সুনীতি মুখোপাধ্যায়
চে-র মৃত্যু আমাকে অপরাধী করেনি কখনো। স্টেথো তুলে রেখে রাইফেল হাতে যখন থেকে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চে, তখন থেকে তিনি নিজেও জানতেন পরিণতির কথা। তিনি জানতেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে একদিন নিজেকেও 'ধ্রুবতারা' হয়ে যেতে হবে। তবু চে পিছপা হননি কখনও। কোথাও একটা ভরসা ছিল তাঁর মধ্যে-- ভরসা ছিল তিনি না থাকলেও তার আদর্শটা থেকে যাবে। তাই বোধহয় আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরা যখন তার দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালাতে ইতস্তত বোধ করছে তখন চে বলে উঠেছিলেন ভয় না পেয়ে গুলি চালাও, তোমরা আমাকে মারতে পারো কিন্তু আমার আদর্শকে না। এহেন চে গেভারার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে না। যে মানুষটার কাছে আদর্শ শুধুমাত্র মন্ত্রের মতো কয়েকটা জারগন ছিল না, যে মানুষটার কাছে আদর্শের অর্থ ছিল লালন-পালন-যাপন, যে মানুষটা তার পরিণতির কথা জেনেও বিন্দুমাত্র পিছপা না হয়ে মন্ত্রিসভার গদি ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুতে আমার অপরাধবোধ জাগেনা; বুক টানটান করে রুখে দাঁড়ানোর শপথ জাগে মনে।
যখন দেখি আজকের এই ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায় চে-র বাজার টক্কর দিচ্ছে বড় বড় ব্র্যান্ডকেও, যখন দেখি আপাদমস্তক ফ্যাসিস্ট সমর্থক বুকে চের ছবি নিয়ে মিছিলে হেঁটে চলেছে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে, যখন দেখি টাটা-সালেম-জিন্দালদের সঙ্গে 'অবৈধ' সম্পর্ক রেখে চলা শাসকশ্রেণীর পার্টি চের ঝান্ডা হাতে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তুলছে, যখন দেখি পুঁজিবাদী-স্বৈরাচারী-ধান্দাবাজ শাসকশ্রেণীর পার্টির লেজুড়বৃত্তি করা ছাত্র-ছাত্রী সংগঠন চে'কে 'ক্রাশ' বলে ডাকছে তখন আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমার অপরাধ জাগে এই অযথা নিষ্ঠুর সেলিব্রেশনে।
যেভাবে ঋত্বিক ঘটকের বোধ হারিয়ে গিয়ে থেকে গেছে শুধু ভবঘুরে মাতাল ইমেজারিটা; যেভাবে নবারুণ-এর ভাবনার জগৎটা চাপা পরে থেকে গেছে শুধু খিস্তিগুলো; যেভাবে রবীন্দ্রনাথের দর্শন ভেসে গিয়ে থেকে গেছে শুধু মূল ভাবের অপভ্রংশ একটা বিকৃত রূপ; ঠিক সেই একইভাবে চে'র দ্রোহটা হারিয়ে গেছে সেই কবেই। শুধু থেকে গেছিল হাভানো ঠোঁটে ধরা ওই ছবিটা। ক্রমে সেই মুখটাও ঝাপসা হচ্ছে। তার বদলে ক্রমেই জায়গা দখল করছে চুরুট আর বেরেট ক্যাপ।
ধনতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা চের মতো একজন ব্যক্তিকে বেচে যে অতিরিক্ত মুনাফা তোলার চেষ্টা করবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হয়েছেও তাই। আদর্শ নৈতিকভাবে পুঁজিতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবী আরনেস্ত চে গেভারে আজকের পুজিঁবাজারে নিজেই একটি বড় প্রোডাক্ট। অস্বাভাবিক তাদের ভূমিকা, যারা চেকে আদর্শ মনে করে (?) তার ঝান্ডা উড়িয়েই সমানে ধনতন্ত্রের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলেছে।
চের বলিভিয়ার ডাইরির ভূমিকা অংশে ফিদেল কাস্ত্রো লিখছেন-- "...মেকি বিপ্লবী, সুবিধাবাদী, যত রকমের বাগাড়ম্বরকারী, যারা নিজেদের মার্কসিস্ট, কমিউনিস্ট অথবা আরও কোনো গালভরা নামে পরিচয় দেয় হয়তো তারাও এই ডায়েরী (চে গেভারার ডাইরী) চেপে রাখত। তারা চে-কে ভ্রান্ত এবং হটকারী বলতে ইতস্তত করেনি। যখন তারা তাঁর সম্পর্কে নম্রভাবে বলেছে তখন তাঁকে আদর্শবাদী বলে বর্ণনা করে তাঁর মৃত্যুকে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী সশস্ত্র যুদ্ধের শেষসঙ্গীত বলে কাব্য করেছে। আবার, তারা তারস্বরে বলেছে "চে যদি এই চিন্তাধারার পরম উদগাতা হন, অভিজ্ঞ গেরিলা যোদ্ধা হয়েও গেরিলা যুদ্ধেই তিনি নিহত হয়ে থাকেন এবং তাঁর আন্দোলনে যদি বলিভিয়া মুক্ত না হয়ে থাকে, তাহলে প্রমাণিত হয় তাঁর পথ কত ভুল ছিল!" চে-র মৃত্যুতে এই হতভাগ্যদের কতজন খুশি হয়েছে! তারা এই চিন্তা করে লজ্জিত হয়নি যে তাদের বক্তব্য ও যুক্তি চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র ও সাম্রাজ্যবাদের কথার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।"
0 Comments