আমাদের টাকা কোথায় গেল- প্রশ্ন তুলে অনশনে দমদম জেলের বন্দীরা


প্রদীপ চ্যাটার্জী

শাহবাজ ইসমাইল। বছর চল্লিশের শাহবাজ পাকিস্তানী নাগরিক। আই এস আই এর চর সন্দেহে বছর দশেক ধরে জেল খাটছেন। কিছুদিন আগে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে তাঁর যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শাহবাজের সাথে এখানে দেখা সাক্ষাৎ করার মত কেউ নেই। পাকিস্তান থেকে তার আত্মীয়রা জেলের ঠিকানায় মানি অর্ডার করে টাকা পাঠান, সেই টাকা জেলের খাতায় জমা থাকে। প্রয়োজন মত টাকা তুলে শাহবাজ তাঁর মামলার খরচ চালান বা জামাকাপড় খাবার দাবার কেনেন। সেই শাহবাজ ইসমাইল গত ২৭ শে জুলাই থেকে দমদম জেলে অনশন করছেন। আজ তাঁকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।কেন অনশন করছেন শাহবাজ? তাঁর অভিযোগ, জেলের খাতায় জমা থাকা তাঁর ৪২ হাজার টাকা জেল কর্তৃপক্ষ 'ঝেঁপে' দেবার চেষ্টা করছে। একা শাহবাজ নয়, এই অভিযোগ দমদম জেলের সিংহভাগ বন্দীরই। এমনকি শাহবাজর ওঠানো দাবীর সমর্থনে অনশনে সামিল হয়েছেন আরও কয়েকজন বন্দী, শোনা যাচ্ছে ৪ ঠা আগস্ট থেকে অনশনে সামিল হয়েছেন একজন রাজনৈতিক বন্দীও, অনুপ রায়।

ঘটনাটা ঠিক কী? গত ২০ এবং ২১ শে মার্চ, ২০২০ দমদম জেলে গন্ডগোল হয়, বন্দীরা কিছু দাবী নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন, জেল প্রশাসন বাইরে থেকে পুলিশ ডাকে। পুলিশ গুলি চালায়, যাতে সরকারী মতে ৫ জন বন্দী মারা যান, বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা ২০-২৫ জন। বন্দীরাও জেল গেটে আগুন লাগিয়ে দেন, জেলারের অফিসে আগুন ধরে যায়। এই ঘটনার পর জেল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যে দাঙ্গাকারী বন্দীরা জেলের সমস্ত খাতাপত্র, রেকডর্স পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে বন্দীদের জমা রাখা টাকাটা অক্ষত আছে। কিন্তু যতক্ষণ অবধি বন্দীরা প্রমাণ দিতে পারছেন যে তাদের কার কত টাকা জমা আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন টাকা বন্দীদের তুলতে বা খরচ করতে দেওয়া যাবে না।
ঘটনার পর ১৬ মাস পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বন্দীরা এখনও তাদের সেই জমা টাকা তুলতে বা খরচ করতে পারছেন না। শাহবাজ ইসমাইল এর ৪২ হাজার টাকা জমা ছিল, তাঁর কাছে মানি অর্ডার রিসিভ করার কপিও আছে। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে টাকা খরচ করতে দিচ্ছে না, তাদের যুক্তি শাহবাজ যা তথ্য দিচ্ছেন সেগুলো সঠিক কিনা তা তারা কোনোভাবেই যাচাই করতে পারছে না। 

কিছুদিন আগে অখিল চন্দ্র ঘোষ বলে একজন রাজনৈতিক বন্দী ঐ দমদম জেল থেকেই মুক্তি পান। জেলের খাতায় তাঁর জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৯০০ টাকা। নিয়মমত, মুক্তির সময় ঐ টাকা তার ফেরত পাবার কথা। কিন্তু ঐ একই 'কোন রেকর্ড নেই' যুক্তি দেখিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে কোনো টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে। রাজনৈতিক বন্দী অসীম ভট্টাচার্যেরও ৫০০০ টাকা জমা আছে দমদম জেল গেটে, কিন্তু তিনি সেই টাকা কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না। রাজনৈতিক বন্দী অনুপ রায় ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করতে চাইছেন, সেইজন্য ইগনু'র স্টাডি সেন্টার আছে এইরকম কোনো জেলে তাঁকে ট্রান্সফার করার আবেদন জানিয়েছেন। নিয়ম হল, জেল ট্রান্সফারের সময় জেল গেটে জমা থাকা টাকাও বন্দীর সাথে অন্য জেলে পাঠিয়ে দিতে হবে, কিন্তু দমদম জেল প্রশাসন অনুপ রায়ের ক্ষেত্রে তা করতে অস্বীকার করছেন। যুক্তি একই। অনুপ রায়ের জমা আছে ১০০০ টাকা। 

গত এক বছরে প্রায় ১০০০ জন বন্দী দমদম জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু কেউই তাঁদের জমা টাকা ফেরত পান নি। একটা হিসাব বলছে, দমদম জেলে গড় বন্দী সংখ্যা ৪০০০ এর মত। তার মধ্যে যদি দাঙ্গার সময় ৩০০০ জন বন্দীরও জেল গেটে টাকা জমা থেকে থাকে এবং যদি গড়ে বন্দী পিছু ১০০০ টাকা করেও জমা থেকে থাকে, তাহলে টাকার পরিমাণটা দাঁড়ায় ৩০ লাখে! এই বিপুল পরিমাণ টাকা যদি বন্দীরা ফেরত না পান, তাহলে টাকাটা কী হবে? বন্দীদের এক অংশের বক্তব্য, আরও দু' তিন বছর কেটে গেলে দাঙ্গার সময় যারা বন্দী ছিলেন, তাদের বেশিরভাগ অংশটাই আর জেলে থাকবেন না, বেরিয়ে যাবেন বা অন্য জেলে বদলি হয়ে যাবেন। তখন এই টাকাটার আর কোনো দাবীদারও থাকবে না। জেলের একটা চক্র এই টাকাটা এইভাবে লুঠে খাওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। ঘটনা যাই হোক, এটা কারা দপ্তরের দায়িত্ব যে বন্দীদের কত টাকা দমদম জেলে জমা পড়ে আছে, সেটা স্পষ্ট করা এবং সেটা কী পদ্ধতিতে বন্দীদের ফেরত দেওয়া হবে সেটা নির্দিষ্ট করা। শুধুমাত্র খাতা পুড়ে গেছে বলে দায় ঝেড়ে ফেলাটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে দূর্নীতির অভিযোগটাই মান্যতা পাবে এবং বন্দীদেরকে অনশন বা অন্য কোন প্রতিবাদে বারবার সামিল হতে হবে। বেশিরভাগ বন্দীই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া স্তর থেকে আসেন, তাঁদের পরিবার অনেক কষ্ট করে রক্ত ঘাম জল করা পয়সা থেকে কিছু অর্থ বন্দীদের জেলের মধ্যে ব্যয়ের জন্য জমা করে, সেই টাকা যদি এভাবে গায়েব হয়ে যায়, সেটা তাহলে খুব ছোট কোন দূর্নীতি নয়।।

(লেখক গণআন্দোলন কর্মী)

Post a Comment

0 Comments