লেনিনের চোখে তলস্তয় : দু-চার কথা

একদিন গোর্কি এসেছেন লেনিনের সাথে দেখা করতে। দেখেন টেবিলের পাশে রাখা 'ওয়ার এন্ড পিস'। লেনিন জানান বইটি পড়তে গিয়ে তাঁর এক কমরেডকে চিঠি লেখার কথা মনে আসে, ইদানিং তিনি একদমই পড়ার সময় পাচ্ছেন না। তবে এরমধ্যে গতকাল তলস্তয় নিয়ে গোর্কির লেখা পড়ে ফেলেছেন। কিছুক্ষণ পর মৃদু হেসে আধবোজা চোখে চেয়ারে গা হেলিয়ে দিয়ে বলেন- "কী অসাধারণ না? কি বিশাল মাপের শিল্পী।" দু এক কথার মাঝে গোর্কিকে জিজ্ঞেস করেন গোটা ইউরোপে তার সমগোত্রীয় কে আছেন? পরে নিজেই উত্তর দেন 'কেউই নেই'। (গোর্কির ভি.আই. লেনিন থেকে পেজ ২৬৯) 

গতপরশু ছিল লিও তলস্তয়ের জন্মদিন। কমরেড লেনিন লিখেছিলেন 'জন্মসূত্রে শিক্ষায় তলস্তয় ছিলেন রাশিয়ার অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ। এই পরিবেশের যাবতীয় প্রচলিত মতামত থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে শেষ দিকের লেখায় তিনি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও আক্রমন চালিয়েছিলেন।'

মস্কো থেকে প্রকাশিত লেনিনের 'On literature and art' বইতে তলস্তয়কে নিয়ে লেনিনের ৫টি লেখা আছে, Tolstoy and the modern labour movement এ লেনিন লিখছেন-  “বিশ্ব পুঁজিবাদের ক্রিয়ায় ১৮৬১ সালের পরে পুরোনো প্যাট্রিয়ার্কাল রাশিয়া দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। কৃষকরা ছিল অভুক্ত, মৃতুমুখী, সর্বসান্ত, যেমনটা আগে কখনও হয়নি। ভিটেমাটি ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছিল শহরে।.. পুরোনো রাশিয়ার সমস্ত পুরোনো খুঁটিগুলোর এই দ্রুত, যন্ত্রনাকর, তীব্র ভাঙনই প্রতিফলিত হল শিল্পী তলস্তয়ের রচনায়, চিন্তাবিদ তলস্তয়ের অভিমতে। গ্রাম্য রাশিয়া সম্বন্ধে জমিদার আর কৃষকদের জীবনযাত্রা প্রণালী সম্বন্ধে তলস্তয়ের জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলিতে এই জীবনের যে বর্ননা আছে তা বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলির মধ্যে পরে। (পেজ ৫৯) ” প্রশংসার পাশাপাশি ক্ষুরধার সমালোচনা করতেও পিছপা হননি লেনিন। leo Tolstoy as the mirror of the Russian revolution এ লেনিন শুরুই করছেন এই বলে একজন মহান শিল্পী যিনি বিপ্লবকে স্পষ্টতই বুঝতে পারেননি, এবং তা থেকে স্পষ্ট দূরত্ব রক্ষা করেছেন। 'তলস্তয়বাদের দগদগে অসঙ্গতি আর তাতে বিপ্লবের কোন কোন ত্রুটিবিচ্যুতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে' তা কিছুটা ব্যাখ্যা করেছেন এই লেখায়। সাথে তার বিপ্লব বিরোধী দিককে কাজে লাগানোর বাসনায় রুশ উদারনীতিকদের ভন্ডামীকেও সমালোচনা করেছেন। একজায়গায় লেনিন বলছেন তলস্তয়ের লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে পুঞ্জীভূত ঘৃণা, ভালো সময়ের আকাঙ্ক্ষা, অতীত থেকে নিষ্কৃতি পাবার কামনা তেমনি একইসঙ্গে আবার অপরিণত স্বপ্ন, রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা, বৈপ্লবিক শিথিলতা (পেজ ৩০)। Tolstoy and the proletarian struggle এ লেনিন লিখছেন “শাসক শ্রেণীগুলির বিরুদ্ধে তলস্তয়ের অভিযোগ প্রচন্ড শক্তিশালী, আন্তরিক ও অকৃত্রিম; গির্জা, আইন আদালত, সমরবাদ, আইনগত বিবাহবন্ধন, বুর্জোয়া বিজ্ঞান প্রভৃতি যেসব প্রতিষ্ঠানাদি দিয়ে আধুনিক সমাজ বজায় থাকে সেগুলোর ভিতরকার মিথ্যাচার তিনি একেবারে স্পষ্ট করে তুলেছেন। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থার কবরখনক প্রলেতারিয়েতের জীবন, কাজ, সংগ্রামের একবারে বিরুদ্ধ প্রতিপণ্ন হয়েছে তার মতবাদ।”.. “তলস্তয়ের সাহিত্য রচনা পড়ে রুশ শ্রমিক শ্রেণী তার শত্রুদের আরও ভালোভাবে চিনতে শিখবে কিন্তু তলস্তয়ের মতবাদ বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রুশ জনগণকে বুঝতে হবে তাদের নিজেদের দুর্বলতাটা। যে দুর্বলতা তাদের মুক্তির লক্ষকে পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে দেয়নি।”.. “রুশ জনগন মুক্তি অর্জন করবে কেবল তখনই যখন তারা উপলব্ধি করবে যে, উন্নততর জীবনলাভ করতে তাদের শিখতে হবে তলস্তয়ের থেকে নয়, তা শিখতে হবে সেই শ্রেণীর কাছ থেকে যার তাৎপর্য তলস্তয় বোঝেননি। তলস্তয় যে পুরনো দুনিয়াটাকে ঘৃণা করতেন সেই দুনিয়াকে ধ্বংস করতে সক্ষম যে শ্রেণী - তার নাম প্রেলেতারিয়েত।” (পেজ ৬২)

শৌভিক মুখার্জী


তথ্যসূত্র:

১) Lenin: On literature and art (progress publishers, Moscow) page: 30, 59, 62, 269 
২) লেনিন : প্রসঙ্গ তলস্তয় (চিরায়ত প্ৰকাশন)

Post a Comment

0 Comments