ছোটগল্প - ডোম | Short story written by Esha Basu


ডোম - এষা বসু 

 একটি ছোট নদী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। তবে গ্রামটি নেহাতই ছোট নয়, বেশ বড় গ্রাম; তার থেকে এক কিলোমিটার দুরত্বে রয়েছে গঞ্জ, নদীর ধারে, সেখানে অনেক  আড়তদার ব্যবসায়ী বাস করে। স্কুল আছে, পোষ্ট অফিস আছে, একটা সিনেমা হলও আছে। 

             এই গঞ্জের কিছু লোকের বদান্যতায় এই বাঁশ পাতি গ্রামে একটি অনাথ আশ্রম তৈরি হয়, জমি তাদের দান ; সরকার বাকি ব্যবস্থা করে। এটি মেয়েদের আশ্রম। সরকার  খাওয়া পরা শিক্ষা স্বাস্থ্য সবই চালায়। এখানকার মেয়েরা নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গঞ্জের স্কুলে যায় পড়তে। যাওয়া আসার পথে নদীর ধারে এখানকার শ্মশানটি। শ্মশান লাগোয়া ডোম পট্টি। তাদের নীচু খড়ের ঘর, উঠোনে এবং আশে পাশে শুয়োর চরে বেড়ায়। উঠনে এক বৃদ্ধ খাটিয়ায় বসে কুলো ঝুড়ি বোনে। এই পাড়াটিতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই কাজ করে। সপ্তাহে একদিন গঞ্জে গিয়ে ব্যাপারীদের কাছে বেচে আসে, সংসারে কিছু আয় হয়। তাদের হাতের জিনিষ এই নদী দিয়ে নৌকা করে দূর দুরান্তে চলে যায়। 

          আশ্রমের বালিকারা যাওয়া আসার পথে দাঁড়িয়ে দেখে এই কাজ, তাছাড়া তাদের আকর্ষণের আর একটি কারণ আছে, এদের পাড়ায় কুল গাছ আর আম গাছ আছে। গরম কালে আম আর শীত কালে কুল তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে। বৃদ্ধকে তারা দাদু বলে ডাকে ‘কুল দাদু’। মায়া বলে একটি মেয়ে প্রথম বলেছিল ‘ও দাদু দাদু তোমাদের গাছে কুল পেকেছে দেবে আমাদের?’ 

    ‘ও খুকি যাও, পেড়ে লাও, আমি কাজ করছি তো, গাছে ঝাঁকা দাও, অনেক কুল পড়বে লিয়ে যাও।’

         মায়া মনের আনন্দে কুল কুড়িয়ে নিয়ে খেতে খেতে স্কুলে যায়, গিয়ে বন্ধুদেরও দেয়। এরপর থেকে আশ্রমের মেয়েরা ডোম পাড়ার কুল নিয়মিত খেত। এই কারণেই বৃদ্ধের নাম হয়ে যায় ‘কুল দাদু’।

      কোন কোন দিন বৃদ্ধ নিজে কুল পেড়ে একটি বাঁশের চুপড়িতে রেখে দিত, আর মেয়েরা আসলে কুলো বুনতে বুনতে বলত ‘চুপড়িতে আছে লে’। 

         গরম কালে যখন গাছে আম হল, তখন দু একটি কাঁচা আমও জুটত মেয়েদের নুন দিয়ে খাওয়ার জন্য। এই অসহায় অনাথ মেয়েগুলিকে দেখে বৃদ্ধের মায়া হত। এই পাড়ায় অন্য যে লোকজন ছিল তাদের সাথেও মেয়ে গুলোর ভাব হয়ে গেল। দুপক্ষের একটি স্নেহের ভাল লাগার বন্ধন তৈরি হল।

       স্কুলে একদিন মাস্টার মশাই ক্লাসে জিজ্ঞাসা করছিলেন ছাত্রছাত্রীদের ‘তুই বড় হয়ে কি হবি?’ কেউ বলল টিচার, কেউ বলল ডাক্তার, কেউ বলল উকিল, কেউ বা বলল ব্যবসা করব। মাস্টার মশাই এবার মায়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই কি হবি রে মায়া?’ 

   ‘আমি ডোম হব’।  

‘কেন সবাই কত কিছু হতে চাইছে তুই ডোম কেন?’

‘এখানে আশে পাশে অনেক ডাক্তার, জজ, ব্যারিস্টার, টিচার আছে, কিন্তু কেউ আমাদের সাথে মেশে না, আমাদের ভালবাসে না। শুধু শ্মশান পাড়ার ডোমরা আমাদের ভালবাসে, ওরা খুব ভালো। তাই আমি বড় হয়ে ডোম হব।’

     সমাজের শ্রেণী ও জাতি বিন্যাস মুহূর্তের মধ্যে শিক্ষকের চোখের সামনে ভেসে উঠল।  

     

Post a Comment

0 Comments