স্বপ্নদীপের স্বপ্নের উড়ান থেমে গেল তারই স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষার্থী দাদার ধর্ষকামী পৌরুষ নির্যাতনে। নিভে গেল বাবা-মার আদরের সন্তানের জীবনদীপ।
এরপর...
এখন পরস্পরের প্রতি শুধু দোষারোপের পালা। এখন শুধু টেলিভিশনের পর্দা আর ফেসবুক-এর উঠোনে খাপ পঞ্চায়েত। এখন কার কতখানি দায় তার চুলচেরা হিসাব-নিকাশ। এখন যাদবপুর কত বড় খুনি, কতটা আতংকপুর তা জনে জনে ছড়িয়ে দেওয়ার মিশন। এখন যাদবপুর মানেই সব দিক থেকে বখে যাওয়া, উচ্ছন্নে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের যথাযথ উত্তম-মধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়ার পালা। এখন ধর্ষকামী র্যাগিং-পরম্পরা থামাতে মাটিতে ফেলে উর্মি-তথাগতদের ওপর চড়াও হওয়ার পালা। পঞ্চায়েতে সারা বাংলায় শান্তিপূর্ণ খেলাধুলোর পর এখন শুধু যাদবপুরে 'খেলা হবে'-র পালা। এখন 'দেশদ্রোহী ভামদের' চোখ উপড়ে নেওয়ার পালা। এখন শিয়াল-শকুনের মহোৎসবের পালা। এখন সিসিটিভির ক্যামেরায় আপাদমস্তক যাদবপুরকে মুড়ে ফেলার পালা। যাতে একটাও দেশদ্রোহী আস্ত না-থাকে।
...এমনই এক সময়ে পুরোনো একটি লেখা নতুন করে এখানে তুলে ধরতে ইচ্ছে হলো।
____________________________________
আক্রান্ত যখন ব্যক্তিগত পরিসর
মোহিত রণদীপ
একটা সময় ছিল যখন আমাদের সাধারণ ব্যক্তি-মানুষের যাপন আবর্তিত হত সামাজিক অস্তিত্বের ওপর ভর করে। আমাদের ব্যক্তি-সত্তা তখনও তেমন করে ডানা মেলতে পারেনি। ক্রমে প্রাক-কৃষি সংগ্রাহক যাপনের পর্ব পেরিয়ে, সম্পূর্ণ কৃষি-নির্ভর যৌথ-পরিবারের দিনগুলো অতিক্রম করে, শিল্প বিপ্লব পরবর্তী জীবনটাকেও পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের হাত ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে। যেখানে শুধু কৃষি নয়, শুধু শিল্প নয়, খুলে গেল যাপনের অজস্র পেশাগত ঠিকানার দরজা। বৃহত্তর পরিবার-ভিত্তিক যৌথতার প্রয়োজন ক্রমশ কমতে কমতে পরিবার এখন এককে রূপান্তরিত।
আমাদের একক ব্যক্তি-মানুষের স্বাতন্ত্র্যের যুগ শুরু হল। ডানা মেলতে শুরু করল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বোধ। ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব পরিসর গড়ে উঠতে শুরু করল। সমাজের কর্তৃত্ব ক্রমশ কমতে শুরু করল। ব্যক্তি মানুষ নিজের মতো করে ভাবতে শিখল, নিজের মতো করে মত প্রকাশ করতে শিখল, নিজের মতো করে বাঁচতে শিখল। সেই ভাবনা, সেই মত, সেই যাপন অনেক সময় সমাজের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে, চলতি স্রোতের বিরুদ্ধেও ধাবিত! সমাজের প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্ন করার মধ্যে দিয়ে যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা, তা সমাজ-প্রগতির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকাই নিয়ে এসেছে! প্রচলিত ধারণাকে, রীতিনীতিকে, নিয়মকানুনকে সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখরাঙানিকে অস্বীকার করে প্রশ্ন করার সাহস এসেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের হাত ধরেই।
এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মানুষকে নিজস্ব পরিসর দিয়েছে রাষ্ট্রের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও, সমাজের বাঁধনের মধ্যে জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও। সেই পরিসরে অন্যের অনুপ্রবেশ সেই ব্যক্তি-মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত। ব্যক্তির স্বতন্ত্র ভাবনা, স্বতন্ত্র যাপনের অস্তিত্ব তাতে বিপন্ন হয়ে পড়ে। ব্যক্তি মানুষের স্বতন্ত্র যাপন যদি অন্যের স্বাভাবিক বসবাসকে বিঘ্নিত বা বিপন্ন না করে, তাহলে আমাদের কারোরই সেই ব্যক্তির স্বতন্ত্র যাপনে বিঘ্ন ঘটানোর অধিকার থাকার কথা নয়। এই মূল্যবোধ বর্তমান সামাজিক যাপনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যা বর্তমান সামাজিক বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সমাজ কাঠামো আর ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে যা জরুরিও। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্পর্ক অনেক কাল ধরেই! তবু বহুক্ষেত্রেই নানা দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সমাজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিকে একটু একটু করে পরিসর দিয়েছে, নিজেকে ক্রমশ বদলে চলেছে। এই দ্বন্দ্ব এবং পরিবর্তন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া।
কোনও ক্ষেত্রে যখন সমাজ ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে জায়গা দিতে চায়নি, তখন ব্যক্তি ওই সমাজের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। সমাজ তাকে চাইলেও অনেক সময় বেঁধে রাখতে পারেনি।
কিন্তু, এতক্ষণ যার কথা এই আলোচনায় আসেনি, সমাজ ও ব্যক্তি ছাড়াও আর একটি সত্তার অস্তিত্ব আমাদের জীবনে প্রবলভাবে রয়েছে বহুকাল ধরেই। সেই সত্তা হল, রাষ্ট্র। রাষ্ট্র আর সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক সময় দ্বন্দ্বের-সংঘাতের আবার কোনো কোনো সময় পরিপূরক মিত্রতার। রাষ্ট্র ক্রমশ সমাজের পরিসরকে গ্রাস করে সর্বশক্তিমান হতে চেয়েছে এবং ক্রমে চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে বারে বারে সংঘাত হয়েছে ব্যক্তির এবং সংঘবদ্ধতার। রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা/কর্ত্রী সর্বদাই ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা থেকে সন্দেহে থেকেছে ব্যক্তি সম্পর্কে, ব্যক্তির সংঘবদ্ধতা সম্পর্কে। রাষ্ট্র তাই নজরবন্দি করে রাখতে চেয়েছে তার সব নাগরিকদেরই। রাষ্ট্রের এই সন্দেহপ্রবণতা, নজরবন্দি করে রাখার প্রবল ইচ্ছে সম্ভবত তার জন্মলগ্ন থেকেই। গোয়েন্দা বাহিনী, গুপ্তচর প্রভৃতির সাহায্য নিয়ে নজরদারি চালানোর চল সেই কোন ঐতিহাসিক যুগ থেকেই জেনে আসছি আমরা!
একসময় ইংল্যান্ডের দার্শনিক ও রাষ্ট্র তত্ত্ববিদ জেরেমি বেন্থাম জেলখানার বন্দিদের ওপর নজরদারির সুবিধার জন্য এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্যশৈলীর ধারণা নিয়ে আসেন, যেখানে একটি মাত্র নজরমিনার থেকে অর্ধবৃত্তাকার বন্দিশালার ওপর প্রসারিত দৃষ্টিতে নজরদারি সম্ভব হবে। এই ধারণা Pan- opticon (প্যান-অপ্টিকন) স্থাপত্যশৈলী হিসাবে চিহ্নিত করেন তিনি। পরবর্তীকালে চিন্তাবিদ, দার্শনিক মিশেল ফুকো সত্তরের দশকের শুরুতে, যে সময় পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনের আবহ, ঊনবিংশ শতাব্দীর বেন্থামের এই ধারণাকে অন্য এক মাত্রা দিলেন। তাঁর ভাবনায় আমরা জানলাম, রাষ্ট্র শুধুমাত্র জেলের মধ্যে থাকা বন্দিদেরই সন্দেহের চোখে দেখে, নজরদারির মধ্যে রাখতে চায় তা নয়, সে জেলখানার বাইরে থাকা সব নাগরিককেও সন্দেহের বেষ্টনিতে আনতে চায়, নজরদারি করতে চায় প্রতিটি নাগরিকের গতিবিধি, ভাবনা-চিন্তার ওপরেই। ক্ষমতা এক ধরনের প্যারানইয়া কিংবা সন্দেহপ্রবণতার জন্ম দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রনায়ক/রাষ্ট্রনায়িকাদের মধ্যে ক্ষমতা হারানোর ভয় প্রতি মুহূর্তে তাঁদের মনকে ঘিরে রাখে। এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় তীব্র সন্দেহ! আর এই সন্দেহ থেকেই তাঁরা রাষ্ট্রের সব নাগরিককেই নজরের ঘেরাটোপে রাখতে চান। সব নাগরিককে নজরের ঘেরাটোপে রাখার জন্য রয়েছে বহুবিধ ব্যবস্থা! আরও নতুন নতুন সংযোজন চলতে থাকে শুধু!
মুষ্টিমেয় স্ক্যানডিনেভিয়ান কয়েকটি রাষ্ট্রকে বাদ দিলে, পৃথিবীর প্রায় সব ধরনের রাষ্ট্রই (ধনতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক... নির্বেশেষে) যা করে চলেছে কিংবা করতে চলেছে…
▪ কোনও একটি প্রতিবাদী মিছিলে আপনি হয়তো হাঁটতে শুরু করেছেন কিংবা প্রতিবাদী কোনও সভায় আপনি বক্তব্য রাখছেন বা দাঁড়িয়ে শুনছেন। আপনার অজান্তেই হয়তো আপনার ছবি উঠে গেল। সেই ছবি পৌঁছে গেল নজরদারির দায়িত্বে থাকা অফিসারদের কাছে। আপনার ঠিকুজি-কুষ্ঠির খোঁজ চলল। কোথায় বাড়ি, কী করেন, কে কে আছে পরিবারে, কাদের সঙ্গে মেশেন, তাদের রকম-সকম কেমন, কোন্ কোন্ সংস্থা-সংগঠনের সঙ্গে আপনার যোগ, কবে কী করেছেন...এই সমস্ত নাড়ি-নক্ষত্র সংগ্রহ করে আপনি ফাইল-বন্দি হবেন। রাষ্ট্রের নজরদারি-মহাফেজখানায় আপনার নামে একটা ফাইল সংরক্ষণ করে রাখা হবে। এমন কি আপনার মৃত্যুর পরেও!
▪ আপনি হয়তো সরকারের কোনও একটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ একটা পোস্ট দিলেন কিংবা অন্য কারোর মতামতে 'লাইক' দিলেন বা 'শেয়ার' করলেন। এরপর আপনার অজান্তেই হয়তো শুরু হয়ে গেল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ আপনার ওপর নজরদারি!
অনেক আগেই রাষ্ট্র কিংবা কর্পোরেট না-চাইতেই আপনি দিয়ে রেখেছেন আপনার সম্পর্কে নানা ব্যক্তিগত তথ্য । প্রতিটি মুহূর্তে নিয়মিত আপনার ব্যক্তিগত ইভেন্ট থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শ-কার্যকলাপ সবই দিয়ে চলেছেন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এর 'দেয়াল'-এ। আপনার প্রতিটি পোস্ট, ইনবক্স মেসেঞ্জারে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত মেসেজগুলো কাটাছেঁড়া করা, আপনার বন্ধু তালিকায় 'সন্দেহভাজনদের' চিহ্নিত করা, তাঁদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগের গভীরতা মেপে দেখার সঙ্গে চলল আরও অনেক কিছুই, যা আপনার ধারণারও বাইরে!
সম্প্রতি আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় সরকার রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দিয়েছে 'দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে' প্রয়োজনে যে কোনও নাগরিকের মেসেঞ্জার ও হোয়াটস্অ্যাপ-এর যাবতীয় মেসেজের ওপর তারা নজরদারি চালাবে।
▪ রাষ্ট্র প্রথমে ঠিক করল আপনার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি। কারণ, কোন্ মুহূর্তে আপনি 'রাষ্ট্র-বিরোধী' হয়ে উঠবেন, 'দেশদ্রোহী' হয়ে উঠবেন কিংবা 'রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক' তা বলা যায় না! তাই আগে থেকেই আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য 'জড়ো করা' প্রয়োজন। একেবারে পঞ্চায়েত/ মিউনিসিপ্যালিটির জন্মপঞ্জিকরণ খাতায় নাম নথিবদ্ধ করার মধ্যে দিয়েই শুরু হলো আপনাকে রাষ্ট্রের ঘেরাটোপের মধ্যে বেঁধে ফেলার প্রক্রিয়া! তার পর একে একে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, আদালত, সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্মশান বা কবরখানার তথ্যপঞ্জি...সবকিছুর মাধ্যমেই সে বাঁধতে শুরু করলো আপনাকে আপনার নিজের অজান্তেই! আপনার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো আপনার (বিনা)সম্মতিতে রাষ্ট্রের করায়ত্ত হল। জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্যে আপনার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আপনার যাবতীয় গতিবিধির ওপরও চাইলেই রাষ্ট্র নজরদারি চালাতে পারে। অনেক আগেই প্যান কার্ডের মাধ্যমে আপনার অর্থনৈতিক লেনদেন-ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় তথ্য রাষ্ট্রের করায়ত্ত হয়েছে। শেষ অব্দি আধার কার্ডের মাধ্যমে আপনাকে বেঁধে ফেলা এককথায় সম্পূর্ণ হয়েছে। আপনার আঙুলের ছাপ, আপনার চোখের মণির ছবি তুলে নিয়ে তৈরি হয়েছে বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার। যার সাহায্যে সহজেই আপনাকে চিহ্নিত করা যাবে, খুঁজে বার করা যাবে, বেঁধে আনা যাবে...এরপর রাষ্ট্র আপনাকে নিয়ে কী করবে, তা তো শুধু সে-ই জানে!
▪ রাষ্ট্র-চালক হিসাবে ভোটে জিতে আসা যেসব নেতা-নেত্রী বা রাজনৈতিক দলকে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, তারা সত্যিই কতটা আসল চালক তা নিয়ে বিস্তর সংশয় থেকে যায়! তাঁরা যদি 'যন্ত্র' হন, তবে 'যন্ত্রী' অবধারিতভাবেই কর্পোরেট বহুজাতিক ( মাল্টিন্যাশনাল ও ট্রান্সন্যাশনাল ) কোম্পানি। রাষ্ট্র-পরিচালনায় তাঁদের সামনে চোখে দেখা যায় না, তাঁদের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন 'দেশবরেণ্য' বড় বড় কাটআউট-শোভিত সেই সব নেতা-নেত্রীরা। কর্পোরেটের যাবতীয় চুরি-ডাকাতি সামলানোর বিনিময়ে তাঁরা দেশ চালানোর দায়িত্ব পান। এমন কি এইসব কর্পোরেট-বাড়ির বিবাহ উৎসবে দেশ-বিদেশের নেতা-নেত্রীদের সমবেত নৃত্যও দেখা যায়, শোনা যায় তাঁদের বাড়িতে আগত ভি ভি ভি আই পি-দের নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তায় আন্তর্জাতিক একটি ইনটেলিজেন্স এজেন্সির ওপর!
আমাদের নাগরিক সমাজের যাবতীয় ব্যক্তিগত, একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যও আজ সহজেই পৌঁছে যায় এইসব মহাশক্তিধর কর্পোরেটদের কাছে। ফেসবুক-এর মাননীয় কর্ণধার সে-কথা ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছেন। সেই কর্পোরেট গোষ্ঠী আপনি কী ব্যবহার করেন, কী খেতে ভালোবাসেন, কোন্ ব্র্যান্ডের জামাকাপড় পড়েন, টেলিভিশনের কোন্ কোন্ চ্যানেল দেখতে ভালবাসেন, কী কী ওষুধ আসে আপনার বাড়িতে, কোন্ খবরের কাগজ পড়েন...সমস্ত তথ্য কর্পোরেটের নখদর্পণে। আমেরিকায় নাগরিকদের একটা অংশ যখন ব্যক্তিগত তথ্য দিতে অস্বীকার করলেন কর্পোরেট নিয়োজিত সমীক্ষকদের, তখন কর্পোরেট সেই সব বাড়ির গারবেজ বিন ঘেঁটে তথ্য জোগাড় করতে শুরু করলো। এইভাবে 'তাঁদের' অগম্য, আর 'তাঁদের' অজানা কিছুই রইল না!
আমাদের ভাবনা-চিন্তা, আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, কোনটা 'প্রগতি' আর কোনটা 'দুর্গতি', কে হবে আমাদের 'বিকাশ পুরুষ' আর কে 'বিকাশ-নারী', কার 'অনুপ্রেরণা'-ভিন্ন গাছের পাতাও নড়বে না...এই সবকিছু স্থির করে দেবেন তাঁরা। আর, 'যন্ত্রী' যা বলবেন ঠিক সেই মতোই চলবে গ্রাম, শহর, রাজ্য, রাজধানী, রাজনীতি, নেতা, মন্ত্রী, আইনসভা, আদালত, খবরের কাগজ, টেলিভিশন, ওয়েবমিডিয়া...সব...সমস্ত কিছু! এই সবকিছুই নির্ধারণ করে দেয় কর্পোরেট, তার বাণিজ্যিক স্বার্থেই! আর সেই সব গূঢ় বানিজ্য-স্বার্থ বিশেষিত হয় 'উন্নয়ন', 'বিকাশ', 'প্রগতি', 'উদারীকরণ'... এইসব নানাবিধ গালভরা বিশেষণে।
▪ রাষ্ট্র যদি মনে করে আপনি শাসকের বিরুদ্ধে, আপনি 'উন্নয়ন-বাবু' কিংবা কর্পোরেট স্বার্থের প্রতিবন্ধক সেক্ষেত্রে সে আপনার নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নিতে পারে। শুধুমাত্র তার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যাবতীয় এটিএম কার্ড, মোবাইল ফোন, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স... সবকিছু অকেজো হয়ে যেতে পারে! আপনি সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন! আপনি 'অনাগরিক'-এ পরিণত হতে পারেন মুহূর্তে!
বুর্জোয়া নৈতিকতায় সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিসর 'ব্যক্তি-স্বাধীনতা', 'ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য' আজ প্রবলভাবে আক্রান্ত ধনতন্ত্রের দ্বারাই!
ব্যক্তিসত্তাকে ধ্বংসকারী এই নিপীড়ক রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু এড়িয়ে যদি পালাতে চাই নিভৃত কোনও দ্বীপভূমিতে তারও উপায় নেই! পল গঁগ্যার জন্য তাহিতি দ্বীপ ছিল। আমাদের পালানোর উপায় অন্তত এখনও অবধি অজানা! আপাতত অপেক্ষায় থাকব এমন কারোর, যে এই রাষ্ট্র কাঠামোটার মধ্যে ঢুকে ক্ষমতার প্রেমে আক্রান্ত না-হয়ে সাবোতাজ ঘটিয়ে ধ্বংস করে দেবে সমস্ত তথ্যভাণ্ডার, রাষ্ট্রের বেঁধে রাখার সমস্ত ষড়যন্ত্র! ঠিক যেমনটা করতে চেয়েছিলেন অ্যারন সোয়ার্টজ।
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার সপক্ষে সোচ্চার অ্যারন বিশ্বাস করতেন, মানুষের অর্জিত সমস্ত জ্ঞান আসলে সব মানুষেরই সম্মিলিত সম্পদ। শুধু কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ নয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলা নানা গবেষণায় লব্ধ জ্ঞানও কোনও একক মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ নয়। অর্থের বিনিময়ে সেই জ্ঞান কেনাবেচার যে প্রথা, তা বঞ্চিত করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশের মানুষদেরই। জানার অধিকার এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্মগত হওয়ার কথা। কিন্তু, বাস্তবে তা হয় না। এর বিরুদ্ধেই ছিল অ্যারনের জেহাদ। দু'হাজার আট সালে অ্যারন ঘোষণা করেন, যে-আইন অন্যায়, তাকে মেনে চলার মধ্যে কোনো ন্যায়ধর্ম নেই। জ্ঞান-সম্পদ নিয়ে ব্যবসা করা একটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সমস্ত গবেষণাপত্র ডাউনলোড করে ফেলেন সর্বসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করে দেবেন বলে। বহুজাতিকের স্বার্থে আঘাত লাগে। ধরা পড়ে যান। বিচারে ছত্রিশ বছর জেল হয়। সাজা ঘোষণার কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর কক্ষে পাওয়া যায় তাঁর নিথর দেহ। ছাব্বিশ বছরের স্বপ্ন-দেখা যুবক নৈতিকতার চর্চায় এক যুগান্তকারী প্রশ্ন রেখে গেলেন এই পৃথিবীর সবার কাছে!
অন্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা এই যুবক রক্তকরবীর সেই রঞ্জনের কথা মনে করিয়ে দেন। অপেক্ষায় থাকবো অ্যারন সোয়ার্টজের মতোই আরও কোনো স্বপ্ন দেখা তরুণ বা তরুণীর, যে ভাঙতে পারবে রাষ্ট্রের দেমাক, তার সমস্ত শৃঙ্খল!
................................................................
0 Comments