'কেউ বলে নায়ক, কেউ জনশত্রু'

জয়র্ষি

বিংশ শতকের শেষভাগের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্বের একবিংশ শতকে নীরবে চলে যাওয়া নিশ্চয়ই বড় ঘটনা। সারা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর কাছে মুক্তির আশা জাগানো শ্রমিকরাষ্ট্র (ততদিনে অধঃপতিত হলেও) ভেঙে বাজার উন্মুক্ত করার মাধ্যমে টাকার কুমিরদের কাছে যে উপহার তুলে দিয়েছিলেন, তার পুরস্কার স্বরূপ নোবেল শান্তি পুরস্কার অবশ্যই অতি সামান্য উপহার৷ তথাকথিত ঠাণ্ডা যুদ্ধ নামক লড়াইটা তো বাহানা মাত্র। তবু সেই বাহানাতে ভর করেই জগৎ জোড়া মিডিয়ার কাছে রাতারাতি মুক্তিসূর্য হয়ে উঠেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধিনায়ক মিখাইল গর্বাচেভ।

তাহলে গর্বাচেভ সত্যিই কি যুদ্ধ থামানো নায়ক? বাস্তব যদিও সেই কথাকে সমর্থন করছে না। সোভিয়েতের পতনের পর থেকে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসা বেড়েছে বহুগুণ। দখল হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি। সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, ইরাক, গাজায় প্রতিদিন লেগে থাকে যুদ্ধ। মালিকদের মুনাফার স্বার্থেই বেঁচে থাকে যুদ্ধ। অথচ, লেনিন - ট্রটস্কির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে শ্রমিকরাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত যখন গঠন হচ্ছে, তখন অন্যতম দাবী হিসেবে উঠে আসছে যুদ্ধ বন্ধের দাবী। যুদ্ধ শেষ করার জন্য শ্রেণী যুদ্ধের কাহিনীর কথা ধ্বনিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। কিন্তু গর্বাচেভের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আশাভঙ্গ হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামে আস্থা রাখা জনতার। বাস্তবতঃ শান্তি হারাচ্ছে বিশ্ব। অনাহার হয়ে উঠছে নিউ নর্মাল। এটাই কি তবে নোবেল কমিটির শান্তির নমুনা?

অথচ, ভাগ্যের পরিহাস, গুটিকয় উদারবাদী মানুষ ছাড়া বিশ্বের তাবড় টাকার কুমিরদের কেউ মনে রাখেনি গর্বাচেভকে। তাদের কাছে গর্বাচেভ ছিলো এক সাময়িক বোরে, যার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিলো শ্রমিকশ্রেণীর দীর্ঘ সংগ্রামের দ্বারা ধীরে ধীরে গড়ে তোলা সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই সাময়িকভাবে নায়কের সম্মান দিলেও বাস্তবে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করাই কাজ হয় এই মালিক ও তাদের তাঁবেদার মিডিয়ার। অন্যদিকে বামপন্থী হিসেবে পরিচিত বা মুক্তমনা চিন্তকদের যারা গর্বাচেভ স্মরণ করে, তাদের স্মৃতিকথায় শুধুই কিছু বিশ্বাসঘাতকতা ও সুবিধেবাদ ছাড়া কিছুই ফোটে ওঠে না। 

অন্যদিকে যদি তাহলে গর্বাচেভকে খলনায়ক চিত্রিত করতে হয়, তবেও তা হয়ে ওঠে এক পরিহাস মাত্র। বামপন্থী শিবিরের এক বৃহদাংশের চোখে গর্বাচেভ জনশত্রু হলেও সোভিয়েত পতনের জন্য এক ও একমাত্র গর্বাচেভকে দায়ী করা যায় না। মার্ক্সবাদ শিক্ষা দেয় ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো পটপরিবর্তনের পথে দীর্ঘকালের বস্তুবাদী ভিত্তি লাগে। কোনো ব্যক্তি নয়, জনতাই ইতিহাস তৈরি করে। সোভিয়েত পতনের ভিত্তিও তৈরি হয়েছিলো দীর্ঘদিন ধরে। ১৯২৪ সালের পরে আমলাতন্ত্রের উত্থানের সময় থেকে সোভিয়েতের যে পরিমাণগত পরিবর্তন হতে শুরু করে, তাই ১৯৯২ তে এমন গুণগত পরিবর্তনের রূপ নেয় যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকে বাজারের জন্য উন্মুক্ত করতে বাধ্য হতে হয়। ২৪ এর পর থেকে আমলাতন্ত্র সুবিধা ভোগ করার জন্য সারা বিশ্বে বিপ্লবে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বারবার পিছিয়ে যায় বিশ্ববিপ্লব। এক দেশে শ্রমিকরাষ্ট্র সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে এবং যান্ত্রিক ক্ষেত্রে রাশিয়া পিছিয়ে থাকার ফলে পশ্চিম বিশ্বের অর্থনীতির চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়৷ স্তালিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আমলাতন্ত্রের অবশ্যাম্ভাবী ফল হিসেবেই রাশিয়া শ্রেণী সমঝোতা করতে বাধ্য হয় চার্চিল, ট্রুম্যানদের মতো টাকার কুমিরদের ম্যানেজারদের সঙ্গে। মালিকদের ম্যানেজারদের সঙ্গে শ্রেণী সমঝোতার মাধ্যমে স্তালিনের হাত ধরে যে পতনের শুরু, তাই ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভের হাত ধরে একইভাবে অতিবাহিত হয়ে সরকারি সিলমোহর পায় গর্বাচেভের হাত ধরে। 

বাস্তবত গর্বাচেভ ইতিহাসে একজন নায়ক বা খলনায়ক হিসেবে নয়, একজন স্কেপগোট হিসেবেই লিখিত থাকবেন। যাবতীয় অন্যায়, যাবতীয় শ্রেণী সমঝোতার সমালোচনা বাদ দিয়ে একা গর্বাচেভকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটাই ইতিহাসের পরিণতি হয়ে উঠেছে। একদেশে সমাজতন্ত্র গঠনের যে মিথ্যে খোয়াব দেখে যাওয়া হয়েছে, তারই অন্তিম পরিণাম গর্বাচেভ হওয়া সত্ত্বেও একা গর্বাচেভকে গালমন্দ করার মাধ্যমে খুব সহজে আমলাতন্ত্রের অপরাধকে আড়াল করে দেওয়া যায়৷ ইতিহাসে গর্বাচেভের অপরাধের পাশাপাশি তাই স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে আমলাতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীও।

এক উদারবাদী মুক্তমনা তার সুবিধাবাদী জায়গা থেকে লিখেছেন, "যে দেওয়ালে ঘুণ ধরেছিলো, যে দেওয়ালকে ভেঙে ফেলতে হতো, তাকেই সরকারিভাবে ভেঙেছেন গর্বাচেভ।" আমি এটাকেই ধার করে একটু অন্যভাবে বলবো, "যে দেওয়ালে ঘুণ ধরেছিলো, যে দেওয়ালে কীটনাশক দিয়ে ঘুণ ধ্বংস করে দেওয়াল মেরামত করতে হতো, তাকেই মেরামত করার বদলে সরকারিভাবে ভেঙে ঘুণেদের দোষ একা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছিলেন গর্বাচেভ।"


গর্বাচেভ প্রসঙ্গে লেখকের এই ব্যক্তিগত বিশ্লেষনের প্রতুত্তরে যেকোন মতামত, রাজনৈতিক বিতর্ক বা সমালোচনা থাকলে নীচে মন্তব্য করুন। 

Post a Comment

0 Comments