কুশল দেবনাথ
শ্রমিকদের অর্জিত আইনী অধিকার কেড়ে নেবার জন্য প্রচলিত শ্রম আইনকে বদলে চারটি ‘শ্রমকোড’ নিয়ে এসেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। নতুন এই শ্রমকোড শ্রমিকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বড় বড় মালিকদের মুনাফার পাহাড় বাড়াতেই সাহায্য করবে, এ’কথা ঠিক। কিন্তু, শুধুমাত্র এই দৃষ্টিকোন থেকে শ্রমকোডকে দেখলে আমরা ভুল করবো। প্রকৃত বিপদটা বুঝতে হলে গোটা দেশে যে পরিকল্পিত ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চলছে, সেই নিরিখেও শ্রমকোডকে দেখতে হবে।
ফ্যাসিবাদ একচেটিয়া পুঁজির সবচেয়ে নির্মম, প্রতিক্রিয়াশীল অংশের শাসনের একটি ব্যবস্থা। স্বাভাবিক ভাবেই ফ্যাসিবাদী জমানা তার শাসনকে জোরদার করতেই শ্রমিকশ্রেণীর উপর তীব্র আক্রমন নামিয়ে আনে। চারটি শ্রমকোড সেই প্রক্রিয়ার একটি অঙ্গ। পুঁজির হামলার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার হলো তার ‘সংঘশক্তি’, অর্থাৎ, তার যৌথতা। ১৮১১ সালে ‘মেশিন ভাঙ্গার আন্দোলন’ থেকে শুরু করে ১৮৭১ সালের ‘প্যারি কমিউন’ অথবা ১৮৮৬ সালের ‘মে দিবসের’ আন্দোলন সহ নানা লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা ‘শ্রেনী’ হিসাবে সংগঠিত হয়েছে, রাজনৈতিক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে, এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতাও দখল করেছে। যেখানে তার মূল হাতিয়ারই ছিলো সঙঘবদ্ধতা। যার মাধ্যমে ‘ব্যক্তি শ্রমিক’ থেকে তার উত্তরণ ঘটেছিল ‘সংঘবদ্ধ শ্রমিকে’। এটাকেই সবচেয়ে ভয় পায় পুঁজির রক্ষকরা। সুতরাং, পুঁজির শাসনকে বাঁচানোর জন্যই পুঁজিপতিশ্রেনী বা তাদের দলগুলি চেষ্টা করে শ্রমিকদের এই সঙঘবদ্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে ‘সংঘবদ্ধ শ্রমিক’কে ‘টুকরো শ্রমিকে’ পরিণত করতে। ফ্যাসিবাদ যেহেতু একচেটিয়া পুঁজির সবচেয়ে নির্মম অংশের একটি শাসন ব্যবস্থা, ফ্যাসিবাদী শক্তি তাই আরো তীব্রতার সাথে এই আক্রমন নামিয়ে আনে। শ্রমিকশ্রেনীকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়াটাই তার লক্ষ্য, তা যে কৌশলেই হোক। চারটি শ্রমকোডকে এই দৃষ্টিকোন থেকেও বিচার করাটা দরকার।
ফিক্সড টার্ম প্রথা বা নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কাজ
এই শ্রমকোডের একটি অংশ হচ্ছে ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কাজ। এই ফিক্সড টার্ম প্রথা প্রথম চালু হয় ২০১৪ সালে সিজনাল শিল্পে। ২০১৬ সালে সূতা শিল্পে। এসবই নোটিফিকেশনের মাধ্যমে করা হয়েছিল। আজ সেটাই আইনের মাধ্যমে বৈধতা পাচ্ছে, রাষ্ট্রের শিলমোহর পাচ্ছে।
ফিক্সড টার্ম প্রথার মানে কি?
একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে মালিকের সাথে শ্রমিকের কাজের চুক্তি। ধরা যাক একজন শ্রমিক মালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলো ১ বছরের জন্য। একবছর পরে তার কাজ সন্তোষজনক হলে আবার ১ বছরের জন্য চুক্তি হবে, নইলে চুক্তি বাতিল হবে। সমস্যা হলো, ঐ চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকটি ব্যক্তি বা ‘টুকরো মানুষ’ হয়ে গেলো। কারণ, প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য হবে আলাদা আলাদা চুক্তি। সে আর ইউনিয়ন করবে না, অধিকারের লড়াই লড়বে না। ‘টুকরো শ্রমিক’ হয়েই থাকবে। ‘সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক’ হয়ে উঠবে না।
প্রশ্ন আসতে পারে এইরকম বিষয় তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই চালু আছে। তফাৎটা কি? তফাৎটা হলো, এতোদিন যেটা বোঝাপড়া করে চলতো, এবার সেটাই রাষ্ট্রের আইন করা হলো। ফ্যাসিষ্ট শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তারা বিষয়টি আইনে পরিণত করেছে। অর্থাৎ শ্রমিকের সঙঘবদ্ধতা ভাঙ্গতে রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের এটা একটা বড় উদাহরণ।
ধর্মঘটের অধিকার হনন
শ্রমকোডের অন্য একটি প্রসঙ্গ, ‘ধর্মঘট’ নিয়ে কিছু আলোচনা করলেও আমরা একই ছবি দেখতে পাবো। ধর্মঘট শ্রমিকদের লড়াইয়ের একটি বড় হাতিয়ার। ধর্মঘট মানে কি? ধর্মঘট মানে একজন বা একদল শ্রমিক স্বেচ্ছায় কাজ বন্ধ করেন। শ্রমিকরা তো কারখানা বা শিল্পে হাজিরা দেন কাজ বন্ধ করতে নয়! কিন্তু মালিকদের আক্রমন প্রতিহত করতে শ্রমিকরা কখনো কখনো কাজ বন্ধ করতেও বাধ্য হন। এতে মালিকদের শুধু ক্ষতি হয়না, শ্রমিকদের নিজেদেরও হয়। কিন্তু অধিকার অর্জনের লড়াই করতে শ্রমিকরা এই ক্ষতি মেনে নেয়।
শ্রমকোডে এই ধর্মঘটের বিষয়টি কি ভাবে রাখা আছে?
শিল্পবিরোধ আইনে লেখা আছে, ‘পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস’ (অর্থাৎ, জরুরি জনপরিষেবা) ছাড়া কোন শিল্পে ধর্মঘট করতে নোটিশ দিতে হবেনা। ধরা যাক কোন চটের কারখানাতে মালিকরা কয়েকজন শ্রমিককে ছাঁটাই করলো। শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করলে সেটা বেআইনি নয়। কিন্তু নতুন শ্রমকোডে সব শিল্পকেই ‘পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোন শিল্পে ধর্মঘট করতে হলে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ দেবার পর মালিক-সরকার আলোচনা করবে। আবার লেখা আছে, আলোচনা চলার সময় কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ ধর্মঘট করা যাবে না। করলে ধর্মঘট বেআইনি ঘোষণা করা হবে! এই ধর্মঘটকে কেউ সমর্থন বা সহযোগিতা করলেও ফৌজদারি মামলা রুজু হবে। মানে, মালিক কাউকে ছাঁটাই করলে বা শ্রমিকদের বেতন না দিলেও শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করতে পারবে না। তাকে দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া নিতে হবে। কার্যত এইভাবে ঘুরিয়ে ধর্মঘটের অধিকারটিই কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আর, ঠিক এটাই চায় কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী সরকার। পুঁজিপতিদের মুনাফার পথকে যেভাবেই হোক মসৃণ করতে হবে। তাই তারা চায় শ্রমিকরা যাতে একজোট না হয়। ইউনিয়ন না করে। ধর্মঘট না করে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধহীন কিছু টুকরো মানুষ দিনে ১২-১৪ ঘন্টা মুখ বুজে কাজ করে আদানি-আম্বানিদের মুনাফার পাহাড় বাড়িয়ে তুলতেই কেবল আত্মনিবেদন করবে, এইরকমই একটা ‘আইনের শাসন’ তারা গড়ে তুলতে চায়। তাদের মতে, এ’ভাবেই তৈরি হবে আগামীদিনের শক্তিশালী ভারত রাষ্ট্র। ‘শ্রমকোডে’র নামে আর.এস.এস-বিজেপির এই ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনা রুখে দেওয়ার চেষ্টা খেটে-খাওয়া মানুষকেই করতে হবে।
"শ্রমিক শক্তি" আগষ্ট সংখ্যাতে লেখাটা প্রকাশিত। লেখক গণ আন্দোলনের কর্মী।
0 Comments