এক বিদ্রোহী অন্তরের কৌতুকী বাহির - প্রতিরোধের ভাষা


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের প্রিয় ছাত্রটি সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠার আগে পার করেছিলেন এক বিদ্রোহী যৌবন। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের অনুপ্রেরণা আর শিক্ষায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে, অনুশীলন সমিতির হয়ে। ঝোলায় গুপ্ত সমিতির বইপত্র আর কখনো বা টিফিন বাক্সে পিস্তল নিয়ে তরুণ সাম্যময় সাইকেলে করে ঢাকার অলিগলিতে চলাচল করতেন নির্ভয়ে, চিঠিপত্র পৌঁছে দিতেন বিপ্লবীদের ডেরায়। ঢাকার সদরঘাটে ঢাকাই কুট্টিদের (টাঙার গাড়োয়ান) সঙ্গে ভাব জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে নজর রাখতেন পুলিশের লোকজনদের গতিবিধির উপর (এই ঢাকাই কুট্টিদের 'সেন্স অফ হিউমার'ই তাঁকে কমেডিয়ান বানিয়েছে, নিজেই বলতেন এ কথা। বস্তুত তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রামোফোন রেকর্ডটির নামই ছিল 'ঢাকার গাড়োয়ান')। ১৯৪১-এ একজন ব্রিটিশ ইনফর্মার খতম হওয়ার পরে পুলিশের নজরে আসেন সাম্যময়, ৩০ দিনের মতো হাউস-অ্যারেস্ট থাকতে হয়েছিল তাঁকে। 

১৯৩০-এর ৭ জুলাই প্রাণপ্রিয় দীনেশদা' শহিদ হওয়ার পরে একটু যেন দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। এর পরের পর্যায়ে অনুশীলন সমিতির অনেক সদস্যের মতোই যোগ দিয়েছিলেন আর.এস.পি দলে। সলিল সেনের সঙ্গে মিলে 'ক্রান্তি শিল্পী সংঘ' গঠন করায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন সাম্যময়, ততদিনে যিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে পরিচিত হতে শুরু করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছিন্নমূলদের যন্ত্রণা নিয়ে ১৯৫১-য় মঞ্চস্থ করেছিলেন 'নতুন ইহুদী' নামের নাটকটি।

আন্তর্জাতিক মানের এই কৌতুকশিল্পী বাংলায় প্রথম 'স্ট্যান্ড আপ কমেডি'কে জনপ্রিয় করেছিলেন, যে ফর্মটি প্রতিরোধ শিল্পের একটা শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু আমরা কখনোই যেটিকে নিয়ে সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা করিনি। রিফিউজি হওয়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এপারে এসেছিলেন, রক্তক্ষরণের মতোই সে যন্ত্রণাকে অবিরত বুকের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতেন তিনি। ঠেট বাঙাল ভাষায় কলকাতার চলচ্চিত্র ও মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি ছিল সেই উপড়ানো শিকড়ের দৈনন্দিন অপমান ও অবজ্ঞার সচেতন প্রতিবাদ। ঠিক যেভাবে মহম্মদ আলির শ্বেতাঙ্গ বক্সারের উপর একেকটি পাঞ্চ কালো মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ হয়ে আঘাত হানত, সেরকমই যেন ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙাল লবজ্। ফারাকটা এই যে, ব্ল্যাক প্যান্থারের দিশায় মহম্মদ আলি ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রশ্নে রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান নিতে পেরেছিলেন, আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অবিপ্লবী রাজনীতির প্রভাবে তাঁর অতীতের বিপ্লবী মননকে ব্যঙ্গের পরিসর থেকে প্রতিরোধের ভাষায় উত্তীর্ণ করতে চেয়েও পারেননি। একটি 'মসিয়ঁ ভের্দ্যু' বা 'আ কিং ইন নিউইয়র্ক'-এর মানের রাষ্ট্রবিরোধী সৃজনের ক্ষমতা যিনি ধরতেন, তাঁকে 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' হিসাবে দেখেই হাততালি দিলাম আমরা। জনশিল্পের ময়দানে এ আমাদের এক নিদারুণ লোকসান। 

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ।। ২৬ আগস্ট ১৯২০ - ৪ মার্চ ১৯৮৩

(‛কবিকে মুক্ত কর’ পরিচালিত প্রতিরোধ সাহিত্যের মঞ্চ)

Post a Comment

0 Comments