দঃ ২৪ পরগনার বিভাজন আদতে সুন্দরবনের বিভাজন হচ্ছে না তো?

২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষনা করেছিলেন সুন্দরবন নতুন জেলা হবে। সুন্দরবন নতুন জেলা গঠনের কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ২০ লাখ মানুষ এবং ৭ লাখ কৃষকের কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ৩ লাখ ঘরবাড়ি ও ৮০০ মেট্রিক টন ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’(লিঙ্ক) মূলত ইয়াস, আমফান সহ ঘুর্নী ঝড় কবলিত সুন্দরবনে আর্থিক সাহায্য ও পরিষেবা ভালো করতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা জেলার প্রস্তাব আনা হলো, ভাবটা ছিলো প্রাথমিক ভাবে এমনটাই। আর সেই জন্য ইয়াস, আমফানের ক্ষয় ক্ষতির উল্লেখ করে সুন্দরবনকে আলাদা জেলা করার প্রস্তাব দেন। প্রাথমিকভাবে সংবাদপত্র গুলোর বক্তব্য থেকে ভাবা হচ্ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার সুন্দরবনের এলাকাগুলো নিয়েই মূলত নতুন জেলা সুন্দরবন গঠন হবে। কিন্তু শেষ পাওয়া খবর থেকে যতদূর জানা যাচ্ছে দঃ২৪ পরগনা ভাঙার পর ঘোষিত নতুন তিন জেলা হচ্ছে বারুইপুর, সুন্দরবন ও ডায়মন্ডহারবার জেলা। এর মধ্যে কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতীমা, রায়দীঘি, গঙ্গাসাগর, মথুরাপুর থাকছে সুন্দরবন জেলায়। আর কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী থাকছে বারুইপুর জেলায়। যেটার বাস্তাবায়ন হলে সুন্দরবনের একটা বড় অংশই বাদ চলে যাবে সুন্দরবন থেকে। শুধু বড় অংশই নয় বরং এটাই সুন্দরবনের ব্যাপক জঙ্গলময় অংশ। আর এই ভাঙ্গনটাই যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে সুন্দরবনকেই ভাঙার চক্রান্ত চলছে সুন্দরবন জেলা গঠনের নাম করে।

দঃ২৪ পরগনা জেলা গঠনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পরাজয় হলে মীর্যাফরের হাত ধরে বাংলায় সাম্রাজ্য বিস্তার করে ইংরেজ। এই সময়ই ১৭৫৭ সালে ২০ ডিসেম্বরে বাংলার নবাব মীরজাফর কলকাতার দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত অঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২৪টি জংলীমহল বা পরগনার জমিদারি সত্ত্ব ২,২২,৯৫৮ টাকা খাজনার বিনিময়ে ভোগ করার অধিকার দেন। সমগ্র অঞ্চলের আয়তন ছিল ৮৮২ বর্গমাইল, যা পরে অন্যান্য অঞ্চলযোগে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫,৬৩৯ বর্গমাইল। এরপর থেকে এই অঞ্চলকে একত্রে চব্বিশ পরগনা নামে ডাকা হতো। এই ২৪টি পরগনা হল- আকবরপুর, আমীরপুর, কলিকাতা, পাইকান বা পৈখান, আজিমবাদ, বালিয়া, বাদিরহাটি, বসনধারী বা বসনধোয়াব, দক্ষিণ সাগর, গড়, হাতিয়াগড়, ইখতিয়ারপুর, খাড়িজুড়ি, খাসপুর, মেদনমল্ল, মাগুরা, মানপুর, ময়দা, মুড়াগাছা, পেচাকুলি বা পাটকুলি, সাতাল, শাহনগর, শাহপুর, উত্তর পরগনা।
          কলকাতা প্রথমে ২৪ পরগনার মধ্যে থাকলেও পরবর্তীকালে ইংরেজরা ২৪ পরগনা থেকে আলাদা করে কলকাতাকে ভারতের রাজধানী ঘোষনা করে। দেশভাগের আগে পর্যন্ত বনগাঁ থেকে খুলনা পর্যন্ত বাংলাদেশের একটা অংশ ও এই জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো যেটা দেশ ভাগের সাথে সাথে পৃথক হয়ে যায়।
          ২৪ পরগনা জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাবেক একটি জেলা। ১৯৮৩ সালে ডঃ অশোক মিত্রের প্রসাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে আবার বিভাজনের সুপারিশ করে। ১৯৮৬ সালে ১লা মার্চ জেলাটিকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা নামে দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। দুটি জেলাই প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।
               এবার ২০২২ সালে সেই দঃ২৪ পরগনা জেলা আবার ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়েছে। সীমানা বিতর্ক নিয়ে নানা ধোঁয়াশা থাকলেও খুব শীঘ্রই জেলা ভাঙ্গার সরকারি নোটিশ বোর্ড যে পড়তে চলেছে তার আভাস বেশ পরিষ্কার ভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে বলা হচ্ছে উন্নত পরিষেবা দানের প্রতিশ্রুতির কথা। যেখানে বলা হচ্ছে প্রশাসনিক সুবিধার কথা। বিগত এক দশকে এরকম বেশ কিছু জেলা ভাগ ও নতুন জেলা নির্মান হয়েছে আমাদের রাজ্যে। কিন্তু তারপরও এখনও সেই সব নতুন জেলাগুলি উন্নত এবং সুন্দর পরিষেবা পেতে ব্যার্থ। এমনকি নূন্যতম প্রশাসনিক পরিকাঠামোটুকুও সুষ্ঠ ভাবে এখনও গড়ে ওঠেনি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের উন্নয়নের এই জেলা ভাঙ্গার প্রতিশ্রুতি যেই সামনে আসে তাৎক্ষনাৎই মনের কোনে প্রশ্ন উঁকি দেয়। এ কোন নতুন ষড়োযন্ত্রের আভাস নয় তো!

সুন্দরবন

সুন্দরবন হল বঙ্গোপসাগরে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর সঙ্গম দ্বারা গঠিত ব-দ্বীপের একটি ম্যানগ্রোভ এলাকা। এটি বাংলাদেশের খুলনার বালেশ্বর নদী থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বদ্ধ এবং উন্মুক্ত ম্যানগ্রোভ বন, কৃষি কাজে ব্যবহৃত জমি, কাদামাটি এবং অনুর্বর জমি নিয়ে গঠিত। সুন্দরবনের চারটি সংরক্ষিত এলাকা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে, যেমন। সুন্দরবন পশ্চিম (বাংলাদেশ), সুন্দরবন দক্ষিণ (বাংলাদেশ), সুন্দরবন পূর্ব (বাংলাদেশ) এবং সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান (ভারত)।বাংলাদেশে অবস্থিত সুন্দরবন স্বাধীনতার পরই ভারত থেকে আলাদা হয়। ভারতে অবস্থিত সুন্দরবন পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত ২৪ পরগনার অংশ ছিলো প্রথমে। পরে উঃ ও দঃ দুটি ভাগে ২৪ পরগনা জেলা বিভক্ত হলে সুন্দরবনও দুটি জেলার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। নতুন করে সুন্দরবন জেলা গঠিত হলে ভারতে অবস্থিত সুন্দরবনের সমস্ত অংশকে রেখেই এই জেলা গঠন জরুরি। অন্যথায় সুন্দরবন জেলা হলেও তার সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকবে না। আর এটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হয়েও হবে বঞ্চনার স্বীকার।

নতুন জেলা গঠনের উদ্দেশ্য

নতুন জেলা গঠন হতে পারে মূলত ভিন্ন জাতি সত্ত্বার স্বাধীনতা দিতে, ভৌগলিক পার্থক্য, সামাজিক পার্থক্য, সাংস্কৃতিক পার্থক্য ইত্যাদির ফলে কিংবা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক কারনেও জেলা বিভাগ হতে পারে। আবার বিদ্রোহ দমন করতেও রাষ্ট্র এরকম করে থাকে। এছাড়া বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে একটা ট্রেন্ডই চলছে বিশ্বায়নের ফলে ছোট ছোট এলাকায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ভালো থাকে। তাই প্রশাসনিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যকে সামনে রেখেও উন্নয়নের ঢাক পিটিয়ে জেলা বিভাজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে জেলা ভাগ করে কোনও জেলার আদতে কতটা উন্নতি হয়েছে আর কতটা অবনতি হয়েছে এটা পরিষ্কার না হলেও ব্যায়বহুল প্রশাসন নির্মান করা গেছে জনগনের বিপুল ট্যাক্সের টাকায় এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকা গেছে। জেলা ভাগের পর জেলার নতুন প্রশাসনিক কাঠামোকে নির্ভরযোগ্য ভাবে দাঁড় করাতেই সময় লেগে যায় আমাদের দেশে বছরের পর বছর। এরই সাথে একথা বহুল প্রচারিত রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা বাড়তি পাওয়ার সম্ভাবনার অজুহাত দিয়েও নিজেদের নতুন জেলার সম্পূর্ন কাঠামো নির্মানের ক্ষমতা থাক না থাক নতুন জেলা গঠন করতে চায়।এখনও নতুন গঠিত ঝাড়গ্রাম জেলাটির দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রশাসনিক পরিকাঠামো সম্পূর্ন ভাবে জেলা গঠনের পাঁচ বছর পেরিয়েও সম্পূর্ন করা যায়নি‌। কোথাও কোথাও একজন ডিএম বা প্রশাসনিক উচ্চ পদস্থ কর্তার ঘাড়ে দু-তিনটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এই জেলাগুলিতে প্রশাসনিক স্তরের পরিষেবা গুলোও মানুষ যথাযথ ভাবে পেতে ব্যার্থ হচ্ছে। আবার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া জেলা ভাগের সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের জনগনের ভোগান্তির কারন বাড়াবে না তো? বরং ভোগান্তির সম্ভাবনাই বেশি থেকে যাচ্ছে লাভের থেকে বেশি। অন্তত অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলছে।
 
দঃ২৪ পরগনা জেলা ভাগের নতুন রুপরেখা ও কিছু প্রশ্ন

এখনও সরকারি কোন ও নির্দেশিকা প্রকাশিত না হলেও যতটুকু দঃ২৪ পরগনা জেলা ভাগ নিয়ে জানা যাচ্ছে তাতে এই জেলাকে  তিনটি টুকরে ভাগ করা হবে। আপাতত ২৯টি ব্লক, ৭টি পৌরসভা, ৩১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৫টি সাব ডিভিশান এবং ৩৩টি পুলিশ স্টেশন নিয়ে গঠিত এই দঃ২৪ পরগনা জেলা। এর মধ্যে ৩১টি বিধানসভা এবং ৪টি লোকসভা আসন আছে বর্তমানে। জেলার নতুন ভাগ নিয়ে সংবাদ মাধ্যম মারফত যেটুকু শোনা যাচ্ছে তাতে তিনটি জেলা তৈরি করা হবে। যার মধ্যে বারুইপুর, সুন্দরবন ও ডায়মন্ডহারবার তিনটি জেলা হয়ে দ: ২৪ পরগনা জেলা তিন টুকরো হবে। এর মধ্যে কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, গঙ্গাসাগর, মথুরাপুর, রায়দীঘি, মন্দির বাজার এগুলো সুন্দরবন জেলার আওতায় আসবে বলে শোনা যাচ্ছে। অন্য দিকে কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী যাচ্ছে বারুইপুর জেলার মধ্যে। আর প্রশ্নের উৎপত্তি এখান থেকেই শুরু হয়। কারন সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলের কিছু কিছু অংশ ব- দ্বীপ সমন্বয়ে গঠিত কুলতলি, গোসাবা, ক্যানিং ও বাসন্তীরর মধ্যে অবস্থিত। এগুলো সুন্দরবন জেলা থেকে বাদ পড়ার অর্থ সুন্দরবনের একটা বড় অংশকে সুন্দরবন থেকে বাদ দেওয়া। যা সুন্দরবন নামটির অসম্পূর্নতারই প্রকাশ ঘটাবে। ফলে সুন্দরবনের সমস্ত সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হবে সুন্দরবনের একটা বড় অংশ। এর সাথে সাথে সুন্দরবনের সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত হবে সুন্দরবনের এই অংশগুলি। আর এটা হলে সুন্দরবনের একটা বড় অংশকে অবলীলায় ব্যাবহার করা যাবে কর্পোরেটের স্বার্থে। জঙ্গল কাটা হবে যথেচ্ছ ভাবে। ট্যুরিসিমের নাম করে জন বসতি উচ্ছেদ করতেও বাধা থাকবে না। ট্যুরিসিমের নাম করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংশ করতে অসুবিধা হবে না। কারন সুন্দরবনের বাইরের অংশ হয়ে যাবে এই এলাকাগুলো। তাই যদি সত্যিই কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিংকে আলাদা করা হয় সুন্দরবন থেকে তাহলে সেটা সুন্দরবন ধ্বংসকারী একটি পদক্ষেপ হবে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সর্বপরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে লকডাউন, আমফান ও ইয়াসে কর্মহীন হয়ে পড়া সুন্দরবনের বহু মানুষ যারা অনন্যপায় হয়ে মাছ, কাঁকড়া ধরে নতুন করে জীবিকা নির্বাহের পথ বেছেছে। একদিকে নোনা জলে জমি নষ্ট হয়েছে, পুকুর নষ্ট হয়েছে। আবার বহু মানুষ লকডাউনে কাজ হারিয়েছে। সেখানে এখন ভরসা কেবল নদীর মাছ, কাঁঙড়া। আর ট্যুরিসিম হলে আগে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অধিকার কাড়া হবে। নদীর পাড়ে ম্যানগ্রোভ কেটে গড়ে উঠবে বড় বড় হোটেল‌। নষ্ট হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। বালি পাচার, ম্যানগ্রোভ পাচার তো এখনও চলে। সেগুলো আরও ব্যাপক পরিমানে বাড়বে। বাড়বে সিন্ডিকেট রাজ। নষ্ট হবে সুন্দরবনের প্রকৃতি দ্রুত হারে। সুন্দরবনে নদী উপকূলে বসবাসকারী আদিবাসীরাও সেক্ষেত্রে উচ্ছেদ হবে। বহু মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়বে। সুন্দরবনের সম্পদ লুটে খাবে কর্পোরেট সংস্থা‌।
   
  
  দঃ২৪ পরগনা জেলার জনজীবন মূলত দুটি বিশেষ বৈচিত্রে বিভাজিত। একটি নদী, সমুদ্র থেকে দূরবর্তী এলাকার জনবসতি আর একটি কোস্টাল এলাকার জনবসতি। দঃ২৪ পরগনা জেলার নদী ও সমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে মেদিনীপুরের অধিবাসী সাঁওতাল, মুন্ডা সহ নানা ধরনের অধিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস বেশি‌। এখানে মানুষের মূল জীবিকা কৃষি ও মাছ, কাঁকড়া ধরে করে জীবিকা নির্বাহ। শোনা যায় ব্রিটিশরা সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করতে ছোট নাগপুর থেকে আদিবাসীদের তুলে আনে সুন্দরবনে। তারপর থেকে দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে এখন তাদের বসবাস স্থল এই সুন্দরবন। হলদিয়া থেকে মেদিনীপুর হয়ে বহু মানুষ বিভিন্ন সময় সুন্দরবনে এসে জনবসতি গড়ে তুলেছে। আবার বিভিন্ন সময় নদী, জঙ্গল পেরিয়ে বহু মানুষ সুন্দরবনে চলে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। এই নদী ও সমুদ্র উপকূলের জনবসতির মধ্যেও কিছু বৈচিত্র আছে। যেমন কাকদ্বীপ, গঙ্গাসাগর, নামখানা, ডায়মন্ডহারবার এগুলো সমুদ্রের পাশে অবস্থিত। এখানে জঙ্গল কম। এখানে বাঘের আনাগোনাও  নেই। এখানে পর্যটন শিল্পও গড়ে উঠেছে। আবার এখানে মৎস্যজীবীরা ট্রলারে করে মাছ ধরে সমুদ্র থেকে। এই এলাকাগুলো থেকে শহরের যোগাযোগও খুব উন্নত। নামখানা ও ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত ট্রেন পথ আছে। এখানে সাধারণ মানুষের আর্থিক আয়ও ভালো। আবার কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী এগুলো নদী বেষ্টিত ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এখানে ঘন জঙ্গল আছে। বাঘের আনাগোনাও লক্ষ্যনীয়।এখানকার বেশিরভাগ মৎস্যজীবিদের সম্বল ছোট ডিঙা বা নৌকা। এরা নদী থেকেই মাছ, কাঁকড়া ধরে খায়। এখানে ট্রলার খুব কম লোকেরই আছে। এই এলাকাগুলোর সাথে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখন্ড গুলির কোনও যোগাযোগ ছিলো না। কিন্তু এখন বেশিরভাগ ভূখন্ডই ব্রীজ দ্বারা যুক্ত হয়েছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এই সব এলাকাগুলিতে এখনও খুব দূর্বল। এখানে ট্রেনের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যাবস্থা অনুন্নত। পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ খুব ভালো হয়নি।এই সব অঞ্চলে ভূ -প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতির পরিমাণও হয় অনেক বেশি। বহু এলাকা আছে যেখানে এখনও পর্যন্ত একটি ব্যাঙ্কও নেই, হাসপাতাল নেই। বিশ ত্রিশ কিলোমিটার জলপথ বা সড়কপথে গেলে তবেই এগুলো পাওয়া সম্ভব। আবার নদীর থেকে দূরবর্তী দঃ ২৪ পরগনা জেলার অংশগুলি শহর ঘেঁষা হবার ফলে এই সব এলাকা গুলো দ্রুত নিজেদের উন্নতি ঘটাচ্ছে। কয়েক বছরে পাল্টে যায় এলাকার চেহারা। জনবসতিও এসব জায়গায় অনেক বেশি। সে অর্থে যদি জেলার বিভাজনও হয় তাহলে এই দুই উপকূলের এলাকা ও উপকূল থেকে দূরবর্তী এলাকা এই বিভাজনকে মাথায় রেখেই এই জেলার বিভাজন করতে হবে। অন্যথায় এই বিভাজন অসম্পূর্ন হবে ও বিকৃতির জন্ম দেবে। যদিও নতুন জেলা গঠনের নামে যা চলে যেনোতেনো প্রকারেনো নামকেবাস্তে একটা জেলা করে অন্য জেলার প্রশাসন দিয়ে আর এক জেলা নিয়ন্ত্রন। সঠিক প্রশাসনিক ও সামাজিক পরিষেবা জনগনকে না দিতে পেরেও জেলা গঠন করে বিস্তির্ন এলাকার জন বসতিকে বিপদে ফেলার প্রচেষ্টা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়। তার পরও দঃ ২৪ পরগনা জেলার ভূ প্রাকৃতিক বৈচিত্র ও জনজীবনে তার প্রভাবকে কেন্দ্র করে দুটি জেলায় ভাগ করাই যায়। একটি নদী ও সমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকা নিয়ে গঠিত জেলা এবং অপরটি বাকি দঃ ২৪ পরগনা জেলা। সেক্ষেত্রে দুটি জেলা হলেই চলে যায়। এর মধ্যে কোস্টাল এলাকা গুলোর মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি এই এলাকাগুলোও পড়তে বাধ্য যদি আলাদা জেলা হিসাবে সুন্দরবন নামে নতুন জেলা আত্মপ্রকাশ করে সেক্ষেত্রে। কিন্তু সেগুলো থাকছে না বলেই এখন শোনা যাচ্ছে। ফলে সুন্দরবনের বিস্তির্ন ভূখন্ড বাদ দিয়েই সুন্দরবন আলাদা জেলা গঠনের প্রচেষ্টা চলছে, এটা কখনও সমর্থযোগ্য হতে পারে না। আর এটা হলে সুন্দরবনের মানুষের জন্যে আরও বিপুল ক্ষতি অপেক্ষা করবে  ইয়াস, আমফান থেকে যে সরকার আদতে শিক্ষা নেয়নি বরং এই ঝড় ঝঞ্ঝা গুলোর প্রতি জনগনের মধ্যে তৈরি হওয়া উদ্বিগ্নতাকে ব্যাবহার করেই সরকার চাইছে সুন্দরবনের একটা বড় অংশকে বিক্রি করে দিতে কর্পোরেটদের কাছে এটা স্পষ্ট। তবে এই প্রচেষ্টা নতুন নয়। বাম আমলেও এই প্রচেষ্টা হয়েছে। সাহারার সাথে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পের জন্য মৌ সাক্ষর হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও সে সময় হয়েছে।আবারও এই নতুন প্রচেষ্টা প্রতিবাদের কন্ঠ দমন করে করতেই নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে জেলা ভাঙ্গার নামে উন্নয়নের ভ্রান্ত ছদ্মবেশে।
     
ইতিমধ্যেই দেউচায় কয়লাখনি প্রকল্পের নামে শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনের প্রচেষ্টা। একই ভাবে অশোকনগরে ওএনজিসি তৈল্য খনি প্রকল্পের প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনের উপর বাঁধা হীন আক্রমন নামার রাস্তা তৈরি হলে আগামী দিনে ব্যাপক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রোখা যাবে না। তাই বাংলার ফুসফুস সুন্দরবন রক্ষায় না এগিয়ে এসে কোনও উপায় নেই। দল মতের উর্ধে উঠে সরকারের নির্দেশিকা আশার আগে থেকেই জনমত গঠন খুব জরুরি এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। যাতে সুন্দরবনের পক্ষে ক্ষতিকর কোনও সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহন করার আগেই জনগনের আওয়াজ জোরালো হয় সুন্দরবন রক্ষার পক্ষে। আশ্চর্যের বিষয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত মৌনতা বা ঘুরিয়ে অগ্রীম সরকারি সিদ্ধান্তে রাবার স্ট্যাম্প মারতে ভূমিকা গ্রহন। এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবন সহ গোটা দক্ষিন ২৪ পরগনার সমস্ত জনগনের উচিৎ এগিয়ে এসে সুন্দরবন ভাঙ্গতে না দেওয়ার পক্ষে আওয়াজ জোরালো করা।

লেখা- শুভ্র

(লেখক অধিকার আন্দোলনের কর্মী)

Post a Comment

0 Comments