ভারতে গণতন্ত্র কাজ করবে না, ভারতের সামাজিক কাঠামো সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধারণ করতে অক্ষম | Ambedkar-BBC interview

১৯৫৩ সালে বিবিসিকে দেওয়া বাবাসাহেব আম্বেদকরের সাক্ষাৎকারের একটি অংশ বিবিসি কিছু বছর আগে (২০১৭) প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকারে ড. আম্বেদকর ভারতের গণতন্ত্র এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন৷ মূল ভিডিও সাক্ষাৎকারটির যেকটি ইংরেজি প্রতিলিপি ইন্টারনেটে আছে প্রায় সবগুলিতেই সাক্ষাৎকারের কিছু জায়গায় অস্পষ্টটার (সাউন্ড) কথা স্বীকার করা হয়েছে। ৭০ বছর পরেও সাক্ষাৎকারটির প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে মেহনতিতে আমরা এটির একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করলাম। বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রেসিডেন্সী কলেজের ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষে পাঠরতা লাবণ‍্য দাস। পরিমার্জনায় টিম মেহনতি। 

সাংবাদিক :  আপনি কী মনে করেন ভারতবর্ষে গণতন্ত্র কার্যকর?
আম্বেদকর : না। খাতায় কলমে থাকতে পারে --
সাংবাদিক : অর্থাৎ? 
আম্বেদকর : অর্থাৎ ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের বেশ কিছু অনুসঙ্গ আছে। যেমন - ধারাবাহিক নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী, এবং আরো অনেক কিছু।
সাংবাদিক : কিন্তু একটা দেশের জন্য ভোট ব্যবস্থা জরুরি নয় কি?
আম্বেদকর : না। ভোট ব্যবস্থা তখনই জরুরি যদি তার মধ্যে দিয়ে কিছু ভালো মানুষ উঠে আসে।
সাংবাদিক : কিন্তু একটা দেশে সরকারে বদল আনার প্রয়োজনে নির্বাচন জরুরি নয় কি?
আম্বেদকর : হ্যাঁ। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারে বদল আনার এই ধারণাটি ক'জন মানুষ পোষণ করে? কেউ নয়। মানুষের মধ্যে এই বোধটাই নেই। তাছাড়া আমাদের দেশের ভোট ব্যবস্থাটা এমনই যেটা কোনো নাগরিককে ইচ্ছেমতো প্রার্থী নির্বাচন করার সুযোগটাই দেয় না। ধরা যাক, কংগ্রেস ইদানিং প্রচার করছে 'ষাঁড়' চিহ্নে ভোট দেওয়ার জন্য। তাই তো?
সাংবাদিক : হ্যাঁ।
আম্বেদকর : এবারে, সাধারণ মানুষ একবার ভেবেও দেখে না কে 'ষাঁড়' চিহ্নের হয়ে ভোটে দাঁড়াচ্ছে। সেই চিহ্নের আড়ালে যে দাঁড়াচ্ছে সে গাধা নাকি একজন শিক্ষিত মানুষ - সেই চিন্তাটা মানুষ করে না, তাই তারা কেবলমাত্র 'ষাঁড়' চিহ্নটাকে দেখে ভোট দেয়।
সাংবাদিক : পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় তো এটাই হয়। কিন্তু আপনি গোড়াতে যে কথাটা বলছিলেন যে, গণতন্ত্র খাতায়-কলমে থাকবে, সেটা যদি একটু ব্যাখ্যা করেন।
আম্বেদকর : ভারতে গণতন্ত্র কাজ করবে না কারণ আমরা এমন একটা সামাজিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে রয়েছি, যা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেশিকে ধারণ করতে অক্ষম।

সাংবাদিক : আপনার কী মনে হয় যে সামাজিক কাঠামোটি একপ্রকার অসমতার উপর নির্ভরশীল?
আম্বেদকর : আমাদের সমাজ অসমতার (বৈষম্য) উপর নির্ভরশীল। যতদিন না জাতিভেদ প্রথার অবসান ঘটছে, ততদিন এই সামাজিক কাঠামোতে কোনো বদল আসবে না। বর্তমান সামাজিক কাঠামোকে ভাঙতে হবে। এবং আমি অবশ্যই মনে করি, যদি শান্তিপুর্ণ পদ্ধতিতে এই বদল আনতে হয়, তাহলে বেশ কিছুটা সময়ই লাগবে। কিন্তু কাউকে এই বদল আনার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
সাংবাদিক : যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বেশ কিছু বক্তৃতায় জাতিভেদ প্রথা রোধের কথা বলছেন?
আম্বেদকর : ওহ্! এই নিরন্তর বক্তৃতাগুলো! যখন কার্লাইলকে স্পেন্সারের রচিত কয়েকটি ভল্যুম দেওয়া হয়, উনি বলেছিলেন, "হায়! খ্রীষ্টের দেশে এই এতো নিরন্তর বক্তৃতা!" আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও ঠিক একইরকম, বক্তৃতা শুনে শুনে আমি অতিষ্ট। আমাদের কিছু কাজ করতে হবে।
সাংবাদিক : কী কাজ করা উচিত বলে মনে করেন?
আম্বেদকর : কিছু কাজ। কাঠামোগত কাজ যার ফলে কিছু বদল আসবে। কিছু কাজ!
সাংবাদিক : আর যদি এইসব কর্মসূচিতেও বদল কিছু না হয়, তখন অল্টারনেটিভ হিসেবে কী করা উচিত বলে মনে করেন?
আম্বেদকর : বিকল্প হিসেবে একপ্রকার কমিউনিজমের কথা বলা যেতে পারে।
সাংবাদিক :  আর আপনার কী কারণে মনে হচ্ছে কমিউনিজম উপকারী হতে পারে? কমিউনিজম কি মানুষের জীবন-যাপনের মান উন্নত করতে পারবে?
আম্বেদকর : অবশ্যই পারবে।
সাংবাদিক : কীভাবে?
আম্বেদকর : নিঃসন্দেহে মান উন্নত করতে পারবে। কেউ কি আদৌ এই নির্বাচনী ব্যবসায় উৎসাহী? মানুষের খাদ্যের দরকার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দরকার, দরকার দৈনন্দিন চাহিদাপূরণের। আমেরিকায় যেমন গণতন্ত্র কার্যকর এবং আমার ধারণা আমেরিকাতে কোনোদিন কমিউনিজম কার্যকর হবে না। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি সেই দেশ কিছুদিন আগেই, যখন একটি ডিগ্রী গ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। তার কারণ প্রত্যেক আমেরিকান যথাযথ উপার্জন করেন।
সাংবাদিক : সেরকমটা তো এখানেও (ভারত) শুরু হতে পারে!
আম্বেদকর : কিভাবে আমরা শুরু করবো? যেমন, আমাদের দেশের মানুষের কাছে নিজস্ব জমি নেই, এখানে বৃষ্টিপাত হয় স্বল্প পরিমাণে, আমাদের জঙ্গলগুলির ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে। তাহলে এদেশের মানুষ রোজগার করবে কী করে? যতক্ষণ না এই সমস্যাগুলো সমাধান করা হচ্ছে -- আর আমার মনে হয় না আমাদের বর্তমান সরকার এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে।
সাংবাদিক : তাহলে আপনি কি মনে করেন যে এই বর্তমান ব্যবস্থার শীঘ্রই পতন ঘটবে? 
আম্বেদকর : হ্যাঁ, আমার মনে হয় যে বর্তমান শাসনব্যবস্থার শীঘ্র পতন হতে পারে, আর তার সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো মানুষ ধৈর্য্য হারাচ্ছে। আমার নিজের মানুষদেরই যেমন ধৈর্য্য হারিয়ে যাচ্ছে। আমি সবসময় আমার নিজের লোকদের দেখেই বুঝি, বিবেচনা করি। কারা সমাজের নিম্নস্তরে থাকে? যদি একটা স্থাপত্যের ভিতের মধ্যে ফাটল ধরে, তাহলে তো গোটা স্থাপত্যটারই পতন হবে!
সাংবাদিক : 'নিজের মানুষ' বলতে কি আপনি অস্পৃশ্যদের বোঝাচ্ছেন?
আম্বেদকর : হ্যাঁ।
সাংবাদিক : কমিউনিস্টরা কি অস্পৃশ্যদের জন্য কিছু কাজ করছেন?
আম্বেদকর : না, কমিউনিস্টরা সেরকম কোনো কাজ করছে না কারণ আমার নিজের লোকেরা আমাকে ভরসা করে এবং এই বিষয়টা নিয়ে আমি এখনো কিছু বলিনি। কিন্তু তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে আজকাল, কমিউনিজমে কী ক্ষতি হবে? ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে এবং আমাকেও কোনো একদিন এর উত্তর দিতে হবে।

Post a Comment

0 Comments