ছত্তিশগড়। পাহাড় পাথর আর লালচে মাটি। এখানকার মাটিতে মিশে আছে কাঁকর পাথর আকরিক ও ভোলা ভালা মানুষের ভালোবাসা। পাথর নিংড়ানো বিন্দু বিন্দু অকপট সঞ্চিত ভালোবাসা ঝর্নার ধারা হয়ে প্রবাহিত হয়। কিশোরি নদীর পায়ের ঘুঙুর হয়ে দিন রাত বাজনা বাজিয়ে হেঁটে বেড়ায় আপন ছন্দে। এখানে পাতার কুটির পাহারা দেয় রোদ বৃষ্টি আর উদার উদাস হাওয়ার হৃদয় ও মধ্যাহ্নের সোনালী রোদ। উঠোন জুড়ে ছায়ার গামছা মাথায় হা ডু ডু খেলে বেড়ায় উলঙ্গ ধুলো মাখা শিশুরা। নুড়ি পাথরের বিছানা আর মাটির কামরা থেকে একদিন আড়ামোড়া ভেঙে জেগে উঠেছিল এক অজানা অচেনা অঙ্কুর। শংকর গুহ নিয়োগী। অঙ্কুর থেকে পাতা লতা ডাল পালার কচি হাত পা আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই শিশু উদ্ভিদ। সেই চারা একদিন শৈশব কৈশোর পেরিয়ে রোদের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নীল নীল সাগরের মতো উদার আকাশে সাঁতার দিয়েছিল। নেংটি পরা নিঃস্ব আদিবাসী দলিত মানুষ অসহায় পোকামাকড় গৃহহীন পাখিদের আশ্রয় দিয়েছিল। সেই বৃক্ষের ডাল পালা আর পাতার সংসার, কোটর, বসত বাড়ি ,পাখ পাখালির কিচিরমিচির গানে উপছে পড়েছিল। কুঁড়ি থেকে ফুল। ফল ভারে, শ্রদ্ধায় দেশের কাছে মানুষের পায়ে অবনত হয়েছিল তার অসংখ্য শাখা প্রশাখা। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ফল ফুল শোভিত বৃক্ষের ম ম করা সুগন্ধ সংগ্রাম ত্যাগের ইতিহাস। অজস্র বাহারি প্রজাপতির ডানা আর গুনমুগ্ধ মৌমাছির গুঞ্জনে ভরে গেছিল ছত্তিগড়ের লাল লাল ধুলো আর মোরাম বিছানো উঠোন উপত্যকা। কিন্তু জল্লাদ দের সহ্য হল না সুগন্ধ আর রোদ ঝলমলে আদিবাসী শিশুর নাচ আর পাহাড়ি নদীর গান। অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে সাপ বিচ্ছুরা ভিড় জমিয়েছিল। কেটে ফেলেছিল, বুকের মাটিতে স্বপ্নের বীজ পুঁতে দেওয়া সেই অবাক বৃক্ষ টিকে। গোপন করাতের দাঁতে পরিকল্পিত ভাবে কেটে কুটে হত্যা করেছিল একটা স্বপ্ন। নিরাশ্রয়ের একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। সেই সুগন্ধি বৃক্ষের নাম ছিল নিয়োগী। সেই স্বপ্ন আর ভালোবাসার নাম ছিল শংকর গুহ নিয়োগী।
শ্রমিক নেতা গুহ নিয়োগী শহীদ হয়েছিলেন ১৯৯১সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। অনেক দড়ি টানাটানি এবং জলঘোলা হয়ে যাওয়ার পর শেষমেশ সি বি আই এর হাতে হত্যার তদন্ত ভার দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন সিবিআই এর কলকাতা দপ্তর থেকে এই লেখক কে ছত্তিশগড়ের দূর্গ জেলা আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া বা বিচার প্রক্রিয়াতে সহযোগিতা করার জন্য ডাকা হয়েছিল। পর পর কয়েক বছর সেজন্য নির্দিষ্ট তারিখে জেলা আদালতে হাজির থাকা জরুরী হয়ে পড়েছিল।
এই কয়েক বছরে সুধা ভরদ্বাজ কে অনেক কাছে থেকে দেখা ও জানার সুযোগ হয়েছিল। সুধা ভরদ্বাজের কথা বলার একমাত্র কারণ আজ তিনি জেলের মধ্যে। ভীমা কোরেগাও মিথ্যা মামলাতে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীদের সাথে তাকেও UAPA আইনে ২০১৮ সালের ২৬ আগষ্ট গ্রেফতার করা হয়েছিল। আজও তিনি বিনা বিচারে আটকে আছেন। কে এই সুধা ভরদ্বাজ? আসুন একবার সংক্ষেপে সুধাজির কর্মধারা ও তাঁর সাথে একবার পরিচয় করে নেওয়া যাক। সুধাজি JNU থেকে অর্থনীতিতে মাষ্টার ডিগ্রী এবং IIT কানপুর থেকে অঙ্কে মাষ্টার ডিগ্রী হোল্ডার ছিলেন। তিনি দিল্লী ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও করতেন। তাঁর মা কৃষ্না ভরদ্বাজ ও ছিলেন একজন জনপ্রিয় প্রোফেসর। সুধা জি ছত্তিশগড়ের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংবিধান ও প্রচলিত আইনের আওতায় আদালতে দাঁড়িয়ে লড়াই করতেন। সম্ভবতঃ সুধা ভরদ্বাজের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে। আমি জানতাম নিয়োগী কবিতা প্রেমিক ছিলেন। তিনি নিজেও অনেক কবিতা লিখেছিলেন। শহীদ সাথীর কবিতা গুলো বাংলাতে অনুবাদ ও একত্রিত করে একটা সংকলন প্রকাশ করার মনস্কামনা ছিল। এটা ছিল শহীদ সাথী গুহ নিয়োগীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। সুধা জি আমাকে রায়পুর শহরে রাজেন্দ্র সায়লের বাড়িতে থাকা নিয়োগীর একটা ডায়েরির খবর দিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র সায়লজি আমার ও পরিচিত ছিলেন। তিনি বহুদিন মধ্যপ্রদেশ রাজ্য PUCL (people's union for civil liberties) এর সম্পাদক ছিলেন। সম্ভবতঃ বছর দুই হলো তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আমি সেদিন সায়ল জির বাড়িতে গিয়ে তার বাড়ি থেকে ঐ ডায়েরিটা নিয়ে এসেছিলাম। ডায়েরির কবিতা ও বেশি ভাগ ভাবনা ও আবেগ গুলো সব নিয়োগী জেলের মধ্যে বসে লিখেছিলেন। রায়পুর থেকে ভিলাই। মনের আকাশে ঝড় উঠেছিল। গাড়িতে বসে বসে নিয়োগীর লিখে রাখা অনুভব পড়েছিলাম। শংকর গুহ নিয়োগী কে হত্যা করার জন্য সুপারি কিলার নিয়োগ, মোটা টাকার লেনদেন, আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহকারী দের নাম ধাম বিচার বিভাগীয় দূষণ সংক্রমণ অনেক বিবরণ নিয়োগী ঐ ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। একটার পর একটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চলেছিলাম। কিছু কিছু জায়গায় গুরুত্ব বোঝাতে নীচে কলম দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছিলেন। কবিতা কয়েক টা কপি করে ঐ ডায়েরি টা ১৯৯১ সালে তৎকালীন তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এমজি আগ্রওয়ালের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। পর পর কয়েক বছর ধরে দূর্গের জেলা আদালতে সাক্ষ্য ও বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন আমাকে যেতে হয়েছিল। আদালতে সাক্ষ্য ও সম্ভাব্য জিঞ্জাস্য আইন কানুন প্রভৃতি সম্পর্কে সুধা ভরদ্বাজ সবাই কে পরামর্শ দিতেন।
একবার তিনি শহীদ নিয়োগীর হাতে লেখা কিছু ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার বিষয় আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন।যার মধ্যে হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা কিছু কবিতা ও ছিল।পড়ার পরে বললেন, আনসার জি আমি জানি আপনি নিয়োগীজির পুরানো এবং ঘনিষ্ট কমরেড দের মধ্যে অন্যতম একজন। আগামীকাল সকালে জেলা আদালতে বিরোধী পক্ষের অনেক আইনজীবীগন থাকবেন। তাঁরা আপনার পরিচয়,নাড়ি নক্ষত্র ছানবিন সহ অপ্রাসঙ্গিক নাস্তানাবুদ করা প্রশ্ন করতে পারেন। এই কাগজের লেখা গুলোর মধ্যে কোনটি নিয়োগী জির হাতে লেখা নয় সেটা খুঁজে বার করুন। আপনি দশ মিনিট সময় পাবেন। এটা যেন ব্যাঙ্ক কর্মচারী নিয়োগের মতো আমাকে পাজল প্রশ্ন দিয়ে সলভ করতে বলা হলো। সম্ভবতঃ সূর্য কবিতা টির নীচে একটা তারিখ লেখা ছিল। খালি চোখে দেখে মনে হতে পারে এ তারিখটাও নিয়োগী লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম ঐ তারিখ নিয়োগীর হাতে লেখা ছিল না। সুধাজি খুব খুশি হয়ে গেছিলেন। ওটা ভুল বশতঃ সুধা জি নিজে বসিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো ভাবেননি যে ঐ ডায়েরিটা ও আদালতে উঠবে। সেদিন আদালতে ভরা কক্ষে আমাকে কিছু সওয়াল করার পর ঐ ডায়েরি থেকে কিছু হিন্দি ও ইংরেজি লেখা পড়তে বলা হয়েছিল। অনেক অপ্রাসঙ্গিক নাস্তানাবুদ করা প্রশ্ন করার পর জিঞ্জাস্য ছিল সূর্য কবিতা টি কবে লেখা হয়েছিল। বিরোধী পক্ষের আইনজীবী কবিতার নীচে লেখা তারিখের নীচে তর্জনী দিয়ে সবার অলক্ষ্যে সমানে ইংগিতে দেখাচ্ছিলেন আমি যাতে নীচে লেখা তারিখটা আদালতে বলে দেই। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সুধা ভরদ্বাজ একজন ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্ন আইনজীবী ছিলেন এই ঘটনা আমার বিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিবার যখন আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেছিলাম কাঠগড়ায় অভিযুক্ত খুনিকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম।
ছত্তিশগড় থেকে শুধু সুধাজি নয় সারা দেশ থেকে ভীমা কোরেগাও কেসে অধ্যাপিকা সোমা সেন, কবি রোনা উইলসন, সুধীর ধাওয়ালে, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, অরুণ ফেরেরা, হ্যানিবাবু, জ্যোতি জগতাপ, রমেশ গাইছার, গঞ্জালেস, সাগর গোর্খী, কবি ভারভারা রাও (জামিন প্রাপ্ত), সহ অনেকেই আজ ও অকারনেই রাষ্ট্রের রোষে বিনা বিচারে জেলের মধ্যে আছেন। এরা সকলেই কেউ কবি কেউ সাহিত্যিক, বিঞ্জানী মানবাধিকার কর্মী সমাজকর্মী আইনজীবী শিক্ষক অধ্যাপক। এঁরা সকলেই আমাদের দেশের সম্পদ। স্ট্যানস্বামী কে তো জেলে বন্দি করে খুন করলো আমাদের দেশের সরকার ও বিচার ব্যবস্থা। এই অশীতিপর বৃদ্ধ নিজে তরল ছাড়া কোনো কঠিন খাবার চিবিয়ে খাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। চুষে খাওয়ার স্ট্র দুটো কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সন্দেহ ছিল হয়তো ওর মধ্যে গুলি ভর্তি ম্যাগজিন ছিল। যে মানুষটি নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারতেন না সেও ছিল বিপজ্জনক এই রাষ্ট্রের কাছে। তিনিও ছিলেন মাওবাদী। তাই ফেক এনকাউন্টারের মিথ্যে দিয়ে তাঁকে হত্যা করা একটু অসুবিধা হচ্ছিলো। তাই তো জেলের মধ্যে তাঁকে খুন করা হয়েছিল।
সুধা ভরদ্বাজকে যতটুকু জানি, তিনি সব সময় সংবিধান অনুযায়ী প্রচলিত আইন মেনে আইনের আওতায় গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লড়তেন। রাষ্ট্রের চোখে তিনি মাওবাদী। কিন্তু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বা গরীবদের জন্য অক্সিজেন স্বরুপ ছিলেন। বিনা ফিসে তিনিএই সব মানুষের জন্য হাইকোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করতেন। বাধ্য করতেন রাষ্ট্র কে ক্ষমা প্রার্থনা বা অসহায় মানুষ কে ক্ষতিপূরণ দিতে। তিনি মজুরের ঘরে পান্তা খেতেন। ছত্তিশগড়কে বলা হয় ধন কে কটোরা। অর্থাৎ সম্পদের ভান্ডার। কিন্তু এখানকার ভোলা ভালা আদিবাসী মানুষ গুলো জন্ম থেকেই হতদরিদ্র নেংটি পরা নিঃস্ব কৌপিনসার। এই সব অন্নহীন, শিক্ষাহীন মানুষের জন্য নূন্যতম চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ও দায় নেই আমাদের মহান রাষ্ট্রের। বরং PESSA আইন কে জঙ্গল কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জল জঙ্গল জমিনের সাংবিধানিক ও আইনগত প্রাপ্য অধিকার থেকে আদিবাসী দের বঞ্চিত করা হচ্ছে শুধু কর্পোরেট দের স্বার্থে। আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে আদিবাসীদের নিয়মিত বিতাড়িত করে চলেছে আমাদের রাষ্ট্র। সুধাজির মতো দেশের বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিবর্গ যদি এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কর্পোরেট দের লুন্ঠনের বিরুদ্ধে আদালতে আইনের আওতায় প্রশ্ন তোলেন তিনি মাওবাদী। তাদের জন্য বরাদ্দ UAPA ধারা এবং অবশ্যই জেলের মধ্যে বিনা বিচারে বছরের পর বছর পচিয়ে পচিয়ে মারা।
এই প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বন জঙ্গল পাহাড় অধ্যুষিত ছত্তিশগড় ও ঝাড়খন্ড বনাঞ্চল এলাকার কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। ২০২১সালের মে মাসের ১৭ তারিখ ছত্তিশগড়ের বিজাপুর সংলগ্ন সিলগের গ্রাম। এখানে তিন জন আদিবাসী মানুষ কে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছিলো সি আর পি এফ। অপরাধ? আদিবাসী জনতা তাদের এলাকায় এবং রায়ত সম্পত্তিতে আধা সেনা শিবির নির্মানের বিরোধিতা করেছিল। আদিবাসী জনতা দাবি জানিয়েছিল, পানীয় জল চাই,অঙ্গন ওয়ারি কেন্দ্র, পাঠশালা, রেশন ডিলার, চিকিৎসা কেন্দ্র চাই বিদ্যুৎ চাই। হত্যার পরেই বলা হয়েছিল নিহতরা সকলেই মাওবাদী। ভিড়ের মধ্যে পদপিষ্ট হয়ে এই ঘটনার কয়েক দিন পর আরো একজন আহত অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। হাস্যকর ভাবে প্রশাসন তিন মৃতের জন্য মোট ত্রিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ও ঘোষণা করেছিল। মাওবাদীদের জন্য ক্ষতিপূরণের মলম ঘোষণা সত্যিই এক অবাক করা বিষয়। সিলগের থেকে ফিরে এসে একদল সাংবাদিক লিখেছিলেন, It was not a fake encounter or a gun fire at night.Bullets flew under thick Sun. Till now the police has not been able to inform us about the charges that existed against the protesters given that they were Naxals. ছত্তিশগড় ,বিজাপুর নীরাম গ্রামের ২৪ বছরের আদিবাসী দলিত তরুণী পাইকো ভিক্কার ধর্ষণ ও হত্যার রহস্য জানেন? ২০২১ সালের ভ্যাপসা গরমের মে-মাসে ৩০ তারিখে রাত্রিবেলা সে নিজের মা সুক্কী সহ আরো অন্যান্য দুজনের সাথে বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে ডি আর জির লোকেরা তাদের বাড়িতে হানা দেয় (district reserve guard)। পরিবারের সদস্যদের সাথে তার মায়ের বাধা দান সত্তেও পাইকো নামে ঐ আদিবাসী দলিত নিরপরাধ হাসিখুশি তরুণী কে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে কাছের দন্তেয়াড়া জেলে খোঁজ করার পর নেলাস্নর থানা থেকে বলা হয়েছিল যে DRG এর লোকেদের সাথে জঙ্গল সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাওবাদী তরুণী পাইকো ভিক্কার মৃত্যু হয়েছিল। শরীরে অজস্র আঘাত যৌন নির্যাতন ও ধর্ষনের প্রামাণ্য সাক্ষ্য নিয়ে আদিবাসী মেয়েটি লাশকাটা ঘরে পড়েছিল। আরো দু-একটি ঘটনা। রায়পুর থেকে প্রায় ৫০কিমি দূরে সোনেসিলা গ্রাম (নয়া পাড়া রাজিম)। এখানকার প্রায় চল্লিশটি আদিবাসী দলিত পরিবার কে জমি থেকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এসব জঙ্গল সংলগ্ন জমিতে তারা গত ৫০ বছর ধরে বসবাস করছেন। আগষ্ট মাসে ৪ তারিখ অভনপুরের SDM নির্ভয় সাহু তাদের জমি জায়গা ফেরতের দাবি বিবেচনা করার অভয় দিলেও সব নিস্ফলা। নেই ক্ষতিপূরণ। নির্যাতিতরা বাল বাচ্চা হাঁড়ি বিছানা নিয়ে গৃহহারা মানুষ গুলো রায়পুর বুড়া তালাবের কাছে ধর্নায় বসে আছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তির দানে আপাতত চলছে। সুধা ভরদ্বাজ যদি এসব মানুষের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। আদালতে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের এসব কার্যকলাপে আদালতের হস্তক্ষেপ দাবি করেন তাহলেই রাষ্ট্র তাকে মাওবাদী বলে জেলে পুরবে। সিলগের থেকে প্রায় ২০কিমি দূরে আছে বাসাগুড়া গ্রাম। গ্রামের মধ্যে দিয়ে এক কিশোরী নদী দুপায়ের নুপুর বাজিয়ে হেঁটে চলেছে। খুবই মন্থর আর ধীর তার চলার ছন্দ। নদীর নাম তালপেরু। নদীর দুধারে মহুয়া ইমলী তেন্দু হাজার বনজ সম্পদ ভুখ মেটানোর জন্য অজস্র কন্দ মূল আর লতাগুল্ম ভরপুর। নদীরও মাঝে মাঝে মনে হতো একদিন ডানা মেলে নীল নীল আকাশে উড়ে যাবে। কিন্তু এই শাল সেগুন মহুয়ার জঙ্গল তাঁকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। মাটির নীচে গোপন সুড়ঙ্গ কেটে এই জঙ্গল শেকড় বাকড় নদীকে নিজের ঘরের দিকে টেনে রেখেছে। আদিবাসী মানুষের মতো তালপেরু নদী ও যেন জঙ্গলের হৃদয়ে মিশে গেছে। নদী আর উড়ে যেতে পারে না। এখানে সপ্তাহিক হাট বসে। ১২০০ গোন্ড, মুরিয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস। একটা সাদা কাপড়ে রং দিয়ে লিখে রাখা হয়েছিল - "সিলগের সিআরপিএফ ক্যাম্প তুন ওয়াপস ওয়না মৈদে ধরনা প্রর্দশন" (সি আর পিএফ ক্যাম্প হটানোর জন্য আমাদের ধরনা প্রর্দশন)। জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গেলে অথবা ফল মূল বা শিকার করতে গেলে সিআরপিএফ গুলি চালায়। আদিবাসী মহিলা কিশোরী রাস্তায় পা দিলে জঙ্গলে কাজে গেলে নির্যাতিতা হতে হয়। ওরা আদিবাসী ভাষা সংস্কৃতি আচার খাদ্যভ্যাস ধর্ম ইত্যাদি বোঝে না। আপনি কি ঝাড়খন্ডের পিরীগ্রামে আদিবাসী তরুন ব্রহ্মদেব সিংহ হত্যার ঘটনা জানেন? লাতেহার জেলার গারু থানার কুকু পীরি জঙ্গলে শিকার করতে গিয়েছিলেন ব্রহ্মদেব সিংহ ও তার বন্ধুরা। সাথে ছিল পাখি মারা বন্দুক ও তির ধনুক। দু হাজার একুশে ১২ জুনের ঘটনা। তখন ছিল আদিবাসী দের নেম সরহুল শিকার পর্ব। আত্মসমর্পণের জন্য হাত তুলে স্যারেন্ডার করলেও সিআরপিএফ গুলি চালিয়ে দেয়।ব্রহ্মদেব সিংহ পড়ে যায়। দীননাথ সিং-এর হাতে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ জখম ব্রহ্মদেব হয়তো হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যেতো। কিন্তু তাকে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকিয়ে আবার গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক মাওবাদী নিহত। ওরা সিআরপিএফ এর দিকে কোনো পাথর ও মারেনি।ব্রহ্মদেবের স্ত্রী হীরামনী তার দুই বছরের শিশু ও তার বন্ধুরা ৩১ আগষ্ট থেকে জেলা শাসকের অফিসের সামনে ধর্নায় বসেছে। সুধা ভরদ্বাজ যদি এসব ঘটনা নিয়ে আদালতে মামলা করেন, যদি আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন তোলেন, ক্ষতিপূরণ আদায় করে রাষ্ট্র কে লজ্জায় ফেলে দেন তবে তিনি মাওবাদী এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সুতরাং এহেন সুধা ভরদ্বাজ দের জন্য UAPA, বিনা বিচারে বিনা জামানতে বছরের পর বছর ধরে জেলে পচিয়ে মারার পরিকল্পনা করবে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা। সেই প্রতিশোধ স্পৃহা হলো রাষ্ট্রের নিজস্ব। সেই হাতিয়ার হলো রাষ্ট্রের UAPA আইন। বিপন্ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বিপন্ন আজ গনতান্ত্রিক অধিকার সাংবিধানিক অধিকার। একটা নিরেট কালো পাথরের মতো ভয়ের দানব কি নদী নৌকা রোদবৃষ্টি পাখির পালক আর শিশুর খিলখিলিয়ে ওঠা হাসি মান অভিমান সব চেটে পুটে খেয়ে নেবে? মানুষ মানবতা মানবাধিকারের জন্য পা রাখার জায়গা কোথাও থাকবে না? এককালে আমেরিকাতে লক্ষনীয় ভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতি প্রতক্ষ করা যেতো। কিন্তু বর্তমানে রেড ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতি খুঁজতে গেলে দূরবীন নিয়ে যাদুঘর কতৃপক্ষের সাহায্য চাইতে হবে। ভারতের আদিবাসী ভূমি পুত্ররা যে হারে উচ্ছেদ আর শরনার্থী হয়ে যাযাবরের মতো জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, আগামী প্রজন্মে কয়েক দশকের মধ্যে তাদের অবস্থা হয়তো রেড ইন্ডিয়ানদের মতো বিলুপ্তির পথে যাবে।
2 Comments
এই নরপিশাচ শাসকের অপসারণ চাই, এরা মানবতার শত্রু। এরা এক ধ্বংসের খেলায় মেতেছে, বাস্তবত এরা দেশের ও জনগনের শত্রু, এই ব্যাবস্থার পরিবর্তন না হলে আমাদের মুক্তি নেই
ReplyDeleteখুব ভালো লেখা,
ReplyDelete