সচ্চী রামায়ণ ও পেরিয়ার রামাসামীর প্রাসঙ্গিকতা

সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন শাসকের মূল দৃষ্টিভঙ্গি, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান, যার হিন্দুদের মধ্যে  ব্রাহ্মণরাই শ্রেষ্ঠ, এমন একটি হায়রার্কিক্যাল ব্যবস্থার অবধারণা ও অনুশীলন রয়েছে। একদিকে ধূর্ত শাসক হিন্দু-ধর্মাবলম্বী অংশকে একত্রিত করার কথা বলে আবার অন্তরে হিন্দুদের ব্রাহ্মণ, উচ্চবর্ণীয় ও নিম্নবর্ণীয় বিভাজনকে শক্তিশালী ভাবে প্রয়োগ করার আকাঙ্ক্ষাকেও লালন করে। মনুস্মৃতির অনুশাসনকেই তারা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। দক্ষিণ ভারতের আয়াপ্পার মন্দিরে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পরও ঋতুমতী নারীদের ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা পূর্বোক্ত বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণ করছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই যেখানে জন্মের ভিত্তিতে কর্ম ও বর্ণ বিভাজনকে শ্রম বিভাজনের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চান এবং রামকে উগ্র-হিন্দুত্ববাদের আদর্শ পুরুষ হিসেবে তুলে ধরতে চান, তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই মনুবাদীরা আসলে শূদ্রাতিশূদ্র বলে চিহ্নিত সম্প্রদায়, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনার্য (যারা ইন্দো-ইরানিয়ান নন) জাতি-গোষ্ঠীগুলিকে দমন, দলন ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে একশ্রেণির ক্রীতদাসে পরিণত করতে চায়। ভীমা কোরেগাঁও মামলা, উত্তরপ্রদেশে একের পর এক দলিত নারীদের ধর্ষণ এবং সেই ঘটনায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পক্ষে থাকা প্রশাসনের ভূমিকাও স্পষ্টভাবে  উক্ত বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা করে।
    
ভারতবর্ষে এই হিন্দুত্ববাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল নায়ক  হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে রাম নামে পুরাণের চরিত্রকে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে নির্মিত হচ্ছে রাম মন্দির। এভাবে রামায়ণকে হিন্দুত্ববাদীরা স্থাপন করছে ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চেতনার কেন্দ্রে। মনে রাখতে হবে এ বিষয় নতুন নয়, তথাকথিত রামরাজ্যের ধারণা শুধু বিজেপি নয় ভারতরাষ্ট্র নির্মাণের পিছনেই এই ভাবনা পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়েই কাজ করেছে। 

এরকম এক পরিস্থিতিতেই তাই 'পেরিয়ার' ই ভি  রামাসামী রচিত সচ্চী রামায়ণ বা সত্য রামায়ণ বইটি আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দিতে পারে। 'পেরিয়ার' রামাসামী রামায়ণকে কোন ধার্মিক অথবা ধর্ম সম্প্রদায়ের মৌলিক গ্রন্থ বলে স্বীকার করেননি। রামায়ণ প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন ছিল, এই রচনায় দক্ষিণের  দ্রাবিড়-অনার্য জনজাতির প্রতি অবহেলা ও অপমানজনক কথাবার্তা লেখা হয়েছে। প্রাচীন দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংসের কিছু ইঙ্গিত রামায়ণে লিপিবদ্ধ আছে। রামায়ণকে তিনি সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক ও কল্পনাপ্রসূত বলে উল্লেখ করলেও এই গ্রন্থকে বিভিন্ন যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বহু বছরের নিরলস অধ্যয়নের পর তিনি 'রামায়ণ পাথিরংগল' বা 'রামায়ণের চরিত্ররা' নামে তামিল ভাষায় একটি  বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৪৪ এ এই রচনা  বই আকারে প্রকাশিত হয় তামিল ভাষায়। ১৯৫৬ তে  বইটির একটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৯ এ এই সংস্করণের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করা হয় 'The Ramayana - A true reading'  নামে। ১৯৬৮ তে  ইংরেজি সংস্করণের হিন্দি অনুবাদ 'সচ্চী রামায়ণ' নামে প্রকাশ করেন উত্তর-প্রদেশের জাতপাত বিরোধী দলিত-মূলনিবাসী আন্দোলনকারী ললই সিং যাদব(বৌদ্ধ)। বইটি অনুবাদ করেন রাম আধার। ১৯৬৯ এর ডিসেম্বর মাসে উত্তর-প্রদেশের  তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বইটির ইংরেজি ও হিন্দি সংস্করণের ওপর  নিষেধাজ্ঞা লাগু করে এবং বইটির সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে। উত্তর-প্রদেশ সরকারের যুক্তি ছিল এই বই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধার্মিক ভাবাবেগে  আঘাত করছে। উত্তর-প্রদেশ সরকারের নির্দেশের বিরুদ্ধে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হন প্রকাশক ললই সিং যাদব। অনেক লড়াইয়ের পর অবশেষে ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারি  সুপ্রিমকোর্টের আদেশে 'সচ্চী রামায়ণ' মুক্তি লাভ করে।' 

'পেরিয়ার' এরোড ভেঙ্কটাপ্পা রামাসামী নায়কর (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৯ - ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৩), বিংশ-শতাব্দীর যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কার আন্দোলনের একজন অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। ভারতবর্ষের সমাজ-রাজনৈতিক  আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি একজন বিচক্ষণ বাস্তববাদী তার্কিক ও মানবিক বিবেকে আস্থাশীল সংগ্রামী পথ-প্রদর্শক। একটি অব্রাহ্মণ্যবাদী নিরীশ্বরবাদী(Atheist) চিন্তাদর্শ থেকে 'পেরিয়ার' রামাসামী তাঁর ভূয়োদর্শী ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির বিনির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। দক্ষিণ-ভারতে হিন্দিভাষা আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন, তামিল ভাষার বিকাশ এবং দ্রাবিড়-জাতিসত্তার মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের চেতনার উন্মেষে তাঁর ভূমিকা ঐতিহাসিক। কংগ্রেসকে একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী দল হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি ১৯২৫ এ কাঞ্চিপুরম সম্মেলন মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ১৯২৭ সালে পুরোপুরি কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় তাঁর। ১৯২৫-২৬ এ তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা 'আত্মমর্যাদা আন্দোলন' এর  মাধ্যমে তিনি ব্রাহ্মণ্য-হিন্দুধর্মের অবহেলা অপমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে 'অনার্য' দ্রাবিড় জাতি ও অন্যান্য নিপীড়িত দলিত অংশের মানুষদের জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। আত্মমর্যাদা লীগের মুখপত্রের নাম ছিল 'কুদি-আরাসু' বা 'জনগণের রাজ' পত্রিকা। জাতপাত বিভাজন ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে 'আত্মমর্যাদা আন্দোলন' সমগ্র দক্ষিণ ভারতের মানুষের বিপুল সমর্থন লাভ করেছিল। তবে শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদ নয়, যে কোনো ধরণের ধর্মীয় অন্ধভক্তি কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা ও যুক্তিহীন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অসীম সাহসী আপোষহীন এক সংগ্রামী যোদ্ধা। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সাম্যতান্ত্রিক সমাজে আস্থাশীল এক চিন্তানায়ক। বিগত ১৭ সেপ্টেম্বর'২১, থিয়োসফিক্যাল সোসাইটি, কলেজস্ট্রীট, কলকাতায় 'পেরিয়ার' রামাসামীর ১৪৩ তম জন্মদিবস পালিত হয়েছে।

বই প্রকাশ / সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১


লেখকের সম্প্রতি “সত্য রামায়ণ ও অন্যান্য রচনা (ভাষান্তর ও রচনা)” বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments