আক্কিরাজু হরগোপাল ওরফে আর কে-র মৃত্যুতে স্ত্রী কান্দুলা শিরিশা'র স্মৃতিচারণ

আক্কিরাজু হরগোপাল ওরফে আর কে 

আমি জানতাম যে আরকে-র স্বাস্থ্য ভালো নয়, কিন্তু এত গুরুতর ব্যাপার হবে তা ভাবিনি। কঠিন সময়ে তার সাথে না থাকার বেদনা আমাকে কষ্ট দেয়। আমি আর কে-র থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর কাছে বিপ্লবী আন্দোলনের স্বার্থ ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। উনি চেয়েছিলেন আমার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক বিকাশ হোক, কিন্তু দায়িত্বের কারণে আমাকে সময় দিতে পারে্ননি। প্রথম দিকে আমি রামকৃষ্ণকে একটু বিরক্ত করতাম - "তোমার স্মৃতির জন্য আমাকে একটা শাড়ি কিনে দাও।" কিন্তু তিনি বলতেন, "কমরেড, তোমার যা খুশি তাই কিনে নাও।" সেই সময় আমাদের ছোটখাটো ঝগড়া হতো। আমি বলতাম - "আপনাকে বাবুর জন্মদিনে থাকতে হবে।" তিনি বলতেন - "আমাকে যেতে হবে।" আমি বলতাম - "আমাকে একটু সময় দিন।" তিনি সবসময় লিখতে এবং পড়তে বসে যেতেন এবং তারপর বলতেন - ওহ দুঃখিত কমরেড, একটি কাজে আটকে গিয়ে ভুলে গেছি। 

তার শৃঙ্খলা এবং প্রতিশ্রুতি আমাকে সবসময় বিস্মিত করেছে। আমার ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে আমি তাকে শাল, সোয়েটার, শার্ট পাঠাতাম, যা তিনি যাদের প্রয়োজন  তাদের দিয়ে দিতেন। জানতে পেরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম - "আমার ভাগ্য কমরেড।" তিনি হেসে বললেন- "তোমার স্মৃতি আমার হৃদয়ে আছে, এইসব জিনিসের মধ্যে নয়, কমরেড।" এরকম অনেক পরিস্থিতিতে  আমি ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছি, কিন্তু তিনি আমার সাথে এমনভাবে আচরণ করেছিলেন যা আমাকে বিপ্লবী দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিত। এসবই আমার কাছে সুরক্ষিত মধুর স্মৃতি। অনেক লোকে মনে করেন বিপ্লবী মানুষরা জটিল হয়, কিন্তু বাস্তবে তাদের মত নরম ও স্নেহশীল প্রকৃতির মানুষ সাধারণ সমাজে খুব কমই দেখা যায়। আর কের ব্যক্তিত্ব এর প্রমাণ, তার একটি বড় হৃদয় ছিল, যা আমার সমালোচনাও মেনে নিতে পারত।

People attending the funeral of Maoist leader Akkiraju Haragopal
আন্দোলনে আমার জীবন

আলকুরাপাডু প্রকাশম জেলার একটি গ্রাম। আমাদের বাবা-মা ছিলেন ভুমিহীন কৃষি শ্রমিক। আমরা পাঁচ বোন। আমি তাদের সবার ছোট ছিলাম। স্কুলের পিছনের বেঞ্চে বসতে বাধ্য করা এবং কৃষকরা গ্রামে এলে আমার বাবা-মার দাঁড়িয়ে ওঠা, এই সব আমাকে খুব বিরক্ত করেছিল। সে সময় আমার জামাইবাবু কল্যাণ রাওয়ের মাধ্যমে বাড়িতে সাহিত্য পত্রিকা 'সৃজন' ও 'ক্রান্তি' আসত, সেগুলো পড়তাম। আমি বলতে পারি ওই পত্রিকাগুলো আমার চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছে। আমার  জামাইবাবুর মাধ্যমে জন নাট্য মন্ডলীর লোকদের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি তাঁর সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শুরু করি। পরিবারে যেমন পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন এবং সমাজে জাতিভেদ ঘটে, বিপ্লবী আন্দোলন ও পার্টিতে আমি তা দেখিনি। এ ছাড়াও আমি লক্ষ্য করেছি যে সেখানে সবাই স্নেহের সাথে আচরণ করে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে শোষণ ও নিপীড়নের অবসানের চূড়ান্ত সমাধান হল শ্রেণী সংগ্রাম। আমিও আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। 'আমি একজন দলীয় কর্মীকে বিয়ে করতে চাই' আমি জন নাট্য মণ্ডলীর নেতাদের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছিলাম।

আমাদের প্রথম পরিচয়

একদিন আর কে, কম. সূর্যমের সাথে ওঙ্গোলে জামাইবাবুর বাড়িতে আসেন। তখন তার গোপন জীবনের নাম ছিল শ্রীনিবাস। আমি একই বাড়িতে থাকতাম এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়তাম। আমি যখন জলের ঘড়া ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে ভাবল, "এই মেয়েটির গায়ে তো খুব জোর।" এটি ছিল আমাদের প্রথম পরিচয়। পরের বছর সূর্যম আমাকে বলেছিল- "আর-কে কে বিয়ে করা ঠিক হবে। এটা নিয়ে ভাবো।" প্রথমে আমার বাবা -মা আমার পার্টির লোককে বিয়ে করার ধারণা পছন্দ করেননি, কিন্তু আমি অটল রয়ে গেলাম। তাই আমরা ১১ অক্টোবর ১৯৮৮ তারিখে ২০ জনের উপস্থিতিতে ত্রোভাগুন্টায় কল্যাণ রাওয়ের বাড়িতে বিয়ে করি। আমরা তিন বছর একসাথে একটি বাড়িতে থাকতাম। মুন্নার জন্মের ৬ মাস পরই তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে পুরোপুরি যুক্ত হন। শিশুটিকে কারো কাছে রেখে তিনি আমাকে পুরোপুরি আন্দোলনে যোগ দিতে বলেন। আমি বললাম - "আমি বাচ্চাকে ছেড়ে যেতে পারব না। তিনি বললেন - "যেমন তোমার ইচ্ছা।" আমি বাচ্চাকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে এলাম। সেখানে থাকাকালীন, আমি সেলাই কারিগর হিসাবে কাজ চালিয়ে যাই এবং সন্তানকে বড় করেছি। যদিও আমি মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতে যেতাম। একবার আমি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছি, কিছু সময় জেলে কাটিয়েছি। এরপর আমি আর তার সাথে দেখা করতে পারিনি।

মুন্নার মা হতে পেরে গর্বিত

একদিন টিভিতে রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার দেখার সময় মুন্না জিজ্ঞেস করলো, উনি আমার বাবা, তাই না?
"কে তোমাকে বলেছে?"

"আমি জানি মা।"

যখন আমি আর-কে কে এটা বললাম, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- "তার তো যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, সে কি বিপ্লবী আন্দোলনে টিকে থাকতে পারবে?" 
আমি রাগ করে বললাম - "মুন্না ওখানে থাকতে পারবে না .. তুমি এটা করছ, তুমি তাকেও নিতে চাও?"

উনি বললেন- "কি হয়েছে কমরেড! আমরা অন্যদের একই কথা বলি, তাই না?"

আমি বললাম, "মুন্না নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে।"

পিতা-পুত্র উভয়ের স্বভাব ছিল একই রকম। সমাজ তাদের দুজনের কাছেই খুব প্রিয় ছিল। 'মুন্না, যে আমাকে ছাড়া একদিনও বাঁচতে পারেনি, আমার অজান্তেই বিপ্লবে নেমেছে'... সে কত বড় হয়েছে শুনে আমি হতবাক। এক অনুষ্ঠানে আর কে বলেছিলেন- "মুন্নার কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে।" আমি এমন একটি ছেলের মা হতে পেরে গর্বিত যার ছেলে সমাজকে এত ভালোবাসে এবং এত অল্প বয়সে তার ধারণার জন্য জীবন বিসর্জন দেয়।

হাতে হাত রেখে 

হয়তো আজ থেকে ২৫ বছর আগে, প্রতিদিন সংবাদপত্রে এনকাউন্টারের খবর দেখে ভয় পেতাম যে তাদের কিছু হতে পারে। আমি আরকে-র সাথে দেখা করে এই কথা বলেছিলাম এবং অঝোরে কেঁদেছিলাম। তিনি আমার হাত তাঁর হাতে নিয়ে বললেন - "আমার ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত আমার কিছুই হতে পারে না, আমি এর বাইরে কিছু বলতে পারি না। তিনি আমাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলেন- "তুমি হতাশ কেন, ভয় বিপ্লবীদের বৈশিষ্ট্য নয়।"

বিয়ের সেমাই পায়েস

আমাদের বিয়ের ঠিক ১০ বছর পর ১০ই অক্টোবর আমি তার সাথে ছিলাম। তারা কিছু গোপন বৈঠক করছিল। আমাদের বার্ষিকী সম্পর্কে জানার পর কিছু মহিলা কমরেড সেমাইয়ের পায়েস বানিয়ে সবাইকে খাওয়ালেন। জানতে পেরে, আর কে ফিসফিস করে বললো - "এটা বুর্জোয়া সংস্কৃতি, বন্ধুরা।" একজন সহকর্মী বললেন, "একজন বিপ্লবী কি ব্যক্তি নয়? এত সামান্য পরিমাণ সুখ কি তার পাওয়া উচিত নয়?"

আরকে আমার সাথে যেভাবে আচরণ করেছে তার জন্য সবাই আরকে -র প্রশংসা করেছেন। তিনি এত সংযত, এত মৃদুভাষী এবং আরও বেশি প্রেমময় ছিলেন। এমন একজন মহান ব্যক্তির জীবনসঙ্গী হতে পেরে আমি আনন্দিত।

স্বপ্ন নয় .... জীবন মূল্যবান

আর কে চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলিকে খুব পছন্দ করতেন। প্রায়ই তেলেগু ও হিন্দি ছবির পুরনো গান শুনতেন। তার মধ্যে 'ভেলুগু নিদালু' ছবিতে শ্রী শ্রী রচিত 'কালা কানিদি ভিভালুয়ানাদি বাগতুকু... কান্নিটি ধরতালো বলিচেয়াকু (কোনও স্বপ্নের জীবন অমূল্য নয়... অশ্রুর স্রোতে আত্মত্যাগ করো না)' গানটি সবচেয়ে বেশি শুনতেন। বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে আমরা একসঙ্গে কিছু সিনেমা দেখেছি। মুন্নার বয়স যখন ৫ বছর, তখন আমরা তিনজনেই হলে গিয়ে 'বোম্বে' সিনেমা দেখেছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আর কে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। যাহোক কিছু খেতে পেলেই চলতো। তাও তিনি খুব কম পরিমাণে খেতেন। তিনি  ডাল, আমের চাটনি এবং ঘি মেশানো ভাত পছন্দ করতেন। 

শেষ পর্যন্ত একসাথে থাকতে চাই

আর কে-র সাথে, বিপ্লবের শেষ পর্যন্ত না যাওয়ার সাধ রয়েই গেলো। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম - "আমরা কি শেষ সময়ে একসাথে থাকতে পারব?"

তিনি বলেছিলেন- "দেখা যাক, তখন কী অবস্থা হয়।" জীবনের শেষ পর্বে আমি ঠিক তার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। আমরা কামনা করেছিলাম যে আমরা দুজনে একসাথে থাকার সময় মুন্নার স্মৃতিগুলি ভাগ করে নেব, কিন্তু তা হয়নি। তারা দুজনেই আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়।

এখন আলাকুরাপাদুতে আমার একটা ছোট দোকান আছে। এভাবেই চলে আমার জীবিকা। কেউ কেউ আমাকে ছেলে হারানোর জন্য সহানুভূতি দেখায়। আমি শুধু এই ধরনের মানুষকে বলতে চাই যে, আমার স্বামী এবং সন্তান একটি মহান আন্দোলনে তাদের জীবন দিয়েছে, এটি তাদের জীবনের আত্মত্যাগ, তাই আমি আপনার দয়া ও সহানুভূতি চাই না।

কান্দুলা শিরিশা


(মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আক্কিরাজু হরগোপাল ওরফে আরকে -র স্ত্রী কান্দুলা শিরিশার এই লেখাটি একটি তেলেগু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, যা হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন চেরুকুরি রাজ কুমারের স্ত্রী অ্যাডভোকেট পদ্মা। সেটি 'জনচওক'-এর ২৪শে অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বর্তমান অনুবাদটি তার ওপরে ভিত্তি করে করেছেন কল্যাণ সুলেখাপুত্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালে অন্ধ্র-উড়িশা সীমান্ত এলাকার রামাগুডায় পুলিশের সঙ্গে 'গুলিবিনিময়ে' শহীদ হন মুন্না )

Post a Comment

0 Comments