শুভ্র মল্লিক
দুয়ারে মদ, দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রেশনের পর এবার এসেছে দুয়ারে পরিবেশ দূষণ। দেখলে মনে হবে পশ্চিমবঙ্গ যেন হরিয়ানা। হুগলির বিস্তীর্ণ কৃষি জমির অবস্থা এখন অনেকটা হরিয়ানারই মতন। কিন্তু কোথাও কোনও খবর নেই। সংবাদ নেই। সব চুপ। নিরবে বাড়ছে দূষন। আর এই দূষিত কৃষি ক্ষেত্র দেখলে মনে হবে ইউক্রেন ও রাশিয়া বিধ্বস্ত কিয়েভ যেনো এখন হুগলির বিস্তীর্ণ কৃষি জমি। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে এটা কি করে হলো? তার চেয়েও বড় কথা এতো বড় ঘটনা এতো নিরবে কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে? কি বা সেই ঘটনা?
আমরা সকলেই জানি হুগলি হলো পশ্চিমবঙ্গের পুরানো শিল্পাঞ্চল। মূলত পাট শিল্পের জন্য বিখ্যাত।যখন আইটি সেক্টর আসেনি তখন কলকাতার অনতিদূরে বিধান চন্দ্র রায়ের হাতে গড়া এই শিল্পাঞ্চলই কলকাতা সহ আশেপাশের বহু মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে। আর এই শিল্পাঞ্চলের ঠিক পাশেই অবস্থিত হুগলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আছে ত্রিফসলা কৃষি বেল্ট। এখানকার উর্বর জমিতে উৎপাদিত পাটই পাট শিল্পের ব্যাক বোন। এক সময় এখানেই সিঙ্গুরে কৃষকদের আন্দোলনের চাপে পিছু হটতে হয় পূর্বতন সরকারকে। এই কৃষি বেল্টই পশ্চিমবঙ্গের বিপুল খাদ্যের চাহিদার বড় অংশ পূর্ন করে। এখানেই ধান, আলু, পাট, তিল সহ একাধিক শষ্য উৎপন্ন হয় সারা বছর। এখানকার পাটই শিল্পাঞ্চলে ব্যাবহৃত হয়। এখানকার আলু সারা পশ্চিমবঙ্গের আলুর চাহিদা পূরণ করে। নভেম্বরে শীত পড়তে শুরু করলেই ধান কেটে শুরু হয় আলু বসানোর কাজ।
অতীতে ধান কাটতে কাস্তের বহুমুখী ব্যাবহার থাকলেও হালে বছর তিনেক হার্ভেস্টার মেশিনের ব্যাবহার শুরু হয়েছে এখানে ব্যাপকভাবে। এগুলোর প্রচলন হরিয়ানা, পাঞ্জাবে আমাদের দেশে বহু বছর ধরেই প্রচলিত আছে। আর হার্ভেস্টার মেশিনে ধান কাটলে ধান কাটার খরচ ও শ্রম উভয় অনেক স্বাশ্রয় হয়। কিন্তু সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। চলিত ভাবে ধান কাটার পর উৎপন্ন খড় গবাদি পশুদের খাওয়ানো হয়, ঘর ছাওয়ার কাজে লাগে। কিন্তু হার্ভেস্টার মেশিনে ধান কাটার পর উৎপন্ন খড় এই প্রচলিত ব্যাবহারিক ক্ষেত্রগুলোতে কাজে লাগে না। তাই এই খড়গুলো চাষীরা পুড়িয়ে ফেলে পুনরায় চাষের প্রস্তুতি নেয়।
২০১৯ সালে এরকম ভয়াবহ ঘটনা হরিয়ানাতেও হয়।ফল স্বরূপ দিল্লি জুড়ে ব্যাপক দূষণ হরিয়ানা থেকে ছড়িয়ে পড়ে। শীতকালে কুয়াশার চাদোরে মুড়ে যায় দিল্লি কয়েক দিনের জন্য। একই ঘটনা এখন পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যাচ্ছে হুগলির কৃষি বেল্টে কয়েক বছর যাবৎ। বছর তিনেক হলো ব্যাপক পরিমানে হুগলির চাষিরা ধান কাটতে ব্যাবহার করছে এই হার্ভেস্টার মেশিন। ফল স্বরূপ ব্যাপক দূষণ ছড়াচ্ছে হুগলি সহ আশেপাশে। কলকাতাও এর দ্বারা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন হুগলিতে ঘরে ঘরে চলছে আলুর বীজ তৈরির কাজ। ধান উঠেছে গোলায়। আর হার্ভেস্টার মেশিনে কাটা ব্যাবহার অযোগ্য খড় দ্রুত পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে। আইনগত এভাবে খড় প্রকাশ্যে পড়ানো যায় না। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবলীলায় চলছে এই কাজ হুগলির কৃষি বেল্টে সর্বত্র। এর প্রভাব আরও ভয়াবহ যে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
টেকনোলজির গতি কেউ জোর করে রুদ্ধ করতে পারে না। একথা যেমন সত্য, তেমন নতুন টেকনোলজি সৃষ্ট নতুন সমস্যা নিয়ে দ্রুত ভাবনা সরকারকে ভাবতে হয়। অতীতে আমরা দেখেছি কম্পিউটার আসা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর আন্দোলন হয়েছে। কারন কর্মচ্যুতি হবার আশঙ্খা। কিন্তু পরে দেখা গেছে কম্পিউটার সম্পর্কে অজ্ঞ বহু সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কর্মচারীরা কম্পিউটারের ব্যাবহার শিখেছে কাজের সুবিধার্থে। এক্ষেত্রে তাদের সময় ও ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাষিদের আজ সচেতন করতে কোনও দায়িত্বশীল ভূমিকাই সরকার দেখাচ্ছে না। সব জেনে বুঝে আইন করেই দায় ঝেড়ে ফেলেছে সরকার। কেউ প্রতিবাদ করলে আইন এর উপস্থিতি বোঝানো হয় মাত্র। কিন্তু তার কার্যকারি প্রয়োগ নেই নির্বাচনী স্বার্থ মাথায় রেখে। হার্ভেস্টার মেশিনের ব্যাবহার কমানোও আজ সম্ভব নয়। কিন্তু চাষিদের বিকল্প রাস্তা সরকার নিশ্চিত দেখাতে পারতো। এখন বিকল্প পথ কি কি হতে পারে এই সমস্যা সমাধানে?
১) পৃথিবীতে প্রচলিত শক্তিগুলোর পরিমান সীমিত।তাই বিকল্প শক্তির খোঁজ জনগনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে সোলার এনার্জি নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও হচ্ছে। আবার প্রচুর পরিমান ধান চাষ হবার ফলে পশ্চিমবঙ্গ বায়ো মাস এনার্জির প্রবল সম্ভাবনাময় বিকাশ করতে সক্ষম। হুগলিতে তো এর প্রচুর সম্ভাবনা আছেই। ইতিমধ্যে কয়েকটি রাইসমিলে হুগলিতে বায়োমাস এনার্জি তৈরির প্ল্যান্ট আছে। বায়ো মাস এনার্জি তৈরিতে ব্যাবহার অযোগ্য খড়ের ব্যাপক ব্যাবহার করে পরিবেশ দূষণহীন বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে এবং বিদ্যুৎ খরচও স্বাশ্রয় করা যেতে পারে। আর এর ফলে ব্যাবহার আযোগ্য খড় বেচে চাষীরাও কিছু উপার্যন করতে পারে।
২) বায়ো কোল তৈরি করতেও ব্যাবহার অযোগ্য খড় ব্যাবহার হতে পারে। এখন বায়ো কোলের ব্যাবহার ও বাড়ছে। এতে চাষীরাও লাভবান হবে।
৩) জৈব্য সার তৈরিতেও এই খড় ব্যাবহার করা যেতে পারে। এতেও কৃষকদের লাভ হবে।
এই সমস্ত উদ্যোগ কৃষি দফতর, WEBREDA, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজ্য সরকারকে সম্মিলিত ভাবেই গ্রহন করতে হবে। আর এই উদ্যোগ গ্রহন করলে কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগও মিলবে। সরকার মনে করলে বিকল্প পথ দেখিয়ে কৃষকদের পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। শুধুমাত্র লোক দেখানো আইন করে খড় পোড়ানো যাবে না এটা বলেই আজ দায় সারা ভূমিকা নেওয়া যায় না। ব্যাপক পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা আজ মানব সভ্যতার সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে সরকার কোনও ভাবেই পরিবেশ দূষণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে প্রমোট করতে পারে না। সরকার চাক না চাক সচেতন জনগন, গন সংগঠন, রাজনৈতিক দল গুলোকে এ নিয়ে লড়াইয়ে নামা জরুরি ঘুমন্ত সরকারের ঘুম ভাঙ্গাতে। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে এসেছে সরকার ঘুমোলে জনগনকে জাগানোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
ছবি: হুগলি জেলার তারকেশ্বরের নিকটস্থ বারিখন্ড স্টেশনের কাছে অবস্থিত চাঁদপুরের কৃষি জমি থেকে তৈরি ভয়াবহ দূষণের ছবি।
0 Comments