সায়ন্তন দত্ত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সামাজিক হইচই আপাতত একটু থিতিয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসে সিসিটিভি লাগানোর ব্যবস্থা, অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ইত্যাদি দাওয়াই-তে সুশীল (?) সমাজ আপাতত কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত - আর ছেলেমেয়েরা ক্যাম্পাসে ‘মদ-গাঁজা-অবাধ যৌনতা’ (মিডিয়ার জনপ্রিয় অ্যাঙ্করের উদ্ধৃতি) করতে পারবে না। তৃণমূল এবং বিজেপি ঘোলাজলে মাছ ধরতে সবচেয়ে তৎপর, তাই তারা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাবে। তার বাইরে তৃতীয় বিশ্বের বৃহত্তর রিগ্রেসিভ সমাজ র্যাগিং আটকাতে নানাবিধ দাওয়াই দিয়ে যাচ্ছে, যাবে। আপাতত হাতে রইল একটি কিশোর ছেলের নিষ্প্রাণ মৃতদেহ এবং প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক এই হত্যার অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকা বিচারপদ্ধতি।
খুব সামান্য কেউ কেউ বলছেন, সিসিটিভি আর সেনাপ্রধাণ মোতায়েন করার জন্য যে খরচ লাগে, তা ইউনিভার্সিটি কোত্থেকে জোগাড় করবে, যেখানে ইউনিভার্সিটির এত এত দেনা? ছাত্রদের কারোর বিশ্ববিদ্যালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহল থাকার কথা নয় - গবেষণায় যুক্ত হওয়ার আগে আমিও এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম। পিএইচডি করতে যাওয়ার সুবাদে কিছু কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কথা কানে আসে - এবং বলা বাহুল্য, যা কানে আসে, তার জন্য ইংরেজী ‘অ্যালার্মিং’ শব্দটা খুব সামান্য। এই পোস্টে শুধু মাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সার্বিক ভাবে ভারতবর্ষে সরকারি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের টাকাপয়সার অবস্থা নিয়ে যতটুকু শুনেছি, সেইটুকু বলার চেষ্টা করবো।
কেউ কেউ মনে করতে পারবেন, অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ারা আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস গতবছর একটি নোটিফিকেশন বার করেছিলেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের উদ্দেশ্যে আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। ঠিক সেইসময়েই পিএইচডি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আমার বিভাগীয় সিনিয়র এক দাদার সঙ্গে কথা বলছিলাম, যিনি ভারতবর্ষের একটি আইআইটির সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। টেলিফোন কনভার্সেশন ব্যক্তিগত, তাই কোনো খুঁটিনাটি উল্লেখ না করে এইটুকু প্রকাশ্যে জানাব।
দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত সরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান (জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত আইআইটি - যা যা নাম মাথায় আসে) বেশ কিছু বছর ধরে প্রচুর টাকার দেনার টাকায় চলছে - অর্থাৎ কেন্দ্রীয় (কিছু ক্ষেত্রে রাজ্য) সরকারের উচ্চশিক্ষাখাতে যে পরিমাণ টাকা দেওয়ার কথা, তা না দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে ব্যাঙ্ক লোন নিতে। একবার লোন নিতে শুরু করলে সেই টাকার পরিমাণ সুদসহ বাড়ে - হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের চক্রবৃদ্ধি সুদের অঙ্ক, আমরা সবাই জানি। শিক্ষাখাতে সরকারি বিনিয়োগ যত কমতে থাকবে, তত বাড়তে থাকবে ব্যাঙ্ক লোনের চাহিদা - ফলতঃ কিছু দিনের মধ্যে লোনের টাকার পরিমাণ এত বেড়ে যাবে, সেই টাকা আর সরকার কোনো পরিস্থিতিতেই শোধ দেওয়ার মত অবস্থায় থাকবে না। এবং সেই অবস্থায় একমাত্র উদ্ধারকর্তা হবে বেসরকারী সংস্থা - বিশেষ করে মোদীপ্রিয় রিলায়েন্স। টাকা দিতে না পারলে সমস্ত পরিকাঠামো ধ্বসে পড়বে, তখন আম্বানী কিংবা আদানীর হাতে বেচে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। একটু ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, ইচ্ছেকৃত ভাবে, পরিকল্পিত ভাবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরেই শুরু করে দিয়েছে।
এবার আসি যাদবপুরের কথায়। আমি চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের গবেষক, এই বিভাগের সূত্র ধরেই শুনেছি, মাঝখানে নিয়মিত যে টাকা আসত, তার পরিমাণ এত কমে গেছিল যে শিক্ষকদের চা খাওয়ার কাগজের কাপ কেনার টাকা পর্যন্ত জোগাড় করা যাচ্ছিল না। বিভাগীয় প্রধাণ একদিন আক্ষেপ করে বলছিলেন, ছেলেমেয়েদের বারণ করি চেয়ার টেবিল নিয়ে অসাবধান হতে, কারণ চেয়ারের হাতল ভেঙে গেলে সেটা সারানোর পয়সা বিশ্ববিদ্যালয় আর দেবে না। চা খাওয়ার কাগজের কাপ কিংবা চেয়ারের হাতল না হয় মামুলি জিনিস; লাইব্রেরীতে গিয়ে গিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করার চেষ্টা করেন, তাঁরা জানেন, ২০১৭-১৮ সালের পর থেকে সারা বিশ্ববিদ্যালয়েই কাগজের বই কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। ই-বুক কেনা হয়, কিন্তু নিয়মিত হার্ডকপির বই লাইব্রেরীতে থাকা যে অত্যন্ত জরুরী, কর্তাব্যক্তিরা আর সেটা মনে করছেন না। আমাদের বিভাগের এক লাইব্রেরীয়ান চাকুরিরত অবস্থায় মারা গেছেন বেশ কয়েক মাস হল, তাঁর জায়গায় কোনো রিক্রুটমেন্ট হয়নি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরী থেকে প্রায় অবসরের গোড়ায় পৌঁছে যাওয়া একজনকে এনে কাজ চলছিল। তিনি অবসর নেবেন সম্ভবত এই মাসেই, তারপর থেকে নিয়মিত লাইব্রেরী খুলবে না আর। এই সূত্রেই কথা বলতে গিয়ে জানলাম, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ লাইব্রেরীয়ানের পোস্ট ফাঁকা পড়ে আছে, কোনো রিক্রুটমেন্ট হয়নি দীর্ঘদিন। আর শেষ খবর, টাকার অঙ্ক প্রকাশ্যে বলব না, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও বেশ কয়েক কোটি টাকার দেনায় চলছে অনেকদিন। অর্থাৎ মেরেকেটে পনেরো কুড়ি বছরের মধ্যে (যদি না ২০৩০-র মধ্যে কলকাতা জলে ভেসে না যায়) ‘রিলায়েন্স যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ বা সমধর্মী কিছু নাম আমরা দেখতেই পেতে পারি।
কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, বেসরকারিকরণ হলে কি হবে? আজকেই দুপুরে দেখছিলাম, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এবং অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য সুরঞ্জন দাস টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর বর্তমান ঠিকানার বিরাট সুখ্যাতি করছিলেন। তিনি নতুন পদে গেছেন, প্রকাশে ওঁকে এই গুণগাণ করতেই হবে। চ্যানেলের অ্যাঙ্কার প্রশ্ন করছিলেন, প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের জন্য এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলি কি ভাবছে? মোক্ষম প্রশ্ন - আর তার মোক্ষম উত্তর আছে, স্কলারশিপ। যদিও তিন বছরে চার থেকে ছয়-সাত লাখটাকা যেখানে পড়াশোনা করার ‘ফি’ দিতে হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বুকে কোন স্কলারশিপ ছাত্রের টিউশন ফি সহ কলকাতায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা মঞ্জুর করবে, তাঁরাই জানেন। সোজা কথায়, উপরিতলে দেখতে গেলে, যে শিক্ষা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বারোশো টাকায় পাওয়া যেত, সেই শিক্ষা (আসলে সেই শিক্ষা নয়)-র জন্য প্রতি বছরে খরচ হবে কয়েক লাখ টাকা। বছরে লাখ টাকার উপর খরচা করে পনেরো বছর পর ছেলেমেয়েরা বাংলা, তুলনামূলক সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রবিদ্যা পড়বে? শুনতে কেমন একটা লাগছে না?
হিউম্যানিটিজের ছাত্র আমি, এবার আসি শিক্ষার কথায়। টেলিভিশনের সেই অনুষ্ঠানে অ্যাডামাসের এক কর্তা বলছিলেন, আমরা প্রথম দিন থেকেই ছাত্রছাত্রীদের প্লেসমেন্ট বিষয়ে নিশ্চিত করতে চাই। অর্থাৎ চাকরীর বাজার যা চাইছে, সেই বিষয়ে সচেতন হয়ে পড়াশোনা শুরু হয় প্রথম দিন থেকেই। অর্থাৎ WBCS কিংবা সিভিল সার্ভিস জাতীয় পরীক্ষা, যা হিউম্যানিটিজ ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ (পড়ুন সবচেয়ে বেশী অর্থের চাকরি) অর্জন, তাই মাথায় রাখা হয় শুরু থেকে। তাই খুব যুক্তিসঙ্গত ভাবেই সিলেবাস থেকে ছেঁটে ফেলা হয় সমস্ত অদরকারী বিষয়। পড়াশোনা হবে কেবল বিষয়মুখী, একগুঁয়ে, চাকরী পাওয়ার মহামন্ত্র।
আজ থেকে ঠিক একশো আট বছর আগে বিশ্বখ্যাত এক বিজ্ঞানী স্রেফ অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সূর্যের মত অত্যন্ত ভারী মহাজাগতিক বস্তু আলোকরশ্মিকে বেঁকিয়ে দিতে সক্ষ্মম - অতএব আলো সবসময় সরলরেখায় চলে - এই কথা ভুল। তাঁর সমসময়েই, সেই দেশেই তৈরী হচ্ছিল এমন এক বিদ্যাচর্চা, যা গোটা শতাব্দী প্রায় শাসন করবে হিউম্যানিটিজের অ্যাকাডেমিয়া। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কিংবা অ্যাডোর্নো-হর্খেইমার-বেঞ্জামিন - এঁদের সারাজীবনের কাজ আপাত ভাবে ইমিডিয়েট প্রায়োগিক প্রয়োজনে লাগে না, এঁদের মত চিন্তা করতে শিখে সঙ্গে সঙ্গে চাকরী পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা এতদিন জানতাম, পড়াশোনার উদ্দেশ্য জ্ঞানচর্চা, নতুন কিছু শেখা, শেখার আনন্দ পাওয়া। তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম ক্লাসে সেই প্রশ্ন ‘হোয়াট ইস পোয়েট্রি’, কিংবা চলচ্চিত্রবিদ্যার প্রথম ক্লাসে সেই অনবদ্য বই - ‘হোয়াট ইস সিনেমা’ - এই প্রশ্নগুলো কোনোদিনো প্লেসমেন্ট ওরিয়েন্টেড পড়াশোনা তার সিলেবাসের মধ্যে নিয়ে আসে না। এমনিতেই বিজ্ঞান কিংবা মানবীবিদ্যাচর্চা - দুইতেই বিমূর্ত চিন্তা করার মানুষ খুব কম। সামান্য যে কজন উচ্চশিক্ষার মধ্যে দিয়ে এই সুযোগ পেতেন, শিক্ষার বেসরকারীকরণ অবশ্যম্ভাবী ভাবে সেই পথ আটকে দেবে।
তাই যাদের টাকা আছে তারা পড়বে আর বাকিরা পড়বে না - এই প্রাথমিক প্রস্তাব পেরিয়ে গিয়েও বোঝা যাচ্ছে, যারা পড়বে, তারাও আসলে কী পড়বে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে এলিট বলে গালাগাল খেতে হয় - তার নামের আগে রিলায়েন্স বসলে আশা করা যায় বৃহত্তর জনসমাজের স্বস্তি হবে - কারণ তখন তো এলিটিজম টাকা দিয়ে কিনতে হবে। অর্থাৎ পুঁজিবাদের চিরকালীন যুক্তি - অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ব্যক্তিগত এবিলিটির প্রশ্ন দিয়ে রিপ্লেস করে দেওয়া। তোমার টাকা কামানোর ‘ক্ষমতা’ আছে, তুমি তাই পড়ছো। তোমার টাকা কামানোর ‘ক্ষমতা’ নেই, তাই তুমি পড়বে না। অবশ্য একটু আগেই বলছিলাম, টাকা দিয়েও সম্ভাব্য কী ধরণের পড়াশোনা হতে পারে।
কী উপায়ে এই বেসরকারীকরণ আটকানো সম্ভব, আমি জানি না - আমাদের মতো মানুষজনদের পক্ষে তা জানা সম্ভবও নয়। রোমিলা থাপার ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, এই সরকার আবার আসা মানে, ‘ভার্চুয়াল শাটডাউন অফ ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমিয়া’। ইদানীং মনে হয় প্রশ্নটা শুধু এই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে নিয়েই নয় - বরং সার্বিক ভাবে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রকে ব্যবসা করে তোলার উৎসাহ-র সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক ভাবে এ দেশের সমস্ত উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রের পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। হিমালয়ের বরফ গলে কলকাতা ভাসিয়ে না নিয়ে গেলে শিক্ষার বেসরকারীকরণ থেকে আর কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না।
সায়ন্তন পেশায় গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে পিএইচডি করছেন। লেখালেখি মূলত নেশা থেকে, লিখতে ভালোবাসেন প্রবন্ধ। চলচ্চিত্র, সঙ্গীত আর সাহিত্য সায়ন্তনের প্রিয়তম বিষয়। 'মাস্টারক্লাসে কিয়ারস্তামি' নামে একটি বই সংকলন ও তর্জমা করেছেন। লেখা ছাড়াও চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ রয়েছে, 'আফটার আসিফা' নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করেছেন। অবসরে সায়ন্তন কিঞ্চিৎ পাশ্চাত্য দর্শন, কিঞ্চিৎ পদার্থবিজ্ঞান এবং আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয়ে মনুষ্যপ্রজাতির ঘোরতর অবদান সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করে থাকেন।
2 Comments
This is an eye-opener regarding the current trends in Indian academia.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete