অন্য এক স্থবির দাসগুপ্ত | রতন খাসনবিশ

রতন খাসনবিশ

তার নাম নিরঞ্জন মাহাতো। ন্যাজাট ছাড়িয়ে নদীবাঁধ ধরে দু’কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছোতে হ’ত নিরঞ্জন-এর বাড়ি। মাটির বাড়ি। সামনে ছোটো বারান্দা। একপাশে ছোটো রান্নাঘর। রান্নাঘরে কোনো কর্মব্যস্ততা নেই। চাল নেই, আটা নেই, রন্ধন  উপকরণ নেই। রান্নাঘরের সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছে নিরঞ্জন-এর বউ। পুত্র রাজকুমার মায়ের তাড়া খেয়ে নদীবাঁধে উঠে বসে আছে। নিরঞ্জন-এর কুঁড়েঘড়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে এক আত্মগোপনকারী নকশাল। নিরঞ্জন বাড়িতে নেই। খাদ্যের সন্ধানে সে ন্যাজাট-এ গেছে। ন্যাজাটে চাল-আটার দোকান আছে। চালু বাজার। বাজারে নিরঞ্জন-এর entitlement নেই। ফন্দি ফিকির খুঁজছে নিরঞ্জন সেই সব দোকানে ঢোকার entitlement অর্জন করতে।

গতশতকের সত্তরের দশকের গোড়ায় সুন্দরবনের এইরকম একটা পরিবেশ ছিলো খুবই স্বাভাবিক। ভাতের যে একটা আলাদা গন্ধ থাকে, যে গন্ধে রাজকুমার বাঁধ থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসে, কৃষক বধূর মুখে একটা দীপ্তি নামে, সেটা জানতাম না। এই জগত আমাকে চিনিয়েছিলো স্থবির দাশগুপ্ত। পড়নে হলদে রঙের একটা লুঙ্গি, কোমরে বিড়ি এবং দেশলাই গোঁজা, গায়ে একটা মলিন ডোরাকাটা শার্ট--আমার এরিয়া কমিটির নেতা স্থবির দাশগুপ্ত। ক্ষুধা এবং বিপ্লবের আন্তসম্পর্ক কী, সেটা তার কাছে জলের মতো স্পষ্ট। সন্ধ্যেবেলা নিরঞ্জন-এর বাড়িতে বসে কৃষকসভার মিটিং। প্রধান বক্তা স্থবির দাশগুপ্ত। কেরোসিন-এর লম্ফ জ্বলে, দেওয়ালে স্থবির-এর ছায়া দীর্ঘ হয়। ‘অভ্যুত্থান’ না ‘খতম অভিযান’ এ নিয়ে বিতর্ক হয়। স্থবির খতম অভিযানে দৃঢ়। অর্ধমৃত অনাহার-দীর্ন কৃষকের ‘শ্রেণীঘৃণা’ জাগাবার জন্য স্থবিরের লেকচার দীর্ঘতর হয়। নিরঞ্জন-এর বউ কুপি নিভিয়ে দেয় কেরোসিন বাঁচাবার জন্য। মিটিং কিন্তু চলতেই থাকে।

নিরঞ্জন-এর বাড়িতে ভাত রান্না হতো কদাচিত। আমরা খেতাম আটাঘোঁটা। উনুনে জল ফুটিয়ে সেই জলে আটা ঘোঁটানো হতো। থালা ভর্তি আটাঘোঁটা নিয়ে খেতে বসতাম। সঙ্গে কোনো তরকারী বা মাছের বাহুল্য নেই। স্থবির মহাউৎসাহে আটাঘোঁটা খেত। আমার মুখে আটাঘোঁটা প্রবেশের পথ পেত না। স্থবির বলতো, একটা লঙ্কা চিবিয়ে নে, দেখিস আটাঘোঁটার কী টেস্ট। 

অরন্ধন কিংবা আটাঘোঁটায় মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতো। সন্দেহ নেই যে এটা ‘পেটিবুর্জোয়া’ ভাইস। কিন্তু এই ভাইস দমনের পথ খুঁজে পেতাম না। স্থানীয় ব্লক অফিসের একজন করণিক ছিলেন আমাদের সমর্থক। রূপমারি স্কুলের একজন শিক্ষকও ছিলেন আমাদের দলের মানুষ। দু’বাড়িতেই ভাত পাওয়া যেতো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই বাড়িগুলোতে হাজির হতাম ভাতের লোভে। স্থবির আপত্তি করতো না। মাঝে মাঝে নিজেও আমার সঙ্গী হতো। বসিরহাটে মিটিং করতে যেতো স্থবির। ফেরার সময় কিছুটা চাল-আটা নিয়ে আসতো আমার জন্য। নিরঞ্জন-এর বাড়িতে চাল-আটা রেখে সে চলে যেতো অন্য শেল্টার-এ। সেখানে খাবার হলো আটাঘোঁটা, তা-ও একবেলা। বলতাম খানিকটা নিয়ে যা। স্থবির উজ্জ্বল চোখে তাকাতো আমার দিকে; হেসে বলতো “আমার ব্যবস্থা আছে”। ছলনার অভিনয় আমাকে পীড়া দিতো।

উত্তরজীবনে আমি মাস্টার হয়েছি। স্থবির হয়েছে পেশাজীবি ডাক্তার। ভাত কাপড়ের অভাব-মুক্ত এই জীবনে ভাতের গন্ধ হারিয়ে গেল। রান্নাঘরের দাওয়ায় বিষন্নমুখ এক কৃষক রমণীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার ছবিও আর মনে পরে না।

স্থবির লিখেছে, এসবের জন্য কোথাও একটা ‘মায়া রহিয়া গেল’। যেটা স্থবির লেখেনি, কিন্তু আমি নিশ্চিত, স্থবির যেটা মনে রেখেছিলো, সেই মাস্টার বা সেই ডাক্তারের মনোজগতে যা কখনোও ‘ডি লিট’ করা যাবে না- তা হলো একটা অপরাধবোধ।

এই অপরাধবোধ ঐ মাস্টারটিকে বা ঐ ডাক্তারটিকে মানুষে রূপান্তরিত করেছিলো, যে মানুষ ‘ভাতের গন্ধ’ জানে, যে মানুষ দুঃখী মানুষকে চিনতে পারে। এ এক বিরল ধরনের পবিত্র অপরাধবোধ খুব কম মানুষই যা অনুভব করার অধিকার অর্জন করে। স্থবির ছিল এই বিরল প্রজাতির মানুষ—অন্য রকমের মানুষ। 

যে বিরল ধরনের অপরাধবোধ উত্তরকালের স্থবিরকে নির্মান করেছিলো, এখন সেটা দুর্লভ। সে কারনেই দেখি হিংস্র, আত্মকেন্দ্রিক, ষড়রিপু তাড়িত মানুষের পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে স্থবির দাশগুপ্তর মতো মানুষেরা।

প্রচ্ছদ: অরিন্দম দে


লেখাটি ‘শব্দ মুখর স্থবির’ বইতে প্রকাশিত। স্থবির দাশগুপ্তের স্মৃতিচারনায় ২২জন লিখেছেন সদ্য প্রকাশিত ছোট্ট এই বইতে। প্রকাশক: গ্রাফ। মুদ্রণ ও পরিবেশনায়: মেহনতি পাবলিকেশন।

বই সংগ্রহে যোগাযোগ: ৯৫৯৩৫৯৩১৬৯
বইটি পাবেন: কলেজস্ট্রিট ধ্যানবিন্দু, কাউন্টার এরা
মুদ্রিত মূল্য: ৫০ টাকা (সাড়ে ৪ফর্মা)

Post a Comment

0 Comments