শাহানারা খাতুন
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ৮২০৭টা সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এদের শিক্ষার্থী সংখ্যা তলানিতে। ত্রিশ জনেরও কম শিক্ষার্থী। স্কুল বন্ধের তালিকা তার পরের শিক্ষাবর্ষে আরো বাড়বে। কেননা সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রম হ্রাসমান। এর কারণ কী? পরিকাঠামোর অভাব? মোটেই না। গত পনেরো বছরে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের ভোল অনেকটা বদলে গেছে। শ্রেণীকক্ষের অভাব নেই। শৌচালয় আছে। বিদ্যুৎ আছে। পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। আছে মডেল স্মার্ট ক্লাস রুম। সেখানে প্রজেক্টর দিয়ে আজকের চন্দ্রাভিযান থেকে অনেক কিছুই দেখানো যায়। লাইব্রেরি আছে। নানা রকম অনুদান আছে। গুণমান ভালো না হলেও মধ্যাহ্ন ভোজন আছে। তবুও শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রম হ্রাসমান। এর কারণ কী? এই যে ৮২০৭ টা স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জনমানসে এর প্রতিক্রিয়া কী? কেন আমজনতা মুখ ফেরাচ্ছে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে? কারণ খুব অগভীর নয়। একটু তলিয়ে ভাবলেই উত্তর পাওয়া যাবে।
নব্বই দশকের নয়া উদার নীতিবাদ ও বিশ্বায়ন প্রথমেই গ্ৰাস করল তৃতীয় বিশ্বের বিশেষত ভারতবর্ষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকে। এতে ইন্ধন জোগালো ১৯৮৬ এর জাতীয় শিক্ষানীতি। ১৯৯২ এর সংশোধিত জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণে বিশ্ব ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়া হলো। ১৯৯৩ সালে উন্নিকৃষ্ণন্ন ও অন্যান্যরা বনাম অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য মামলায় সুপ্রীম কোর্ট ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষার অধিকারকে "একটি অধিকার" হিসেবে গণ্য করে বলেন, "এদেশের নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ২১ ধারা থেকে এই অধিকার জন্মায়। কিন্তু এটি চরম অধিকার নয়। এর অন্তর্বস্তু ও প্রয়োগ ৪৫ এবং ৪১ ধারার দ্বারা নির্ধারিত। অন্য অর্থে এ দেশের প্রতিটি শিশু/ নাগরিক ১৪ বছর বয়স অবধি বিনা ব্যয়ে শিক্ষা পাওয়ার অধিকারী। তারপর তার শিক্ষার অধিকার রাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্গতির দ্বারা সীমাবদ্ধ।" এই রায়ের পর দেশব্যাপী শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করার দাবি ওঠে। ২০০২ সালে সংবিধান সংশোধন করে ৮৬ তম সংশোধনীতে ২১(ক) ধারা যুক্ত হয়। এই ধারায় বলা হয়- "রাষ্ট্র ৬-১৪ বছর বয়সী সব শিশুদের বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা এমনভাবে করবে যা রাষ্ট্র আইনের দ্বারা স্থির করবে।" (এই আইন হলো RTE Act। আর এই আইনের ফাঁক গলেই আজকের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি।) রাষ্ট্র সব শিশুর বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করতে গিয়ে দেখল যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তা ভাঁড়ারে নেই। ভারতে বছরে প্রায় ২.৫ কোটি শিশু জন্মায়। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য ১৪ হাজার কোটি ব্যয় বরাদ্দ হলো। এই সামান্য টাকায় সব শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হলো। টাকা ধার করা হলো SIDA, UDA, WORLD BANK থেকে। বেসরকারিকরণের দরজা খুলে দেওয়া হলো।
দেশের বিপুল সংখ্যক শিশু শিক্ষার্থীর শিক্ষার ভার তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হলো। ফলে অলিতে গলিতে নানা কিসিমের বেসরকারি স্কুল ও দিল্লি বোর্ডের স্কুল গজিয়ে উঠলো। এর সাথে যুক্ত হলো নব্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের চাওয়া- পাওয়া, আশা -আকাঙ্খার গল্প। প্রাথমিক থেকে ঝট করে ইংরেজি তুলে দেওয়ায় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাঁদে পৌঁছানোর আকাঙ্খাকে যেন আরো তীব্রতর করলো। মুখ ফিরিয়ে নিল বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে। ব্যতিক্রম অবশ্যই রইলো। জেলার নামকরা স্কুল গুলো। এই ব্যতিক্রমের পিছনেও কারণ আছে। ২০১০ এর RTE ACT অনুযায়ী দশ শতাংশ সরকারি / সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলকে উন্নীত করার কথা ছিল কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় বা নবোদয় বিদ্যালয়ের মতো। সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা অটুট রইলো। অবশ্য বর্তমানে সেখানেও আগের থেকে চাপ কম। আর ডাবল রিফাইন/ ট্রিপিল রিফাইন করে ছাত্র ভর্তি করতে পারছে না।
বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলের দৈন্যদশার আরেকটি কারণ ভ্রান্ত শিক্ষানীতি, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষার গুণগত মানের অবনমন, ব্যবহারিক মূল্যায়নের অকার্যকারিতা। শিক্ষার সার্বিক বিস্তারে, সবার জন্য শিক্ষা এই নীতিকে সামনে রাখতে গিয়ে বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলের সিলেবাস হলো প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীর কথা মাথায় রেখে। কোথাও অনাবশ্যক জটিল কোথাও অনাবশ্যক সরল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের শিক্ষার্থী এই সিলেবাসে আস্থা হারালো। No Detention পদ্ধতিও শিক্ষার্থীকে অনেকাংশে অনাগ্ৰহী করলো। তারা ধরেই নিল না শিখলেও পরের ক্লাসে ঠিক পৌঁছে যাবো। অপরিণামদর্শী লকডাউন একে আরো তীব্রতর করলো। আগে একধাপ পেরোতে। এ একেবারে দু'ধাপ। শিক্ষাদান পদ্ধতিও শিক্ষার্থী হীনতার একটা কারণ। এক) শিক্ষকদের শিক্ষাদান ছাড়াও একাধিক সরকারি দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষকদের। দুই) এক শ্রেণির শিক্ষক গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাঠদান পদ্ধতি বজায় রাখলেন। তিন) শুনতে খারাপ লাগলেও, আমি নিজেও শিক্ষক' এক শ্রেণির শিক্ষক আসি যাই মাইনে পাই,কাজ করলে উপরি চাই পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। শিক্ষকতাকে সমাজসেবা মূলক কর্ম না ভেবে বাঁধা মাইনের নির্দিষ্ট duty hour এর চাকরি হিসেবে দেখলেন। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কিসসু হবে না ভেবে অবহেলা করলেন। স্কুলগুলোর মান দিন দিন কমতে লাগলো। আর তাই শিক্ষিত আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারের শিক্ষার্থী চলে গেল বেসরকারি স্কুলে। এছাড়াও আর যে কারণ টা রইলো তা হলো শিক্ষার ব্যবহারিক দিক। কী কাজে লাগবে শিক্ষা? শিক্ষান্তে শিক্ষার্থী কী কাজ পাবে? বড়ো প্রশ্ন। সরকারি নিয়োগ প্রায় নেই। কিছু করে কম্মে খেতে হবে। আর কিছু করতে হলে গ্যাট ম্যাট করে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইংরেজি বলতে হবে। বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলে সে সম্ভাবনা কই? তাই ভরসা ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল।
তাই জনমানস নির্বিকার। হাসপাতালে চিকিৎসা করতে যায় গরিব গুর্বোরা। সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলেও পড়ে/ পড়বে নেহাতই যাদের উপায় নেই/ আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা। কিংবা এখনও কিছুজন কিছুটা ভরসা রাখেন বলে। স্কুল গুলো উঠে গেলে কী হবে? সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া তাদের কথা শোনার লোক নেই। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের ভাবনা সবার যা হবে তাদেরও তাই হবে। এ নিয়ে রাজনীতি করার জন্য অন্য লোক আছে। তাদের কোনো দায় নেই। আর বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তো আগেই আত্ম সমর্পন করে বসে আছেন। তাঁদের প্রায় সকলের সন্তান বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হবে। পাতি বাংলা মাধ্যম স্কুলে মরতে তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেন পড়াতে আসবে? অতএব বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুল থাক বা যাক স্কুল খুলুক বা না খুলুক মাস পয়লা বেতন ঢুকলেই হবে। তাঁদের দেখে কবি মোহিতলাল মজুমদার এর ঐ পংক্তিটি খুব মনে পড়ে – "ফাঁসির কয়েদী ওজনে বাড়িছে ধন্য সে সুখচোর।"
তাই দু'বছর লকডাউনে তাঁরা সব গর্তে সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন। রেল বেসরকারিকরণ হলে রেল কর্মচারী আন্দোলন করেন। ব্যাংক বেসরকারিকরণ হলে ব্যাংক কর্মচারী। কৃষি বিল হটাতে কৃষকরা। শুধু শিক্ষা বেসরকারিকরণ হলে শিক্ষকরা নীরব। যাঁদের গর্জে ওঠা দায় ছিল তাঁরাই রয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব রয়ে গেলেন। আর ভাতাজীবি, অনুদান জীবি জনসাধারণ আস্থা রাখছেন ফোকটে কিছু পাওয়ার আশায়। তাই সন্তানের শিক্ষা নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। শিক্ষক অভিভাবক মিটিং এ তাঁদের হাজিরা নেই। আগ্ৰহ নেই। কিন্তু সন্তানের 'শ্রী' যুক্ত অনুদানের ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার। লকডাউনের সময় স্কুল খুলুক না খুলুক কোনো হেলদোল নেই। মাসে মাসে চাল আলু পেলেই হবে। কোথায় স্কুল বন্ধ হলো, তাতে কার ক্ষতি হলো, তাঁদের নিজের সন্তান সন্ততিদেরই বা কী হবে? এসব ভাবনা তাঁদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এঁরা চোখে দেখেও না দেখেন না। কানে শুনেও শোনেন। শুধু বিশ্বাস করেন নেতার মোহিনী ভাষণ।
লেখক শিক্ষিকা ও অধিকার আন্দোলনের কর্মী
0 Comments