নবারুণ ভট্টাচার্য
(শিলিগুড়িতে পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত বক্তৃতামালায় প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষেপিত রূপ। গণসংস্কৃতি, প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, আগস্ট ২০০৯। সোর্স: ভাষাবন্ধন)
দিন কয়েক আগের ঘটনা। একটি ছেলেকে বাঁকুড়ায় গ্রেপ্তার করা হল। তার কাছে পাওয়া গেছিল কেমিক্যাল হাব হলে পরিবেশ কেমন ভাবে নষ্ট হতে পারে তার সম্বন্ধে একটা পুস্তিকা। ছেলেটি কিন্তু কোনো বামপন্থী দলের সদস্য ছিলনা, বরং আমরা যাদের দক্ষিণপন্থী বলি সেরকম একটা দলের সে সমর্থক ছিল। এর দিন দুয়েক পরে তাঁর স্ত্রীকে বলা হয় যে তাঁর স্বামী অসুস্থ। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর স্ত্রী বাঁকুড়া যান এবং সেখানে প্রথমে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বলা হয় তিনি নাকি ল্যান্ড মাইন বসাচ্ছিলেন। এই ঘটনা কোনো খবরের কাগজে বেরোয়নি। ছেলেটির দাদা কলকাতার একজন প্রকাশক, যার প্রকাশনা থেকে পরিবর্তনপন্থী এবং পরিবর্তন বিরোধীদের অনেকেরই বই বেরিয়েছে। আমি তাঁর কাছ থেকেই খবরটা পাই। এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে কেবল লালগড়ে যৌথ বাহিনীর দ্বারাই চলছে এটা এমন নয়। এর আওতায় এখন সারা ভারতবর্ষ। অনেকেই নিয়মিত টেলিভিশনের অনেকগুলো নিউজ চ্যানেল দেখেন এবং অনেকগুলো খবরের কাগজ পড়েন, তাঁরাও এ বিষয়ে পুরোটা অবহিত নয়। সব সময় দেখলে, পড়লে বা শুনলে যে ব্যাপারটা জানা যায় তা ঠিক নয়। বাস্তবতার কতটা আমরা জানছি, জানতে পারছি, বর্তমান পরিস্থিতিটা কি, সেটা কিভাবে দেখছি তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আজকের এই বর্তমানটা, এটার পেছনে একটা অতীত আছে, সামনে একটা ভবিষ্যত আছে। এই দুইয়ের একটা মিলিত মূল্য আছে। এটা যখন ঐতিহাসিক নিয়মে একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে যায়, তখন আমরা নন্দীগ্রাম দেখি, লালগড় দেখি। এটাই যে থাকবে এমন কোনো কথা নেই, এটা কিন্তু পিছিয়েও যেতে পারে, এগিয়ে পিছিয়ে, নানা টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে এই সময়টাকে ধরা এবং বোঝা দরকার।
এই সময়টাকে বুঝতে গিয়ে কবি জীবনানন্দের একটি অদ্ভূত রূপকের কথা মনে পড়ে যায় — ডিনামাইটের ওপর একটা পাখি বসে আছে। কিছু হচ্ছে না। ডিনামাইটও ফাটছে না, পাখিটাও মরছে না। ওই একটা রূপকের মধ্যে অসম্ভব পরিমাণ টেনশন ও বারুদ জমে আছে। যে কোনো সময়ে ডিনামাইটটা ফাটতে পারে। পাখিটার তখন কি হবে? পাখিটা তার আগেও উড়ে যেতে পারে। ওই একটা রূপক দিয়ে আমরা বোধ হয় বর্তমান সময়টাকে বোঝার একটা চেষ্টা করতে পারি।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে ‘ডেথ স্কোয়াড’, ‘ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স' ইত্যাদি কতগুলো অনুষঙ্গ চলে আসে। লাতিন আমেরিকা -এল সালভাদর, গুয়াতেমালা। একটা পরিবার বসে খাচ্ছিল, 'ডেথ স্কোয়াড' এল, যে অবস্থায় বসেছিল সেই অবস্থাতেই তাদের মাথাগুলো কেটে নিয়ে চলে গেল। আর্জেন্টিনা— হাজার হাজার ছেলে নিখোঁজ; হাজার হাজার মা বুয়েনাস এরিয়াস-এর রাস্তায় মিছিল করছে। এই ঘটনা যখন ঘটছে মারাদোনা তখন দুর্ধর্ষ খেলছেন। এই সময়ে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতে। চিলি— হাজারে হাজারে কবি, শিল্পী, গায়ক, শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে গেছে। অসংখ্য লোককে অজ্ঞান করে হেলিকপ্টার থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অনেক সংখ্যায় 'ভিখারি পাসয়ান’ করে দেওয়ায় রাষ্ট্রের একটা সুবিধা আছে। এতে রাষ্ট্রকে কোনো দায়িত্ব নিতে হয় না। এই একস্ট্রা লিগ্যাল উপকরণগুলো দিয়েই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তৈরি; যেগুলো আমরা আমাদের এখানেও দেখছি। এটা একটা কর্মসূচি। এটায় রাজ্য সরকারও আছে, কেন্দ্রীয় সরকারও আছে।
লালগড়ের কথায় আসি। ‘যৌথ অভিযানের’ আগে ছত্রধর মাহাতোদের ডাকে আমি লালগড়ে গেছি। প্রায় কুড়ি হাজার লোকের সুশৃঙ্খল সমাবেশ। প্রত্যেকে টাঙ্গি ও তীরের ফলাতে নেকড়া জড়িয়ে রেখেছে, পাছে কারও খোঁচা লেগে যায়। তাঁদের প্রশ্ন করি তোমাদের সম্বন্ধে তো অনেক গালগল্প চালু আছে; তোমরা কি সবসময় এগুলো নিয়ে ঘোরো? তারা বলল, যখন আমাদের মা, বউ, মেয়েদের ইজ্জতের সওয়াল আসে, তখনই আমরা এগুলো ব্যবহার করি। সভা শুরুর আগে মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছিল। লালগড়ের আন্দোলন একটা অত্যন্ত ‘ব্রড বেসড' আন্দোলন। এই আন্দোলনে নানা নরকম, নানা মতের, নানা বিশ্বাসের লোকেরা আছেন। এই আন্দোলনকে ভেঙে দেবার জন্যে যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেটাও একটা কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চিদাম্বরম যখন লোকসভায় এই যুদ্ধের স্বপক্ষে দীর্ঘ ভাষণ দিচ্ছেন তখন তিনি একবার বলছেন ‘মাওবাদী' পরেরবারই বলছেন 'নকশালপন্থী'।
এই ধুরন্ধর মানুষগুলো যে কোনো কথাই ভুলক্রমে উচ্চারণ করেন না তা আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। বিহারে প্রবীণ, বরেন্য নকশালপন্থী নেতাদের গ্রেপ্তারির হুমকি দেওয়া হচ্ছে, পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং এ রাজ্যের অধঃপতিত বাম সরকার ভালোভাবেই জানে যে, ভবিষ্যতে কোন শক্তি তাদের মোকাবিলা করবে। এটা শুধু যে সামরিক শক্তি দিয়েই করা হচ্ছে তা নয়। সারা দেশে অভিন্ন পরিচয় পত্রের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে এ দেশের সমস্ত মানুষের তথ্য— কত লম্বা, পরিচয় জ্ঞাপক চিহ্ন, কোথায় থাকে, কি করে, সমস্ত কিছু কম্পিউটার জাত করা হবে। মানুষের পরিচয় শুধু নামেই থাকবে না। তার সঙ্গে থাকবে একটা নম্বর। এইটা দিয়েই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে। ব্রাজিলে আমরা দেখেছি রাতে রাস্তায় ঘুমানো ‘পরিচয়বিহীন’ শিশুদের গুলি করে মারতে ভাড়াটে গুণ্ডা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ, সবার হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া হল। এই হত্যার পিছনে কি চিত্তাকর্ষক যুক্তি— বড়ো হয়ে তো ডাকাতই হবে, তাই ছোটো থাকতেই সাবাড় করে দাও। এ যুক্তি তো আমরা আগেও শুনেছি চার্চিলের কাছে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় বাহিনী পাঠিয়ে চার্চিল বললেন— 'ইট ইজ বেটার টু স্ম্যাশ বলশেভিক এগস্ রাদার দ্যান টু চেস্ বলশেভিক চিকেনস্।' আমরা সোকার্নোর কালে ইন্দোনেশিয়ায় দেখেছি। লাখে লাখে কমিউনিস্টদের হত্যা করা হচ্ছে। শবদেহ ফেলার আর কোনো জায়গা নেই, বলা হল হত্যা করে একটা কান কেটে আনো তার বদলেই পয়সা পাবে। কাটা কানগুলো ফেলাতে একটা নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনার পিছনে সরাসরি মদত ছিল আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার। এদেশে যখন নকশালবাড়ির আন্দোলন চলছে, পথে-ঘাটে, গ্রামে-শহরে খুন হচ্ছে হাজারে হাজারে যুবক; ঠিক একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভারত এবং আরও কয়েকটি পশ্চিমী শক্তির মদতে শ্রীলঙ্কায় হাজার হাজার ট্রটস্কিপন্থী যুব আন্দোলনের কর্মীদের হত্যা করা হয়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় যে তামিল গণহত্যা ঘটল তার সঙ্গে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। এই দেশ দুটি তাদের স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে পাওয়া তথ্য শ্রীলঙ্কা সরকারকে দিয়েছে। আমাদের দেশে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এসেছে তাতে যে আমেরিকা যুক্ত নয় এটা প্রমাণিত হলে আমি খুশি হব। শুধু হত্যা নয়, রাষ্ট্র জানে সবাইকে হত্যা করা যায় না তাই একটা ভয়ের আবহ তৈরি করাটা ভীষণ জরুরি। এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে প্রত্যেককে পরের কথাটা হিসাব করে বলতে হবে। এটাই রাষ্ট্রের সন্ত্রাস জারি করার নকশা এবং প্রকল্প।
এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা কি করতে পারি? আমরা একটা সার্বিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি, যাঁর লেখেন তাঁরা লিখে করবেন, যারা ছবি আঁকেন তাঁরা ছবি এঁকে করবেন, যাঁরা প্রায়োগিক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা গান, নাটক ইত্যাদি দিয়ে করবেন। মনে রাখা প্রয়োজন নানা দেশ এবং কালে ফ্যাসিবাদের নানা চেহারা, কারণ তাদের কোনো মতাদর্শ নেই। এটাই লভ্য আছে; কমিউনিস্টদের নির্মূল করা। তাদের হয়ে যে দালালরা বিভিন্ন দেশে কাজ করে তারাও বুঝতে পারে না যে তারা কি করছে! আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে বিশেষ ওয়াকিবহাল নন। হয়তো এ বিষয়ে তাঁদের যথেষ্ট লেখাপড়া নেই। অথবা তারা এক সস্তা আবেগে গা ভাসাচ্ছেন। আমাদের প্রতিরোধের ঐতিহ্য আছে, ঘরানা আছে, কে নেই আমাদের সঙ্গে? আমাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আছেন, প্রেমচাদ আছেন, কাজী নজরুল আছেন। আমরা তাঁদের তৈরি ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে আছি। আজ যখন মহাজনী সভ্যতা সবকিছু গ্রাস করেছে তখন আমি লেখক ও শিল্পী বন্ধুদের বলব যে, আমাদের সৃজন যেন রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। জনতার পদধ্বনি যেন আমাদের কানে থাকে।
_________
0 Comments