অশোক মুখোপাধ্যায়
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং-কে কেন্দ্র করে একটি প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুকে সামনে রেখে শুরু হয়ে গেছে এক নতুন তরজা। এই তরজার লক্ষ্য দ্বিবিধ: ক) যাদবপুর তথা রাজ্যের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে এখনও টিকে থাকা গণতান্ত্রিক খোলামেলা বহুস্বর পরিবেশকে এই সুযোগে ধ্বংস করে ফেলা; খ) ওখানে টিএমসিপি এবং এবিভিপি-কে বাস্তু গড়ে তোলার লক্ষ্যে কিঞ্চিত ফাঁকা জমি নিষ্কাশণ। দুই দখলদার বাহিনীই পুরো দস্তুর কাজে নেমে পড়েছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের প্রশাসনিক পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। একটা মাত্র তথ্য দিলেই এটা খানিক বোঝা যাবে। সমগ্র ক্যাম্পাসে যেখানে অন্যূন ৩৮০ জন নিরাপত্তা কর্মী লাগে, সেখানে এখন আছে মাত্র ৮০ জন। প্রতি দিন অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে একাংশ ছুটি নিলে মোটামুটি জনা ষাটেককে দিয়ে ৩৮০ জনের কাজ করিয়ে নিতে হয়। যা আসলে হয় না।
“আতঙ্কপুর” ঘোষণাকারী নেত্রীদি এটা কি জানেন? না জেনে থাকলে তাঁকে নিয়েই আমাদের দুশ্চিন্তা শুরু হবে। জেনে থাকলে তাঁকে বলতে হবে, যাদবপুরকে আতঙ্কপুরী বানানোয় তাঁর কোনো অবদান আছে কিনা। শিক্ষামন্ত্রীও কি রক্ষী সংখ্যার বিষয়টা জানেন না? না জেনেই কি মার্ক্সবাদী মাওবাদী বামপন্থীদের উপর দোষারোপ করে দায় এড়াতে চাইছেন?
দেশের সত্তর শতাংশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে বামপন্থীদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে হোস্টেলগুলিতে র্যাগিং আছে কিনা, ছাত্ররা মারা যায় বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় কিনা খবর রাখেন? রাখার প্রয়োজন বোধ করেন? এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমাস আগেই একটি ছাত্র র্যাগিং-এর ফলে আত্মহত্যা করেছিল।
সিসিটিভি বসালে সিকিউরিটি এক নয়া পয়সাও বাড়ে না, যদি সিসিটিভিরও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা না থাকে। বছর দশেক আগে আমার পরিচিত একজন কেন্দ্রীয় সরকারী স্কুলের প্রিন্সিপালের অভিজ্ঞতা হল, সিসিটিভিতে মোড়া স্কুলেই রাতের বেলায় ভয়ঙ্কর ডাকাতি সংঘটন। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এগুলো অআকখ বোধ। যা দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত।
শুভেন্দু যাদবপুর নিয়ে এত লাফাচ্ছে কেন? সে কি গিয়েছিল আইআইটি খড়্গপুরে, যেখানে গত বছর অক্টোবর মাসে একজন প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃতদেহ অন্য রুমে আবিষ্কৃত হয়েছিল? সে কি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বলে যায়নি, নাকি, ছাত্রের নামে একটা আরবি ফারসি ছাপ ছিল বলে যাওয়া উচিত কাজ বলে মনে করেনি? নাকি দুটোই?? তখন তার র্যাগিং বিরোধী চেতনা কি ভেন্টিলেশনে ঢোকানো ছিল?
রাজ্য সরকার কেন আই আই টি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্তভাবে সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত আটকাতে চেয়েছিল?
এবিভিপি তথা বিজেপি দিল্লির জেএনইউ-তে কিংবা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করেছে আমরা ভুলে গেছি বলে ভাবছে নাকি? রোহিত ভেমুলার মৃত্যুও কর্তৃপক্ষের দুঃশাসনিক র্যাগিং ছাড়া আর কী? তা নিয়ে শুভেন্দুর বক্তব্য কী?
র্যাগিং-এর কারণে মৃত্যু একটা চরম দুঃখজনক ঘটনা। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যুলোকে চলে যাওয়ার মতো খারাপ পরিণতি আর হয় না। র্যাগিং একটা অসভ্য অপকৃতি। এর মধ্যে আছে শক্তিমানের দুর্বলের উপর দৈহিক মানসিক নির্যাতন করে তৃপ্তি পাওয়ার এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও এই মানসিকতাই বর্তমান। এমনকি স্কুলে স্কুলেও দেখা যায়, একজন ছাত্র একটু অন্য রকম (তোতলা, বেঁটে, ইত্যাদি) হলে বাকিরা তার পেছনে লাগতে থাকে এবং অনেক সময়ই তার স্কুলে আসা দুর্বিষহ করে তোলে। এই সব কিছুর বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী জনমত গঠন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার দিকে দিকে।
১৯৭৮-৮৪ সময়কালে আমি যখন এআইডিএসও-র কলেজ স্ট্রিট এলাকায় কাজ দেখার দায়িত্বে ছিলাম, ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমাদের সদস্য বোর্ডাররা সমস্ত রকম র্যাগিং বন্ধ করে দিয়েছিল। সিনিয়র ছাত্র কর্মীরা পাঁচটা ওয়ার্ডের ঘরে ঘরে ঢুকে দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষের ছেলেদের কঠোর ভাবে বারণ করে দিয়েছিল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের পেছনে লাগতে। আর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আশ্বস্ত করে রেখেছিল, যে কোনো সমস্যা হলেই তাদের জানাতে এবং নির্ভয়ে থাকতে। হোস্টেলে এতে ডিএসওর সমর্থক সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল সেই সময়। কেন না, অদ্ভুত ঘটনা হল, র্যাগিং ভীত প্রথম বর্ষের ছাত্ররাও অনেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে র্যাগার হওয়ার বাসনায় লালায়িত হয়ে ওঠে।
এগুলো করা যায়। র্যাগিং একটি প্রতিরোধ যোগ্য প্রবণতা। প্রতিরোধ মানে সিসিটিভি নয়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া নয়। ক্যাম্পাসে পুলিশ পিকেট বসিয়ে ছাত্রদের উপর খবরদারি করা নয়। কলেজ স্কোয়ারে প্রতিবাদী সভা নিষিদ্ধ করে দেওয়া নয়।
এর বিকল্প হচ্ছে, সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ শাসনের হাতিয়ার তুলে দেওয়া। যে রাজ্য পুলিশ আনিস খানের হত্যাকারীকে আড়াল করতে উৎকোচের লোভ দেখায়, তার হাতে কোনো ছাত্রই নিরাপদ নয়। যে রাষ্ট্র উমর খালেদকে বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখে আর অনুরাগ শর্মাকে খুঁজে পায় না, ব্রিজভূষণের নারী হেনস্থার ভিডিও ফুটেজ খোঁজে আর মনিপুরে হামলাকারীদের হাতে পুলিশের অস্ত্রভাণ্ডার তুলে দেয়, তারা আর যাই করুক র্যাগিং আটকাতে পারবে না।
যে ছাত্ররা একদিন আসানসোলের ইমাম পুত্রের হত্যায় উস্কানিদাতা র্যাগার বাবুল সুপ্রিয়কে আটকে দিয়েছিল এবিভিপি-র সভা করতে না দিয়ে, তাদের উত্তরসূরিরাই পারবে ক্যাম্পাসের হোস্টেলে র্যাগিং ঠেকাতে, র্যাগিং-জনিত মৃত্যু ঠেকাতে।
অন্যরা বড় জোর ৮বি-তে লাফালাফি করবে। আর হুমকি দেবে। সেও ক্ষমতাসীনদের এক রকমের র্যাগিং। তারও তীব্র নিন্দা করছি।
0 Comments