ভারতে জলস্তরের সঙ্কট প্রসঙ্গে

প্রীতিলতা বিশ্বাস

প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে ভারতের বিভিন্ন শহরে পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেয়। ২০১৯ এ চেন্নাই শহরে স্কুল কলেজ তো বটেই এমন কি অফিস কাছারিও বন্ধ রাখতে হয়েছিল তীব্র জলসঙ্কটের দরুন।  

ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে নুড়ি-পাথর, বালি এবং বালিপাথরের মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বৃষ্টির জল, নদী, বা অন্যান্য জলাশয় থেকে  জল ভিতরে গিয়ে সঞ্চিত হয়। ভূ-পৃষ্ঠের এই স্তরকে জলস্তর বলা হয়। পৃথিবীর তিন ভাগ জল এবং এক ভাগ স্থল হলেও বেশির ভাগ জলই লবণাক্ত হওয়ার কারণে পানের বা চাষের কাজে ব্যবহারের অযোগ্য। তাই ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরই মানুষের একমাত্র ভরসা। 

ইউনেস্কোর  হিসাব অনুসারে ভারতে সব থেকে বেশি ভূ-গর্ভস্থ জলোত্তলন হয়।  ২০৩০ এর মধ্যে ভারতের ২১টি শহরের ভূ-গর্ভস্থ জল নিঃশেষ হয়ে যাবে।  ১২২ টি দেশের মধ্যে জল সূচকে  ভারত আছে ১২০ নং স্থানে।  ৭৫ শতাংশ মানুষের  বাড়িতে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। ৪৮ শতাংশ বাড়ি পাইপ লাইনে জল সরবরাহ ব্যবস্থার বাইরে পড়ে। এর উপরে জলস্তরের প্রায় ৭০ শতাংশ জলই দূষিত।

কেন এরকম পরিস্থিতি তৈরী হল? 

ভারতে সবুজ বিপ্লব লাগু হবার পর থেকে কোম্পানীর ধান ও গমের বীজ চাষ শুরু হয়। এই চাষে প্রচুর পরিমাণে জল প্রয়োজন হয়, যা মাটি থেকে তোলা হয়। মনে রাখতে হবে এই ভাবে চাষ করা ধান ও গম যখন আমাদের দেশ থেকে রপ্তানী হয় তখন সঙ্গে আমাদের ভূ-গর্ভস্থ জলও ফ্রীতে রপ্তানী হয়ে যায়। অথচ ভারতের দেশজ ধান, গমের বীজের এমন প্রজাতি আছে যা খরা, বন্যা, লবণাক্ত সব পরিবেশে চাষ করে ধান পাওয়া সম্ভব ছিল। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের জলস্তরের দূষণ মাত্রাতিরিক্ত। সব থেকে বিপজ্জনক দূষণটি হল পানীয় জলে আর্সেনিকের  দূষণ। এছাড়াও রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নদী নালার মাধ্যমে বাহিত হয়ে সমুদ্রে পড়ে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রে এলগির পরিমান বৃদ্ধি করেছে যার ফলে সমুদ্রে তৈরী হয়েছে ডেড জোন বা অক্সিজেন বিহীন অঞ্চল।

নাগরিক জীবনে ক্রমাগত জলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিশুদ্ধ জলপানের চাহিদা গৃহস্থালিতে RO Plant এর  প্রয়োজনীয়তা  এবং বিসলেরির মত হাজারো ডিস্টিলড ওয়াটারের চাহিদা এমন এক বাজার তৈরী করেছে যা কোন রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ভূ-গর্ভস্থ জলের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে গত কয়েক দশক ধরে। RO Plant গুলি এক বোতল পানীয় জল বার করতে প্রায় দ্বিগুণ পরিমান জল ড্রেন আউট করে। কোকাকলার জলের ব্যবহার এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। 

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার উপর ভরসা হারানো উচ্চবিত্ত মানুষের একাধিক ফ্ল্যাট কিনে নিজের সঞ্চয়কে সুরক্ষিত করার চেষ্টা রিয়েল এস্টেটের বাজারকে তেজি রাখে। যার ফলে পুকুর, জলা জমি ভরাট হয়ে কংক্রীটের জঙ্গলে ভরে যাচ্ছে শহর, আধা-শহর গুলো।  বৃষ্টির জল মাটিতে সঞ্চিত হবার সুযোগটুকুও পাচ্ছে না।  বনাঞ্চল ও জলাভূমি নষ্ট হবার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে  স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। 

সমাধানের উপায়

CGWA বা সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার অথোরিটির বেশ কিছু গাইড লাইন আছে। যা ঠিক মত লাগু হওয়া প্রয়োজন। 

সব মানুষের পানীয় জল পাওয়াটা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। অথচ সেই জল আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। আর যারা এই পণ্য কিনতে পারছেন তারা জলের অপচয় প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র সচেতন নন। প্রতিটি আবাসন, স্কুল-কলেজ, অফিস এমন কি হাসপাতাল বিল্ডিং এ রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আবশ্যিক হতে হবে, যাতে জল সংরক্ষণ ও জলের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। একক বাড়িগুলিতে জলের অপচয় সম্পর্কে সাবধান হতে হবে।

দেশজ বীজে প্রকৃতিক চাষে ফেরা অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে মানুষের উদ্যোগী হয়ে কৃষক-বিপনক ও উপভোক্তার একটি সরল শৃঙ্খল গঠন করা খুব প্রয়োজন। যা কৃষকের শ্রমের মূল্যকে নিশ্চিত করতে পারে। 

প্রাকৃতিক জলাশয় বুজিয়ে গজিয়ে ওঠা ইমারতকে উন্নয়নের মডেল হিসাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যে উন্নয়ন প্রকৃতি পরিবেশকে নষ্ট করে তা মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যত--কোনও প্রজন্মকেই সুস্থিত করতে পারে না।

কোকা কলা, বিসলারি ইত্যাদি কোম্পানীর জল-লুঠ বন্ধ করতে হবে।

সব শেষে বলি, মানুষকে সচেতন হতে হবে। প্রতিটি পৌরসভা ও পঞ্চায়েত অঞ্চলে  ভূ-গর্ভস্থ জলের ম্যাপ অঞ্চলবাসীর গোচরে আসা প্রয়োজন। অঞ্চলবাসীদের নিজেদের যৌথ সম্পদ অপচয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

Post a Comment

0 Comments