। অন্তত একটা মহাকাব্য রচনা তাঁর চাইই। যেখানে গ্রিস দেশের প্রাচীন মহাকবি হোমারের সঙ্গে প্রাচীন এক মহাকবি বাল্মীকির মিলন হবে।   

তবে শেষ কেন? 

মধুকবি নিজেই আরও একটা মহাকাব্য রচনায় হাত লাগাতে পারলেন না কেন? করবার ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও? তাঁর অনন্য প্রতিভার মুকুরে তখন ধরা পড়ে গেছে—হয়ত তাঁর নিজের অগোচরে—কালের আদেশে এবার নতুন বন্দরের অভিমুখে যাত্রা করতে হবে। যে কাজ এবার বঙ্কিম করবেন, তাঁকেও সেই কাজেই নামতে হবে। মহাকাব্যের পরিসর নিয়ে উপন্যাসের প্রাসাদ নির্মাণে। তার সাক্ষ্যও তিনি আমাদের বোঝার জন্য রেখে গেলেন। গ্রিক মহাকবি হোমারের “ইলিয়াদ” (মধুসূদন সর্বত্রই একে “ইলিয়াস” লিখেছেন) নামক মহাকাব্যের যে সংক্ষিপ্ত অসম্পূর্ণ অনুবাদ তিনি “হেক্‌টরবধ” নাম দিয়ে ১৮৬৭ সালে শুরু করে আর শেষ করে যেতে পারলেন না, তা যখন ১৮৭১ সালে প্রেস থেকে ছাপা হয়ে বেরল, দেখা গেল, তা আধুনিক গদ্য বাংলায় বর্ণিত কাহিনি হিসাবে রচিত। 

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (“বৃত্রসংহার”), নবীন চন্দ্র সেন (“রৈবতক”, “কুরুক্ষেত্র” ও “প্রভাস”), কায়কোবাদ (“মহাশ্মশান”)—প্রমুখ যাঁরা পরে মহাকাব্য লিখতে গেলেন তাঁরা উপরে কথিত মহাকালের অমোঘ দুন্দুভি যেন শুনতে পেলেন না। আর মধুসূদন দত্তের সেই উত্তুঙ্গ প্রতিভা ও কলম দক্ষতা তাঁদের ছিল না। ফলে তাঁরা মহাকাব্যের নামে যা রচনা করলেন তা কার্যত মেঘনাদবধের দুর্বল ও অক্ষম অনুসরণ হয়ে রইল। তার বাইরে আর এগোতে পারল না। মধুসূদন অনন্য আর অধরাই থেকে গেলেন। 

মধুসূদনের হাতে নির্মিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ সজ্জায় নির্মিত এই মহাকাব্যটি তাই একটি ছদ্মবেশী উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উঠতি যৌবনে যে এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন, কিংবা ঠাকুর পরিবারের আর এক সদস্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও যে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, তাঁদের সকলেরই তখন এই একই সমস্যা। ছদ্মবেশটিকে চিনতে না পারা। আবার পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ যখন তাকে চিনলেন, তাঁর মনোভাব প্রায় আমূল বদলে গেল। বারবার নানা প্রসঙ্গে তিনি মেঘনাদবধে ফিরে ফিরে এসেছেন, আর এক একবার এক এক দিক থেকে এর প্রশংসা করেছেন। 

এই কাব্যে মধুসূদন যে পুরাণের প্রধান ও পূজনীয় চরিত্র রামচন্দ্রকে নায়কের আসন থেকে নামিয়ে দেন এবং তাকে ভিরু কাপুরুষ হিসাবে দেখান তার মধ্যে রামায়ণের কবির সৃষ্টিকে তিনি এতটুকু বিকৃত বা পরিবর্তিত করেননি। সূর্পনখার লাঞ্ছনায়, সুগ্রীবের সাহায্যার্থে বালীবধে, এবং লঙ্কাযুদ্ধে ইন্দ্রজিত বধে মধুসূদন রাম লক্ষণের চরিত্রকে যেমনটা দেখিয়েছেন তা রামায়ণেরই হুবহু প্রতিচ্ছবি। তাঁর হাতে যেটা নতুন এবং তিনি যেটা পাল্টে দিয়েছেন তা হল সেই কাব্যরঙ্গ দেখার চোখ। রাম রাবণের যুদ্ধকে তথাকথিত আর্য অনার্যের যুদ্ধ হিসাবে চিত্রিত করে যে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের জয়গান হচ্ছিল এত কাল, যেখানে রাম লক্ষণের সমস্ত আচরণকে দৈব ঘটনা এবং ভালো বলে দেখার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল, আধুনিক গণতান্ত্রিক মানবতাবাদের আলোকে মধুকবির চোখে তার দৈন্য ধরা পড়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি তাঁর কাব্যকাহিনিকে সাজালেন ন্যায় অন্যায়ের যুদ্ধ হিসাবে, নৈতিক মূল্যবোধের পরাকাষ্ঠা হিসাবে। কাপুরুষতার বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের উদ্বোধনের মঞ্চ রূপে। আর্যতত্ত্বটাই তাঁর কাছে পুরোপুরি অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। বুঝতে সম্মত হলে আমাদের কাছেও তিনি একে চিরকালের জন্য নির্বাসিত করে দিয়ে গেছেন। 

আর তাই যুদ্ধে মনোগতভাবে রামচন্দ্রের বদলে রাবণের পক্ষ নিলেও রাম লক্ষণের শিবিরভুক্ত নারী হিসাবে সীতার চরিত্র চিত্রণে তাঁর কোনো ভুল হয়নি। সীতার বন্দিত্ব এবং দুঃখ তাঁর কাছে নিপীড়িত নারীর সমস্যা। নারী যে আসলে পুরুষে পুরুষে বৈরিতার দাবা খেলায় ব্যবহার্য বোড়ে, তার আপন সত্তাকে যে পুরনো সমাজ স্বীকার করেনি, সেই কথাও তিনি এই মহাকাব্যে চমৎকারভাবে কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। রাবণের সীতা অপহরণকে তিনি নিন্দা করেছেন। 


[৬] বীররসের কারবারি 

তারুণ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেঘনাদবধকাব্যে বীররস খুঁজে পাননি। আর রবীন্দ্রনাথ কিছু না পেলে অনেক সমালোচকই তা আর দেখতে পান না, যেমন বুদ্ধদেব বসু। কেন না, রাবণ রাজা এবং বীর হয়েও শোক দুঃখ আঘাত পেলেই কেঁদে ফেলে। শক্তিমানের বীরত্ব সম্পর্কে ধারণাও যে এতে কিঞ্চিৎ হ্রস্বকায় হয়ে বসে আছে, তা সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথের বোঝার কথা নয়। কিন্তু অধিক বয়সেও বিদ্বান মানুষ বুদ্ধদেব বুঝবেন না—এর একটাই অর্থ। অনেক পড়াশুনা করা সত্ত্বেও ইতিহাসের খাতায় বীর ব্যক্তিত্ব উপস্থাপনা আর সাহিত্যের পাতায় বীর চরিত্র চিত্রণের মধ্যে তিনি পার্থক্য বুঝতে অপারগ থেকে গেছেন। তাঁর ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত আর একটা কারণও কাজ করেছিল বলে আমার মনে হয়। তিনি তাঁর “মাইকেল” প্রবন্ধে যেভাবে মধুসূদনকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে ফেলেছিলেন (নজরুলের ক্ষেত্রেও তাঁর একই ধরনের বিচার দেখেছি), তাতে সন্দেহ হয়, সাহিত্যের কলাকৈবল্যবাদী বিচারক হিসাবে কাব্য সাহিত্যের শরীরে অঙ্গসৌষ্ঠব (form) ছাড়া আর কিছু তিনি সম্ভবত চিনতেন না, বা, চিনতে চাইতেন না। তাতে যে বিষয়বস্তু (content) বলেও একটা জিনিস থাকে, এবং সেই জিনিসটার অগ্রগামিতাই যে শেষ বিচারে আঙ্গিকের শ্রেয়ত্বকে সমকালীন পাঠকদের এবং চিরকালীন ইতিহাসের দরবারে পাকা আসন প্রদান করে তা হয় তিনি মানতেন না, অথবা জানতেন না। 

অথচ, আমরা অবাক হয়ে দেখি, যাঁর মতাদর্শগত জায়গা থেকে মধুসূদনের প্রতি বিরূপতা জাগ্রত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক, সেই মানুষটিই কিন্তু মেঘনাদবধ কাব্যের বীররসের সন্ধান পেয়েছিলেন ঠিক ঠিক ভাবে। রাবণ এবং ইন্দ্রজিতের যে প্রকৃত বীরত্বের ছবি একেঁছিলেন মধুসূদন তা বিস্ময়কর ভাবে আকৃষ্ট করেছিল স্বামী বিবেকানন্দকে। তিনি তাঁর এক শিষ্যকে কথাপ্রসঙ্গে মাইকেল সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন: “ওই একটা অদ্ভুত genius তোদের দেশে [পূর্ব বাংলায়—অ. মু.] জন্মেছিল। ‘মেঘনাদবধ’-এর মতো দ্বিতীয় কাব্য বাংলা ভাষাতে তো নেই-ই, ইউরোপেও অমন একখানা কাব্য ইদানীং পাওয়া দুর্লভ। . . . এই ‘মেঘনাদবধ’—যা তোদের বাংলা ভাষার মুকুটমণি—তাকে অপদস্থ করতে কিনা ‘ছুঁচোবধকাব্য’ লেখা হল! তা যত পারিস লেখ না, তাতে কী? সেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এখনও হিমাচলের মতো অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার খুঁত ধরতেই যাঁরা ব্যস্ত ছিলেন, সে সব critic–দের মত ও লেখাগুলো কোথায় ভেসে গেছে!” তাঁর মতে সেই কাব্যের সর্বোৎকৃষ্ট অংশ রাম-ঘটিত নয়, রাবণ-ঘটিত: “যেখানে ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে নিহত হয়েছে, শোকে মুহ্যমানা মন্দোদরী রাবণকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করছে, কিন্তু রাবণ পুত্রশোক মন থেকে জোর করে ঠেলে ফেলে মহাবীরের ন্যায় যুদ্ধে কৃত সংকল্প—প্রতিহিংসা ও ক্রোধানলে স্ত্রী-পুত্র সব ভুলে যুদ্ধের জন্য গমনোদ্যত—সেই স্থান হচ্ছে কাব্যের শ্রেষ্ঠ কল্পনা। ‘যা হবার হোক গে; আমার কর্তব্য আমি ভুলব না, এতে দুনিয়া থাক আর যাক’—এই হচ্ছে মহাবীরের বাক্য। মাইকেল সেই ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যের ওই অংশ লিখেছিলেন।”       

বীররসপৃক্ত এই ট্র্যাজেডি তাই সেদিন এইভাবেই এক উপন্যাস প্রতিম মহাকাব্য রূপে আপামর বাঙালি পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিল। 

আজ আর শুধু বাঙালি নয়, ভারতীয় নয়, সারা বিশ্বেরই বুঝি তিনি মন জয় করে নিয়েছেন। 

মধুসূদন একদিন ইংরেজি সাহিত্যের রাজপ্রাসাদে অমরকবি জিসাবে বন্দিত হতে চেয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি বাঙালি কবি হিসাবেই খ্যাতিমান হয়েছেন। জানতে পারলে তিনি সুখী হতেন, মৃত্যুর শতবর্ষ পেড়িয়ে আজ সত্যিই ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরের পারে পারে বিভিন্ন ইংরেজি ভাষী দেশেও তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য বিদেশি ছাত্ররা পড়ছে, পড়াচ্ছেনও বিদেশি শিক্ষকরা, তার জন্য অনুবাদ করে নিচ্ছেন এই কাব্য ইংরেজিতে। এক অনুবাদক, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, ক্লিন্টন বি সিলি, ১৯৭০-এর দশকে ছাত্রদের জন্য এই কাব্যগ্রন্থ বেছে নিয়ে ২০০৪ সালে অনুবাদের ভূমিকায় লেখেন, “The nineteenth century, however, seemed somewhat of an enigma. I had to prepare myself. And what better place to begin than with Michael Madhusudan Datta, identified by the literary historians as the man who began the modern age, literarily, and a man who wrote during the heart of the nineteenth century? His magnum opus, “The Slaying of Meghanada,” was not available in an English translation. I had to struggle through this very erudite poet’s rich but linguistically complex text. The experience proved rewarding, so much so that I have kept on reading and translating and rereading and retranslating his epic poem ever since.” 

আর এক অনুবাদক, উইলিয়াম রাদিচে, ২০১০ সালে তাঁর অনুবাদের ভূমিকায় ঘোষণা করেন, “For all his difficulty and complexity, his appeal in his lifetime to a very small elite, Madhusudan is a poet whom any modern person can love. In Bengal, divided as it is between West Bengal and Bangladesh, this already seems to be the case. . . . His works contain no political statement, no explicit call for inter-cultural or inter-religious unity, but they nevertheless—formed as they are from a potpourri of traditions and influences—[declare] . . . that ‘Bharat’ is something that goes beyond race or caste or religion or the nation states into which South Asia is divided today.” 

আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, প্রায় সমকালে প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের সেই বিশ্ববিখ্যাত বইটার মতোই মধুকবির সেই শোকান্ত বীররস কাব্যছটা বুদ্ধদেব বসুর মতামত উপেক্ষা করে আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। নইলে একই কাব্যগ্রন্থের একই দশকে দুবার ইংরেজি অনুবাদ হবে কেন?  


[৮] ভাষারও নয়া বাস্তুকার 

একটা বিভ্রান্তি আমাদের অনেকের মধ্যেই আজকাল কাজ করে থাকে, সীমান্ত কাঁটাতারের দুই পাশেই, তা হল, রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অক্ষয়কুমার দত্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে বাংলা গদ্য ভাষার যে চেহারাটা দাঁড়াল, তা বনেদি বা সাবেক আমলের শেষ মধ্য যুগের শব্দমালার গঠন হারিয়ে এক সংস্কৃতায়িত অভিজাত বাংলা হয়ে দাঁড়াল। যা মঙ্গল কাব্য বা এমনকি ভারতচন্দ্রের কাব্য ভাষা থেকেও অনেকটা আলাদা এবং অন্য ধরনের। বাংলার মধ্যে আরবি ফারসি তুর্কি উর্দু হিন্দি যে সমস্ত শব্দ ও বাগ্‌ধারা চালু ছিল, সেগুলি একে একে উধাও হয়ে গেল। আম বাঙালির মুখের ভাষা হারিয়ে গেল এক ইসলাম বিরোধী হিন্দু ভদ্রলোকি সম্ভ্রান্ত লেখ্য ভাষার দরবারে। 

অভিজ্ঞ পাঠক জানেন, এই অভিযোগটা কিন্তু ১৯৬৮-৭৬ কালের সরোজ দত্ত বা বিনয় ঘোষ প্রভাবিত উনিশ শতকীয় নবজাগরণ বিরোধী সোচ-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উত্তাল কালে উত্থাপিত হয়নি। অন্তত আমার কানে সেকালে আসেনি। কোনো উল্লেখযোগ্য নথিপত্রেও দেখতে পাইনি। অবশ্য আমি দেখিনি মানেই যে কেউ কোথাও বলেননি, এমনটা নাও হতে পারে। তবে কোথাও এর গুরু নির্ঘোষ উচ্চারিত হলে অবশ্যই শুনতে পেতাম বলে আমার একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে। সমগ্র ১৯৭০-এর দশক এবং আশির দশকেরও মাঝামাঝি পর্যন্ত এরকম কথা কানে ওঠেনি। পশ্চিম বাংলার সমস্ত জেলাতেই এবং অনেক প্রত্যন্ত প্রান্তে রাজনৈতিক কাজে ঘোরাঘুরি করা সত্ত্বেও এই জাতীয় কথা কাউকে বলতে শুনিনি যে ইস্কুলে কলেজে যে বাংলা ভাষা পড়ানো হয় তা আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েদের বিদেশি বানিয়ে ফেলছে।

আগেও কেউ কেউ যে বলেননি তা নয়। কিন্তু সেই সমালোচনার মধ্যে কোনো মতাদর্শগত আবিলতার প্রলাপ বা প্রলেপ ছিল না। ১৯৯০-এর দশকে এদিক ওদিক থেকে কানে আসতে থাকল এই সব কথা। তত দিনে আমাদের দেশে এবং পশ্চিম বাংলায়ও পোস্ট মডার্ন ভাবধারার প্রবেশ ঘটেছে এবং তারই অন্যতম উপাঙ্গ হিসাবে পোস্ট কলোনিয়াল চিন্তাধারা বা উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির আলোচনায় বেশ ভালো মতন জায়গা করে নিয়েছে। ওপার বাংলাতেও তার ঢেউ তদ্দিনে পৌঁছেছে। 

তখন থেকেই ভাষার প্রশ্নে এই জাতীয় অভিযোগ কানে আসতে শুরু করে।

এই ধরনের কথা বা অভিযোগ যে সর্বৈব ভ্রান্ত এবং তথ্যচ্যুত, তা আমি দত্ত-বিদ্যাসাগরি গদ্য ভাষার আলোচনায় এবং নানা প্রসঙ্গে অনেক বার বলেছি। প্রচুর তথ্য ও যুক্তি সহ সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। এখানে তার আর পুনরুচ্চারণের চেষ্টা করছি না। আমি এবারে দেখাতে চাই, মধুসূদন তাঁর সাহিত্য সাধনার মধ্যে এই ভ্রান্তির বিরুদ্ধেও কিছু ভাবনাচিন্তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রেখে গিয়েছেন। তাঁর জন্ম দ্বিশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে এটাও আমাদের নেবার মতো একটা দামি উপচার হিসাবে গণ্য হতে পারে। 

প্যারীচাঁদ মিত্রের অনুজ কিশোরীচাঁদ ছিলেন মধুসূদনের বন্ধু। ফলে তাঁদের বাড়িতে প্রায়শই মধুকবির যাতায়াত ছিল। ১৮৫৬-৫৭ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের “আলালের ঘরের দুলাল” এক মাসিক পত্রিকায় কিস্তিতে প্রকাশিত হতে শুরু করলে এক দিন সেই বাড়িতে সাক্ষাতের কালে মধুসূদন তাঁকে চেপে ধরেন, এসব আপনি কী লিখছেন? এ কী ধরনের বাংলা? 

মিত্র বলেন, এইই একালের গদ্য। অচিরেই বাংলা সাহিত্য এই ভাষার বশবর্তী হবে। 

প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, এর বেশ অনেক কাল পরে বঙ্কিমচন্দ্রও আলালি ভাষাকেই বাংলা কথাসাহিত্যের ভবিষ্যত মাধ্যম বলে উচ্চ প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। 

মধুসূদন দত্ত কিন্তু সেদিন খুব জোর দিয়ে বলেন, না, বঙ্গসাহিত্যে এই ভাষা টিকবে না। আমি যে ভাষায় লিখব, দেখবেন, সেটাই বাঙালি নেবে। 

আজ বিশ্বব্যাপী বাংলা সাহিত্যের ক্রমবর্ধমান সুবিপুল সম্ভারের দিকে তাকিয়ে যেকোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই স্বীকার করবেন, বা করতে বাধ্য হবেন, মধুসূদনের পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োগ সেদিন অভ্রান্ত ছিল। কেন না, ভবিষ্যত বাংলা গদ্য ভাষা শৈলী সেদিনের সেই চমকদার আলালি রীতিকে গ্রহণ করেনি শুধু নয়, আলালের লেখক নিজেও তাঁর আর কোনো গদ্য রচনায়, এমনকি উপন্যাসেও, সেই রীতিতে লেখা চালিয়ে যাওয়ার কোনো রকম ঝুঁকি নেননি। উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলেই তিনিও নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, বঙ্কিম আলাল-গদ্যের যতই প্রশংসা করে থাকুন, ইংরেজ ইংরেজ দেখতে হলেও বাংলা ভাষার শৈলীপথ সেই মধুকবি তাঁদের দুজনের চাইতেই অনেক ভালো বুঝেছেন এবং আয়ত্ত করে নিয়েছেন। 

দত্তকবি সেদিন মিত্রকে একটা সরল উদাহরণ সহযোগে বিষয়টা বুঝিয়েছিলেন। একজন মানুষ ঘরের মধ্যে আটপৌরে পোশাক পরে থাকে, তাতে শৈথিল্য থাকে, অগোছালো ভাব থাকে, পারিপাট্য থাকেই না। তাতে কোনো দোষ হয় না। কিন্তু বাইরে সে যখন কোনো অনুষ্ঠানে যায়, তখন আর সেই পরিচ্ছদে চলে না, ভালো করে সেজেগুজে যেতে হয়। মুখের ভাষা বা কথ্য ভাষার সঙ্গে লেখ্য ভাষার গদ্য শৈলীতেও এরকম পার্থক্য।    

মুখে স্বীকার করুন চাই না করুন প্যারীচাঁদ মিত্র (এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষক বঙ্কিমচন্দ্র) বাস্তবত এই পরামর্শ যে মেনে নিয়েছিলেন গত একশ পঁচাত্তর বছরের বাংলা সাহিত্য তার প্রমাণ বহন করে চলেছে। এমনকি, বিদ্যাসাগরি অক্ষয় দত্তীয় মধুসূদন-কৃত ভাষা শৈলীর সমালোচকরাও আজ সেই ভাষা রীতিই ব্যবহার করে থাকেন। বাংলা ভাষী সমস্ত অঞ্চল জুড়েই। 

এই ভ্রমনিরাস প্রশ্নে, সুতরাং, মধুসূদন তাঁর দায়িত্ব চমৎকার ভাবে পালন করে গেছেন। ভাবীকালের জন্য একটা বিপজ্জনক অথচ সহজাকর্ষক ভ্রান্তি মোচন করে দিয়েছেন।  


[৭] অমধুর সমাপন

অবশেষে আমরা প্রবেশ করতে চাই একটা সময়ানুগ প্রশ্নে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলেন কেন? মদ? বিলাসিতা? সাহেবিয়ানা? দেশি চামড়ার নীচে বিদেশের নকলনবিশী? অদূরদর্শিতা? অপরিণামদর্শিতা? অবিমৃষ্যকারিতা? আয়ের তুলনায় অমিতব্যয়িতা? 

না, শুধু এগুলোর কোনোটা দিয়েই, এমনকি সব কয়টি দিয়েও, তাঁর এত দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা হয় না। অন্তত মদ্য-বিলাসিতার ব্যাপারে সুরেশ চন্দ্র মৈত্র সেকালের যে লম্বা তালিকা এবং বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করেছেন, তাতে মধুসূদনের আর প্রায় কোনো বিশেষত্বই থাকে না। 

আসলে মাইকেলের যে অনন্যসাধারণ প্রতিভা, যার সম্পর্কে তিনি নিজেও প্রথম থেকেই সচেতন, আত্মবিশ্বাসী এবং প্রায় প্রকাশ্যেই ভয়ঙ্কর অহঙ্কারী, সেই প্রতিভাই বোধ হয় তাঁর কাল হয়ে দাঁড়াল। তাঁর অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা শেক্সপিয়র মিলটন বায়রনের উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য উদ্গ্রীব। অথচ এক সময় তিনি নিজে নিজেই উপলব্ধি করলেন তাঁকে সেই উচ্চতার সাধনা ইংরেজিতে নয়, আপন মাতৃভাষাতেই করতে হবে। ইতিহাস তাঁকে এক বড় কবি হিসাবে মেনে নেবে, কিন্তু তা ইংরেজ কবি হিসাবে নয়, বাংলার কবি হিসাবে। 

বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, তিনি মেনে নিয়েছিলেন ইতিহাসের এই নিরুচ্চার আদেশ এবং দায়। অন্তত অনুভবে বুঝেছিলেন: Overall historical circumstances are stronger than the most powerful individuals. To a great man, the overall nature of his times is “an empirically given necessity"—যে কথাটা একজন প্রবাসী রুশ বিপ্লবী, গেওর্গি প্লেখানভ, একালে অখ্যাত একজন জার্মান ইতিহাসকার, কার্ল লাম্প্রেখট-এর রচনাকে ভিত্তি করে, তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরে উচ্চারণ করবেন। আসলে কোনো প্রতিভাই যে সমাজ ইতিহাসের উপরে যেতে পারে না, সামাজিক ঐতিহাসিক দেশকালগত সীমানা নির্ধারিত খেলার মাঠে তারই বিধিনিয়ম মেনেই তাঁকে খেলতে হবে, যাবতীয় পারদর্শিতা সেখানেই দেখাতে হবে—ব্যক্তিসত্তার উপর সামাজিক সত্তার এই অমোঘ বিধান সচেতন ভাবে গ্রহণ করতে না পারায় তাঁর কাছে এক চিরস্থায়ী পাষাণভার হয়ে রইল। এক রকম সংক্ষোভ সমেত। মনে মনে ভেবেছিলেন হয়ত, ইতিহাস তাঁকে সৃষ্টি করলেও তিনিও এক নতুনতর ইতিহাস সৃষ্টি করে যাবেন। তাই যত দিন এগোল, তিনি সেই মাঠে খেলতে খেলতেই চাইলেন কাঁধের উপর থেকে সেই অদৃশ্য দায়ভার নামিয়ে ফেলতে। নিজের স্বাধীন ইচ্ছা মতো খেলতে। আর ততই এক বাস্তবে বিদ্যমান অসমান দ্বন্দ্ব তাঁকে অনিবার্য পরাভবের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একাধিক নতুন অধ্যায় যোগ করে যাওয়া সত্ত্বেও। 

বিদ্যাসাগরকে তিনি এত শ্রদ্ধা করতেন। অন্তর থেকেই গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তবু তাঁর পরামর্শ মেনে চলতে পারলেন না জীবনযাত্রায়। মাঝে মাঝে আমাদের মনে হয়, ইংরেজি ভাষার উপর বিপুল অধিকার থাকা সত্ত্বেও একটা মাত্র বাক্য—Cut your coat according to your clothe—তিনি যেন জীবনে কোনো দিনই আয়ত্ত করে উঠতে পারলেন না। 

এইখানে মধুসূদন দত্তের হিমালয় সদৃশ প্রতিভার বিপর্যয় ঘটে গেল। 

আমরাও যেন মাইকেলের এই দ্রুত নিঃশেষণকে ভালো ভাবে আত্মস্থ করে নিতে পারিনি। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি বা কবিগুরুর আখ্যান পেয়েছেন, নজরুলকে আমরা বিদ্রোহী কবির শিরোপা দিয়েছি; মধুকবির জন্য বাঙালি আজ অবধি কোনো তক্‌মা খুঁজে পেল না। শীতাংশু মৈত্র তাঁকে বলেছিলেন “যুগন্ধর মধুসূদন”। বইটির কপি নিঃশেষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সেই বিশেষণও বাংলা সাহিত্য মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছে। 

জন্মের দ্বিশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে বাঙালি চিত্ত আবার নতুন করে একটু বোধ হয় চঞ্চল হয়ে উঠতে চলেছে। এদিকে ওদিকে কিছু কিছু আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে। দেখা যাক, এই উপলক্ষে এবার আমরা তাঁর জন্য কোনো সার্থক অভিধা খুঁজে বের করতে পারি কিনা। 


সহায়ক গ্রন্থসূত্র


মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২০২৩), মধুসূদন রচনাবলী (সং ক্ষেত্র গুপ্ত); সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। 

রামগতি ন্যায়রত্ন (১৮৮৭), বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব; স্বপ্রকাশিত, হুগলী। 

বুদ্ধদেব বসু (১৯৫৪), সাহিত্য চর্চা, সিগনেট প্রেস, কলকাতা। 

যোগীন্দ্রনাথ বসু (১৯০৭), মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত; সান্যাল অ্যান্ড কোং, কলকাতা।  

স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৯), “স্বামী-শিষ্য-সংবাদ”; স্বামীজীর বাণী ও রচনা; ৯ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা। 

সুরেশচন্দ্র মৈত্র (১৯৭০), মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য; স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা।


G. V. Plekhanov (1976), “On the Question of the Individual’s Role in History”; Selected Philosophical Works, Vol. II; Progress Publishers, Moscow. 

Michael Madhusudan Dutta (2004), The Slaying of Meghanada: A Ramayan from Colonial Bengal (translated by Clinton B. Seely with an Introduction); Oxford University Press, New York.  

Michael Madhusudan Dutta (2010), The Poem of the Killing of Meghnad (translated by Willian Radice with an extended Introduction and extensive notes); Penguine Books India Ltd., Kolkata.  


Post a Comment

1 Comments

  1. গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন অশোক বাবু।

    ReplyDelete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)