ঠুড়্গা মামলার শুনানি : একটি রিপোর্ট


২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঠুড়্গা মামলার শুনানি : একটি রিপোর্ট

আগের দুটি শুনানিতে (১২ ও ২৬ আগস্ট, ২০২১) সরকার ও WBSEDCL এর উকিল (বাদীপক্ষ) সওয়াল করেছিলেন। আজ ছিল অযোধ্যাবাসী মামলাকারীদের উকিলের (বিবাদীপক্ষ) জবাবের পালা।

২০১৮ সালে হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে প্রজেক্টটির বিরুদ্ধে পাহাড়ের মানুষের আইনি অভিযোগটি ছিল মোদ্দায়—বনাধিকার আইন, ২০০৬ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, গ্রামসভা আয়োজন না করে, মিথ্যা বলে নামমাত্র মানুষকে সই করিয়ে নিয়ে প্রশাসন ও কোম্পানি প্রকল্পের ছাড়পত্রের কাগজ তৈরি করেছেন। আদালতে মামলা রুজু হওয়ার পরে পরেই হঠাৎই পাঁচশ’ গাছ কেটে কাজ শুরুর চেষ্টা হয়। শুনানি শুরু হয়। বিচারপতির সমুখে সমস্ত তথ্য-প্রমাণাদি পেশ করে প্রায় এক বছরের লড়াইয়ে জয় এনে দেন মামলাকারীদের পক্ষের উকিল মাননীয় অম্বর মজুমদার মশাই। ২০১৯এর ২ জুলাই মাননীয় বিচারপতি দেবাংশু বসাক স্পষ্ট রায় দেন, প্রকল্পের ছাড়পত্রের জন্য আইনানুগ পদ্ধতি মানা হয়নি, উপরন্তু ভুয়া কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে এবং নতুন করে আইনানুগ পথে ছাড়পত্র সংগ্রহের আগে পর্যন্ত উক্ত প্রকল্পের সমস্ত কাজ স্থগিত থাকবে। তিনি জেলা শাসককে এই প্রহসনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভর্ৎসনাও করেন, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ভারতের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত মন্ত্রক ভুয়ো কাগজে কীভাবে প্রথম দফার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তাই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
এই পর্যায়ে মামলাকারীদের সবচেয়ে কঠিন যে পরীক্ষাটি দিতে হয় তা হল লোকাস স্ট্যান্ডাই প্রতিষ্ঠা। যেকোন দেশের বিচারব্যবস্থার মতোই ভারতীয় বিচারব্যবস্থাতেও লোকাস স্ট্যান্ডাইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অভিযোগকারীকে/দের আদালতে প্রমাণ করতে হয়, যে আইন বা প্রকল্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেটির সঙ্গে তাঁর/তাঁদের যথেষ্ট সংযোগ এবং সেই সূত্রে আইন বা প্রকল্পটি লাগু হলে সরাসরি ক্ষতি হতে পারে। এক্ষেত্রে ঠুড়্গা প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলাকারীদের ভোটার পরিচিতিই যথেষ্ট ছিলনা, প্রকল্প এলাকায় জমির পাট্টাও দেখাতে হয়েছিল এবং সেই জমিতে চাষবাসের প্রমাণও দিতে হয়েছিল বিচারপতিকে। তবেই বিচারপতি মামলা গ্রহণ করেছিলেন।

সিঙ্গেল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় রাজ্যসরকার ও কোম্পানি। লকডাউনের জন্য দীর্ঘদিন শুনানি বন্ধ ছিল। জুন, ২০২১ থেকে শুনানি শুরু হয়। এই পর্যায়ে বাদীপক্ষ অর্থাৎ সরকার-কোম্পানির উকিল সওয়াল করেন
১/ মামলাকারীদের লোকাস স্ট্যান্ডাই অনুযায়ী তারা এই মামলা করতেই পারেন না।
২/ যেহেতু এখনও মামলাকারীদের কোন ক্ষতি হয়নি তাই এই পিটিশন করার যোগ্যতা তাদের নেই।
৩/ এই প্রজেক্টের ক্ষেত্রে নাকি বনাধিকার আইন (২০০৬) প্রযোজ্য নয়।

আজ মাননীয় বিচারপতিরা প্রায় আধঘন্টা মামলাটি শোনেন বলে জানা গেছে। বিবাদীপক্ষের উকিল ব্যখ্যা করেন কেন এক্ষেত্রে পিটিশনাররা ন্যাশানাল গ্রিন ট্রাইবুনালের দ্বারস্থ না হয়ে উচ্চ আদালতে অভিযোগ করেছেন। এরপর লোকাস স্ট্যান্ডাইয়ের প্রশ্নে বনাধিকার আইনে বর্ণিত কমিউনিটি রাইট বা সামুদায়িক অধিকারের ধারণাটি তিনি মাননীয় বিচারপতিদের সামনে তুলে ধরেন। শুধু কাষ্ঠল গাছের উপর অধিকার নয়, গুঁড়িবিহীন অরণ্যসম্পদের উপর বনবাসী মানুষের অধিকারের কথাটি কোর্ট রুমে উঠে আসে। উঠে আসে অরণ্যের বিভিন্ন সম্পদের উপর পুষ্টি থেকে জীবিকা—বনগ্রামবাসীদের বহুমাত্রিক নির্ভরশীলতার কথা। উকিল মহাশয় সওয়াল করেন ২০১৮ সালে ৫০০ টি গাছ কেটে ফেলার ঘটনা অরণ্যবাসীরা তাঁদের সামুদায়িক অধিকারে অনধিকার হস্তক্ষেপ মনে করেছেন এবং আইন তাঁদের এই প্রশ্নে মামলা দায়ের করার অধিকার দেয়। তিনি আরো জানান মামলাকারীদের মধ্যে বয়জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি লোকাস স্ট্যান্ডাই প্রমাণ করে বাকিদের পরিচয় স্বীকার করে নিলেই আইনমতে বাকিদের লোকাস স্ট্যান্ডাই সিদ্ধ হয়ে যায়। এখানে আইন আদিবাসী গ্রামসমাজের সাধারণ সামাজিকতার যুক্তিকে ধারণ করেছেন বলা যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন বিবাদীপক্ষীয় উকিল মহাশয়। আজ পর্যন্ত ভারতে কোনো মামলা কি বনাধিকার আইন (২০০৬)এ ভর করে জয়ী হয়েছে? তিনি ওড়িশার ডোংরিয়া কোন্ধদের প্রাচীন বাসস্থান নিয়মগিরিতে খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলায় ভারতের উচ্চতম আদালতের পর্যবেক্ষণটি পেস করেন। উক্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বনগ্রামবাসীদের ব্যক্তিগত, সামুদায়িক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় বনাধিকার আইন (২০০৬) ও তফসিলভুক্ত এলাকায় বিশেষ পঞ্চায়েত আইন মোতাবেক গ্রামসভাকে গণতান্ত্রিক নীতি-নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ প্রাঙ্গন হিসাবে অনুমোদন দিয়েছিলেন সেই ২০১৩ সালে।       
সরকার-কোম্পানি পক্ষ সংশয়জ্ঞাপন করেছিল মামলাকারীরা যেহেতু নিজেদের কৃষক হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন, তাঁরা সামুদায়িক অধিকারের আওতাভুক্ত হন কী করে! বিবাদীপক্ষের উকিল মহাশয় আইন উদ্ধৃতি করে সওয়াল করেন, বনাধিকার আইন বনগ্রামবাসীদের নিজস্বার্থে কৃষিকাজ করার অধিকার প্রদান করেছেন। এখানেই আজকের মতো শুনানি শেষ হয়। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

প্রসঙ্গত, চলমান মাসজুড়ে সারা পৃথিবীতে জলবায়ু সংকট রোধে সচেতনতা প্রসার এবং মানবপ্রজাতি ও ক্রমক্ষীয়মান বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় কর্পোরেট লবি নিয়ন্ত্রিত রাষ্টশক্তিগুলিকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার আন্দোলন চলছে। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বের বহু শহর মফস্বলে পালিত হবে আবিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘট (Global Climate Strike)। আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর, ২০২১ ইউরোপের গ্লাসগো শহরে বসতে চলেছে জলবায়ু সম্মেলন। উপস্থিত থাকবেন তাবড় রাষ্ট্রনেতারা। তাঁদের চ্যালেঞ্জ জানাতেই এই বিপুল আন্দোলনের প্রস্তুতি। জলবায়ু সংকট রোধে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষেরা পথে নামছেন যে সময়-পরিসরে, তখন পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের চিরকাল বঞ্চিত লাঞ্ছিত অবহেলিত অবমানিত আদিবাসী অ-আদিবাসী মানুষ ঠুড়্গা প্রকল্পের বিরোধিতায় গ্রামে গ্রামে সংগঠিত করছেন জনচেতনা বৈঠক। আযোধ্যার প্রাচীন অরণ্যানী ও সামূহিক প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে মানুষ এসে ভিড়ছেন স্ব স্ব ক্ষেত্রের অবহেলিত সমস্যাগুলি নিয়েও। কোর্টের রায় ‘প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’এর নেতৃত্বে চলমান অযোদিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলনে বিশেষ মাত্রা যোগ করবে হয়ত; তবে রায় যাই হোক এই আন্দোলন অযোধ্যা পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে আজকের পুঁজিবাদবিরোধী প্রাণ-প্রকৃতি আন্দোলনের আন্তর্জাতিক ধারাকে পুষ্ট করে চলবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই। সন্দেহ নাই, আগামীদিনের মুনাফাচালিত ‘উন্নয়নী’ প্রকল্প চাপিয়ে দিতে অতি উৎসুক রাষ্ট্র-কোম্পানি যৌথের আগ্রাসনের মুখে হাতে হাত ধরে দাঁড়ানো প্রাণ-প্রকৃতিনিবিড় মানুষের সারিকে অযোধ্যা পাহাড়ের আন্দোলন সাহস যোগাবেই...

#অযোধ্যাবাঁচাও
#অযোদিয়াবুরুবাঁচাও
#SaveAjodhyaHills




Post a Comment

0 Comments