প্রীতিলতা বিশ্বাস
ডিসেম্বরের শুরুতেই চেন্নাই এর উপর দিয়ে বয়ে গেল ঘূণিঝড় মিগজাউম, সঙ্গে প্রবল বর্ষণ। সতর্কবার্তা ছিল অনেক আগে থেকেই। পয়লা ডিসেম্বর তামিলনাড়ু ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের এসএমএস ও ঢুকে গিয়েছিল সকলের ফোনে। ইন্টারনেটে ঘূর্ণিঝড়ের ক্রমবিকাশও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তথাপি বন্যা আটকানো গেল না। গেল না প্রাণহানির সংখ্যা শূন্য রাখা। ২০২১-২২ সাল থেকেই চেন্নাই জুড়ে স্টর্মওয়াটার ড্রেন তৈরীর কাজ চলেছে। একদিকে স্টর্মওয়াটার ড্রেনের কাজ আর একদিকে মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ—শহরবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত! তবু ধৈর্যধরে মানুষ খানা-খন্দ বাঁচিয়ে পথ চলেছে। শহরের উন্নয়ন হচ্ছে বলে কথা!
মাত্র দুদিনের বৃষ্টিতে যে চিত্রটা উঠে আসল
SRM ইউনিভার্সিটি ভারতের প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল শিক্ষার নামী-দামী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। কাট্টানকুলাত্তুরের মেইন ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো ২-৩ তারিখে হয়ে গেল এক একটা স্রোতস্বিনী নদী। দুদিন ধরে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী ক্যাম্পাসে আটকে থাকল—আলো নেই, জল নেই, খাবার নেই। OMR বা ওল্ড মহাবলিপুরম রোডের ধারে পাল্লিকারানাই marshland(নিচু ঘাসজমি যা বৃষ্টির জল ধরে রাখে)এর উপর ১৪১ একর জমি নিয়ে তৈরী সত্যবামা ইনিস্টিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি। এখানকার হোস্টেলে থাকা ছেলেমেয়েদেরও তখন একই দুর্দশা। নেট নেই, ফোনের টাওয়ার দুর্বল—সব রকমভাবেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে থাকা বাসগুলোর জানলা পর্যন্ত জল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার বার্ষিক নূন্যতম খরচ ৪-৫ লাখ টাকা।
OMR চেন্নাই এর আইটি করিডর নামে পরিচিত। অ্যাডেয়ার থেকে শুরু করে মহাবলিপুরম পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৫ কিমি রাস্তার ধারে প্রথম আইটি হাব টাইডেল পার্ক, এক রাতের টানা বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ জলমগ্ন হল। টাইডেল পার্কের এক কিমি আগে আরও খারাপ অবস্থা। এই রাস্তায় রয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। উইমেনস পলিটেকনিক, এশিয়ান কলেজ অব জার্নালিজম, ক্যাটারিং এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইনিস্টিটিউট, এমজিআর ফিল্ম সিটি, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটোমিক এনার্জির রিসার্চ ইনিস্টিটিউট IMSc. ইত্যাদি। প্রত্যেকটি জায়গায় একতলায় কোথাও হাঁটুজল তো কোথাও কোমর পর্যন্ত জল। IMSc এর একতলার সব ঘরে কম্পিউটারের ইউপিস খারাপ হয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে বই-পত্তর। পিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স আর কম্পিউটার সাইন্সের বিশ্বমানের গবেষণা হয় এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে। একাধিক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের সাক্ষি IMSc র রামানুজম অডিটোরিয়ামের বসার চেয়ারগুলো জলের নীচে থেকে থেকে খারাপ হয়ে গেছে। অডিটোরিয়ামকে আবার কাজ করার মতো জায়গায় আনতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মীরা।
টাইডেল পার্ককে পিছনে ফেলে OMR ধরে যত এগোনো যাবে দুধারে সুউচ্চ ইমারতের সারি। কোনোটা আবাসন আবার কোনোটা আইটির বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ। সর্বত্র সমস্যা একই, OMR কে উঁচু করে বানানো হয়েছে, এদিকে দুপাশের অঞ্চল নিচু এবং নিকাশি ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে জলমগ্ন। OMR থেকে সামান্য ভিতরে ঢুকে চেন্নাই কর্পোরেশনের শেষ সীমানায় পেরুমবাক্কামের পিছনের দিকে চেন্নাই স্লাম কন্ট্রোল বোর্ডের সেমনচেরি পুনর্বাসন প্রকল্পের সারি সারি বহুতল। সুনামি বিধ্বস্ত জেলে পরিবার ও ২০১৫ র বন্যায় নিচু জমিতে বসবাসকারী প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে এখানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মন্দির-মসজিদ-গির্জা সবকিছু থাকলেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সেইভাবে করা যায়নি। এছাড়াও আজীবন সমুদ্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের অনেকেই সমুদ্র থেকে ৫-৭ কিমি দূরে এসে থাকতে পারেনি। তাই অনেক পরিবার সরকারী পুনর্বাসন প্রকল্পে পাওয়া বাসা ভাড়া দিয়ে নিজেরা অন্যত্র থাকে। এই পুরো অঞ্চলটিই পাল্লিকারানাই মার্শল্যান্ডের অংশ কাজেই নিচু এবং সাধারণ বৃষ্টিতেই এখানে জল জমে। আর এখন একতলা সম্পূর্ণ জলমগ্ন হয়ে পড়ায় বাসিন্দারা নিজেরাই নৌকো চালিয়ে নিজেদের মতো কিছুটা নিরাপদ স্থানে সরতে থাকে।
OMR এর আইটি হাবকে কেন্দ্র করে গত দুই দশকে এর দুপাশে অতি দ্রুত গতিতে বেড়েছে নগরায়ণ। নগরায়ণের স্থপতিরা কিন্তু কেউ তামিলনাড়ুর বাসিন্দা নয়। এখানকার নির্মাণ শিল্পের কর্মীদের বেশিরভাগটাই পরিযায়ী শ্রমিক। এছাড়াও চা-জুসের দোকান, সেলুন, খাবার দোকান, আরবান কোম্পানির কাজে রয়েছে বিহার, ইউপি, অসম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ এবং উড়িষ্যা থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা। সেমনচেরির ভাড়াটিয়াদের একটা বড় অংশ এই পরিযায়ী শ্রমিকরা। অনেক সময় কোম্পানিগুলোই এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করে। উড়িষ্যার একটি গ্রাম থেকে আসা নির্মাণ শ্রমিকদের একজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের দরুন জানতে পারলাম ২ তারিখ রাতেই ঘরের দেওয়াল ভেঙ্গে গিয়ে সব জিনিসপত্র ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কোম্পানির তরফ থেকেই উদ্ধার করে ওদেরই হাতে বানানো ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চারদিন শুধু ম্যাগি খেয়ে থেকেছে। তারপরে কোম্পানি দুদিন ভাত খাইয়েছে। সরকারী সাহায্য কিছু পেয়েছে নাকি জানতে চাওয়ায় বলল— 'আমাদের দেবে না, আমরা তো এখানকার নই।’ সত্যিই তো! পরিযায়ী শ্রমিকদের যদি এত কিছু দিতে হয় তাহলে পরিযায়ী শ্রমিক দিয়ে কাজ করাবার সুবিধাটা আর কী! সেমনচেরিতে পুনর্বাসন পাওয়া তামিল অধিবাসীদেরই পানীয় জল, দুধ ইত্যাদি নূন্যতম পরিশেবা পাওয়ার জন্য রাস্তা অবরোধ করতে হল।
যে নগরায়ণ গড়ে উঠেছে তাদেরই বা অবস্থা কী? ভেলাচেরি অঞ্চলের বহু আবাসনের বেসমেন্ট পার্কিং জলের তলায়। গাড়িগুলো তাই ভেলাচেরি ফ্লাই ওভারে দাঁড়িয়ে থাকল জল না সরা পর্যন্ত। বহুতল আবাসনের গ্রাউন্ড পার্কিং এ দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ গাড়ি জলের স্রোতে ভেসে যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হতে দেখেছেন অনেকেই। ওটা মেধাবাক্কামের পূর্বা আবাসনের প্রাচীর ভেঙে গিয়ে হয়েছে। পেরুমবাক্কাম অঞ্চলে কোটি টাকা দিয়ে কেনা ভিলার একতলার অর্ধেক জলের নীচে। বাসিন্দারা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
সাধারণ ভাবে দুই থেকে চারদিন লেগেছে সব জায়গায় কারেন্ট আসতে। যেসব অ্যাপার্টমেন্ট জেনারেটর চালাতে পেরেছে তারা কিছুটা জলের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। না হলে সর্বত্র ছিল খাবার জলের হাহাকার। এই চিত্রটা চেন্নাই শহরের উন্নয়নের অংশ হয়ে ওঠা নতুন অঞ্চলের। পুরোনো শহর টিনগর, অ্যাপোলো মেইন হসপিটালের সামনেও নৌকা চলেছে। দিন সাতেক বাদে চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোর হাই ওয়ে দিয়ে যাবার পথে দেখলাম রাস্তার ধারের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ডালে ডালে বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক আটকে আছে। জল নেমে গেছে, জলের আবর্জনা উঠেছে গাছে। মানুষ-প্রকৃতি, ধনি-দরিদ্র, সরকারি-বেসরকারি—কোনটাই রেহাই পায় নি ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে।
এবারে একটু কারণ খোঁজা যাক
চেন্নাই শহরে তিনটি নদী, পাঁচটি বড় লেক এবং ছটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে। এছাড়াও পাল্লিকারানাই এর মতো একটি মার্শল্যান্ড আছে। প্রাকৃতিকভাবে রীতিমতো সমৃদ্ধ একটি শহরের আজকের অবস্থাটা খুবই করুণ। ১৯৬৫ সালের জরিপ অনুসারে ৫৫০০ হেক্টরের পাল্লিকারানাই আজ মাত্র ৬০০ হেক্টরে পরিণত হয়েছে। ৩৪৯ টি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল এটি। ১৩৩ রকমের পাখি এখানে দেখা যায়, যার মধ্যে অনেকগুলি পরিযায়ী প্রজাতির। পাখি আসার সংখ্যাটা কমে আসছে ক্রমশ। এহেন পাল্লিকারানাই এর বাস্তুতন্ত্র ও আয়তন সংকোচনের জন্য যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাঙের ছাতার মতো আবাসন প্রকল্পগুলি দায়ী তেমনই সরকারও তার বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য বেছে নিয়েছে এই মার্শল্যান্ডকেই। যেমন নাশান্যাল ইনিস্টিটিউট অব ওসান টেকনোলজি, সেন্টার ফর উইন্ড এনার্জি টেকনোলজি, এছাড়া সব থেকে বেশি জায়গা জুড়ে করা হয়েছে পেরুংগুডি ডাম্প ইয়ার্ড ও সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। GCC বা গ্রেটার চেন্নাই কর্পোরেশন ২০০ একর জমি নিয়ে তিন/চার দশক ধরে এখানে আবর্জনা ফেলছে। গত বছর এই ডাম্প ইয়ার্ডে আগুন লেগে যায়, উচ্চমাত্রায় নির্গত মিথেন গ্যাস যার কারণ। GCC শেষপর্যন্ত এখানে বায়ো মাইনিং প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে যে প্রক্রিয়া প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। রামসার ট্যাগ যুক্ত পাল্লিকারানাই এর শুধু সংকোচন হচ্ছে তাই-ই নয়, এর বাস্তুতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভীষণ ভাবে। যে মার্শল্যান্ড বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারত তাকে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করা হচ্ছে। সেখানেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকছে না বেশির ভাগ আবাসনে। এই না থাকাটা বেনিয়মের মধ্যেই পড়ে।
চেন্নাই এর তিনটি জলের ধারা অ্যাডেয়ার রিভার, কুয়ম রিভার আর বাকিংহাম ক্যানেল—তিনটেরই অবস্থা খুব খারাপ। এবছরই তামিলনাড়ু দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের জল বিশ্লেষণের রিপোর্ট অনুসারে তিনটে নদীই আপাতত মৃত। এগুলির জলে কোনও অক্সিজেন দ্রবীভুত নেই। BOD বা বায়লোজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড ২০ র নীচে, যে অবস্থায় অ্যারোবেটিক ব্যাকটেরিয়াগুলো বাঁচতে পারে না। এখানে প্রতিমাসে প্রতিলিটার জলে ৫০০-৭০০০ মিগ্রা কঠিন পদার্থ জমা হয় যা ডিকম্পোজ করার জন্য কোনও ব্যাকটেরিয়া নেই। অথচ এই নদীগুলি দিয়ে একসময় পণ্য পরিবহন করা হত নিয়মিত। ব্রিটিশ আমলে পণ্য পরিবহনের জন্য অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত ৪২০ কিমি দীর্ঘ বাকিংহাম ক্যানেল তৈরী হয়। একে যুক্ত করা হয় অ্যাডেয়ার নদীর সঙ্গেও। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এখান দিয়ে নিয়মিত পণ্য পরিবহন চলেছে। সরকারি নথি অনুসারে ১৯৫১-৫২ সালে বাকিংহাম ক্যানেল দিয়ে ২০.৭৩ কোটি টাকার পণ্য পরিবাহিত হয়েছে। ধীরে ধীরে অপরিসর ক্যানেল দিয়ে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়, প্রতি বছর পলি পরিষ্কার করাও ছিল ব্যয় সাপেক্ষ। তাই পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ক্রমে মজে যেতে শুরু করে নদী ও ক্যানেল। এগুলির সংস্কারের জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া দূরে থাক বিভিন্ন অঞ্চলের সিউয়েজের জল এখানে ফেলা হতে থাকে। এটাই সব নয়। টাইডেল পার্কের কাছ দিয়ে যাওয়া MRTS রেল লাইনের জন্য বেশিরভাগ পিলার তৈরী করা হয় বাকিংহাম ক্যানেলের মধ্যেই। রেল লাইন বা ব্রিজের জন্য নদীতে পিলার তৈরী হয় কিন্তু নদীর প্রস্থও সেক্ষেত্রে একটি বিচার্য বিষয় হওয়া উচিৎ। OMR এর উপর বেশিরভাগ স্টর্মওয়াটার ড্রেন যোগ করা হয়েছে বাকিংহাম ক্যানেলের সঙ্গে, যা নিজেই মৃত প্রবাহ।
ভেলাচেরি অঞ্চল এমনিতেই নিচু এবং প্লাবন প্রবণ অঞ্চল। তামিলে ভেল্লাম শব্দের দুরকম বানানের জন্য দুটি অর্থ হয়। একটি ভেল্লাম মানে হল বন্যা। সেখান থেকেই ভেলাচেরি নামকরণ। এই ভেলাচেরিতে একটি বড় লেক ছিল গত শতাব্দীর ৮০ এর দশক পর্যন্ত। এখন সেই লেকের আশি শতাংশ দখল হয়ে ফ্ল্যাট উঠে গেছে। যে কোনও লেকের ধারই প্রথমে নাগরিক সমাজের বর্জ ফেলার জায়গা, পরে সৌন্দর্যায়নের উপায় হিসাবে লেক ভিউ অ্যাপার্টমেন্ট।
এত কিছুর পরেও চেন্নাইবাসীর সামন্য ভরসা ছিল স্টর্মওয়াটার ড্রেনের উপর। কিন্তু সে গুড়ে বালি! চেন্নাই এর বিভিন্ন জায়গা অবস্থানগত কারণেই নিচু। জায়গাগুলি অনেকটা কানা উচু থালা বা বাটির মতো, যেখানে আশপাশ থেকে জল এসে সহজেই জমা হয়ে যেতে পারে। এরকম একটি শহরের স্টর্মওয়াটার ড্রেনের নেটওয়ার্ক তৈরীর জন্য যে পরিমান contour study (বিভিন্ন জায়গার সমন্নতি বোঝা) করার প্রয়োজন ছিল সেটা করা হয়নি। স্টর্মওয়াটার ড্রেনগুলির পরস্পর সংযুক্তি করণের ক্ষেত্রেও বিশেষ ত্রুটি আছে। IMSc র সামনের রাস্তার ড্রেনের থেকে OMR এর স্টর্মওয়াটার ড্রেনের উচ্চতা বেশি, তারপরে সেটা গিয়ে পড়েছে যে বাকিংহাম ক্যানেলে তার জল প্রবাহের ক্ষমতা নেই। পরিণতিতে তিন/চার ফুট জল দাঁড়িয়ে গেছে ঐ রাস্তায়।
গজিয়ে ওঠা এত ফ্ল্যাট বাড়ির কি সত্যিই দরকার আছে?
লগ্নিপুঁজির একটা অংশ ব্যাঙ্কে থাকা সামাজিক সঞ্চয়। এই সামাজিক সঞ্চয়কে বাজারে টেনে আনার জন্য একটা সময় জমা টাকার উপর লোভনীয় সুদ দেওয়া হত ব্যাঙ্কে। তারপর ক্রমে সুদের পরিমাণ কমতে থাকে। বাজারে মুদ্রাস্ফীতিও বাড়তে থাকে। দুই এ মিলে জমা টাকা ব্যাঙ্কে থাকলে একসময় ঋণাত্মক সঞ্চয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আবার সুদের উপর আয়কর বসানো হল। এদিকে বিশ্বায়নের যুগে যখন মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে আইটি হাব গড়ে উঠতে শুরু করল তখন ভারতে মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল, যাদের আয়ের বাড়তি অংশকে বাজারে টেনে আনার জন্য ব্যাঙ্কঋণ সুলভ করা হল। থাকল হাউস বিল্ডিং লোনের উপর আয়কর ছাড়ের ব্যবস্থা। লোনের টাকার গন্তব্য হল রিয়াল এস্টেটের মার্কেট। আর ইএমআই এর মাধ্যমে ব্যাঙ্ক টেনে নিতে থাকল মাসিক আয়ের একটা অংশ। ফ্ল্যাট কেনাটা বাস করার জন্য যতটা দরকার তার চেয়েও একটা বড় তাগিদ সঞ্চিত অর্থকে ক্রম অবমূল্যায়নের হাত থেকে বাঁচানো, কারণ বাড়ি তৈরীর উপকরণের বাজার দর ফ্ল্যাটের দামকে অবমূল্যায়ন হওয়ার থেকে বাঁচায়। উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের প্রয়োজন ও নিরুপায়তা—এই দুই রিয়াল এস্টেটের বাজারের আসল মূলধন। তৈরী হল একদল জমি মাফিয়া, যারা প্রশাসনের ছিদ্রগুলোকে খুঁজে নিয়ে জাঁকিয়ে বসল। একের পর এক জলাভূমি দখল হতে থাকল, সরকারি নিয়ম কানুন থাকল কাগজে বন্দি হয়ে। বাস্তবে সে সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাজার এগোতে থাকল। তৈরী হওয়া সারি সারি ফ্ল্যাট বাড়ির একটা অংশ খালি পড়ে থাকে। একটা অংশ চুক্তি ভিত্তিক ভাড়ায় ভাড়াটিয়া বদল হতে থাকে নিয়মিত। বহু ফ্ল্যাটের মালিক এদেশে থাকেই না। শুধুমাত্র বিনিয়োগের উদ্দেশ্যেই ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে।
উপসংহার
চেন্নাই এর এই নতুন নগরায়ণ এখনও পর্যন্ত জলাভূমি ভরাট করেই তৈরী হয়েছে। এখানে যে বনাঞ্চলগুলো আছে তাতে খুব একটা হাত পড়ে নি। তবে পুঁজি বিনিয়োগোর ও বাজারের বর্তমান এই ধারা শুধু চেন্নাই এর সমস্যা নয়। এ সমস্যা ভারতের সর্বত্র। বিশ্বের অন্যত্রও আছে। খুব সস্তাই প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিয়ে ঠিকা শ্রমিককে শোষণ করে পুঁজিকে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। আর এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বায়নের দরুন বদলে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন এই পাল্টে যাওয়া বাস্তুতন্ত্রকে আরও বিপদজনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে ক্রমশ। ক্লাইমেট এন্ড ক্যাপিটালিজম ওয়েব পোর্টালের একটি রিপোর্ট বলছে এ বছর ভারতে ১ লা জানুয়ারী থেকে ৩০ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৭৩ দিনের মধ্যে ২৩৫ দিন চরম আবহাওয়া নথিভুক্ত হয়েছে। ৩০০০ মানুষ এই চরম আবহাওয়ার বলি হয়েছেন এ পর্যন্ত। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রীন হাউস গ্যাসের হিসাবের তালিকায় পরিবহন ও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে খরচ হওয়া জীবাশ্ম জ্বালানিকে শুধু আনা হচ্ছে। যাকে সামনে রেখে বিকল্প শক্তির সন্ধান চলছে আর পরিবহনে বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির জন্য বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এটি আগামীদিনের বিপুল সম্ভামনাময় বাজার হতে চলেছে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় বিরল ধাতুর নিষ্কাশনে যেমন জল লাগে তেমনই বিদ্যুৎ লাগে। তাছাড়া একটি যুদ্ধে যে পরিমান জ্বালানি ও রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় তা যে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য ব্যাপক পরিমানে দায়ী এবং ঘটমান অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক সে কথা প্রথম বিশ্ব সযত্নে এড়িয়ে যায়, কারণ যুদ্ধাস্ত্রের বাজার তাদের অর্থনীতিকে সজীব রাখে, যুদ্ধ দিয়েই পুঁজিবাদ তার সঙ্কট থেকে উত্তরণের রাস্তা খোঁজে। তাই যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ করার কথা বা যুদ্ধ বন্ধ করার কথা তারা কখনও বলে না।
চেন্নাই এর বন্যা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গোটাটাই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলস্বরূপ মনুষ্যকৃত অবিমিশ্রকারিতার ফসল। কাজেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থার আমূল বদল ছাড়া এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্র উপকূলবর্তী অনেক শহর জলের নিচে তলিয়ে যাবার কথা। চেন্নাই তাদের মধ্যে একটি। হয়তো আমাদের মধ্যে অনেকেই সেদিন থাকব না, তবু সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াসটুকু জারি থাকুক। জারি থাকুক পরিবেশ আইন উল্লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, সব সবকমের বেনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ।
0 Comments