কলরবের ইতিহাস বিশ্লেষণে উঠে আসুক লিঙ্গ রাজনীতি

ঝিলাম রায়

সেপ্টেম্বর কলরবের মাস। ২০শে সেপ্টেম্বর মিছিলের দিন। সাত বছর আগের বৃষ্টি মিছিল। দু বছর আগের ফ্যাসিবাদ বিরোধী মিছিল। তাই ২০শে সেপ্টেম্বর এলেই টাইমলাইন ভরে যায় স্মৃতিচারণায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। স্বাধীন না ঐক্যবদ্ধ। ব্যানার না ব্যানারলেস। পতাকা না পতাকা বিহীন। স্বতস্ফূর্ত না সচেতন সংগঠিত সংগ্রাম। গত সাত বছরে শিক্ষার্থী আন্দোলনেরও মূল তর্কে পরিণত হয়েছে এই প্রশ্নগুলো। যে তর্কগুলো প্রত্যেকটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই তর্ক, বিশ্লেষণের মধ্যে যা প্রায়েই বাদ চলে যায়, স্মৃতিচারণের ব্লাইন্ড স্পটে থেকে যায় তা হলো লিঙ্গ রাজনীতির প্রশ্ন। আমরা ভুলে যাই হোক কলরবের জোয়ারে ভিসি পদত্যাগ করলেও মেয়েটি ন্যায় পায়নি। আমরা সহজেই ভুলে যাই পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে হঠাৎ করেই একদিন মেয়েটির ছবি দিয়ে পোস্টার পরে 'I am sorry, I lied' বলে। যে পোস্টার রাতারাতি সরিয়ে নিলেও তা নিয়ে প্রবলভাবে বিক্ষোভ হয় না। আমরা ভুলে গেছি হোক কলরবে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নামলেও মেয়েটি পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনো চালিয়ে যেতে পারেনি। আরো অনেক মেয়ের মতোই হারিয়ে গিয়েছে। 

তাহলে কি আন্দোলন অসফল? এতটা সরলীকরণ হয়তো করা যায়না। হোক কলরব যেমন শুধুমাত্র যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের মার খাওয়া, ক্যাম্পাস গণতন্ত্র, ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকার প্রতিফলন ছিল না, তাতে মিশে গেছিল হাজার হাজার মফস্বলের পড়ুয়াদের ক্ষোভ, শাসকের প্রতি ক্রোধ, ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের জান কবুল লড়াই, তেমনই মেয়েটির ন্যায়ের বিচারের সাথে আছড়ে পড়েছিল হাজার হাজার মেয়ের ক্রোধ। যে ক্রোধ একটু একটু করে জমা বাঁধছিল ২০১২র পর থেকে। জ্যোতি সিং-এর  ন্যায়ের দাবিতে উত্তাল মিছিলে। জিএসক্যাশ বাতিল হয়ে আইসিসি হওয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। মেয়েদের হোস্টেল কারফিউয়ের বিরুদ্ধে। রাতের ক্যাম্পাসে মেয়েদের বাথরুমের দাবিতে। মেয়েদের লাইব্রেরীতে প্রবেশের দাবিতে। যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে। যে আন্দোলন যাদবপুর হয়ে বিশ্বভারতী, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, জেএনইউ, ডিইউ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। বদলে দিয়েছিল শিক্ষার্থী রাজনীতির মুখ। বাধ্য করেছিল ছাত্র সংগঠনে লিঙ্গ রাজনীতি প্রশ্নের অন্তর্ভুক্তিকরণে। পোশাকের রাজনীতি, প্রেমের রাজনীতি, যৌনতার রাজনীতিকে ছাত্র আন্দোলনের ইস্যু করে তুলতে বাধ্য করেছিল। নতুন জোয়ার এনেছিল এনজিওকরণে প্রায় ভেঙে পড়া স্বতন্ত্র নারীবাদী আন্দোলনের বুকেও। 

হয়তো সেই সময়ে আমরা কেউই সেইভাবে তৈরি ছিলাম না মেয়েদের সেই ক্রোধকে, সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলোকে সচেতন ভাবে সংগঠিত করে বিপ্লবী সংগ্রামের রূপ দিতে। তাই হয়তো সেই ক্রোধই পরবর্তীকালে আছড়ে পড়লো মিটু আন্দোলনে। নয়া উদারবাদী রাজনীতির হাত ধরে। র‌্যাডিকাল ফেমিনিজমের স্লোগান 'personal is political' আবারও তোলা হলো কিন্তু তা যে যৌথতার কথা বলতো, ৬০ এর দশকের যে বাম আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তা উঠে এসেছিল, সেই রাজনীতি ছেঁটে দেওয়া হলো। চয়েস, এজেন্সির কথা উঠলো তবে তার বস্তুগত বাস্তবতার কথা বাদ দিয়ে। 

তবুও লড়তে চাওয়া মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো একটু একটু করে সংগঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতেই। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনে আরো বেশি করে জোট বেঁধেছে। সেই জোট বাঁধাই আছড়ে পড়েছে জামিয়ার মেয়েদের প্রতিরোধে। শাহীনবাগ, সিলামপুর, পার্ক সার্কাস, মুম্বাইবাগের মেয়েদের রাত জাগা লড়াইয়ে। ঘুম কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্রের। ইউএপিএ, এনআইএ সামনে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করেই যা পরবর্তীকালে আবারও জোট বেঁধেছে দিল্লি সীমান্তে। কৃষক শ্রমিক শিক্ষার্থী ঐক্যে। বাধ্য করেছে যৌন হেনস্থা, মেয়েদের আন্দোলনে অংশীদার হওয়ার দাবি, মেয়েদের জমির অধিকারের দাবিকে, লিঙ্গায়িত কাজের প্রশ্নকে কৃষক আন্দোলনে কথোপকথনের আওতায় আনতে। 

শুরুটা হয়তো হয়েছে কোথাও। কোথাও বা বিচ্ছিন্ন ভাবে। কোথাও বা চলমান ইতিহাসের গতিতেই। এখনও অনেক পথ বাকি। তাই কলরবের ইতিহাস, কলরবের বিশ্লেষণে উঠে আসুক এই আলোচনাও। কলরবের ফিরে দেখায় উঠে আসুক এই ইতিহাসও। শুধু টোকেন এজেন্ডা হিসেবে নয়, বিপ্লবী শিক্ষার্থী আন্দোলনে কথা হোক লিঙ্গ রাজনীতি নিয়ে। শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, বাস্তব আন্দোলনের জমিতে আলোচনা হোক মিটু নিয়ে। আলোচনা হোক যৌন হেনস্থা নিয়ে। আলোচনা হোক আন্দোলনের, সংগঠনের মধ্যেকার পিতৃতান্ত্রিক প্র্যাকটিস নিয়েও।


ছবি: সংগৃহীত

Post a Comment

0 Comments