একদিনে যে বইটার ১২৫০ কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল

অশোক মুখোপাধ্যায়

২৪ নভেম্বর ১৮৫৯। লন্ডন শহরের একটি বইয়ের দোকান। সময় – সন্ধ্যা ৬ বেজে ৩৭। 

কাউন্টারে একজন খদ্দের এলেন।

-- জীববিজ্ঞানের নতুন বইটার এক কপি দিন। 

-- On the Origin of Species? দুঃখিত স্যর, আর কোনো কপি নেই। একটু আগেই শেষ হয়ে গেল। 

-- একটাও কপি আজ পাওয়া যাবে না? 

-- না, মিস্টার, সন্ধের মধ্যেই ওনারা যা ছাপিয়েছিলেন সব শেষ হয়ে গেছে। 

-- তার মানে মিঃ মারে কম করে ছাপিয়েছেন বোধ হয়, তাই না?

-- তাই বা বলি কী করে? একজন নবাগত লেখকের একটা অত্যন্ত সিরিয়াস তথ্যবহুল বই সাহস করে ১২৫০ কপি ছাপিয়ে এনেছিলেন। ওনাদের নিজেদের কাউন্টার আর আমাদের মতো চার জায়গায় কপি দিয়েছিলেন। লোকে কার্যত লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বই কিনে নিয়ে গেল। জাস্ট ভাবতেই পারছি না, কয়েক ঘন্টার মধ্যে এটা কী হল। 

-- আমারও অবাক লাগছে। ভাবলাম অফিস করে বাড়ি ফেরার সময় কপি নিয়ে যাব। ছেলে অনেক করে বলে দিয়েছিল। এরকম জানলে তো লাঞ্চ ব্রেকের সময়ই একবার বেরিয়ে এসে..

-- হ্যাঁ, আমরা কেউই ভাবতে পারিনি, বইটার এতটা চাহিদা হবে। তাহলে আগে থাকতেই আরও কপির অর্ডার দিয়ে রাখতাম।

-- এনার কিছু কিছু লেখা এদিক ওদিকে পড়েছি। খুব ইন্টারেস্টিং। তবে তখন সেরকম থ্রিলিং কিছু মনে হয়নি। তাই আমার ধারণাই ছিল না, এত তাড়াতাড়ি সব বিক্রি হয়ে যাবে!

-- যাই হোক, খুব বেশি হতাশ হবেন না। প্রকাশক সাহস পেয়ে গেছেন। খুব শিগ্‌গিরই আবারও ছাপবেন আর এবার কম করে পাঁচ হাজার কপি ছাপাবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। মাসখানেক হয়ত লাগবে। টাইটেলটা নিরীহ দেখতে হলেও বইটার মধ্যে একটা কিছু মারাত্মক জিনিস আছে। রিভিউ হলে বুঝতে পারব। যাই হোক, পরে খোঁজ নিয়ে আসবেন, পেয়ে যাবেন। 

-- কাইন্ডলি একটু জানাবার ব্যবস্থা করা যাবে? 

-- নিশ্চয়ই কেন নয়? আপনি আপনার ঠিকানা লেখা একটা রিপ্লাই পোস্টকার্ড পাঠিয়ে রাখবেন। আমরা বেরলেই চিঠিটা ডাক বাক্সে ফেলে দেব। আপনার নামে এক কপি রেখেও দেব।

-- ঠিক আছে। তাই করব। আগামী কাল। পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ। 

-- আপনার জন্যও সর্বোত্তম শুভেচ্ছা। অবশ্যই আবার আসবেন। 

কী ব্যাপার? কী এমন ঘটনা ছিল সেই বইটার প্রকাশ? এক দিনে দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে গেল! 

আসুন, একে একে দেখি।

রহস্য আর কিছুই নয়। ১৮৫০-এর দশকে ইংল্যান্ডের শিক্ষিত নাগরিক সমাজে, লন্ডন ম্যাঞ্চেস্টার অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজের ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে আড্ডায় আলোচনায় তখন ভেসে বেড়াচ্ছিল একটা ভাব তরঙ্গ – এই বুঝি সেই উনির সৃষ্টিতে আবার এমন কিছু ফাঁক ধরা পড়তে চলেছে, যাতে ওনার আসন টলমল করে উঠবে। 

চার্লস ডারউইন পেশাদার অর্থে গবেষক নন, অধ্যাপকও নন। অন্তত তখন অবধি পেশাদার বিজ্ঞানী হিসাবেও গণ্য ছিলেন না। তিনি তখন একজন শখের প্রকৃতিবিদ। সেই হিসাবে সরাসরি বিজ্ঞানীদের ক্লাব সদস্য নন। কিন্তু তখনকার কয়েকজন নামকরা বিজ্ঞানী তাঁকে চিনতেন এবং একনিষ্ঠ প্রকৃতি পর্যবেক্ষক ও প্রাকৃতিক নমুনা সংরক্ষক হিসাবে তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন এবং মূল্য দিতেন। তিনি যখন অথৈ নীল (কিংবা কালো অথবা লাল) সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়াচ্ছেন দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে, তখন সেই বিজ্ঞানীদের কাছে নানা রকম সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের সবিস্তার খবর দিয়ে চিঠিপত্র লিখতেন। তিনি জানতেন না, সেই সমস্ত চিঠি বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ঘরোয়া সভায় সম্মিলিত ভাবে পড়া হত এবং কোনো কোনোটা এদিক ওদিকে দু একটা পত্রিকায় ছাপাও হয়ে যেত। এই ব্যাপারে জন স্টিফেন্স হেন্সলো এবং অ্যাডামস সেজউইক বেশি করে উদ্যোগ নিতেন। বিশেষ করে তাঁর সংগ্রহের বৈচিত্র্য নতুনত্ব ও বিশালতা দেখে দেখে সেজউইক সেই কালেই পূর্বঘোষণা করে ফেলেছিলেন যে “চার্লস অচিরেই ইউরোপের সেরা প্রকৃতিবিদদের মধ্যে জায়গা করে নেবে”। তবে এই সেজউইক আবার ডারউইনের প্রজাতি রূপান্তরের চিন্তার সঙ্গে একমত ছিলেন না। 

ফলে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সমাজে জীব জগতের প্রজাতিগুলির ধ্রুবত্ব এবং চিরস্থায়িত্ব নিয়ে নানা মাত্রায় প্রশ্নের গুনগুনানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আবার ডারউইন একটু দ্বিধায়ও ছিলেন, প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা তাঁর নতুন ভাবধারাকে কীভাবে গ্রহণ করবেন। ১৮৪৪ সালে সদ্য পরিচিত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী জন হুকারকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমি প্রায় নিশ্চিত যে প্রজাতিগুলির পরিবর্তন হয়েছে।” তার পরেই বন্ধনীতে লিখলেন, “it is like confessing a murder”! 

মার্ডার? বলেন কী? কাকে? 

হ্যাঁ, এই সেই প্রশ্ন যা নিয়ে আজও দুনিয়ার এক পবিত্র অংশ তোলপাড় হচ্ছে নিত্য দিন। প্রজাতির পরিবর্তনের বিষয়টার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্য অসংখ্য প্রজাতির বিলোপের পরিঘটনা। যিনি এদের পরম স্রষ্টা তিনিই আবার একই সঙ্গে তাদের বিলোপন কর্তা হন কী করে? তাঁর সৃষ্ট জীবকে কে বা কারা বিলুপ্ত করে দিল? প্রকৃতি? তাহলে প্রকৃতি কি তাঁর চাইতেও বেশি শক্তিমান? ডারউইনের নতুন প্রস্তাবিত তত্ত্ব কি গুটি গুটি পায়ে সেদিকেই এগোচ্ছিল? 

টমাস হেনরি হাক্সলে তখনও প্রজাতির পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন না। না, কোনো আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের কারণে নয়। স্রেফ সাক্ষ্যের অভাবে। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানী হিসাবে তথ্য প্রমাণ ছাড়া তিনি কিছু মানতে পারেন না – সেই কারণে। কিন্তু যতই ডারউইনের বিভিন্ন ছোটখাটো লেখা পত্র পত্রিকায় বেরতে লাগল, ডারউইন সম্পর্কে তিনি এধারে ওধারে নানা রকম প্রশংসা বাক্য শুনতে পেলেন, তাঁর মতও পাল্টাতে শুরু করল। 

ইতিমধ্যে ডারউইন রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন (১৮৩৯)। ১৮৪৪ সালে লিনিয়ান সোসাইটিরও সদস্য হলেন। ফলে চতুর্দিক থেকে তাঁর কাছে পরামর্শ, আবদার, প্রশ্ন ধেয়ে আসতে লাগল, তিনি কবে তাঁর সমস্ত পর্যবেক্ষণকে বিশ্লেষণ করে একটা বইতে প্রজাতি রূপান্তর প্রক্রিয়াকে পরিপূর্ণ তত্ত্বের আকারে ব্যাখ্যা করবেন। 

তিনি সবাইকেই বলেন, কাজ এগোচ্ছে। ১৮৪২ সাআল থেকে একটা বৃহৎ আয়তনের বইতে হাত দিয়েছেন বলে শুভানুধ্যায়ীদের জানান। অথচ মাঝে মাঝেই তাঁর শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়ে। তখন কাজ একেবারে থমকে যায়। ১৮৫১ সালে তাঁর আদরের বড় মেয়ে স্কারলেট জ্বরে ভুগে মারা যায়। আবার কাজ ঢিমে হয়ে পড়ে। 

তার পর ১৮৫৮ সালের ১৮ জুন এল একটা ছোট চিঠি আর একটা বড় প্যাকেট। চিঠিটা লিখেছেন আলফ্রেড রাশেল ওয়ালেস, সুদূর প্রাচ্যের বোর্নিও থেকে। প্যাকেটে ছিল বোধ হয় একটা কাল-বোমা। ওয়ালেস ডারউইনের পরিচিত এবং অনুজ বন্ধু স্থানীয়। বহু কাল ধরে দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠি এবং তথ্য চালাচালি হত। ওয়ালেস এর আগে ডারউইনকে অনেক নমুনাও পাঠিয়েছেন বিবেচনার জন্য। সেই তিনি একটা প্রবন্ধ লিখে চার্লসকে পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন, যার শিরোনামেই জ্বলজ্বল করছে প্রাকৃতিক নির্বাচন কথাটা। ডারউইনের ছোট ছেলেটি তখন খুব অসুস্থ। ২৮ জুন সে মারা যায়। ফলে তিনি পেপারটা নিয়ে গেলেন চার্লস লায়েল এবং হুকারের কাছে। তাঁদের বললেন, “আমার মন মেজাজ ভালো না। কাগজ কলমে মন দিতে পারছি না। এই ব্যাপারে আপনারাই যা করার করুন”। 

তাঁরা দুজনে মিলে ঠিক করলেন, লিনিয়ান সোসাইটিতে ১ জুলাই এক সভায় ডারউইন এবং ওয়ালেসের তরফে একটা যুগ্মপত্র পড়া হবে। তাতে দুজনেরই কাজ সম্পর্কে কিছু কথা থাকবে। কে কবে থেকে কতটা এগিয়ে – সেই সব তথ্য সবাইকে জানানো হবে। 

মজার কথা হল, পেপারটা পড়া হলেও সেই পাঠের প্রতিক্রিয়া তেমন হল না। ১৮৫৯ সালের মে মাসে লিনিয়ান সোসাইটির সভাপতি আক্ষেপ করলেন, এখনও তেমন কোনো যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা আসছে না। শুধু মাত্র এক অধ্যাপক স্যামুয়েল হটন বললেন, “সেই পত্রে যে সব কথা নতুন, সেগুলি ভুল; আর যে কথাগুলি ঠিক সেগুলো নিতান্তই পুরনো।”

কিন্তু কেউ কেউ এত সব কাণ্ড ঘটার আগেই খানিক বুঝে ফেলেছিলেন, জীববিজ্ঞানে নতুন একটা যুগান্তকারী চিন্তা আসছে। ১৮৫৮ সালের ১৪ জুন ম্যাঞ্চেস্টারের ফ্রেডরিক এঙ্গেলস নামক এক জার্মান শিল্পপতির পুত্র তাঁর একজন প্রবাসী দরিদ্র জার্মান বন্ধু কার্ল মার্ক্সকে চিঠি লিখলেন, চার দিক থেকে প্রজাতিগুলির বিবর্তনের খবর ভেসে আসছে। বুড়ো হেগেল বেঁচে থাকলে খুশি হতেন দেখে যে তাঁর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন সংঘটনের সূত্রটি এখন জীববিজ্ঞানের পাতায় পাতায় কিলবিল করছে। 

তখনও লিনিয়ান সোসাইটিতে কিন্তু সেই যুগ্মপত্র পাঠ করা হয়নি। 

অর্থাৎ, হ্রস্বতর শব্দে হলেও ১৮৫৯ সালের নভেম্বর মাসের সেই বইটির জন্য টেমস নদীর ধারে ধারে একটা উন্মুখতা তৈরি হচ্ছিল। বইটার আগমন যখন ঘোষিত হল, আগ্রহী ক্রেতারা আর দেরি করেননি। এমনিতেই তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১২৫০ কপি এমন আর বেশি কী? 

আরও মজার কথা হল, ম্যাঞ্চেস্টারের সেই প্রবাসী জার্মান ভদ্রলোক কিন্তু সেদিন দুপুরে ফ্যাকটরি থেকে বেরিয়ে এসেই এক কপি কিনে নিয়ে গেছেন।  


না, সবটা এখনও বলা হয়নি। আর সামান্য ধৈর্য ধরতে হবে। 

অতঃপর ডারউইন কর্তৃক স্বীকারিত সেই হত্যা কাহিনি। যে খুনের মামলা আজও চলছে। 

১৮৫০-এর দশকে ইংল্যান্ড, কিংবা ইউরোপে, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইত্যাদি ভৌত বিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞান, শারীরতত্ত্ব, গণিত – এই সব মিলিয়ে ধরলে বিজ্ঞানের জগতে নিয়মের রাজত্ব মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল বলে ধরা যায়। আধুনিক (কোপারনিকাস ও ভেসালিউস উত্তর) বিজ্ঞানের উদ্ভব যে ধর্মতত্ত্ব প্রচারিত এবং সেই সুবাদে জনমতে সঞ্চারিত জগৎ সম্বন্ধীয় ধ্যান ধারণাগুলিকে প্রায় নির্বংশ করে দিয়েছিল, সেই কথা এখন সকলেই জানেন। শুধু খ্রিস্টমত ভাবলে ভুল হবে, সমস্ত ধর্মেরই তত্ত্বকথাকে ধরেই কথাটা বলতে চাইছি। পৃথিবী অস্থির হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ধরে রাখার জন্য প্রকল্পিত হাতি, কচ্ছপ, বাসুকীনাগ ইত্যাদিরা চিরকালীন ছুটি এবং অনন্ত কালীন বিশ্রাম পেল, ঘাড় থেকে অত ভারি একটা বোঝা বওয়ার হাত থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতিও পেল। মাথার উপরের নীল আকাশ মর্ত্যলোক থেকে অনেকটা দূরে সরে গেল। সিনাই অলিম্পাস বা হিমালয় পর্বতের ঠিক উপরে আর সে রইল না। সূর্যের তেজও তার পর অনেকটা বেড়ে গেল। সে আর এখন থেকে নিছক গ্রহ নয়, তারা হিসাবে চিরস্থায়ী মর্যাদা পেয়ে গেল। সৌর পরিবারের কর্তা বনে গেল। আমাদের এই প্রাণপ্রিয় যে পৃথিবীর এত কাল কোনো আই কার্ড ছিল না, সেও এখন গ্রহ হিসাবে খানিক স্বীকৃতি লাভ করল। পাশাপাশি, চাঁদ মামার স্ট্যাটাস একটু নেমে গেল ঠিকই, কিন্তু তাকে অন্তত প্রাকৃতিক বস্তু হিসাবে মেনে নেওয়ায় তার উপর আগে যে সমস্ত দায়দায়িত্ব বা দোষের ভাগ চাপানো হচ্ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হল। 

আবার এই সমস্ত ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের যে নিয়ম সর্বস্বতার খবর পাওয়া যাচ্ছিল, তার মধ্যে সহজেই ভগবান সাহাবকে ঢুকিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল। এই নিয়মগুলো কে চালু করল? কেন, ভগবানজি! কে এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুকে এত সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালনা করছে? মহামহিম ঈশ্বর, আবার কে? গ্রহ নক্ষত্রগুলিকে আকাশের বুকে চির চলমান করে রেখে দিয়েছে সেই সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরই। পৃথিবীর বুকে অপর্যাপ্ত জল হাওয়ার বন্দোবস্ত করে রেখেছে সেই সর্ব কল্যাণপরায়ণ ভগবানই। সেই ভগবানই আবার উদ্ভিদ প্রাণী মানুষ সবাইকে এমন ভাবে তৈরি করেছে যে একে অপরের কাজে লাগে, খাদ্য পায়, বাহক পায়, ওষুধ পায়, আস্তানা বানাতে পারে, ইত্যাদি। যেদিকেই তাকাও না কেন, সব দিকেই তার খেলা, তারই লীলা, তারই মঙ্গলময় ছাপ। সর্বজ্ঞানের সাক্ষ্য, অতুল বুদ্ধির চিহ্ন। 

অমন যে হাফ-নাস্তিক জাঁ ব্যাপ্তিস্ত ল্যমার্ক, তিনিও এই সার্বিক ঈশ্বরমগ্নতায় দাঁত (আসলে কলম) ফোটাতে পারেননি। 

কিন্তু.. 

এই বারে আমরা সেই আসল ঘটনার পৃষ্ঠজমিতে পা দিতে চলেছি। কিংবা বলা ভালো, আমরা ১৮৩৮ সালে চার্লস ডারউইনের পেছন পেছন সেই জমির দিকে পা ফেলে চলেছি। 

ডারউইন নেহাত আকস্মিক ভাবেই এক পাদ্রি কাম অর্থনীতি লেখক টমাস রবার্ট ম্যালথুস (১৭৬৬-১৮৩৪)-এর সেই কুখ্যাত বইখানা হাতে পেয়ে পড়তে শুরু করেছেন। An Essay on Population; ম্যালথুস নিতান্ত শ্রেণিগতভাবে শ্রমিক বিরোধী অবস্থান থেকে গরিব মানুষের জীবন সংগ্রামের যে আখ্যান রচনা করেছিলেন, যেখানে তিনি সরকারকে গরিবদের সাহায্য করতে নিরুৎসাহ করতে চাইছিলেন, যাতে বাইরের সাহায্য না পেয়ে গরিব লোকের সংখ্যা আপনা থেকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, বেড়ে যেতে না পারে (এবং সেটা তিনি আবার অঙ্কশাস্ত্রের সাজসজ্জা দিয়ে পেশ করেছিলেন), সেই জায়গাটা পাঠ করে ডারউইনের চোখ খুলে গেল। 

তাই তো, তাই তো! 

তাহলে জীব জগতেও কি এটাই বাস্তবে ঘটে? কোনো পরামর্শদাতা ছাড়াই? কারও হস্তক্ষেপ ছাড়াই? প্রকৃতিতে এক একবারে যত জীব শাবকের জন্ম হয়, সীমিত রসদ ও সুযোগের কারণে সকলের পক্ষে বেঁচে থাকা, টিকে থাকা সম্ভব হয় না, খাদ্য সুরক্ষার এই সংগ্রামের জন্য? এতে তাহলে সেই তিনিজির কোনো ভূমিকা নেই?

বুঝুন কাণ্ডটা। ঈশ্বর ভক্ত পাদ্রি সাহেব কি আর জানতেন, তাঁর লেখা থেকেই একজন প্রকৃতিবিদ ঈশ্বরের অক্ষমতার হদিশ পেয়ে যাবেন? কিছু করার নেই। মানে, তাঁর আর কিছু করার ছিল না। ডারউইন যখন তাঁর সেই বইটা পড়ছেন, তিনি তখন ইতিমধ্যেই উপরে (মতান্তরে, নীচে) চলে গিয়েছেন। বইটার আর কোনো পরিমার্জিত ঈশ্বর রক্ষক সংস্করণ বের করার উপায় তাঁর ছিল না। বোরোলিনের টিউব থেকে মলম অনেকটা বেরিয়ে গেছে। আর তা টিউবে ফিরে ঢোকানো সম্ভব নয়। 

অস্যার্থ, ম্যালথুসের থিসিসটা সামান্য উলটে দিলেন ডারউইন। সরকার হস্তক্ষেপ না করলে মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে; ডারউইন বুঝলেন, প্রকৃতিতে পশুপাখি গাছপালার সার্বিক সংখ্যা যে নিয়ন্ত্রণে থাকে তারও কারণ এই যে কেউ হস্তক্ষেপ করছে না, বা, করতে পারে না। 

থিসিসটা শোনার পর মনে হতে পারে, এ আর এমনকি কথা। এর জন্য ম্যালথুসকে লাগছে কেন? 

সব রহস্য সমাধানের পরেই এই এক প্রশ্নবোধক বাক্য ধেয়ে আসে। এদেশের মতোই ওদের দেশেও। সমাধান হয়ে গেলেই সকলে মনে করতে থাকে, কী সহজ, কী সহজ। এ আর এমন কী! কিন্তু না, যতক্ষণ সমাধান না হচ্ছে, তখন অনেক কাজ আটকে থাকে। ডারউইনের ছিল। ওয়ালেসেরও ছিল। ম্যালথুস থেকে পাওয়া সেই ক্লুটা খুব জরুরি ছিল। ম্যালথুসের উপরে আমাদের রাগ থাকতেই পারে। থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রশ্নে তাঁর এই অবদানকে অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতার সমান।

অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও তাই বলে রাখা ভালো, ডারউইনের চোদ্দ বছর পরে মালয় দ্বীপে জ্বরে ভুগে শুয়ে থাকার সময় আলফ্রেড রাশেল ওয়ালেসও ম্যালথুসের সেই বইটা পড়ে মোটামুটি সেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। 

অস্তিত্বের সংগ্রাম। যার জৈব সামর্থ্য বেশি, খাদ্য সংগ্রহ এবং/অথবা আত্মরক্ষার যোগ্যতা বেশি, সে টিকবে। অন্যরা অস্তিত্ব থেকে হঠে যাবে। সামর্থ্য বেশি বা কম কী দিয়ে ঠিক হয়? কে ঠিক করে দেয়? 

এই প্রশ্নের উত্তরে আর তিনিজিকে বসানো যাচ্ছে না।

তার তো সকলের জন্যই কল্যাণীয়েষু রূপ থাকার কথা। সে কিছু জীবের ভালো চাইবে আর অন্যদের কুচোখে দেখবে এমনটা কি হতে পারে? হলে কি তাকে সেই উচ্চাসনে বসিয়ে পুজো করা যায়? 

কাজটা করে প্রকৃতি। প্রকৃতিই ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। অশৃঙ্খল প্রভেদন (random variation)। অস্তিত্বের সংগ্রামে যারা সফল তারাই প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয়। বাকিরা বিলুপ্ত হয়। 

প্রকৃতি কি জেনে বুঝে করে? 

না। জেনে বুঝে করা গেলে ভগবানই কাজটা করে ফেলতে পারত। না বুঝেই করতে হয় বলে প্রকৃতিকে লাগে। প্রকৃতির তো আর চৈতন্য নেই। নেই বলেই তো বিজেপি-র অত সাধের চার ধামের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে ধস নেমে গেল। কেদার বদ্রিরা কিছুই করতে পারল না। জোশীমঠ মাটিতে উলটে পড়ল প্রকৃতিরই খেয়ালে। কেউ কি ঠেকাতে পারল? 

ভগবানের জায়গায় এই ভাবে যখন ডারউইন প্রকৃতিকে একটু একটু করে সামনে নিয়ে আসছেন, তখনই তাঁর খেয়াল হয়, আ রে, এতে সেই তিনির তো বারোটা বেজে যাবে! খুব মন খারাপ হল তাঁর, ভক্ত এবং বিশ্বাসীদের কথা ভেবে। আর দুঃখ করে সে কথাই তিনি চিঠিতে লিখে ফেলেন, It is like confessing a murder! 

আজ যদি কোনো নিরপেক্ষ বিচারকের ঘরে এই মামলা যায়, তিনিও বলতে বাধ্য হবেন, “বাদী ঈশ্বর ও বিবাদী প্রকৃতি দুই পক্ষের উকিলদিগের কথা সবিস্তারে বহু কাল ধরিয়া শুনিবার পর আদালত উপযুক্ত বিচার বিবেচনা সাপেক্ষে ঘোষণা করিতেছে যে বিবাদী পক্ষের প্রথম উকিলের আদি স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সত্যই প্রকৃতি ১৮৫৯ সালের ২৩ নভেম্বর খুন করিয়াছে ঈশ্বরকে। এবং তদনুযায়ী বিবাদী পক্ষের উপর এই অপ্রত্যার্হ সাজা ঘোষণা করিতেছে যে বিবর্তনবাদের পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক মনুষ্য বসবাসকারী ধরাধামে সেই দিবস হইতে সর্বসাকুল্যে ২৬৭ বৎসর পর্যন্ত স্থায়ী হইবে। তৎপূর্বে ইহার কোনো রকম নিষ্পত্তি হইতে পারিবে না।”

বিতর্ক তাই ডারউইনের পেছন ছাড়েনি আজও। আসছে বছর আবার হবে। বছরের মাঝখানেও হবে। বিভিন্ন ধর্মের তাকতশালী গোষ্ঠী যখন যে দেশে ক্ষমতার আসনে বসবে তখন তারা পাঠ্যক্রম থেকে ডারউইনের তত্ত্বকে নির্বাসনের মরিয়া প্রচেষ্টা চালাবে। বিজ্ঞানের সপক্ষে নতুন নতুন উকিল এসে তার বিরোধিতা করবে, বিবর্তনবাদের পক্ষ নিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষাকে তুলে ধরবে। 

এই মতাদর্শিক বিরোধ চলতে থাকবে আরও অনেক দিন।

Darwin's hand-written quote from Origin of Species (left) for the Autographic Mirror magazine. Credit: National University of Singapore

  

    

Post a Comment

0 Comments