কাঁটাতারের প্রহরায় মানবাধিকার

জি.এম.আনসার

আপনি কি প্রকাশ বর্মনকে চেনেন? অবশ্যই সবার পক্ষে কুচবিহার জেলার সিতাই থানার চামটা গ্রামের প্রকাশ বর্মনকে চেনার কথা নয়। ৩৫ বছর বয়সী এই (এস সি) যুবকের বাড়ি ছিল চামটা বর্ডারের কাছে। ছিল, বললাম এজন্য যে বাড়িটা থাকলেও সেই ছেলেটি এখন আর বেঁচে নেই। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে BSF এর পাহারাদার প্রকাশকে খুব কাছে থেকে অর্থাৎ পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জের মধ্যে মাথায় গুলি করে মেরে দিয়েছে। বিএসএফের অভিযোগ হলো ঐ ব্যক্তি সীমান্তে চোরাচালানে যুক্ত ছিল। মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (MASUM) পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদ পত্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে (NHRC) পাঠানো হয়েছে। ঐ চিঠিতে লেখা হয়েছে "If the man is actually a smuggler then in which Indian law it is stated that a smuggler can be shot dead by the BSF?" ভারতীয় আইনে কি স্মাগলার কে গুলি করে মারা যায়? বিএসএফের লিখিত অভিযোগ অনুসারে আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই সীমান্ত পাহারাদাররা গুলি করে মারতে বাধ্য হয়েছিল। মাসুমের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে আক্রান্ত  বর্ডার গার্ডদের আঘাতের ধরন Type of injury টা কেমন। এটা একটা ঘটনা বা উদাহরণ মাত্র বলা যায়। সীমান্ত এলাকায় যারা বসবাস করেন, তারা হামেশাই এমনি নানান ধরনের সমস্যা ও বাহিনীর দ্বারা হেনস্থার শিকার হন। পাঠকের নিশ্চয়ই ফেলানী খাতুনের হত্যার ঘটনা স্মরনে আছে। চৌধুরী হাট সীমান্ত চৌকি তে ১৪ বছরের এই বাংলাদেশী মেয়েটিকে গুলি করে মেরেছিল বিএস এফ। মেয়েটি বাবার সঙ্গে দিল্লীতে পরিচারিকার কাজ করতো। কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় তার ফ্রক আটকে গেছিল কাঁটাতারে। ভয়ে কেঁদে উঠলে বিএসএফের অমিয় ঘোষ গুলি চালিয়ে দেয়। মেয়েটির দেহ পাঁচ ঘণ্টা ধরে কাঁটাতারের বেড়ার উপর ঝুলতে থাকে। আরও ঘন্টা ত্রিশেক পর দুই দেশের বাহিনীর সিদ্ধান্ত মতো মেয়েটির মৃতদেহ বাংলাদেশের বর্ডার গার্ডদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।  

কাঁটাতারে ঝুলতে থাকা দেহ, বিএসএফের গুলিতে মৃত ১৪ বছরের ফেলানী খাতুন

ঘটনা দুটো শুধু প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করলাম এজন্য যে সীমান্তে বিএসএফের যেকোন ব্যক্তিকে তল্লাশি, আটক করা, ঘরদোর দোকানে প্রবেশ করে জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার এলাকা এবার তূলনায় অনেকটা বিস্তৃত করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর নতুন ভাবে আমাদের দেশের সরকার এক গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা সংলগ্ন রাজ্য পাঞ্জাব, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বিএসএফের নজরদারির এলাকা পনেরো কিমি থেকে বৃদ্ধি ঘটিয়ে এবার ৫০ কিমি করা হয়েছে। এর ফলে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় ২১টি বিধান সভা সহ প্রায় অর্ধেক লোকসভা কেন্দ্র সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার ও তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসল। এইসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা আর রাজ্য সরকারের অধীনে বলা যাবেনা। উত্তরবঙ্গের প্রায় পুরোটাই, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অর্ধেকেরও বেশি অংশ কেন্দ্রীয় সরকার ও তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। বিদেশি পুঁজির অবাধ প্রবেশ, রাষ্ট্রীয় সংস্থার বেসরকারি করন, বিমূদ্রাকরন, নয়া শ্রমকোড, নাগরিকত্ব সংশোধন, কৃষি পন্য আইনের পর এখন আবার রাজ্য গুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা শেষ করে দিতে ক্রমশঃ সামরিকীকরনের দিকে পদক্ষেপ নিয়েছে দেশের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরনজিৎ সিং সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নজরদারির এলাকা বৃদ্ধি সম্পর্কে বলছেন যে রাজ্যের এতটা অভ্যন্তরে ঢুকলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে বিবাদে ফেডারেল ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজ্যের সার্বভৌমত্ব স্বাধীন কার্যপদ্ধতি অবশ্যই বিঘ্নিত হবে। সংবিধান অনুসারে আভ্যন্তরীন আইন শৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। কিন্তু এভাবে রাজ্যে ক্ষমতা দখল তো সরাসরি সংবিধানকে অগ্রাহ্য করা। তাছাড়া লোকসভায় আলোচনা ও সাংসদদের মতামত ছাড়াই, সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ তো সংবিধানের উপর আক্রমণ।

গ্রামে গ্রামে টহলদারি

UPA সরকারের আমলে পি চিদম্বরম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকার সময়ে তিনিও রাজ্যসভায় বিএসএফের নজরদারির ক্ষমতা বা এলাকা বৃদ্ধি করার জন্য  একটি সংশোধনীর প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন (বিএসএফ Amendment bill 2011)। কিন্তু গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যিনি বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেছিলেন "create a state within a state" "This is an attempt by the centre to weaken the federal structure of the country " কিন্তু আজ সেই একই ভাবে রাজ্য গুলো দূর্বল করে সংবিধানকে পাত্তা না দিয়ে লোকসভা এড়িয়ে separation of power এই সাংবিধানিক চিরাচরিত নিয়ম তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ২০১৯ সালে UAPA আইনে একটি মারাত্মক সংশোধনী এনেছিল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। এতদিনকার প্রচলিত আইন ছিল যেকোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসী কী না, বিপজ্জনক কী না দেশের পক্ষে,  সেটা নির্ধারণ করার এক্তিয়ার কেবলমাত্র আদালতের। কিন্তু সংশোধনীর ফলে সরকারের অধীনস্থ যে কোনো কর্মচারী তিনি যেকোনো ব্যক্তিকে সন্দেহ বশে সন্ত্রাসবাদী বা বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করতে পারবেন। বিচার বিভাগীয় স্বাতন্ত্র্যতা, স্বাধীনতা বা বলা যায় আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগীয় যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রতা নীতি ছিল (separation of power) সেটা কেড়ে নেয়া হলো। সোজা কথায় বললে দেশের সরকার এখন Democracy থেকে ক্রমশঃ Dictatorship এর দিকে এগিয়ে চলেছে। বহুল প্রচারিত শব্দ গুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো অনুপ্রবেশ, পাচার। 

বিএসএফের গুলিতে মৃত মেয়ের কবরে মা, বাবা

অনুপ্রবেশকারি মানুষ তো সব সময় হিন্দু বা মুসলমান হয়না। তাঁরা দিন আনি দিন খাই, খেটে খাওয়া গরীব শ্রমজীবীও হয়। পাচার বা অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রশ্নহীন ক্ষমতা বৃদ্ধি চাই। বিএসএফের হাতে ক্ষমতা চাই, কিন্তু গুজরাট রাজ্য সীমান্ত এলাকায় তো নজরদারির নির্ধারিত ১৫ কিমি এলাকা আরও কমিয়ে আনা হয়েছে। কিছু দিন আগে শাহরুখ খানের ছেলে মাদকদ্রব্য পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ভালো কথা। কিন্তু ঐ গুজরাটের আদানিদের কেনা একটি বন্দরে জাহাজ থেকে তল্লাশির পর ৩০,০০০ কেজি মাদকদ্রব্য হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছিল। তার চলতি বাজার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকার উপরে তাহলে গুজরাটের বেলা ছাড় কেন। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন। The Shine News Dinhata তাদের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দিনহাটা দুই নম্বর ব্লকের কালিমাটি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে যেসব চাষীরা ধান চাষ করেছেন তারা বিএসএফের বাধায় পাকা ধান কেটে ঘরে আনতে পারছেন না। কুচবিহারের দিনহাটা ২ নং ব্লকে তুফান গঞ্জের ১নং ব্লকে, নাককাঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের ধাদিয়াল, শিয়ালপাড়া, মেখলিগঞ্জের জামালদা গ্রাম পঞ্চায়েতের অনেক অনেক গ্রামবাসীদের বাঁশ বাগান, গাছ কেটে, ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে অন্য কোথাও জিনিস পত্র নিয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অমান্য করলে এসব ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। সীমান্তের নাগরিকরা সদা সন্ত্রস্ত। আসলে বিএসএফের পাহারা দেওয়ার কথা কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে। কিন্তু বিএসএফের প্রহরা চলে গ্রামের মধ্যে। আগামী দিনে সীমান্ত এলাকা থেকে দেশের ৫০কিমি অভ্যন্তরে নজরদারি টাওয়ার তৈরি, তল্লাশি, গ্রেফতার ও জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা প্রদান বা নাগরিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ নতুন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নির্মাণের দিকে দিক নির্দেশ করে। নতুন গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার  সাথে সাথেই বিএসএফ পশ্চিম বাংলার সীমান্তে তাদের অপারেশন শুরু করেছে। আগামী দিনে এসব অপারেশন আরো ৫০ কিমি অভ্যন্তরে শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহ বশে মাদকদ্রব্য পাচারকারি বা সন্ত্রাসী তকমা লাগিয়ে আটক করা UAPA আইনে বিনাবিচারে বছরের পর বছর জেলে আটক করে রাখার আইনি অধিকার কেন্দ্রীয় বাহিনীর মিলে গেল। সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান সহ মাদকদ্রব্য গবাদিপশু ও মানুষ পারাপার বা পাচারও চলে টাকার বিনিময়ে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোক জনের অনেকেরই সে সব জানা। তবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসবের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে পাচার অসম্ভব। কেবলমাত্র  প্রান যায় শুধু নুন আনতে পান্তা  ফাঁকা সংসারে খেটে খাওয়া সাধারণ লোকের। আসল মাথারা  থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। উদ্দেশ্য খুবই পরিস্কার, সেটা আর চাপা নেই। নজরদারির এলাকা বৃদ্ধি ঘটিয়ে বকলমে বা ঘুরপথে রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলটা তো আগে করে নেওয়া যাক। জো কুছ ভী হো বাদ মে দেখেঙ্গে। বেসরকারী করন, বিমুদ্রা করন, নয়া শ্রমকোড, নাগরিকত্ব সংশোধন, কৃষি কানুনের মতো এটাও নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়ে রাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণ করার এক নিষ্ঠুর খেলা। এক দেশ, এক আইন, এক প্রশাসনের অধীনে চলবে সমগ্র দেশ। গুলি মারো যুক্তরাষ্ট্র ব্যাবস্থা। 

একটা বিষয় চিন্তার, এইসব অসাংবিধানিক, অগনতান্ত্রিক কাজ, বা নাগরিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বা সরকার বিরোধী দলগুলো কেন চুপচাপ থাকে। কোথাও নেই জোরালো প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। তবে হাঁ, বিভিন্ন সময়ে নাগরিক সমাজ বা মানবাধিকার সংগঠন গুলোকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সমাজকর্মী আইনজীবী বুদ্ধিজীবীদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে। কৃষি কানুন বাতিলের ক্ষেত্রে আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজনৈতিক দলগুলোরও তেমন ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। লিঞ্চিং থেকে শুরু করে, দলিত হত্যা, রেপ, আদিবাসী সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মীয় বা জাতিগত ঘৃণা বর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ মানবাধিকার সংগঠন গুলো। সেটা নামাজ পাঠে বাধা দানের ক্ষেত্রে হোক বা আদিবাসী সমাজের জল জঙ্গল জমিনের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় হোক। প্রশ্ন থেকে যায়, কেন বিরোধী প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ভীমাকোরেগাঁও দলিত সমাবেশে নাগরিক সমাজকে UAPA আইনে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলের মধ্যে রাখা। তাঁরা শহুরে নকশাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টুকড়ে টুকড়ে গ্যাঙ বলে বিশেষিত করার উদ্দেশ্য মানব অধিকার, নাগরিক অধিকার আদায়ের  সংগঠন গুলোকে কালিমা লিপ্ত করার চেষ্টা। ছত্তিশগড়ে মাওবাদী নিকেশ প্রচার দিয়ে নিরপরাধ আদিবাসী দের যখন রাষ্ট্র হত্যা করে তখন কোন প্রতিবাদ হবে না। নাগরিক ও ছাত্র সমাজকে আক্রমনের শিকার বানানোর পথ পরিস্কার করে রাখার জন্য JNU এর গেটে যুদ্ধের ট্যাঙ্ক বসানোর সামরিক নিদান। উদ্দেশ্য,  সচেতন শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অঙ্গনকে অধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ হিসেবে বেছে নেয়া। তাদের বিরুদ্ধে  যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া। কিছুদিন আগে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বলেছেন ভারতবর্ষের বিপদ আছে দেশের অভ্যন্তরে। নাগরিক সমাজকে দিয়ে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। বক্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অবশ্যই। দেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যখন কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে "মানবাধিকার আন্দোলন কী সন্ত্রাসবাদ ও নকশালবাদ দমনের বিরুদ্ধে বাধা" এমনি একটি বিষয় কে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে  বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন, তখন মনে হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও কী মানবাধিকারের পরিপন্থী। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে রাষ্ট্র এখানে  যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিরোধী দল বা বিদেশী কোন প্রতিবেশী দেশকে বেছে নেয়নি। বরং রাষ্ট্র তার কামান বিমান রকেট জেট নির্যাতন নিপীড়নের গোলা গুলি বর্ষণের লক্ষ্য বস্ত হিসাবে দেশের বুদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিক সৎসাহস সম্পন্ন সাংবাদিক, ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষক, শিক্ষাঙ্গন, সমাজকর্মী, আইনজীবী, মানবাধিকার সংগঠন গুলোকে বেছে নিয়েছে। কারণ নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, কৃষি কানুন বাতিলের আন্দোলন, মানবাধিকার রক্ষা আন্দোলন বা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বর্ষনের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী এজেন্ডা গুলোর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী মুখ এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার উদারবাদী মানুষ, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী মানবাধিকার সংগঠন। মহারাষ্ট্রের ভীমাকোরেগাঁও দলিতদের শতবর্ষপূ্র্তি সমাবেশ থেকে সরকার যেভাবে নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে , সেই যুদ্ধ এখনো চলছে। সমাজকর্মী আইনজীবী মানবাধিকার কর্মী অধ্যাপক বিঞ্জানী লেখক কবি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জেলে ঢোকানোর পরেও অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেমে যায়নি। বিএসএফের নজরদারির এলাকা বৃদ্ধি করার প্রয়াস আসলেই রাজ্যে রাজ্যে অবৈধ ভাবে  ক্ষমতা দখল। সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার হরণ। কর্পোরেটদের পায়ে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার জন্য বিরোধী কন্ঠস্বর থামিয়ে দেওয়ার এক কর্মসূচি। দেশ জুড়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা আজ আর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কয়েক দিন আগেও নাগাল্যান্ডে তেরো জন নিরীহ শ্রমজীবী মানুষকে উগ্রপন্থী সন্দেহে গুলি করে হত্যা করেছে আধাসামরিক বাহিনী। অধিকার আদায়ের আন্দোলনও তাই থেমে না থেকে চলতেই থাকে। যতই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মানবাধিকারকে ঘিরে দেয়া হোক, আর বুটের দাপাদাপি বৃদ্ধি হোকনা কেন। রাত বিরাতে কাঁটাতার যতই তার হাত পা ছড়িয়ে অগ্রসর হোক, যতই বুুুটের শব্দ মানবাধিকারের উঠোনে উঠোনে প্রতিধ্বনি তুলুক। অধিকার আদায়ের আন্দোলন কিন্তু থেমে থাকে না।

Post a Comment

0 Comments