কম: শংকর গুহ নিয়োগীর ছত্তিশগড়, বস্তার ও সংলগ্ন আদিবাসী অঞ্চলে আত্মগোপনে থাকা জীবন কাহিনী অবলম্বনে রচিত ১০ অধ্যায়ে “অজানা নিয়োগী” বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। বইটিতে ধীরেশ নামে আত্মগোপনে থাকাকালীন নিয়োগীর বাংলায় লেখা দুটি অপ্রকাশিত ছোট গল্প ও একটি প্ৰবন্ধও সংযুক্ত হয়েছে। পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেন ‘কিউবার বিকল্প কৃষি’ ও প্রকাশিতব্য ‘ফাইট ফর দ্য ফরেস্ট: চিকো মেন্ডিস ইন হিজ ওন ওয়ার্ডস’ বইয়ের অনুবাদক প্রীতিলতা বিশ্বাস।
জি এম আনসার মহাশয়ের লেখা ‘অজানা নিয়োগী’ বইটি বিপ্লবী শঙ্কর গুহ নিয়োগীর ছত্তিশগড়ে অজ্ঞাতবাসে থাকা এযাবৎ অপ্রকাশিত যাপনের বিভিন্ন দিককে সামনে নিয়ে এসেছে। সময়টা ১৯৬৮-৭৭ সাল। জলপাইগুড়ি শহরে বেড়ে ওঠা, মার্কসবাদে বিশ্বাসী শঙ্কর গুহ নিয়োগী কর্মসূত্রে চলে আসেন ভিলাই-এর ইস্পাত কারখানায়। সেখান থেকে ছত্তিশগড়ের গ্রামে—নিজের জীবনচর্চার মধ্যে দিয়ে নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে, তাদের একজন হয়ে অধিকার অর্জনের লড়াই-এ নেতৃত্ব দিয়েছেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী। বস্তুত এই সময়ে তিনি ধীরেশ গুহ নিয়োগী ছদ্মনামে ছত্তিশগড়ের মানুষকে যেমন সংগঠিত করেছেন তেমনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সংগ্রামী হিসাবে। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন—চিনেছেন গাছ-গাছালি, জেনেছেন মানুষের সংস্কৃতি, অদম্য নিষ্ঠার সঙ্গে শিখেছেন গোন্ডি ভাষা। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে নিজেকে ভেঙে-চুড়ে বার করেছেন, যুক্ত হয়েছেন কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে। জি এম আনসারের লেখায় এই বিষয়গুলি খুব প্রাণবন্ত হয়ে উঠে এসেছে।
অনেকটা উপন্যাসের আকারে লেখা বই-এর শুরুতেই দেখি গোন্ডি ভাষায় অনভ্যস্ত ধীরেশের প্রথম বন্ধুত্ব হয় মোংলির সঙ্গে, যে কিছুটা হিন্দি ভাষা জানে। ক্রমে বন্ধুত্ব থেকে সহযোদ্ধা। ছত্তিশগড়ে হলবা, ওঁরাও, নাগবংশী, তেলি, কুর্মি, সতনামী প্রভৃতি আদিবাসী মানুষ প্রায়শই বাধ্য হয় তাদের ছাগল, মুরগী, ডিম, মহুয়ার মদ ভেট হিসাবে সরকারী নানান মাপের কর্মচারীদের দিতে। ‘লামদাহা’ বা বেগার খাটানোর প্রচলনও শোষণের এক পদ্ধতি। ধীরেশ ও তার সাথীরা এই বেগার খাটানোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এর বাইরে ছিল ঠিকাদার, কন্ট্রাকটারদের শোষণ। এদের মাধ্যমেই প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার তেন্দুপাতা, বাঁশ, মূল্যবান কাঠ ট্রাক বোঝাই করে জঙ্গল থেকে বাইরে চলে যায়। বিড়ি বানানোর তেন্দুপাতা সংগ্রহ করা আদিবাসী মহিলাদের অন্যতম জীবীকা, কিন্তু ঠিকাদারদের কাছ থেকে তাদের শ্রমের উপযুক্ত দাম পাওয়া দুরুহ বিষয়। নিয়োগীর অনুপ্রেরণায় দুধিভামার স্ত্রীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দুর্গাবতী বাহিনী। ঠিকাদারদের জোর জুলুমের বিরুদ্ধে যেকোনো জায়গায় দা, ঝাঁটা, বটি হাতে উপস্থিত হয় দুর্গাবতী বাহিনী। লড়াই জারি থাকে।
সংগঠিত করার সময় নিয়োগী খুব সাধারণ কথায় তাদের বোঝাতেন, লড়াই-এ উদ্বুদ্ধ করতেন। যেমন তিনি বলতেন—একথালা ভাত একেবারে খাওয়া যায় না, সেরকমই অত্যাচারীর সব অত্যাচারকে একবারে বন্ধ করা যায় না। ক্রমাগত লড়াই-এর মাধ্যমে নতুন সমাজ গঠনের দুঃখ কষ্টকে তিনি নবজাতকের জন্ম দেওয়া মায়ের কষ্টের সঙ্গে তুলনা করতেন। নিয়োগীর সংস্পর্শে থাকা মোংলু যখন বিদ্রোহের কবিতা পড়ে, ভেত্তিলাচ্চু যখন বক্তব্য রাখে, সংগ্রামে অংশ নেয় তখন আদিবাসী জীবনের পরিবর্তনকে লক্ষ্য করতে পারা যায়।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিথষ্ক্রিয়া যে অন্যান্য প্রাণীর থেকে পৃথক তা নিয়োগী বুঝিয়ে দেন খুব সামান্য কিছু অভিযোজনের উদাহরণ দিয়ে। বিজ্ঞান প্রকৃতিকেই বিশেষ ভাবে জানা, তাই খুব সহজ করে তিনি সাথীদের কাছে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। জ্ঞানের আলো মুক্তির পথকে চিনতে সাহায্য করে। ক্রমে নিয়োগী তার সাথীদের নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে পাঠশালা গড়ে তোলেন।
তিনি নিজে যা শ্রমের মজুরি হিসাবে পেতেন তার থেকে সামান্য কিছু জমিয়ে গরু-ছাগল কিনে বিভিন্ন মানুষকে দত্তক দিতেন। এতে পশুর বাচ্চা জন্মালে তার অর্ধেক মালিকানা পালকের বাকি অর্ধেকের অর্থমূল্য আসল মালিকের প্রাপ্য। আদিবাসী গ্রামের এই অর্থনীতি কোনো লেখা-ঝোকার নিয়মে চলে না। মানুষের সততা আর বিশ্বাস এখানে লিখিত সত্যের ঊর্ধে।
দশম অধ্যায়ে আনসার লিখছেন—'ছত্তিশগড়ে মাত্র কয়েক বছর আগে যারা ঘর থেকে ঘটি হাতে করে নিঃস্ব অবস্থায় এক টুকরো থান কাপড় পরে এসেছিল তারা আজ গোটা ছত্তিশগড়ের মালিক।’ এখানে মনে হতে পারে এই জনগোষ্ঠী কী দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষ? সেই মানুষেরা এখানে কিছু পরিমানে থাকলেও শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে নি। প্রথমে যে ঠিকাদার কন্ট্রাকটারদের কথা উনি বলেছেন, তারা মূলত দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্রিটিশ আমলেই এসব অঞ্চলে এসেছিল সহজে বড়লোক হবার উদ্দেশ্যে। আমরা যদি বস্তার অঞ্চলের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখব ১৮৭৮ এ ব্রিটিশ আইন করে বনাঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে নেয়। রাতারাতি আদিবাসীরা জঙ্গলে অনুপ্রবেশকারী হয়ে যায়। কিন্তু রেলের স্লিপার তৈরীর জন্য কন্ট্রাক্টররা জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি পায়। বনবিভাগ ও এই ব্যবসায়ীরাই এই অঞ্চলের শোষণের যন্ত্র।
নিয়োগী বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়ান, মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেন। এইভাবেই তিনি দেখলেন বেশ কিছু গ্রামে জাত-পাতের সমস্যা গভীরে প্রথিত হয়ে আছে। তিনি এদের সংস্কৃতিকে আরও গভীরে গিয়ে জানার চেষ্টা করেন। সংগ্রহ করেন এদের সংগ্রামী ইতিহাস। মোংলু বিভিন্ন গোষ্ঠীর উৎসব ও তা পালনের সময় ও উদ্দেশ্য মানুষের কাছ থেকে জেনে লিখে নেয়। ক্রমে নিয়োগী বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক মেল বন্ধন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আদিবাসী নাচ গানের মধ্যে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও লড়াই-এর কাহিনীকে তুলে আনার চেষ্টা করেন।
মহুয়া গাছ এবং তেন্দুপাতা্র গাছ এই জঙ্গলে স্বাভাবিক ভাবে জন্মানো উদ্ভিদ এবং দুটিই এই অঞ্চলের মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস। দুর্ভাগ্যের বিষয় দুটোই নেশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই আদিবাসী মানুষরা মহুয়া ফল থেকে খুব উৎকৃষ্ট মানের মদ তৈরী করতে পারে। ১৮৯২-সালে ব্রিটিশ নিজেদের দেশিয় মদের আমদানি বাজার রাখার জন্য এদের মদ তৈরী নিষিদ্ধ করেছিল। এদের মধ্যে শরাবের নেশাও খুব প্রাচীন। বহিরাগতের উপদ্রবহীন তিন হাজার বছরের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর জীবনে মদ ক্ষতিকারক ছিল না। কিন্তু এখনকার শোষক তাদের মদের নেশাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়। এই উপলব্ধি থেকেই সম্ভবতঃ নিয়োগী চেষ্টা করতে থাকেন মদ্যপানের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার। পাশাপাশি চলে জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে হাসপাতাল তৈরীর কাজ।
ছত্তিশগড়ের মানুষ যখন শ্রেণীগত ভাবে অনেকটা সচেতন, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই-এ সংঘবদ্ধ, নিজেদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য তৈরী স্কুল ও হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে সক্ষম তখন নিয়োগী ধীরেশ থেকে শঙ্কর লাল ঠাকুর হিসাবে বস্তার ছেড়ে ভিলাই-এ চলে আসেন। সাথীদের কাছে তার বক্তব্য ছিল সমাজে বদল আনার জন্য একটুখানি জায়গায় তাপ দিয়ে জল ফোটালে চলে না, জলটা ভালো করে ফোটানোর জন্য আগুনটা অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। শহীদ হবার আগে পর্যন্ত তিনি আগুন হয়ে এই জল ফোটানোর কাজটা করে গেছেন।
এই চিত্রটাকে তুলে ধরার জন্য বাংলার সঙ্গে হিন্দি এবং গোন্ডি ভাষার মিশ্রণ এসেছে খুব স্বাভাবিক কারণে। বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃতি-রূপ বর্ণনার সাহিত্যগুণ প্রশংসার দাবী রাখে। এই বই-এর শেষে নিয়োগীর নিজের বাংলায় লেখা দুটো ছোটো গল্প এবং একটি প্রবন্ধ যুক্ত করা আছে। গল্প দুটি পড়লে বোঝা সেগুলিও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই উঠে আসা গল্প। প্রবন্ধটি থেকে জানতে পারি যে ছত্তিশগড় অঞ্চলে ব্রিটিশ আগমনের সময়েও ডোম জাতির একজন রাজা ছিলেন, যার শাসন আদিবাসীরা ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল। অন্তজ কোনো সম্প্রদায়ের রাজা ভারতের আর কোথাও তখন খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে রামায়ন রচনার সময়কাল ছিল ভারতে কৃষি সম্প্রসারণের যুগ এবং আর্য উপনিবেশ স্থাপনের যুগ। তাই ব্রিটিশ আগমনের সময়ও একজন ডোমরাজার অস্তিত্ব এই অঞ্চলের সমাজ জীবনের অপরিবর্তিত রূপটাকে বুঝতে সাহায্য করে। এই প্রবন্ধে নিয়োগী দেখান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজের সুবিধার্তে উপনিবেশের সামন্তবাদী চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখে আর ধর্ম সেই কাজে তাকে সাহায্য করে।
তার সমাজ জীবনের উপলব্ধিই তাকে টেনে নিয়ে গেছে মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই-এ। “হর জোর জুলুম কে টক্কর মে সংঘর্ষ হামারা নারা হ্যায়।”—এ ছিল তার জীবনের স্লোগান। পাশাপাশি সমাজ জীবনকে উন্নত করার জন্য নির্মাণ করেছেন পাঠশালা, হাসপাতাল, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের যৌথ প্রয়াস। “সংঘর্ষের জন্য নির্মাণ, নির্মাণের জন্য সংঘর্ষ”—এটাই ছিল তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র। আশাকরি, বইটির সচেতন পাঠ অবশ্যই পাঠককে সমৃদ্ধ করবে।
অজানা নিয়োগী
জিএম আনসার
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০/-
মেহনতি পাবলিকেশন
বইটি বিশেষ ছাড়ে সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন 9593593169 নম্বরে। ২০২৩ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত অজানা নিয়োগী বইটির কপি শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই বইটি পাবেন কলেজস্ট্রিটে ধ্যানবিন্দু, কাউন্টার এরা এবং আখর বুকশপে। বই এবং প্রকাশনা সংক্রান্ত যেকোন মতামত জানান এখানে mehanati.info@gmail.com
1 Comments
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete