প্রসঙ্গঃ রাজনৈতিক বন্দীদের স্বাস্থ্যের অধিকার


প্রসূন 

ভিন্ন মত ও ভিন্ন পথের অধিকারকে কোন শাসকই স্বীকার করে না। কেউ কেউ খাতায় কলমে স্বীকার করলেও বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হয় না। তার মধ্যে আমাদের দেশের অবস্থা তো শোচনীয় রকমের খারাপ। ভিন্নমত পোষণকারী ও পথিকদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে তাদের উপর যত ধরনের নির্যাতন চালানো যায়, সবই আমাদের দেশে চালানো হয়। ব্রিটিশ আমলের রাজদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহের আইনগুলোর পাশাপাশি নতুন আইন তৈরি হয়েছে - সন্ত্রাসবাদ দমনের আইন- ইউএপিএ। এর যথেচ্ছ প্রয়োগ করা হয় ভিন্নমত পোষণকারী ও ভিন্ন পথের পথিকদের উপর। কিছু দিন আগে অশীতিপর ও ভীষণ রকম অসুস্থ জেলবন্দী স্ট্যানস্বামীর ওপর নির্যাতন চালানো ও তার স্বাস্থ্য তথা বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেবার ঘটনা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একই রকম ভাবে পশ্চিমবাংলায় সুদীপ চোংদার, বুদ্ধদেব মাহাতো সহ বহু রাজনৈতিক বন্দীর জীবনের অধিকার খর্ব করার ঘটনা সহ অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক বন্দীরা সমাজের অগ্রণী। তাঁরা যে কোন অন্যায় অত্যাচার নিয়ে আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকেন। তাদেরই যদি স্বাস্থ্যের অধিকার তথা বেঁচে থাকার অধিকার না থাকে, তাহলে সাধারণ বন্দীরা জেলখানার ভিতরে কেমন অবস্থায় থাকতে পারেন, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা দুর্নীতির অভিযোগে জেলবন্দী হলে, বা মাফিয়া ডনেরা জেলবন্দী হলে তাদের কথা অবশ্যই আলাদা রকমের হয়। এটা সবাই আন্দাজ করে নিতে পারেন।

জেলখানার নোংরা পরিবেশ, জঘন্য খাবার ও নামমাত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনিতেই সবার আয়ু কমিয়ে দেয়। ধরা পড়ার পর তথ্য বের করার জন্য রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর সব ধরনের নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশি হেফাজতে বন্দীদের চব্বিশ ঘন্টায় একবার করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর আইন আছে। কোন ডাক্তারের এত সাহস হয় না যে তিনি পুলিশের হুকুমের বিরুদ্ধে রিপোর্ট লিখবেন। ফলে বন্দীদের স্বাস্থ্যের অধিকার ধরা পড়ার সময় থেকেই লঙ্ঘিত হতে থাকে। এরপর বন্দী যখন জেলে আসে, জেলগেটে ঘন্টার পর ঘন্টা বন্দীকে হাঁটু মুড়ে নীল ডাউন করে বসিয়ে (কলকাতা জেলগুলোতে দাঁড় করিয়ে) রাখা হয়। যাদের পায়ের সমস্যা আছে, তাদের সমস্যা জেল গেটেই আরো বেড়ে যায়। মেদিনীপুর জেলে বন্দীকে সেন্ট্রাল টাওয়ারের নিচে নিয়ে গিয়ে আরো কয়েক ঘন্টা নীল ডাউন করে বসিয়ে রাখা হয়। এটা আমি ২০০৫ সালেও দেখেছি, ২০০৯-২০১০ সালেও দেখেছি। তাই আজও এই ব্যবস্থার বদল হয়েছে বলে মনে হয় না।

এরপর একজন বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয় জেল ডাক্তারের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। সেখানে ডাক্তার কার্যত জনসমক্ষে বন্দীকে যৌন হেনস্থা করে। কম বয়সী বন্দীদের ডাক্তার উলঙ্গ করিয়ে জনসমক্ষে অন্ডকোষ টিপে দেখে যে বন্দীর হার্নিয়া আছে কিনা। তারপর বন্দী যায় আমদানি ফাইলে, মানে একটা হল ঘরে যেখানে নতুন বন্দীদের প্রথমে রাখা হয়। প্রথমদিনে বন্দীদের দেওয়া হয় নোংরা ও কুটকুটে কম্বল, নোংরা থালা বাটি। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত বন্দী হলে তাকে ইচ্ছে করে পায়খানার ধারে শোয়ার জায়গা দেয়া হয়, যাতে প্রথম দিনেই সে হাঁপিয়ে উঠে জেল কর্তৃপক্ষের সাথে সাপ্তাহিক বন্দোবস্ত করে। বন্দীকে চাপ দিলে তবেই না সে টাকা বের করবে। এই টাকা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভাগ হয়। রাজনৈতিক বন্দীরা এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বলে জেলের ভেতরেও তাঁদের ওপর অনেক বিধি-নিষেধ চাপানো হয়। তাঁকে পার্মানেন্টলি সেলে (ছোট ঘর) বন্দী করা হয়। তাদের সাথে কাউকে দেখা করতে বা কথা বলতে দেওয়া হয় না। রাজনৈতিক বন্দীর নিরাপত্তার(!) অজুহাতে তার সমস্ত আইনি অধিকার খর্ব করা হয়।

এতে বাইরের শাসকরা খুশি হয়, জেলের প্রশাসকরাও খুশি হয়। বন্দী কোর্টে গিয়ে চেঁচামেচি করলে জজরা চোখ কান বন্ধ করে রাখেন। এখন আবার নতুন নিয়ম হয়েছে যে রাজনৈতিক কারণে বন্দীরা (প্রশাসনের ভাষায় ডেঞ্জারাস টেরোরিস্ট) যাতে কোর্টে গিয়ে বাইরের সমাজে এসব বলতে না পারেন, তাই জেল থেকেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁর বিচার প্রক্রিয়া চালানো হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র সেই মামলার বিচার চলার সময় জজের টেবিলে থাকা কম্পিউটারের স্ক্রিনে সেই বন্দীর ছবি ফুটে উঠবে জজই একমাত্র বন্দীদের দেখতে শুনতে পাবে! জজের শোনার ইচ্ছে না হলে বন্দীকে মিউট করে রাখবে! রাজনৈতিক বন্দী তার উপর ঘটে চলা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বা অভাব অভিযোগ কোথাও বলতে পারবেন না! আগে বন্দীর সাথে সপ্তাহে একবার তার বাড়ির লোকেরা বা বন্ধুরা দেখা করতে পারতেন! বর্তমান সরকার এই নিয়ম বদল করে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্কের লোকেদের দেখা করার অধিকার রেখেছে। সেটাও আবার তিন ধরনের গোয়েন্দা অফিসারদের সামনে। সাধারণত রাজনৈতিক বন্দীকে তাঁর বাড়ি ও কোর্ট থেকে বহু দূরের জেলে রাখা হয়, যেখানে পরিবারের লোকেরা যেতে পারবেন না। অর্থাৎ একজন পূর্ণ মাত্রায় সচেতন রাজনৈতিক বন্দিকে সম্পূর্ণ অসহায় বানিয়ে তোলা হবে। তিনি কোথাও কোন প্রতিকারের আশা করা তো দূর, কাউকে বলতেও পারবেন না নিজের অসহায়তার কথা। ফলে সেই বন্দীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা একবার ভাবুন। অল্পদিনের মধ্যেই হয় তাঁকে প্রশাসনের হাতের পুতুলে পরিণত হতে হবে, নয়তো শরীরে মনে হাজার গন্ডার রোগ বাসা বাঁধবে, যা তাকে তিলে তিলে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে।

লেখক একজন গণ আন্দোলন কর্মী। লেখাটি জনস্বাস্থ্য মোর্চার মুখপত্র জনস্বাস্থ্য জনবার্তার ২০২৩ বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্য মোর্চার পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক জারি করা একটি বিবৃতির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে উপরের লেখাটির সাথে আমরা যুক্ত করলাম। — মেহনতি. ইন


রাজনৈতিক বন্দীদের জনস্বাস্থ্য তথা বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করার বিষয়ে আমাদের বিবৃতি 

সম্প্রতি এপিডিআর এর বিবৃতি ও সংবাদ পত্রের রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারলাম যে দমদম জেলে রাজনৈতিক বন্দীদের সুচিকিৎসা ও ওষুধ পাওয়ার অধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে এপিডিআর এর প্রতিনিধিদল দমদম জেল সুপারিনটেনডেন্ট এর সাথে দেখা করতে গেলে কারা কর্তৃপক্ষ প্রতিনিধিদলকে জেল থেকে বহু দূরে বিশাল পুলিশ বাহিনী দিয়ে আটকে দেয়। জেল সুপার প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করতে ও অভিযোগ পত্র গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। 

বাংলার স্বৈরশাসকের রাজত্বে তাঁর অধস্তন আমলারা এক একটি ক্ষুদে স্বৈরশাসক হবে -- এটাই স্বাভাবিক। জেল গুলিকে মধ্যযুগীয় দূর্গের মতো করে রাখা হয়েছে। জেল সুপার ও জেলাররা একেকটি দূর্গাধিপতি। তাঁরা যেন মধ্যযুগীয় স্বৈরশাসক। লিখিত আইন কানুন এখানে ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। তাঁদের কথাই এখানে আইন। গণতন্ত্রের মুখোশ পরা শাসকরা এবং এই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিদিন জেল বন্দীদের বেঁচে থাকার অধিকারকে খর্ব করে। জেল বন্দীদের খাবার, ওষুধ পত্র সবকিছুই এই আমলাদের পকেটে ঢুকে যায়। আর রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর অত্যাচার চালাতে পারলে শাসকদের সুনজরে থাকা যায়, প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া যায়। তাই এই কুকর্ম করার জন্য জেল আমলাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা চলে। 

এরকম পরিস্থিতিতে  আমরা জনস্বাস্থ্য মোর্চা রাজনৈতিক বন্দীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা বাংলার জনগণের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি -- একমাত্র তীব্র গণআন্দোলনই পারে বধিরকে উচ্চ কন্ঠে শোনাতে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের স্বাস্থ্য তথা বেঁচে থাকার অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে। তাই এই উদ্দেশ্যে গণআন্দোলন তীব্র করুন।

জনস্বাস্থ্য মোর্চা
People's Alliance for Public Health

Post a Comment

1 Comments

  1. রাজবন্দীদের স্বাস্থ্যের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেখানে রাষ্ট্র বিনা বিচারে জেলবন্দী রেখে তাঁদের জীবনীশক্তি শেষ করে দিতে উদ্যত।

    ReplyDelete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)