অশোক মুখোপাধ্যায়
ত্রিভুবন ধিংড়া স্যর নিজে আসছেন এই মফস্বলের ব্লকের এন আর সি-র কাজ কেমন চলছে দেখতে। বিডিও সাহেব ঘন ঘন স্টাফদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। চেয়ার, চা এবং লাঞ্চে আপ্যায়ন, বিশ্রামের জায়গা সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। বলেন্দ্র বাগচী রসিকতা করে বলেই ফেলল, ‘স্যর, অত ভাবছেন কেন? যে তিনটে কেস আজ ওনার জন্য রেডি করে রেখেছি, খানাপিনা আর বিশ্রাম আজ ওনার কপালে জুটবে কিনা সন্দেহ।’
‘আরে বাগচী, ওটাই তো ভয়ের।’ বিডিও পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। অবশ্য কেউ কেউ পেছনে বলে, উনি নাকি ঘাম না থাকলেও রুমালটাকে কপালে ঘসে দেন, যাতে উনি যে উদ্বিগ্ন বোঝা যায়। ‘আমরা কেন কেস্টা ট্যাকল করতে পারলাম না, এটা বোঝাতেই আমাকে হিমসিম খেতে হবে। আপনাদের আর কী? শুধু দেখবেন, চায়ে যেন গন্ধটা ঠিক মতো আসে।’
বাগচী বলল, ‘স্যর অত ভাববেন না। আমি আর কেশব তিন কাপ চা শুধু টেস্ট করার জন্যই খেয়ে নিয়েছি। বিলকিস ম্যাম যা বানাচ্ছেন, কী আর বলি আপনাকে। নেবেন নাকি এক কাপ?’
‘অ্যাঁ, বল কী বাগচী? তোমরা কি চা বানিয়ে রেখেছ নাকি? স্টক থেকে ওনাকে দেবে? ধিংড়া তোমার এবং আমার চামড়া গুটিয়ে দেবে। একদম নয়, একদম নয়।’
কেশব আর বলেন্দ্র পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। ভাবখানা হচ্ছে, ওরকম কত ধিংড়া এল আর গেল! নেহাত, এখন এন আর সি-র কাজ চলছে, এবং দুচারটে কেস জলে যাওয়ায় এগনো যাচ্ছে না, তাই। নইলে—
বিডিও বললেন, ‘ডিএম অফিস থেকে ডিএম স্যরকে নিয়ে উনি বেরিয়ে পড়েছেন। এখানে পৌঁছতে আর হয়ত আধ ঘন্টা লাগবে। পার্টিকে বসিয়ে রেখেছ তো? দরকার হলে ওদেরও একটু চা বিস্কুট পাঠিয়ে দাও। অফিসের চা আবার দিতে যেও না। রতনলালের দোকান থেকে—’
‘ব্যবস্থা হয়ে গেছে স্যর। তেনারা তাস খেলছে। দুদিন বাদে কে কোন ক্যাম্পে যাবে ঠিক নেই, কিন্তু ফুর্তিতে তাস খেলে যাচ্ছে।’
বলেন্দ্র খুব ভালো মুডে আছে। অনেক কায়দা করে এই কটা সেকুকে পাওয়া গেছে একেবারে খাপে পুরে ফেলার জন্য। রাজ্য সরকার যাই বলুক, ওর বক্তব্য এই অ্যাদ্দিনে দিল্লিতে একটা কাজের লোক প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসেছে। যারা শুধু মুখেই ওদের বিরুদ্ধে বলে না, করে দেখাতে চায়। কাশ্মীরে আসামে করে দেখিয়ে দিচ্ছে। খপাখপ কাটার বাচ্চাদের জালে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই ব্লকেও এত দিনে হাজার তিনেককে সনাক্ত করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই তিনটে লোকের জন্য সব খেলা মাটি হয়ে আছে। প্রচারটচার করে পাব্লিকের মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব এনে ফেলেছে।
কেশব বলল, ‘না বলাইদা, এটা তোমার ভুল ধারণা। এরাও যে এতটা করতে পারল তার কারণ কিন্তু আসাম। এত টাকাপয়সা খরচা করে এত ঢাকের বাজনা শুনিয়ে শেষ অবধি কিন্তু আমাদের লোকই বেশি ফেঁসে গেল। কাটা কম কাটা পড়ল। এতে খুব বাজে প্রভাব পড়েছে এখানকার লোকেদের মধ্যে।’
‘তুই সব বুঝে গেছিস না?’ বলেন্দ্র টেবিলে একটা সার্জিকাল চাপড় মেরে বলল, ‘শুধু ওদের করলে কী হত বুঝিস? নাগরিক পঞ্জির কাজটাকেও সাম্প্রদায়িক বলে সারা বিশ্বে সেকু মাকুরা একটা হইচই ফেলে দিত। তাই কটা আমাদের লোককেও দেগে দেওয়া হয়েছিল। প্ল্যান ছিল, পরে এফ টি থেকেই বেশির ভাগ বের করে আনা হবে।’
‘কিছু কি হল তার?’
‘হবে কী করে? সে ব্যাটারা এই সব প্যাঁচ বোঝে নাকি? শালারা বলছে, এখন আর এফ টি-তে যাবেই না!’
‘তুমি কি মনে কর বাগচীদা, এদের বিশ্বাস করা যাবে?’
‘কেন, তোর হঠাৎ এরম প্রশ্ন কেন? বিশ্বাস না করার মতো কিছু হয়েছে?’
‘না, মানে, আমি বলছিলাম, উনিশ লাখের মধ্যে বার লাখই হিন্দু—এটা কি ন্যায্য হল?’ কেশব একটু এদিক ওদিক দেখে নিল, আর কেউ শুনছে কিনা, ‘সতের লাখ কাটাদের করে দুলাখ হিন্দুদের না করলেই হত। তাহলে এত কথা উঠত না।’
বলেন্দ্র খেপে গেল প্রায়, ‘কাদের তুই এত হিন্দু হিন্দু করছিস? এই সব লোকগুলো বেশিরভাগই হিন্দু সমাজের গাঁজলা। শ্যামাপ্রসাদের লেখা পড়ে দেখ। ওরম হিন্দু আসলে হিন্দুই নয়।’
‘বামুন কায়েতও কম নেই। রোজই কিছু কিছু নাম বেরচ্ছে। কাগজে, ফেসবুকে। তুমি দেখ না?’
‘দেখব না কেন? শোন পাগল, শুভ কাজে নিজেদের কিছু আত্মদানও করতে হয়। ধরে নে না কেন, এরা তারাই।’
কেশবের মুখ শুকিয়ে গেল। ‘তাহলে আমাকেও নাম কেটে দেবে? পাল বলে?’
এতক্ষণে বলেন্দ্র বুঝতে পারল গোল কোথায় হচ্ছে। ও যে লাইনে সংলাপ চালাচ্ছিল, তাতে কেশবের এখনই এন আর সি-র বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার কথা। সেটা হতে দেওয়া যায় না। আজ অনেক ঝামেলা আছে অফিসে। ও এবার লাইনটা তাড়াতাড়ি পালটে ফেলল, ‘দ্যাখ ভাই, আমি প্রধানমন্ত্রীকে যেমন দেখছি, উনি খাঁটি হিন্দুদের খুব ভালোবাসেন। উনি না থাকলে এখন কত জনের যে জেল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল জানিস তো? সবাইকে উনি বের করে এনেছেন, বাইরে রেখেছেন। আসাম যদি সহযোগিতা করে, একজন হিন্দুকেও ক্যাম্পে যেতে বা থাকতে হবে না। একটা হাফ মুরগি চ্যালেঞ্জ!’
কেশব পাল থতমত খেয়ে গেল। ‘সেই চ্যালেঞ্জ নিলে, তাও আবার হাফ মুরগি? ওতে কিছু হয়?’
এগারোটা বাজে। বাইরে গাড়ির আওয়াজ হতেই সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। বিডিও একদম মূল দরজার কাছে চলে গেছেন। ধিংড়া সাহেবের ব্যাগটা বলেন্দ্র নিল, ডিএম সাহেবেরটা নিল কেশব।
‘স্যর, চা না কফি, কী দিতে বলব?’
ডিএম বললেন, ‘কফিই দাও, কিন্তু কাজ জলদি শুরু কর। ওনার আবার ছটায় ফ্লাইট। অনেকটা রাস্তা গাড়িতে যেতে হবে। রাস্তায় জ্যাম হলে মুশকিল।’
‘ইয়েস স্যর, ইয়েস স্যর। স্যর লাঞ্চ কখন সার্ভ করা হবে? নাকি খেয়ে একবারে শুরু করবেন?’
‘এই বুদ্ধি নিয়ে ব্লক চালান কী করে? এই সব ক্রস চেকিং-এ ভীষণ চাপ হয়। মাঝখানে বিশ্রাম নিতে দিতে হবে। দেখছেন না বয়স্ক লোক?’
ধিংড়াই এবার হস্তক্ষেপ করলেন, ‘ওকে ওকে, ডোন্ট কোয়ারেল। লেট আস প্রসিড। কাম চলতে চলতে হম খানেউনে কা কাম নিপ্টা লেঙ্গে। পহ্লা কেস্কো বুলোয়াইয়ে। পেপারস আপ কে পাস রেডি হ্যাঁয়?’
কেশব বারান্দায় গিয়ে হাঁক দিল, ‘বিরূপাক্ষ গোলদার? ভেতরে আসুন। কাজ শুরু হবে।’ দু পা ঘরের বাইরে গিয়ে আর একবার হেঁকে বলল, ‘এই যে আপনারা চেঁচামেচি করবেন না। আস্তে কথা বলুন। অফিসে কাজের অসুবিধা হয়।’
ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক ভেতরে এলেন।
বলেন্দ্র বাগচী আগেভাগেই ডিএম সাহেবকে এনার সম্পর্কে অনেকটা ফিডব্যাক দিয়ে রেখেছেন। ডিএম আবার ধিংড়া সাহেবকে দিয়েছেন। ইনি এন পি আর-এ কোনো সহযোগিতা করেননি শুধু নয়, করবেন না বেশ জোর দিয়ে বলে দিয়েছেন। পাড়াতে বহু লোককে ইনি এত প্রভাবিত করেছেন যে ওনার এলাকায় অনেকেই এন পি আর ফর্ম ভর্তি করেনি। সুতরাং একে আজ একটু জোরে রগড়াতে হবে বলে ভাবা আছে।
বিডিওই একটু গলা খাকারি দিয়ে শুরু করলেন, ‘আপনার নাম?’
বিরূপাক্ষবাবু অনুচ্চ স্বরে উত্তর দিলেন, ‘জানেন তো আপনারা সকলেই। আপনার অফিসের একজন তো এই মাত্র হাঁকল। নিশ্চয়ই শুনেছেন। পরের প্রশ্ন করুন।’
‘নাম বলতে আপত্তি কেন?’ বলেন্দ্র বললেন, ‘নিজ মুখে . . . ’
‘আপত্তির কী থাকবে?’ বিরূপাক্ষ বললেন, ‘আমার নামে গোপন কিছু নেই। আপনাদের অফিস থেকেই আমাকে ডেকেছেন। নিশ্চয়ই নাম জেনে এবং ধরেই ডেকেছেন। তাই বলছিলাম, দু নম্বর প্রশ্ন করে ফেললেই হয়। আপনাদের আর আমার সময় বাঁচে।’
‘বলছিলাম না স্যর, এই কটা লোক টেরিয়া আছে। আমাদের কাজে প্রবল ভাবে বাগড়া দিয়ে চলেছে।’
ধিংড়া সাহেব নড়েচড়ে বসলেন চেয়ারে। চশমাটা টেবিলে নামিয়ে রেখে যতটা পারা যায় গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ম্যায় পুঁছ রহা হুঁ, আপকা শুভ্ নাম ক্যায়া হ্যায়?’
যাকে প্রশ্ন করলেন, তিনি চুপ করে বসে রইলেন। মুখে কুলুপ।
বলেন্দ্র বাগচীর মাথা গরম হয়ে গেল, ‘সাহেব প্রশ্ন করছেন আর আপনি চুপ করে বসে আছেন?’
বিরূপাক্ষ বাবু মাথা ঘুরিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, ‘উনি কী জানতে চান? আমাকে বলেছেন কিছু?’
‘এখানে আপনি ছাড়া আর কে আছে যাকে ইন্টারভিউ করা হচ্ছে? নাম জানতে চাইছেন।’
‘আপনারা বলে দেননি?’
‘আরে, মশাই, আপনি তো দেখছি খুব ত্যাঁদড়। একজন অফিসার নাম জিগ্যেস করছেন, আর আপনি ইয়ার্কি মারছেন?’
‘ইয়ার্কি মারলাম কোথায়? ওনার প্রশ্ন তো আমি বুঝতেই পারিনি। মনে হল গারো ভাষায় কিছু বললেন বটে। কিন্তু আমি ওদের ভাষা একদম বুঝি না। আর আমাকেই যে বলেছেন তাও বুঝতে পারিনি।’ ধিংড়া সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাফ করবেন স্যর।’
বিডিও সাহেব এবার সত্যিই ক্ষেপে গেলেন। ‘বলি, একটা প্রশ্ন নিয়ে আর কতক্ষণ খিল্লি চলবে?’
ডিএম এতক্ষণে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ বণিক। তোমাদের ইয়ং চ্যাপদের ভাষা একজন সিনিয়র অফিসারের সামনে নাই বললে। উনি তো আর এরকম বাংলা শুনে বুঝবেন না!’ তারপর বিরূপাক্ষবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনুন বিরূপাক্ষ গোলদার মশাই। উই আর ওয়েস্টিং সাম প্রেসাস মোমেন্ট। আপনার মাথার উপর খাড়া ঝুলছে, সেটা আশা করি জানেন। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলে আপনারই লাভ হবে। বড় সাহেব একবার বিগড়ে গেলে কেস্ কোন দিকে ঘুরে যাবে বলা মুশকিল। নাম আপনাকে আর বলতে হবে না। কিন্তু এর পর থেকে যা যা জিগ্যেস করা হবে, ভালো ছেলের মতো উত্তর দিতে থাকুন। বণিক, নেক্সট।’
‘বয়সের প্রমাণপত্র এনেছেন কিছু? বের করুন।’ বলেন্দ্র কাজের কথায় ফেরেন।
‘স্কুলে পড়ার সময়কার ক্লাশ সেভেনের মার্কশিট এনেছি। এটাই আছে আমার কাছে। ওতে হবে?’
‘স্কুলের মার্কশিটে বয়স? আবার ফাজলামো করছেন?’
‘তা কেন? আমি যদি ১৯৬৫ সালে ক্লাশ সেভেনের ছাত্র হই, তাতেই তো প্রমাণ হয় আমার জন্ম ১৯৮৭ সালের আগে। তা নইলে আ---’
বিরূপাক্ষ গোলদারের কথা মুখেই ফুরিয়ে যায়। বিডিও ধমকে ওঠেন, ‘যুক্তি দিচ্ছেন? সাহেব কি যুক্তি দিতে বলেছেন না প্রমাণ? এরম করতে থাকলে আপনাকে ক্যাম্প থেকে বাঁচানো যাবে না বলে দিচ্ছি। এটা আপনার নাগরিকত্ব প্রমাণের ব্যাপার। বিয়ের লগ্ন গণনা নয়!’
‘প্রমাণ হিসাবে কী আনতে হবে বলুন।’ বিরূপাক্ষবাবু এখনও শান্ত।
‘জন্ম সালের প্রমাণ। বুঝেছেন? কবে জন্মেছেন তার সঠিক প্রমাণ চাই আমরা।’ বলেন্দ্র বাগচী উত্তর দেন।
বিরূপাক্ষবাবু বলেন, ‘আমার মা বাবা কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু একজন মাসি বেঁচে আছেন। তাঁকে আনলে হবে?’
‘মাসি? জন্মের প্রমাণ পত্র? পাগল নাকি মশাই আপনি? কাগজ লাগবে।’
‘কাগজই তো এনেছিলাম স্যর। তাকেও তো আপনারা নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। আর কী কাগজ আনব?’
ডিএম মনীন্দ্রলাল পয়রা এতক্ষণ ধিংড়াকে চালু হিন্দিতে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন। তার ভিত্তিতে সাহস করে তিনি বলে উঠলেন, ‘আপ কা বার্থ সার্টিফিকেট কাঁহা হ্যায়? ও লাইয়ে!’
কেশব ফ্যাঁচ করে হেসে ফেলল। হাসিটাকে ঢাকতে গিয়ে বলেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে কেশে নিল খানিকটা। ডিএম তাড়াতাড়ি বললেন, ‘নো স্যর, হি ইজ সেয়িং হি ওয়াজ বর্ন ইন নাইনটিন ফিফটিফোর। ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল কম্পালসরি বার্থ সার্টিফিকেট ওয়াজ ইন্ট্রোডিউসড ইন নাইনটিন এইটটি এইট। সো ও চিজ কোই আদমি লা নহি পায়েগা।’ পরিস্থিতি ম্যানেজ করার জন্য বিডিওকে বললেন, ‘বণিক, এনাকে চা দাও।’ তারপর চোখ টিপলেন।
বলেন্দ্র বাগচীও বুঝলেন। সোজা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গোলদার, আপনি এখন আসুন। আপনাকে আর একটা চান্স দেওয়া হবে। পরে যেদিন ডাকব সেদিন যদি বয়সের প্রমাণ আনতে না পারেন, তাহলে কিন্তু আর . . .’
চা খেতে খেতে সকলের মিনিট পাঁচ সাত গেল। ধিংড়া সাহেব বললেন, ‘চলিয়ে, কাম শুরু কিয়া যায়।’
তারপর ডাকা হল দ্বিতীয় জনকে, ‘নুরুদ্দিন শেখ, চট করে চলে আসুন।’
লুঙ্গি পরে যে লোকটি ভেতরে এলেন, তাকে দেখে গেজেটেড সাহেবদের ভক্তি হওয়া সম্ভব নয়। একেবারে চাসা বলতে যা বোঝায় তাই। মুখে অনেক দিনের দাঁড়িগোঁফ। বলেন্দ্রই শুরু করল, ‘আপনার নাম?’
‘জি, নুরুদ্দিন, মানে নুরুদ্দিন শেখ।’
‘বাবার নাম?’
‘আজমল রশিদ সার।’
বিডিও সাহেব সপাটে ধমকে উঠলেন, ‘কী বলছেন মশাই—বাবার নাম আজমল রশিদ আর আপনার নাম নুরুদ্দিন শেখ? এরকম হয় কখনও?’
‘কেন হবেনি সার, আমার বড় আব্বার নাম ছিল কলিমুদ্দিন হান্নান . . .’
সুখেন বণিক ডিএম-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যর পুরো কেস গোলমেলে। এর নাম কেটে দিন। আর ফালতু সময় খরচা করে কাজ নেই।’
‘এটা আজ তোমার বলার কথা নয়।’ পয়রা সাহেব অনুচ্চ স্বরে শাসিয়ে দিলেন, ‘মিঃ ধিংড়া স্যর এসেছেন, উনিই ফাইন্যাল ডিসিসন নেবেন। তোমার যা বলার ওনাকে বল।’
‘ইয়েস স্যর, সিওর স্যর।’
ধিংড়া মনে করলেন, ওনার এবার কিছু বলা দরকার, ‘বাত ক্যায়া হ্যায়? ইনকি গড়বড়ি কুছ হ্যায় লাগতা হ্যায়?’
‘স্যর ম্যায় কহুঁ?’ বাগচী জানেন ওর মতো চোস্ত হিন্দি এই ব্লকে কেউ বলতে পারে না। দেশপ্রেমিক প্রতিভা দেখানোর এই সুযোগ উনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না, ‘দেখিয়ে স্যর, ইন কা পিতাজি কে নাম সে ইন কা নাম তালমেল খাতা নহি হ্যায়। ইয়ে অপনা দাদাজি কা জো নাম বতায়া ও ভি কুছ অওর হ্যায়। ম্যায় নে শুরুয়াত সে হি তো বোল রহা থা, ইয়হ দেখনে সে হি পতা চলতা হ্যায় কি---’
‘নো লেকচার বাগচী’, ডিএম সাহেব ওনাকে থামিয়ে দিলেন, ‘নো লেকচার, নো ইন্টারপ্রিটেশন। আপ সির্ফ স্যর কো ফ্যাক্টস বতা দো। উস সে ফয়সালা ক্যায়া নিকালনা, ওয়ে কহেঙ্গে।’
মিঃ ধিংড়া এই একটানা হিন্দি বাচনে খুশি হলেন। এতক্ষণ ধরে খালি বাংলা চলছিল। কিছু বলতেও পারছিলেন না। কাজটা করতে হবে। ভাষা নিয়ে মাথা গরম করে দিলে এখন আসল কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। এই ব্লকের ৩৬৭ জনের নাম বাদ পড়তে চলেছে, তিনি শুনেই এসেছেন। তাঁর কাজ আজ তাকে সরকারি শিলমোহর লাগিয়ে যাওয়া। সেন্ট্রাল হোম মিনিস্টার রোজ হিসাব চাইছেন, পার ডে কজনকে ডি করা হল। আজকেই তিনজন হয়ে যেত, কিন্তু এরা তো একজনকে ঝপ করে ছেড়ে দিল। ওনার নিজেরই বোকামিতে। কিন্তু এই লোকটাকে . . .
‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড, আই আন্ডারস্ট্যান্ড, মিঃ পায়রা’, উনি বললেন, ‘ইস আদমি কা নাম কো কাট দে সকতে হ্যাঁয় আপলোগ। মুঝে পতা চল গয়া হ্যায়। পেপার্স দিজিয়েঁ।’
পয়রাকে পায়রা বলাতে রাগ হলেও ডিএম সাহেব সেটা আপাতত হজম করে নিলেন। হিন্দিওয়ালাদের উচ্চারণ ওরকমই। কী আর করা যাবে। কিন্তু ডিসিসনটা আজই হয়ে যাক, তিনি চাইছেন না। লোকজন চারদিকে ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে আছে। একটা মারকাটারি ভাব জেগে উঠছে। না পার্টি না মিনিস্টার কেউ পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। এটা আর যাই হোক আসাম নয়। এখানে তো বাঙালিরা ভয়ে ভয়ে নেই। চতুর্দিকে নো এনার্সি, নো এনার্সি করে যে পরিমাণ হুজুগ চলছে, তাতে ঘি ঢালা ঠিক হবে না। যেভাবেই হোক, ভুজুং ভাজুং দিয়ে এই কেস্টাকেও আজ ঝুলিয়ে দিতে হবে। মুচকি হেসে বললেন, ‘অগর মুঝে পারমিসন দেঁ তো ম্যায় এক বাত কহুঁ।’
‘হাঁ হাঁ, জরুর বোলিয়ে।’
‘আই থিঙ্ক, উই শুড গিভ দিস চ্যাপ অ্যানাদার চান্স টু প্রুভ হিস আইডেন্টিটি। উই হ্যাভ টাইম।’
‘আপ হিচকিচাতে কিউঁ?’ ধিংড়া এবার মনে হল একটু রেগেই গেলেন, ‘দেস কো কোই করোর ঘুসপেটিয়োঁ সে বচানে কে লিয়ে হম সভি লোগোঁ কো চন্দ স্ট্রিক্ট হোনা পড়েগা। অওর ইয়হ মুসলিম হ্যায় না? বংলাদেস সে ইন সারে লোগ আ গয়ে হোঙ্গে। লেকিন অব জো সরকার হ্যায়, ওহ চাহতি হ্যায়---’
বাগচী আর পারছিলেন না। একটা মুরগি হাতের তলা দিয়ে গলে যাচ্ছে ভেবে প্রায় খেপে গিয়ে বলে ফেললেন, ‘স্যর, দুচারটে মুসলিমকে নাম কেটে দিলে পাব্লিক খুশিই হবে। আপনি যে ভয় পাচ্ছেন, . . .’
ডিএম ধমকে দিলেন, ‘লুক টু ইওর অডিয়েন্স ইডিয়ট!’
বিডিও অবস্থা সামলাতে মিঃ ধিংড়াকে বললেন, ‘স্যর ইন কো আভি হাম ছোর দেঙ্গে ক্যায়া?’
বড় অফিসার তো, বুঝলেন এবারও একটা কিছু ঝামেলা হয়ে গেছে। খুব দুঃখের সঙ্গেই বললেন, ‘হাঁ, ঠিক হ্যায়, আপলোগ জ্যায়সে সমঝেঙ্গে, . . .’
লাঞ্চটা জব্বর হল। কেশব ঠিকই বলেছে। কাটারা রাঁধতে জানে। “আরসালান” লোকাল রেস্তোরাঁ থেকে নিরামিষ যে লাঞ্চ প্যাক করে দিয়েছে, বিশেষ করে বাটার পনিরটা, দুর্দান্ত। মিঃ ধিংড়ার পাতের চামচটাতে আলো পড়ে যেরকম চিকচিক করছে, তাতেই এর স্বাদ মালুম! উঃ মাটন বিরিয়ানি হলে যে আজ কী ভালো হত! বলেন্দ্র আর এক পিস পনির দাঁত দিয়ে কাটতে কাটতে ভাবলেন।
‘আপ কা দিল দিমাগ ঠিক হ্যায় না পায়রা?’
‘ব্বস, ঠিক হুঁ ম্যায়! বোলিয়ে স্যর।’
‘আপ কা হোমওয়ার্ক পুরা নহি হুয়া ক্যায়া?’
‘ইয়েস স্যর।’ মনীন্দ্রলাল পয়রা বিরক্ত হলেও মনে মনে ভাষাটা একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘মেরা জহাঁ তক সুচনায়েঁ মিলি হ্যাঁয়, ইস জিলে মেঁ মহমেডান লোগোঁ নে বহোত দিনোঁ সে ইস দিন কে লিয়ে তৈয়ারি কিয়া হ্যায়। ইন এভরি মসজিদ দে হ্যাভ মেট অ্যান্ড টকড ফর ডেইজ টুগেদার হাউ টু অ্যানসার আওয়ার কোয়ারিজ। দে আর নট মোস্টলি আউটসাইডার্স। রাদার, আ লার্জ পার্ট অফ দা বেঙ্গলি হিন্দুজ আর আউটসাইডার্স। উই হ্যাভ টু প্রসিড কেয়ারফুল্লি।’
‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড, আই আন্ডারস্ট্যান্ড’, ধিংড়া বললেন, ‘ওকে, জ্যায়সে আপলোগ চাহেঙ্গে। . . . আরে আরে, ফির কফি কিউঁ? আধা ঘন্টা তো কম সে কম জানে দেঙ্গে।’
সুখেন বণিকও কেস্টা বুঝে নিলেন। হাজার হোক, এই ডিএম-এর সঙ্গে আরও ক মাস কাটাতে হবে। এই মওকায় একটু তাল (বা আসলে এক রকমের তেল) দিয়ে রাখা ভালো। কফির কাপ হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘এটা আপনি একদম পারফেক্ট বলেছেন স্যর। মুসলিম পরিবারে সারনেম সব সময় মিলিয়ে হয় না। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। ওই লাইনে আইডেন্টিফাই করতে গেলে সত্যিই প্রবলেম হতে পারে।’
বাগচী ধিংড়ার সামনে নিজের অবস্থান বোঝানোর সুযোগটা নিয়ে ফেলল, ‘বাট স্যর, উই আর গেটিং নোহোয়ার উইথ দিস আল্ট্রা-কশন! দিজ ফেলোজ আর ব্ল্যাকমেইলিং আস!’
ডিএম বললেন, ‘তুমি একটা লোকের নাগরিকত্ব কেটে নেবে, আর সাবধান হবে না? কী বলছ? হ্যাঁ, প্রেসার তো আছেই। দুদিক থেকেই আছে। উপর থেকেও চাপ আসছে। সরকার একবার যখন ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে, আমাদের প্রসিড করতে হবে। আবার নীচের চাপও আছে। মনে রেখ বাগচী, আজ এরা আছে, কাল নাও থাকতে পারে। তুমি আমি এই সব দপ্তরে থেকে যাব। কোথাও না কোথাও। জবাব পরে আমাদেরই দিতে হবে। এরা আসামে যে ছুঁচো গিলে নিয়েছে, সেটাই আগে পেটে যায় না বেরিয়ে আসে দেখ।’
বলেন্দ্র আপাতত চেপে গেলেন। উপরে ডিএম আর নীচে কেশব প্রায় একই কথা বলছে। পা ফেলার আগে চোখ মেলে গর্ত দেখে না নেওয়া ঠিক হবে না।
নাম ডাকের পরে বিনয় মার্ফা নামে যে ব্যক্তিটি এসে ঢুকলেন, তার পরনে ধুতি, গায়ে ফতুয়া। কিন্তু কপালে এক দলা সিঁদুর লেপে রয়েছে। দেখেই বলেন্দ্রর পিত্তি জ্বলে গেল। ব্যাটা খাঁটি হিন্দু সেজে এয়েচে। মাঠে ময়দানে সেকুলারিগিরি করে এসে এনার্সির টেবিলে সিঁদুর! মজাটা টের পাওয়াতে হবে।
‘নাম কী মহাশয়ের?’
‘আমার ওই একটিই নাম। যা দিয়ে হাঁকলেন দাদা।’ মার্ফাবাবু বিনয়ের অবতার যেন।
‘নাম বলায় আপত্তি আছে?’ বলেন্দ্রর পারা চড়ল।
‘না না, আপত্তি কেন? যা জানেনই মশায়রা, তা আবার কইতে হবে কেন বুঝতে পারলুম না।’
‘আপনি কি সব বুঝে বুঝে কাজ করেন?’
‘বাব্বা, না বুঝে করলে হবে? কখন কী বেফাঁস কথা কয়ে দেব, রক্ষে আছে তখন?’
বিডিও সুখেন বণিক হাল ধরে নেবার চেষ্টায় ব্রতী হলেন, ‘এখানে প্রশ্ন আমরা করব, আপনি শুধু উত্তর দেবেন। পালটা প্রশ্ন করবেন না।’
‘আচ্ছা স্যর।’
ডিএম জিগ্যেস করলেন, ‘বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি ছিল আপনাদের?’
মার্ফা অবাক হলেন, ‘বাংলাদেশে? ওখেনে বাড়ি হতে যাবে কেন? আমরা হাওড়ার আদি লোক। এখন কাজের সূত্রে এখানে এসে বাড়ি করে পরিবার নিয়ে আছি’
‘হাওড়া?’ ডিএম আগ্রহ বোধ করলেন। তিনিও হাওড়ারই কিনা। ‘হাওড়ার কোন জায়গায়?’
‘গরচুমুক, স্যর। উলবেড়ে দিয়ে যেতে হয়। হুগলি নদীর ধারে একদম।’
‘তাহলে আপনাদের জমিজমা সংক্রান্ত পুরনো দলিল পত্র সবই তো আছে। দেখাননি কেন?’
‘রেজিস্ট্রি অফিস দেখতে চাইলে অবিশ্যিই দেখাতুম। কিন্তু নাগরিক হওয়ার জন্য দেখাতে মন করল না। এত বছর দেশে আছি। চাষবাস করে করে-কম্মে খাচ্ছি। এখন যদি দুম করে বলেন, তুমি এদেশের লোক বট কিনা প্রমাণ দাও, সে বড় অপমানের বিষয় হয়ে পড়ে হুজুর।’
বলেন্দ্র জানেন, ডিএম নিজে সাক্ষাৎকার নেবার সময় তার কথা বলা উচিত নয়, তবুও না বলে পারলেন না, ‘আর দেশ থেকে বের করে দিলে সম্মান বাড়বে বুঝি!’
বিনয় মার্ফা সব কটা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝে নিলেন, এটাই সকলের কথা কিনা। নিশ্চিন্ত হয়ে নিয়ে থেমে থেমে বললেন, ‘দেখুন সাহেবগণ, আপনাদের হাতে লাঠি বন্দুক আছে, চাইলে জোর করে আমাদেরকে বের করে দিতেও পারেন। কিন্তু তাতেও সম্মান কেড়ে নিতে পারবেন না। ফাঁসিতে চেপে ক্ষুদিরামের বা মদনলালের মান যায়নি। বেড়েছেই বরং। জমির মালিকানা নিয়ে ঝগড়া হোক, দলিল দেখাব। ভোট দিতে এসে বুথে আই কার্ড দেখাব। কিন্তু নাগরিক কিনা জানতে চাইলে কিচ্ছু দেখাব না। কোথায় যেতে হবে বলুন, রেডি হয়েই এসেছি।’
ধিংড়া সাহেবের মনে হল, তাঁকে কিছু বলা হল। নামটা কেমন যেন শোনা শোনা ঠেকল। মদনলাল --- মদনলাল --- হ্যাঁ ধিংড়াই তো। অনেক পুরনো ইতিহাস মনে পড়ে গেল। তাঁর নিজের রাজ্য পাঞ্জাবের কথা। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে বিশ সাল বাদে লন্ডনেই ডায়ারকে গুলি করে মেরেছিল যে ভারতীয় ছাত্র, পাঞ্জাবের লোক। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসের মধ্যে একটা তরঙ্গ বয়ে গেল এক লহমার জন্য। বিস সাল বাদ। বিস সাল বাদেও যে খুনীকে ছাড়েনি। পয়রার দিকে ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করলেন, ‘ইয়হ বন্দা ক্যায়া বোলনা চাহতা হ্যায়?’
ডিএম এই প্রশ্নে বিপদ গুনলেন। কথা ঘোরানোর জন্য বললেন, ‘দে আর পলিটিক্যাল মেন স্যর। অলওয়েজ এজিটেটিং পিপ্ল আগেন্সট এনার্সি প্রোগ্রাম।’
‘নহি নহি, ও বাৎ ছোড়িয়ে। উহ ম্যায় সমঝ গয়া। লেকিন মদনলাল নাম সে ইন কা ক্যায়া লেনাদেনা?’ তারপর মার্ফার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘সিন্দুর চুপকাকে কিউঁ আয়া আপ?’
বলেন্দ্র খুশি হলেন। ডিএম ফিএম বাঙালি বলে সহজে কাউকে কিছু করতে চাইছেন না। এ লোকটার সে দায় নেই। সাহসী আছে। বিনয় মার্ফার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, মিঃ মার্ফা, কপালে অত সিঁদুর চাপিয়েছেন কেন? বড় সাহেব জানতে চাইছেন।’
বিনয়বাবু এই বার তাঁর নিজের জায়গা যেন খুঁজে পেলেন। হেসে বললেন, ‘শুধু আমি একা নই স্যর। বাইরে আরও হাজার দুয়েক লোক সিঁদুর চাপিয়েই এসেছে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখুন।’
বলেন্দ্র বাগচী এই বার চমকে গেলেন। ‘হাজার দুয়েক লোক? সবাই সিঁদুর চাপিয়ে? মানে কী এর?’
‘হিন্দু ঘরানায় স্যর বলি দেবার আগে পাঁঠার মাথায় কপালে সিঁদুর লেপে দেওয়া হয়। বড় পবিত্র বস্তু কিনা।’ খানিকটা দম নিয়ে বললেন, ‘আমাদেরও তো আপনারা বলিই দেবেন ঠিক করেছেন। তাই আমরা ভাবলুম, কপালে কিঞ্চিত সিঁদুর ঘসে যাই। বড় অফিসারের জন্য এক কৌটো সিঁদুর ভরে এনেছি। উনি এক চামচ করে আমাদের সকলের মাথায় লাগিয়ে দিন! ক্যাম্পে হয়ত দিন কাল ভালো কাটবে।’
ডিএম বিডিও এবং ধিংড়া স্যরের মধ্যে নিঃশব্দ ইসারা বিনিময় হল। মিঃ বণিকের চোখের ইসারায় কেশব বারান্দায় গিয়ে বাইরেটা দেখে ছুটে ভেতরে এল। ‘সাংঘাতিক ব্যাপার স্যর। বাইরে অজস্র লোক। সবাই কপালে সিঁদুর লেপ্টে এসেছে। আর প্রত্যেকের হাতে একটা করে তোরঙ্গ।’
‘কী ব্যাপার বিনয় মার্ফা? কী চান আপনারা?’ বিডিও সাহেব জিগ্যেস করলেন, ‘এসবের মানে কী?’
মিঃ মার্ফা আরও বিনয় দেখালেন, ‘কিছুই নয় স্যর। অহেতুক ভয় পাবেন না। বাইরে এনারা সবাই চলে এসেছেন ক্যাম্পে যাবেন বলে। নাগরিক হওয়ার লোভে এরা কেউ কাগজপত্র দেখাবেন না। তাই তৈরি হয়েই এসেছেন।’
‘আমরা তো ডাকিনি এদের কাউকে?’
‘আজ না হলেও কাল তো ডাকবেন। কী দরকার? আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে? আমরা চলেই এলাম। বসে থাকব। যেদিন ক্যাম্পে নিয়ে যাবেন চলে যাব। মাঠেই আছি।’
ডিএম সাহেব দ্রুত বিডিওর হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। খুব নিম্ন স্বরে বললেন, ‘অবস্থা ভালো ঠেকছে না। আপনি পেছনের কোনো জায়গা দিয়ে ধিংড়াকে গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করে দিন। ঘেরাও ফেরাও করার আগে।’
‘আপনিও স্যর ওনার সাথেই চলে যান। আমরা এদিকটা সামলে নিচ্ছি।’
‘ওকে। আমি গাড়িতে উঠে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পুলিশকে মেসেজ পাঠাচ্ছি।’
মিঃ বণিক বললেন, ‘একটা কথা বলব স্যর? পুলিশ ডাকবেন না। খবর একবার ছড়িয়ে গেলে দু হাজার থেকে দু লক্ষ হতে সময় লাগবে না! তার চে’ আজ আমরা অফিস ক্লোজ করে দিই, কাল সকালে এসে দেখা যাবে।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, ফাস্ট ফাস্ট।’
তিন বড় অফিসার চলে যাওয়ার পর বিনয়বাবু উঠে দাঁড়ালেন, বলেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারাও পালাবেন নাকি? আমি তাহলে বাইরে গিয়ে সবাইকে খবরটা দিই?’
‘কী খবর?’
‘এনার্সি হচ্ছে না। দলিল দেখনেওয়ালারা সিঁদুর দেখে পালাচ্ছে!’
কেশব পাল অবুঝের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল—হা হা হা হা হা!
0 Comments