পাঠ প্রতিক্রিয়া: ‘বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা কমরেড সিরাজ সিকদার ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম যুদ্ধ’

আব্দুল মমিন

আমার চোখে "বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা কমরেড সিরাজ সিকদার ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম যুদ্ধ" বইটি। আমি মনে করছি সামগ্রিকভাবেই বইটি সম্পর্কে লেখা উচিত। সেই চিন্তা থেকেই লিখছি। বইটি মূলত লেখকের ৭১ কেন্দ্রিক নিজের আত্মজীবনীমূলক বই। এখানে তিনি ৭১ সালে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ন ইতিহাস, সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় লেখক ঝালকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগ ছিলেন। ঘটনার দিক দিয়ে বইটি প্রায় তিনটি খন্ডে বিভক্ত। প্রথমাংশ জুড়ে তিনি ৭১ সালে ঢোকার আগে তার সেকেন্ড অফিসার হবার কাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কও তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অংশ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন বা সিরাজ সিকদার বা সর্বহারা পার্টি কে ঘিরে। আর তৃতীয়াংশ হচ্ছে লেখকের ভারত গমন পরবর্তী অংশ। 

লেখক এ সমাজেরই একজন মানুষ। ৭১ কে তিনি দেখেছেন সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। অর্থাৎ এখানে একটি কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে ইতিহাস চর্চা করেন নি, কারন তিনি কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লোক নন। তার মধ্যে একটি দেশপ্রেমিক চেতনা বিরাজমান ছিল। যার কারনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গিয়ে (দেশপ্রেমিক চেতনা ছিল বলেই) দেশীয় জনগণকে যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছিলেন, হ্যাঁ সেটি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে একত্রিত হয়েই।

তো কাহিনীর এই দ্বিতীয় অংশে ঢোকার মুহূর্তেই তিনি সুন্দরভাবে পরিচিত হচ্ছেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে। লেখক গল্পের ছলে তুলে ধরছেন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরাই প্রথম জাতীয় শত্রু খতম করছে। এই খতম করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে দিচ্ছে। এমনকি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সমগ্র জনগণকে লড়াই করার পদ্ধতি, শত্রু মিত্র চিহ্নিত করে পথ দেখাচ্ছেন। তা দেখে লেখক নিজেও উজ্জীবিত হচ্ছেন। 

লেখক একদিকে যখন টুকটাক ট্রেনিং দিচ্ছে তখন 'পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন' ঐক্যফ্রন্ট করতে আসে। যার সাথে যুক্ত ছিল লেখক নিজে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ। শ্রমিক আন্দোলন যেসব দাবি হাজির করে - "পাকিস্তানি আর্মিদের যুদ্ধ করে তাদের পরাভূত করা, পাকিস্তানি দালাল ও সহযোগী অর্থাৎ জাতীয় শত্রুদের খতম করা। এমনকি যারা এ সমস্ত কাজের বিরোধিতা করবে তাদের খতম করা" (পৃষ্ঠা ৮১ )। এটি লিখিত পেশ করে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নয়। ঐ দাবিতে ঐক্যফ্রন্ট হয়। এমনকি এই ঐক্য যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের পছন্দ হয় নাই, অর্থাৎ তারা একটি গোপন দলের সাথে কাজ করবে এটা তারা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন নাই বলেই লেখক উল্লেখ করছেন (পৃষ্ঠা ৮২)। যেটি পজিটিভ দিক। এমনকি এপ্রিলের মধ্যেই বরিশালের এমএনএ আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম মঞ্জু সব ছেড়েছুঁড়ে ভারতে পলায়ন করে, যদিও বলা হচ্ছিল তিনি ভারত থেকে অস্ত্র আনতে গেছেন। দেখা গেছে সে আর ফেরত আসেনি (৭৪,৭৫,৯৪)। একই চিত্র ঝালকাঠি আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ আলী ও বেলায়েত হোসেনের ক্ষেত্রেও। ঐক্যফ্রন্ট হবার পরই সেখান থেকে নিজ নিজ আত্মীয়ের বাড়ি চলে যায় তারা (পৃষ্ঠা ৮২)। লেখক দেখছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এভাবে পালাচ্ছেন যুদ্ধ থেকে। বাস্তবে একমাত্র পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনই মাঠে থেকে যুদ্ধ করছে। এইটাও পজিটিভ। 

এরপর প্রায় ৩৯ দিন লেখক কমরেড সিরাজ সিকদার ও তাদের গোপন গেরিলা ওয়ার্কের মধ্যে ছিলেন। লেখকের সাথের কর্মীরা সবাই সিরাজ সিকদারের প্ল্যান মাফিক ও শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সাথেই কাজ করছে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে। লেখক এইটা জাহিরই করছেন, যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার যাবার জায়গাও ছিল না। কমরেড সিরাজ সিকদারের ওরফে কমরেড সালাম সান্নিধ্যে এসে তিনি ব্যাপক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এইটা হয়েছে কমরেড সিরাজ সিকদারের সংগ্রামের কারণেই। লেখককে কমরেড সিরাজ সিকদার কয়েকবার বিপ্লবী হয়ে যাবারও আহ্বান জানান কিন্তু তিনি তা কর্নপাত করেন নি (পৃষ্ঠা ১১৫..)। হয়তো তিনি সিরাজ সিকদারদের মত বিপ্লবী কষ্টকর জীবনযাপন চান নাই। নিজেকে একটু পজিশনে রেখে দিতে চেয়েছেন। যদি বিপ্লবী হতে চাইতেন তাহলে কমরেড সিরাজ সিকদারের আহ্বানে বিপ্লবী হয়ে যেতেন, কিন্তু সেটি তিনি করেন নি। সাক্ষাৎ যুদ্ধের ময়দান থেকে অন্যদিকে মুভ করার সিদ্ধান্ত নেন (যদিও তিনি ভারত যাবেন এই চিন্তা বা সিদ্ধান্ত আগে থেকেই ছিল বোঝা যায়)। বিপ্লবী না হয়ে তিনি ভারতে যাবার জন্য প্রস্তাব করেন। যদিও তিনি এটা বুঝেছেন, কমরেড সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক লাইন যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া না। তারা সম্মুখে লড়াই করে। এজন্যই তিনি বলেন, ভারত যাওয়া আপনাদের লাইনের সাথে সাংঘর্ষিক। তবুও কমরেড সিরাজ সিকদার তাকে ভারতে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন। লেখক এটি বুঝে যান সর্বহারা পার্টির কমরেডরা অকুতোভয় বীর, তারা মৃত্যু আলিঙ্গন করেই লড়াই করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন বা সিরাজ সিকদার বা সর্বহারা পার্টি এইটা ঘটনার দ্বিতীয় অংশ। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন বা সর্বহারা পার্টিকে ঘিরে এই পর্বটা ছিল একটা হিস্টরিকাল পার্ট। তিনি বিপ্লবী না হলেও বিপ্লবী শহীদ সিরাজ সিকদারকে খুব পজিটিভলি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। আর বোঝা যায় এই পার্ট টায় তথ্যের উপস্থাপনের দিকে কিছু ঝামেলা হয়েছে সেটি তার শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, সংগ্রামকে না বোঝার কারণে। যেমন, তিনি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনকে সহায়তা করছেন, আবার বলছেন মুক্তিবাহিনীর কথা আবার গণবাহিনীর কথাও। আবার নিজেকে গেরিলা যোদ্ধাদের একজন ভাবছেন কিন্তু আদতে তিনি হচ্ছেন না। স্যার স্যারই রয়ে যাচ্ছেন। 

দ্বিতীয় অংশে মোটা দাগে তিনি সর্বহারা পার্টির নামকরন থেকে শুরু করে গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে একাত্মতার জীবনযাপন করেছেন ৩৯ দিন। একাত্মতার জীবনযাপন করলেও যে বিপ্লবী হয়ে যায় না, এখান থেকেও শেখার বিষয় থাকে। লেখক কমরেড সিরাজ সিকদারকে ঘিরে ব্যাপক প্রভাবিত ছিলেন। প্রভাবিত থাকা সত্ত্বেও তিনি সিরাজ সিকদার ও তাঁর সংগ্রাম বুঝতে পারেন নি। তিনি তাদেরকে মুক্তিবাহিনী বলে প্রকাশ করছেন, আবার গণবাহিনীও বলছেন। ইতিহাসে মুক্তিবাহিনী আর গণবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ও পার্থক্য আছে। দুটো এক জিনিস নয়। তো লেখক সংগ্রাম দেখেছেন, ভেবেছেন কিন্তু রাজনৈতিক লাইনে সজ্জিত হন নাই। এটা তার দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা। এইটা নিয়া সমালোচনা থাকতেই পারে। 

পরবর্তীতে তিনি যখন ভারত যান তখন তিনি আবার ভিন্নদিকে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। ক্যাপ্টেন সিপাহ ও ভারতের বন্দনা করেন। দেশ একখণ্ড ভূখন্ড পাবার পর (তথাকথিত স্বাধীন হবার পর) তিনি আবার দেশে ফেরেন এবং দায়িত্ব নেন। এমনকি তিনি বলেন ক্যাপ্টেন সিপাহ্ ও ভারতের কারণেই দেশ স্বাধীন হয়! কিন্তু তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঐ ৩৯ দিনের শিক্ষা তিনি নেন নাই। ৩৯ দিন পরই সিরাজ সিকদার হারিয়ে গেল! এই দিকটিও সমালোচনা হতেই পারে। 

ভারত প্রীতি, আওয়ামি প্রীতি ইত্যাদি নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি কমরেড সিরাজ সিকদারের সংগ্রাম, ঐ সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবীদের ইতিহাস প্রকাশ হওয়া উচিত, সেটি নানাদিক থেকে হওয়া উচিত, এমনকি সঠিকভাবে প্রকাশ হওয়া জরুরি। সান্নিধ্যে আসা ব্যক্তিদের পর্যায় থেকেও বিপ্লবীদের তুলে ধরা জরুরি। এই বইতে কমরেড সিরাজ সিকদার-সর্বহারা পার্টি ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা যে যাই বলুক তার মধ্যে ছিল না (যেমনটা আমরা দেখেছি লাল সন্ত্রাসের মধ্যে)। বিকৃত করতে চাইলে সিরাজ সিকদারকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় যত ধরনের প্রপাগান্ডা আছে তা তিনি আরোপ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। লেখক এই জায়গায় ধন্যবাদ পাবার যোগ্যই। তিনি যেমন সিরাজ সিকদারকে তুলে ধরছেন আবার ভারত প্রীতি ও আওয়ামী প্রীতিও করেছেন। ফলে সিরাজ সিকদার, শ্রমিক আন্দোলন বা সর্বহারা পার্টির বাইরের ঘটনা অথবা ইতিহাসের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক কোনকিছু আমি লেখকের কাছ থেকে নিব না। সিরাজ সিকদার ইতিহাসের সস্তা কোন চরিত্র নয়। আর তাই তো তাকে নিয়ে জলঘোলা কম হয় নাই, ভবিষ্যতেও নিঃসন্দেহে আরো হবে। ৭১ এ কমরেড সিরাজ সিকদার ও তাঁর পার্টির ভূমিকা সবার সামনে আরো খোলাখুলি এবং সঠিকভাবে আসুক। 

আরেকটা কথা, যেহেতু লেখকের নিজের আত্মজীবনীমূলক বই সেহেতু এর নাম ভিন্ন রকমের কিছু হওয়া উচিত ছিল। এরকম কথা বলছেন অনেকে। সেক্ষেত্রে আমিও মনে করি, যদি এমন নাম দেওয়া যেত যেখানে লেখকের আত্মজীবনীও ফুটে উঠতো আবার সিরাজ সিকদারের ভূমিকাও সামনে আসতো, এরকম নাম  বেশি যুতসই ছিল। আবার যদি শুধু নিজের আত্মজীবনী লিখতেন বইয়ের নাম হিসেবে তাহলে সেটায় বাইরে থেকে ৭১ এ সিরাজ সিকদারের ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যেত না, অথবা ভূমিকা যে আছে সেটা আপনি জানতেন না অথবা ৭১ এ সিরাজ সিকদার যে একটা স্তম্ভ এটা নিয়ে আমরা কথাও বলতাম না। আবার লেখক কেন এই নামটাই দিয়েছেন সেটাও জানা দরকার। ব্যক্তিকে তার মত প্রকাশ করতে দিতে হবে, যদি না ব্যক্তি সরাসরি শাসকশ্রেণী হয়। আমি চিন্তার রক্ষণশীলতার বিপক্ষে। কমরেড মাও বলেছেন, শত ফুল ফুটুক, শত চিন্তা দ্বন্দ্বে মাতুক।

সুতরাং এই বইটা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যুদ্ধের পিরিয়ডে লেখকের জীবনে সিরাজ সিকদারই ছিল হিস্টরিকাল পার্ট। আর সেটিকে লেখক যেভাবেই দেখুক পার্টটা হিস্টরিকাল। ঐ হিস্টোরিতে নায়ক সিরাজ সিকদারই। কমরেড সিরাজ সিকদার লাল সালাম!

২৮.০৩.২৩ 
লেখক রাজনৈতিক কর্মী

Post a Comment

0 Comments