অন্ধকারের মাঝে তারার আলোই ভরসা

সৈকত মিস্ত্রী 

নিটশের একটা বই পড়তে পড়তে কবি ইয়েটস একটি পাতায় লিখে রেখেছিলেন -' রাতের কোনও তারা নেই, আছে বাদুড়, প্যাঁচা আর অপ্রকৃতিস্থ চাঁদ।'  আজকাল আশেপাশে যেমন ঘনিয়ে ওঠা তমসায় বাদুড় আর প্যাঁচার দাপট দেখেছি তাতে একথাই বার বার মনে হয়েছে। সম্প্রতি কুমিল্লা জেলার নানুয়া দীঘির পাড়ে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে তমময় প্রকাশ দেখেছি তাতে ভরসা করার কিছু পাইনি। পেয়েছি বাদুড় আর প্যাঁচার দাপট। এই অন্ধকারের মাঝে দু একটা তারার আলো এসে পড়লে বড় ভালো লাগে। এই যেমন সদ্য  একদল ইসলাম ধর্মপ্রাণ মানুষ হাতে হাত রেখে অবশিষ্ট মণ্ডপের সামনে পাহাড়ায় দাঁড়িয়ে রইলেন সে ছবি দেখে বড় ভরসা জাগল। এই ছবি অন্ধকারের মাঝে যেন তারার আলোর মতো। 

সংশয়ী বলবেন, যখন ধর্মীয় উদ্মাদনায় মণ্ডপের পর মণ্ডপ জ্বলছে, রাষ্ট্র শক্তি তাৎক্ষণিক  ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ, ধর্মের আলখাল্লা গায়ে হামলাকারীদের তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে নিন্দায় সরব হয়েছেন অনেকে - এতসবের পর এই  ভিন্ন ধর্মীদের হাতে হাত রেখে মণ্ডপ রক্ষার ছবি বানিয়ে তোলা, ড্যামেজকন্ট্রোল। এতে ভরসার কি আছে?  কই তখন তো তাঁদের দেখেনি! এ আলো নাকি! জবাবে বলব, অন্ধকারের মাঝে যেটুকু আলো কোথাও খুঁজে পাব, খুঁজে নেব সেখান থেকে ভরসা খোঁজাটা জরুরি।  নিজেদের জন্য জরুরি। রাতের আকাশে থাক না প্যাঁচক, তবু তারার আলো থাকলে অস্বীকার করব কেন? বরং দুঃসময়ে এই আলোটুকু আমাদের পথ দেখাবে। পথ খুঁজতে সাহায্য করবে। আসলে সবটাই বানানো তো। বানিয়ে তোলা কাপড়ে কেউ রাজা, কেউ ভিখিরি।  হিংসা কেউ বানিয়ে তুলবে, আবার কেউ তাকে প্রশমিত করবে। এটাই তো দস্তুর। বছর কয়েক আগে আসানসোলে যখন ইমাম ছেলেকে হারিয়েছেন, তারপর দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে উঠেছিলেন হিংসায় - ইমামের শান্ত, সংযত ঘোষণা সেই ক্ষোভ আর ঘৃণার আগুন প্রশমিত করেছিল। কুমিল্লা থেকে ছড়িয়ে পড়া হিংসার মুখে যখন গোটা দেশ জ্বলছে, তখন এমন একদল মানুষের সংহত প্রত্যয়, অপর সহনাগরিকদের উপাস্য মণ্ডপ রক্ষার ছবিতে ভরসা পাব না!!!

আশিস নন্দী গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, পৃথিবীর দাঙ্গার ইতিহাসে যারা প্রাণে বেঁচেছেন তার অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষকে রক্ষা করেছেন বিবাদমান ভিনধর্মের কোনও না কোনও মানুষ। বাংলাদেশ বা ভারতে দাঙ্গা নতুন নয়। দাঙ্গা, ধর্মীয় উত্তেজনা কেন হয়? কোন শক্তি নেপথ্যে কাজ করে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনা সবার কমবেশি জানাও। তবু কোনও সূত্র পেলে, বিচার না করে মানুষ যে হিংস্র হয়ে ওঠে - সেই মননের গভীরে আলো পৌঁছাতে পারাটা বহু শতকের মনীষার কাজ। সেকাজ সমাজ অভ্যন্তরে চলছে, চলবেও।

১৯৭১ এর স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটিতে  কোনও ধর্মীয় পরিচয় সরকারি ভাবে তেমন করে পরিচিত পায়নি। উগ্র ধর্মবাদীরা ভিতরে ভিতরে ক্রিয়াশীল ছিল বহুকাল। ১৯৭৭  এ ক্ষমতায় এসে জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী এনে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' কথাটিকে বাদ দেন৷ ১৯৮৮ তে এরশাদ পাকাপাকি ভাবে বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। তারপর অনেক জল বয়ে গেছে। ২০১০ এ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট  পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। সেই পর্যন্ত। মানুষের মনোভূমিতে যে ধর্মীয় জিগির ডালপালা মেলেছে তাকি আইনের অস্বীকৃতিতে মুছে যায়। এই  যেমন ভারত খাতাকলমে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এদেশে কেউ কেউ অশান্তি পাকানোর চেষ্টা করলেন, চেষ্টা করে চলেছেন - তাতে নিরপেক্ষতায় আস্থা রাখা কঠিন। বিগত কিছু বছর ভারতের শাসকবর্গ যে ধর্মীয় হিংসার বাতাবরণ তৈরি করেছেন,  নানা দাঙ্গার ইতিহাস রচনা করেছেন তাতে আশঙ্কা হয়। এই আশঙ্কার অন্ধকারে যতই বাদুড়, পেঁচার দাপাদাপি মাত্রা ছাড়াক বাংলাদেশের একদল ধর্মীয় মানুষ যেভাবে মণ্ডপ আগলালেন, এরাজ্যে আসানসোলের ইমাম যেমন সংযত গলায় নিরস্ত করলেন হিংসা - সেই আলোটুকু ভরসা হয়ে থাকুক। তমময় অন্ধকারেও এমন তারার আলোয় আলো দীপান্বিত হয়ে উঠুক।

Post a Comment

0 Comments