আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর, ১৮৮০ - ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৬) সে অর্থে হিন্দুত্ববাদী, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল ঘরে তোলা 'পণ্ডিত' বৃত্তের সমাজ-রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ ছিলেন না। ১৯৩৭ পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সদস্য হলেও ১৯২০,২২,২৪ এ রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও আসামের নিপীড়িত উচ্চবর্ণীয় জমিদার দ্বারা অত্যাচারিত চাষিদের সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। পূর্ব ভারতে পরবর্তীকালে সামন্তবাদ বিরোধী জঙ্গি চাষি-সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তাতে ভাসানীর অবদান অন্যতম বললে অত্যুক্তি হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাজশাহীতে ভাসানীর নেতৃত্বে থাকা চাষি ও জমিদারদের মধ্যে, 'চাষির হাতে জমির দাবি'তে যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম হয় তা আজও ইতিহাসে অষ্টম মোল্লার চাষি বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
'আমি ও আমার মওলানা ভাসানী' গ্রন্থে লেখক সৌমিত্র দস্তিদার যা লিখছেন তা সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়- 'জমিদারতন্ত্রের অত্যাচার ক্রমেই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। হিন্দু জমিদারদের এলাকায় গরু জবায়ের অধিকার ছিল না মুসলিম মেহনতি পরিবারের। হিন্দু অথবা মুসলিম কোনো জমিদারের বাড়ির আশপাশ দিয়ে জুতো ও ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটার অধিকার ছিল না হিন্দু নিম্নবর্ণীয় এবং মুসলিম প্রজার। ভাসানী এই যুগযুগ ধরে শোষিত প্রজাদের মুখে বিদ্রোহের ভাষা জুগিয়ে ছিলেন।
১৯৩৭-৩৮ এর আগে প্রায় সমস্ত সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের পিছনে ছিল চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য। এমনকি (পরবর্তীকালে) নোয়াখালির মতো ভয়ংকর হিন্দু নিধন পর্বের সময় গান্ধীজী জানতে চেয়েছিলেন, এখানকার (নোয়াখালী) ভূসম্পত্তির মালিকানা কাদের হাতে রয়েছে। তিনি যখন শুনলেন, সেখানে জমির মালিকানার ৮০% রয়েছে হিন্দু-উচ্চবর্ণীয়দের হাতে তখন ওঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, একতরফা দাঙ্গা (POGROM) যতোই নিন্দনীয় হোক এর পিছনে অন্যতম কারণ চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বৈষম্য'। এবিষয়ে আমার মন্তব্য হল ১৯৪৬ এর অক্টোবরের নোয়াখালী দাঙ্গাকে অনেকে অগাস্টের 'গ্রেট কলকাতা কিলিং' এর ভয়ংকর মুসলিম নিধনের (POGROM) প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু এই দেখাটি যে সঠিক নয় তা প্রমাণিত হয় এই যুক্তিতে যে ৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গার সঙ্গে অর্থনীতির বা জমি-প্রশ্নের কোনো যোগ ছিল না। অন্যদিকে নোয়াখালীর আন্দোলন যা শুরু কিছুদিন পর সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছিল তার পিছনে আর্থসামাজিক কারণ ছিল অন্যতম কারণ। ১৯৩৭ এর পর মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হলেও মতাদর্শগত ভাবে তিনি ঐ দলের সঙ্গে ছিলেন এমনটা মনে হয় না।
ভাসানী পঞ্চাশের দশকেই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানকে এক অচল রাষ্ট্র-কাঠামো বলে মনে করতেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে থাকলেও শেখ মুজিবের শাসনকে তিনি বুর্জোয়া স্বৈরাচারী শাসন বলেই মনে করতেন। প্রকৃতই তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এক মৌলানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে তাঁর উক্তি ছিল - "আজ সারা দুনিয়ার মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে। এই শান্তিকামী মানুষের মিছিল দুনিয়ার সমস্ত রাস্তায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। সে মিছিলের সামনের সারিতে আছেন পল রবসন, হাওয়ার্ড ফাস্ট, হেমিংওয়ে আইজেনস্টাইন এর মতো অসংখ্য বিশিষ্টজন থেকে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার হাজার হাজার সাধারণ জনগণ, আমাদের বিজয় অনিবার্য।"
শুধু ব্রিটিশ পর্বের অসংখ্য চাষি-আন্দোলনে নেতৃত্ব দানই নয় ১৯৪৫-৪৬ এর 'বাঙ্গাল খেদাও' এর নামে নৃশংস দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভাসানী এক সাহসী গণসংগ্রাম গড়ে তুলে পেরেছিলেন। ১৯৬৪ সালে পাবনার লাহিরিপুর কৃষক সম্মেলন, '৬৭ তে বিন্নাফেরে পাটচাষি সম্মেলন, '৬৯ তে শাহপুরে লাল্টুপি চাষি সম্মেলন, ৭০ সালে সন্তোষে ও তবাতেকসিংহে চাষি সম্মেলন, '৭২ এ শিবপুরে চাষি সম্মেলনসহ অসংখ্য চাষি সম্মেলন সমগ্র বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেছিল।
ভাসানী ‛মৌলানা’ হলেও তাঁর কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনোরকম ধর্ম-সম্বন্ধিত বক্তব্য তিনি রাখতেন না। যে কারণে তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের চাষি, মজদুর তথা মেহনতি মানুষের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। ভাসানী ছিলেন সমাজতন্ত্র এবং সাম্যে আস্থাশীল এক ধর্ম-নিরপেক্ষ নেতৃত্ব যিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাভাবনা থেকে মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রশ্নটিকে দেখতেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওবাদী কমিউনিস্ট অথবা বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই কারণে তাঁকে লাল মৌলানা বলে ডাকতেন তাঁর সাথিরা। ১৯২৯ এ ধুবরি জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান নামক একটি চরে প্রথম চাষি সম্মেলন আয়োজন করেন। এখানেই সংগঠিত কৃষকরা তাঁর নাম দেন ভাসানী। যাইহোক, ভাসানীর স্বপ্ন, চিন্তাভাবনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা আরো বিস্তার লাভ করুক। সৌমিত্রদার কাছ থেকে এই বই উপহার পেয়ে পাঠকরা, রাজনৈতিক সমাজকর্মীরা নিশ্চিতভাবে উপকৃত হবেন। আমিও হলাম। এপার বাংলায় ভাসানী চর্চার ক্ষেত্রটিকে সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক সৌমিত্রদা ব্যাপক প্ররোচনা দিলেন একথা বললে ভুল হয় না। অবশ্যই সংগ্রহ করুন বইটি।
বই - আমি ও আমার মওলানা ভাসানী
লেখক - সৌমিত্র দস্তিদার
মুল্য - ৩০০/ টাকা
গ্রন্থ পর্যালোচনা -
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
২৭/০৩/২০২২
0 Comments