রূপায়ণ ভট্টাচার্য
১৯৩৬ সালে আজকের দিনেই ইন্ডিয়া স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস নাম বদলে হয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। এমনই এক ৮ জুন। খবরটা দেখে হঠাৎই মনে পড়ছে সাইদা বানোর কথা। দেশের প্রথম মহিলা খবর পড়িয়ে। সোজা ইংরেজিতে যাঁদের এখন বলে নিউজ রিডার। এখন তিনি থাকলে হয়তো লোকে তাঁকে বলত আরজে সাইদা।
এই যে এখন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে এত চর্চা, মুসলিম মেয়েদের শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা নিয়ে এত গবেষণা, রেডিও জকিদের নিয়ে এত কথাবার্তা---যাঁরা এই ‘চর্চা’ ও ‘গবেষণা’ করেন, নাম শুনেছেন সাইদা বানোর? সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকা এই মহিলার কথা? ভদ্রমহিলা কাজ করতেন প্রথমে লখনউ, পরে নয়াদিল্লি রেডিও স্টেশনে। দুটো জায়গাতেই ইতিহাস দেশের প্রথম মহিলা রেডিও জকির। নারীবাদ, নারীবাদীদের নিয়ে এত লেখালেখি—তাঁকে নিয়ে লেখালেখি তো পড়িনি অনেকদিন। আমাদের ছোটবেলায় বাংলার ঘরে ঘরে যে দুজনের নাম অতি পরিচিত ছিল, সেই নীলিমা সান্যাল, ইভা নাগদের কথাও কেউ বলে না।
অল ইন্ডিয়া রেডিওর লখনউ স্টেশনে বসেই বেগম আখতার একদিন বন্ধু সাইদা বানোকে বলেছিলেন, ‘বিত্তা, তুই আমাকে প্লিজ ইস্তিয়াক আব্বাসি সাহাবের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দে। আমি ওঁকে বিয়ে না করলে মরে যাব।’
সাইদা ১৭ বছরেই এক বিচারকের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন দ্বিধাহীন। ওই আমলে একা একা গাড়ি চালাতেন। সিঙ্গল মাদার। সমাজের রক্ষণশীলতার পর্দা উড়িয়ে দিতেন সব সময়। দিল্লির তিনবারের মেয়র নুরুদ্দিন আমেদের সঙ্গে লিভ ইনে ছিলেন পঁচিশ বছর। নুরুদ্দিনের ছিল বিদেশিনী স্ত্রী। ১৯৪৭ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওয় উর্দু খবর পড়ার সময় ভারত ও পাকিস্তানে তীব্র আলোচনা হত সাইদাকে নিয়ে। পাকিস্তানিরা চিঠি লিখত, কেন তুমি পাকিস্তানে এলে না? ফিরে এসো। ভারতীয়রাও একই ভাষায় লিখত, ‘কেন তুমি পাকিস্তানে যাওনি’। আবার অজস্র ভক্তদের চিঠিও আসত। অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে চিঠিও দিতেন।
সাইদা না থাকলে বেগম আখতার কি বেগম আখতার হতেন? লখনৌতে আখতারি বাইকে অভিজাত সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরার কাজটা করেছিলেন সাহিদা। তাঁর যাবতীয় যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে। নইলে তাঁর আগে আখতারি বাইকে স্রেফ একজন বাঈজি হিসেবেই দেখত লখনউ। বন্ধু আখতারির প্রেমের আকুতি জেনে তাঁর অকুতোভয় মেজাজে সোজা ইস্তিয়াক আব্বাসিকেই ফোন করেন সাইদা। পরদিনই চা খেতে ডাকেন। সেখানে আব্বাসিকে সোজা প্রস্তাব দেন আখতারি বাইকে বিয়ে করার। প্রস্তাব মানে অনুরোধ নয়, আদেশ। এতটাই মূর্তিময়ী ব্যক্তিত্বময়ী তিনি সে সময়ের লখনউয়ে।
বেগম আখতারের বিয়েটা ১৯৪৫ সালে। কেন এমন প্রেমিক বেছেছিলেন দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ গজল গায়িকা, সে প্রশ্নটার কোনও উত্তর মেলেনি। তবে প্রেম যে অবুঝ, এটাই বোধহয় বড় সত্যি। বিয়ের পর আখতারি বাইয়ের গান গাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন স্বামী। একেবারে কামাল আমরোহী-মীনা কুমারীর গল্পের মতো যেন। তখনই তিনি সিনেমা ও গানে স্টার, এই অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন অবসাদগ্রস্ত বেগম। তাঁকে গানে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা ছিল সাইদার। সারা ভারত কৃতজ্ঞ থাকবে তাঁর কাছে।
সাইদা নিজে যখন বিয়ে করেছিলেন, ইচ্ছে ছিল না। লখনউতে থাকার সময় বিচারপতি আব্বাস রাজা তাঁকে প্রেমপত্র পাঠাতেন, বদলে তিনি পাঠাতেন একটা উপন্যাসের নাম। যা তিনি সেই সময় পড়ছেন। তিনি তো পড়তেই চেয়েছিলেন। ভোপালে জন্ম। সেখানে দেখেছেন, মেয়েদের স্বাধীনতা। পরপর চারটে প্রজন্ম নারীরা শাসকের ভূমিকায় ছিলেন সে শহরে। সাইদা তাই বাবাকে চার পাতার একটা চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলেন, এখন বিয়ে করব না, পড়ব। বাবা শোনেননি। বন্ধু বেগম আখতারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। তিনিই চেয়েছিলেন বিয়ে করতে। অথচ দুজনেরই জীবনের বৈবাহিক জীবন যেন গজল হয়ে গেল।
কত লোক সমীহ করতেন সাইদাকে। তাঁর কাছে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত শুধু শুনেছিলেন, তিনি রাজধানীর অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে কাজ করতে চান। ডিভোর্স হয়েছে তখন। আর লখনউ থাকতে চান না। কথাটা শুনেই বিজয়লক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলেন সেখানকার এক কর্তাকে। তিনিও চাইতেন, মেয়েরা স্বাধীন ভাবে কিছু করুক। কদিনের মধ্যে নিয়োগপত্র এসে যায় সাইদার।
স্বাধীনতার ৫ দিন আগে, ১০ অগস্ট নয়াদিল্লিতে পা রাখা তাঁর। ১৩ অগস্ট প্রথম খবর পড়া। তাঁর আগে নয়াদিল্লির রেডিও বা বিবিসিতে কোনও মহিলাকে খবর পড়ার জন্য চাকরি দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতা দিবসের উর্দু খবরে ছিল সাইদার উজ্জ্বল উপস্থিতি। খাবার নিয়ে যেতেন সকালে। সে খাবার রাখা থাকত গাড়িতে। মাঝে মাঝে এসে খেতেন। তখনকার দিনে অনেকে বলতেন, সাইদা খবর পড়ার আগে চুড়ির শব্দ শুনতে পেতেন শ্রোতারা। সেটাই একটা ইঙ্গিত—মহিলারা খবর পড়ছেন।
স্বাধীনতা দিবসে খবর পড়লেও গান্ধী হত্যার দিন তাঁর গলা আর শুনতে পাননি শ্রোতারা। কেন? খবরটা শুনে সাইদা এত কেঁদেছিলেন, তাঁর খবর পড়ার অবস্থা ছিল না। তাঁর সঙ্গে শিফট পাল্টে নেন এক সতীর্থ।
নেহরুর সঙ্গে সাইদার ব্রেকফাস্ট পর্বটির গল্প চমৎকার। তাঁর উর্দু আত্মজীবনী ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন তাঁর নাতনি। সেখানেই ঘটনাটা পড়া। সাইদা তখন রেডিওর স্টার নিউজ রিডার। ডিউটির মাঝে গল্প করছেন সতীর্থদের সঙ্গে। নেহরু এসে বলেছিলেন, ‘তোমরা এত সকালে এসেছো। খাওয়াদাওয়া হয় না ভালো করে। একদিন তিনমূর্তি ভবনে চলে এসো। ব্রেকফাস্ট করবে। ব্রাউন ব্রেড খাওয়াব। বাড়িতে তৈরি ব্রাউন ব্রেড।‘’
তিনমূর্তি ভবনের একেবারে উপর তলায় সামনের বারান্দায় নেহরুর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট। সেখান থেকে মুঘল গার্ডেন দেখা যাচ্ছে। নেহরু তাঁদের সবাইকে ব্রাউন ব্রেডে বাটার মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। ওয়েটারকে বারবার বলছিলেন, এটা আনতে ওটা আনতে। টোস্টের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন পিপার-সল্ট। জানতে চাইলেন, এমন রুটি কখনও তোমরা খেয়েছো? সাইদা মাথা নাড়ালে নেহরু তাঁকে আর একটি টোস্ট বানিয়ে দেন।
ওদিকে সাইদা তখন উসখুশ করছেন। দুই ছেলে আসাদ ও সইদকে এনেছেন সঙ্গে। বিশাল পরিবেশে কোথাও তারা খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের দেখতে না পেয়ে সাইদা উদ্বিগ্ন। তিনি চাইছেন, ছেলেরা এই দৃশ্যটা দেখুক। চিরদিন মনে রেখে দেবে স্মৃতিতে।
তোমায় এত উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে? প্রশ্নটা করেছিলেন নেহরু।
আমার ছেলে হারিয়ে গিয়েছে।
সাইদার এক ছেলে একবার উদ্বাস্তু শিবিরে হারিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। ছেলেদের নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন থাকতেন।
কত বয়স তোমার ছেলের? জানতে চাইলেন নেহরু।
এগারো।
নেহরু হেসে বললেন, ‘এগারো বছরের ছেলে এখানে হারিয়ে যাবে না। এখানেই আসবে। তুমি চা খাও। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওঁরা উঠে আসছেন। নেহরু ফের তাঁকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না। ওকে পেয়ে যাবে। এগারো বছরের ছেলে হারাতে পারে না।‘’
এখন নারী নিউজ রিডারদের খবর পড়া নিয়ে হইচই হওয়ার প্রশ্নই নেই আর। খবরের আগে চুড়ির সামান্য শব্দের কথা ভাবাও তো হাসির খোরাক। তবে আমাদের দেশ এমনিতে আজকাল যেন বহু ক্ষেত্রে ফিরে যাচ্ছে পুরোনো জমানায়। সেই সময়গুলোর কথা ভাবলে, বোঝা যাবে সাইদা বানোদের লড়াই করে ওরকম জনপ্রিয়তার মণ্ডপে উঠে আসা কত কঠিন ছিল। আজ ৮ জুন। বিভিন্ন ভাষায় এরকম আরও অজস্র সাইদা বানোদের স্মরণ করার দিন অল ইন্ডিয়া রেডিওর। তারা করবে তো?
(লেখাটি ফেসবুক থেকে লেখকের অনুমতিতে প্রকাশিত)
আরো আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করুন।
0 Comments