রঞ্জিত শূর
কলকাতার দমদম জেলের রাজনৈতিক বন্দি অসীম ভট্টাচার্যের মুক্তির আদেশ দিয়েছে পয়লা ডিসেম্বর। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি বিচারাধীন বন্দি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি মাওবাদীদের রকেট লঞ্চের বানাতে সাহায্য করেছেন। সেজন্য তাকে গ্রেপ্তার করে এসটিএফ। পরে মামলাটা NIA নেয়। এই মামলায় আরও ১৪ জন বন্দি আছেন। ২০২০ সালের মে মাসে এনআইএ আদালত এবং ১৫ই মার্চ ২০২১ সালে কলকাতা হাইকোর্ট তাঁদের জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। অসীম ভট্টাচার্যের পরিবার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলে সুপ্রিম কোর্ট তাকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়েছে। আইন সংক্রান্ত খবরাখবরের ওয়েবসাইট livelaw.in এই মামলাটি তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। পশ্চিমবাংলার বিচারব্যবস্থার কি করুণ হাল তার কিছু নিদর্শন এই অর্ডারে তুলে ধরা হয়েছে। এবং কিছু সংশোধনী পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে পাঠকের নজর টানার জন্যই এই লেখা।
২০২০ সালের ৬ জুলাই অসীম ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। যদিও তার আগে থেকেই অন্য মামলায় তিনি বন্দি ছিলেন। মূল মামলার এফআইআরে হয়েছিল ২০১২ সালের পয়লা মার্চ। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রথম চার্জসীট এবং ২০১৭ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয় চার্জসীট হয়। ২০শে জুন ২০১৯ এ এই মামলার চার্জ গঠন হয়ে বিচার শুরু হয় UAPA এবং অন্যান্য ধারায়। লক্ষ্য করুন, গ্রেপ্তার ২০১২ সালের ৬ জুলাই, চার্জ গঠন এবং বিচার শুরু ২০১৯ সালের ২০ জুন অর্থাৎ ৭ বছর পরে। সরকার পক্ষের সাক্ষী ২৯৮ জন। ২০২১ এর ডিসেম্বরে জামিনের আদেশ যখন হচ্ছে প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য তখনও শেষ হয়নি। প্রথম সাক্ষী হলেন FIR কারি STF অফিসার অর্থাৎ প্রায় ১০ বছরেও বিচার কার্যত শুরুই হয়নি। এসব তথ্য তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আইন অনুযায়ী এনআইএ বিশেষ আদালতে এই মামলার ডে -টু- ডে বেসিসে অর্থাৎ প্রতিদিন শুনানি হওয়ার কথা। সে জন্যই বিশেষ আদালত তৈরি করা। অথচ দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালের চার্জশিটে চার্জ গঠন হয়েছে সাত বছর পর ২০১৯ এ এবং ২০২১ পর্যন্ত একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যও শেষ হয়নি, যেখানে স্বাক্ষীর মোট সংখ্যা ২৯৮। শেষ পর্যন্ত যদি ১০০/১৫০ জন সাক্ষীও হাজির হয় তাহলে এই বিচার কতদিন চলবে! অথচ ২০১২ সালের ৬ জুলাই থেকে বন্দিরা জেল হেফাজতে আছে। মোট ৯ বছর ৬মাসেরও অধিক। এরপর সুপ্রিমকোর্ট বহুবার বলা ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবিধান ইত্যাদি নিয়ে অনেক জ্ঞান বাণী দিয়ে অসীম ভট্টাচার্যের জামিন মঞ্জুর করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ হলো এর পরের অংশ। আইন অনুযায়ী NIA মামলাগুলোর বিচার প্রতিদিন হওয়ার কথা - day to day basis এ। দ্রুত বিচারের জন্যই বিশেষ আদালত। অন্য মামলা থেকে এই মামলাগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। আগে এইসব মামলার শুনানি করতে হবে। অথচ পশ্চিমবাংলার NIA আদালত আছে মাত্র একটি। সুপ্রিম কোর্ট মামলার সমস্ত রেকর্ড খতিয়ে দেখে বলেছে, এনআইএ আইনকে লঙ্ঘন করে এই মামলার শুনানি হচ্ছে মাসে একদিন। অথচ প্রতিদিন শুনানি হওয়ার কথা। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গে এনআইএ বিশেষ আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং কলকাতা হাইকোর্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পারস্পরিক আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে যথাশীঘ্র সম্ভব রাজ্যে এনআইএ আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আইন মেনে সমস্ত এনআইএ মামলার শুনানি Day to Day Basisএ অর্থাৎ প্রতিদিন শুনানি করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট যতটা দেখেছে বাস্তব অবস্থা তার থেকে অনেক অনেক খারাপ। বর্তমানে রাজ্যে এনআইএ বন্দি কত আছে? জানা নেই। মাওবাদী সন্দেহে গ্রেপ্তার রাজনৈতিক বন্দী, মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে ধৃত বন্দি (সংখ্যাটা যথেষ্ট বড়), জাল টাকার মামলায় ধৃত বন্দি। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা বেশ ভারি। কোন মামলাই ১২/১৪ বছরের আগে মীমাংসা হয় না - যদি না বন্দি অপরাধ স্বীকার করে নেয়। অথচ আইন বলছে প্রতিদিন শুনানি করে দ্রুত বিচার শেষ করতে হবে। ছত্রধর মাহাতোকে ২০০৯ সালের মামলায় নতুন করে FIR করে NIA গ্রেপ্তার করেছে। সম্প্রতি তার সঙ্গে জঙ্গলমহলের রাজনৈতিক বন্দি মনসারাম হেমব্রমকে ওই মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। যে কোন প্রান্তে বোমা ফাটলে NIA মামলা হচ্ছে এবং বন্দি সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। অথচ সেই একটাই আদালত। মানবাধিকার সংগঠনগুলো NIA বাতিলের দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু বাতিল সাপেক্ষে এনআইএ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আইন অনুযায়ী প্রতিদিন শুনানি করে দ্রুত বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া খুবই জরুরী। অসীম ভট্টাচার্যের এই মামলাতেই আরো ১৩ জন রাজনৈতিক বন্দি দশ বছর ধরে বন্দী হয়ে আছেন। বিচারের নামে প্রহসন চলছে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অধিকার কর্মীদের কাছেও এনআইএ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সমস্ত বন্দিদের সমস্ত মামলার প্রতিদিন শুনানি করে দ্রুত বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
লেখক মানবাধিকার কর্মী
0 Comments