নাম প্রকাশে সন্ত্রস্ত লেখক
আমরা এখন নিজদেশে নিজ আবাসে অন্তরীণ। যেন বা খোঁয়াড়ের প্রাণী। দিনের কোন একটা সময় আমাদের অনুমতি দেয়া হয় ঘর থেকে বের হবার। কখনো দু'ঘন্টা, কখনো তিন, কখনো চার কিংবা পাঁচ ঘন্টা। আমাদের সামনে কয়েকটি টিভি চ্যানেল দেয়া হয়েছে। মহামহিমেরা ঠিক করেছেন আমরা রাত্তিরে বের হলে দেশ রসাতলে যাবে। বাচ্চারা খেলবে না। শিশুরা স্কুলে যাবে না। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা ভীষণ বেয়াড়া হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তাদের বয়স্ক বাবা মায়েরাও। তাঁরা মিছিল করতে চায়। গলা ফাটিয়ে শ্লোগান ধরে। আমাদের মহারাণী ও তাঁর পারিষদ এর এতে ভীষণ মাথা ধরে। সুতরাং, বেশি কথা বলা যাবেনা। রাতে এখানে সেখানে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। শ'য়ে শ'য়ে নয়, হাজার হাজার গ্রেপ্তার। রাস্তা থেকে পিটিয়ে আমাদের সন্তানদের, আমাদের বন্ধুদের বাড়ি, হাসপাতাল ও গোরস্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাঙচুর আর আগুন দেওয়া হচ্ছিল খুব। লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাস, ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, সাউন্ড গ্রেনেড এসব দিয়ে একারণে আচ্ছা মত সাজা দেয়া হয়েছে। মামলার স্তুপ জমেছে। তদন্ত চলছে। নির্জন স্থানে নির্যাতন চলছে। সুতরাং, এমন বেয়াড়া নাগরিকদের একটু টাইট দেয়া হচ্ছে আপাততঃ। ইন্টারনেট চালানোর মত যোগ্য আমরা নই। আমাদের কাছে থাকা তথ্য পাছে যদি আর কোথাও যায়! কেন এমন হল? আপাততঃ লিখে রাখছি। সময়ের দলিল হিসেবে। কখনো মুক্তি পেলে জানানো যাবে অন্তত। চলুন ঘটনাস্থলে।
৫০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থের যোগান পাওয়ার আশা নিয়ে চলতি মাসেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফর করেন চীন। ফিরে আসেন শূন্য হাতে। আশাবাদের বাণী ব্যতিরেকে প্রাপ্তি ছিলনা কিছুই। ভারত সফরের অব্যবহিত পরেই ছিল এই সফর। ভাটির দেশ বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা - তিস্তার পানি প্রবাহের উপর উজানের দেশ ভারতের একতরফা পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের জনমনে অসন্তোষ বিপুল। শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের ভারতীয় সরকারের বন্ধুপ্রতীম বলে দাবী করে থাকেন। কিন্তু, নিজেদের শাসন ক্ষমতায় থাকার প্রশ্নে ভারতের আশীর্বাদপুষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার জনগণের স্বার্থ আাদায়ে বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছ থেকে আদায় বা ছাড় নিতে পারেননি কিছু। বরং, নিঃশর্তে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট দিয়ে বিনিময়ে কিছুই আাদায় করতে না পারার কারণে জনমনে নেতিবাচক মনোভাব উল্লেখযোগ্য। স্মর্তব্য, বাংলাদেশে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিগত সফরকালে বিপুল বিক্ষোভ ঠেকাতে ১৭ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৪ জুলাই, ২০২৪ চীন সফর উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে সফরের বিষয়বস্তুর সাথে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও একজন পরিচিতমুখ সাংবাদিক ফারজানা রুপা'র (যিনি ইতোপূর্বে তাঁর হাসিনা বন্দনার অংশ হিসেবে "ম্যাজিক্যাল প্রাইম মিনিস্টার" বলে সম্বোধনের জন্য খ্যাত!) প্রশ্নের উত্তরে চলতি মাসেই শুরু থেকে দানা বেঁধে ওঠা সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন " কোটা কী মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি- পুতীরা পাবে নাকি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? " ব্যাঙ্গাত্মক এ বক্রোক্তি একেবারেই শান্তি পূর্ণ সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। ততোধিক ব্যাঙ্গাত্মক শ্লোগানে প্রায় একইদিন রাত ১১ টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী গগন বিদারী শ্লোগান ক্যাম্পাসে এবং সেই সাথে সারা দেশের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ঝড় তোলে। রবিবার মধ্যরাত অবধি প্রধান শ্লোগান ছিল " তুমি কে, আমি কে / রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে / স্বৈরাচার, স্বৈরাচার। চাইতে গেলাম অধিকার / হয়ে গেলাম রাজাকার। " ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী হিসেবে রাজাকার শব্দটি অত্যন্ত নিন্দার্থে ধর্মীয় মৌলবাদীদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং, কোটায় প্রবল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর "রাজাকারের নাতিপুতি" বলার প্রত্যুত্তরে উচ্চারিত শ্লোগান এর গভীরে ক্ষমতাসীনদের প্রতি ক্ষোভ ও দৃষ্টিভঙ্গী, স্পষ্টতঃ ইঙ্গিতপূর্ণ শ্লোগান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মরমে গিয়ে বিঁধে । সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী এবং একই সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদাধিকারী ওবায়দুল কাদের আরো নগ্ন ভাষায় প্রকাশ করেন, "রাজাকার দাবীদার আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট"। তখনো পর্যন্ত দু'হাত শূন্যে ছোঁড়া আর কণ্ঠে শ্লোগান প্রকম্পিত করা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারাদেশের সর্বত্র একযোগে আক্রমণ করে ছাত্র লীগের কর্মীরা মুল দলের সাধারণ সম্পাদক এর নির্ভরতার প্রমাণ দেন। প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্র লীগের কর্মীরা লঠি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, রামদা, ধারালো দেশীয় অস্ত্রের সাথে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর। যা দেশের সকল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা সারাদিন ও রাত সারাদেশে বেদম প্রহার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে পরদিন আবার মাঠে নামে। আরো ব্যাপকতা নিয়ে, আরো তেজোদ্দীপ্ত শ্লোগান নিয়ে। ক্রমশ শিক্ষার্থীরা হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন সব সাধারণ জিনিস গাছের ডাল, বাঁশের কঞ্চি, বড়জোর কুড়িয়ে পাওয়া লোহার রড আর অসম সাহস নিয়েই প্রতিরোধ ও বিক্ষোভে নামে। কার্যতঃ ১৬ জুলাই মঙ্গলবার ঢাকা, রাজশাহী আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেদিন সারাদেশে পুলিশ, বিডিআর নামে ছাত্রলীগের সাথে। যদিও ক্যাম্পাসগুলোতে আর রাজপথের প্রতিরোধ মোকাবিলায় ছাত্র লীগের ছাত্র, অছাত্রদের সাথে বিপুল সংখ্যক বহিরাগত পেশাদার চাঁদাবাজ, চিহ্নিত খুনীদের আবির্ভাব ঘটে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর সহ সারাদেশে শহীদ হন প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক ৬ জন। আহত অজস্র ও অজানা।
গণতন্ত্রের দাবীতে ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭ সালে বুকে পিঠে শ্লোগান লিখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন এক অসম সাহসী পেশায় বেবী ট্যক্সি চালক তরুণ নুর হোসেন। বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন অমর পংক্তিমালা " বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় " শিরোনামে। আর ২০২৪ এর ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবুু সাঈদ ( রংপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক) এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই বাহু প্রসারিত হাতে বুক চিতিয়ে একের পর এক রাবার বুলেট বরণ করেছেন। সরে দাঁড়াননি। আর পুলিশ ঠিক নিশানায় প্র্যাকটিস করার মত শুট করেছেন। মনে হতে পারে রুপকথার গল্প। মুম্বাইয়ের বা হলিউডের চিত্রনাট্য। না, গল্পকার এর উর্বর চিন্তা প্রসূত গল্প নয়। তত্ত্বের জটিল বয়ানের চকচকে বাণী নয়। এ প্রতিবাদী আর প্রতিরোধী বাংলাদেশের ছাত্র গণ আন্দোলনের উজ্জ্বলতম ইতিহাস। আবু সাঈদ ইতিহাসের ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠেছেন। আবু সাঈদ আমাদের " নুরলদীনের সারা জীবন " এর কাছে নিয়ে যায়, আমাদের ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের আসাদের কাছে নিয়ে যায়, আবু সাঈদ তিতুমীর এর বাঁশের কেল্লা, মাস্টার দা'র চট্টগ্রাম বিদ্রোহ, আবু সাঈদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ক্যাম্পাসের প্রমিথিউস শহীদ মঈন হোসেন রাজু ভাস্কর্য। একের পর এক বুলেট তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আবু সাঈদ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের দ্রোহী তারুণ্যের চিরন্তন ও জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে। হতদরিদ্র কৃষকের নয় সন্তানের মধ্যে কেবল তিনিই শিক্ষাজীবন টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় প্রবেশ করেছেন তাঁর পরিবারে শুধু তিনিই। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সকল পেশা ও বয়সের মানুষের কাছে যেন বা জীবনকে ভালোবাসবেন বলে, জীবন বিলিয়ে দেয়ার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে ছাত্র গণআন্দোলনের ইতিহাসেে নতুন এর অভ্যূদয়।
পরদিন ছিল ১৭ জুলাই, মহররমের ছুটি। গায়েবানা জানাজা আর প্রতীকী কফিন মিছিলের কর্মসূচি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের হামলা মোকাবিলা করতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। সন্ধ্যায় কালো শাড়ি পড়ে টিভিতে লিখিত ভাষণ পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী। গৎবাঁধা বাক্য শুনিয়ে তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করে ছাত্র ছাত্রীদের আহ্বান জানান। কোন অনুতাপ নেই তাঁর পূর্ব বক্তব্যের। কোন নিন্দাধ্বনি নেই তাঁর অনুগত অমাত্যদের বিপুল আক্রমণ, পুলিশ বিজিবি'র নির্বিচার হত্যা ও আক্রমণের। তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন দেশের উচ্চ আদালতে শিক্ষার্থীদের দাবি পূর্ণ হবে। কারণ, তিনি জানেন বাংলাদেশের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ মানেই তিনি। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজেরও তা অজানা ছিলনা। সুতরাং, " বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো " বলে যে প্রবাদবাক্য রয়েছে, সে প্রবাদবাক্য শিক্ষার্থীরা না বোঝার মত নির্বোধ নয়। সংলাপ বা আলোচনার সরাসরি আহ্বান না জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্ররা চাইলে আলোচনা হতে পারে। তিনি কী চান, তিনিই জানতেন। ফলে একদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে, সহস্র উপায়ে তাঁর পারিষদ বলতে শুরু করেন, শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করেছেন তাদের শ্লোগানে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশেষত বাংলাদেশে বহুল জনপ্রিয় ফেসবুকে সরকারের অমাত্য ও সুবিধাভাজনদের এ প্রচার এর সাথে চলতে থাকে শংকা, আন্দোলন বিএনপি - জামাতের হাতে চলে যাচ্ছে। চলে হুমকি - ধামকি - গ্রেপ্তার। ছাত্র লীগের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ। আর বিপুলসংখ্যক ক্যাম্পাসে বয়ে যায় যেন ছাত্রলীগ মুক্ত অঞ্চলের বোধ ও স্রোত। হলে হলে ছাত্র লীগের কক্ষ তল্লাশি করে পাওয়া যেতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ ধারালো অস্ত্র ও লাঠি। অনেক জায়গায় শিক্ষার্থীরা এসব উদ্ধার করে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেন। একদিকেে হামলা আবার টিভিতে আইনমন্ত্রী আলোচনার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দেন, "রক্তের উপর দিয়ে কোন সংলাপে যাবে না। "
ফলে ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার একদিকে ছাত্র লীগমুক্ত ক্যাম্পাস রক্ষায় শিক্ষার্থীরা লাঠি হাতে পাহারা দেন। আর রাস্তায় নেমে আসে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক যোগে প্রতিরোধ সংগ্রামের বীরত্বগাঁথা। একদিকে মহাখালি- রামপুরা - বাড্ডা - মালিবাগে ব্র্যাক - ড্যাফোডিল - কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের একযোগে লড়াই, মীরপুরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেন বিপুল সাধারণ মানুষ, মীরপুর - মোহাম্মদপুর সর্বত্র প্রতিরোধ। ঢাকার আকাশে Rab এর হেলিকপ্টার। আকাশ থেকে হামলা। শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে ওঠা ৬০ জন পুলিশকে উড়িয়ে উদ্ধার করে Rab এর হেলিকপ্টার। বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন ঘটনা। আন্দোলনে পরিণত হয় গণ অভ্যূত্থানে। যদিও ইতোমধ্যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১৭ জুলাই। কিন্তু, তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ছাত ছাত্রীরা নগণ্য সংখ্যায় হল ছাড়ে। সারাদিন ও গভীর রাত পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকে দেশজুড়েই। ঢাকা সর্বাগ্রে, কিন্তু সারাদেশের প্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আওয়ামী গডফাদারদের সকল ভয়কে জয় করে অজেয় অজস্র মানুষের লড়াইয়ের গৌরবগাঁথা রচিত হয়। ১৮ জুলাই বাংলাদেশ নতুন গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করল। এদিন ছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত " কমপ্লিট শাট ডাউন "। নয়া জমানার নয়া পরিভাষা। এসব শব্দ ছিলনা বাংলাদেশের গণ আন্দোলনের ইতিহাসে। ১৯৬৯ এর প্রথম গণ-অভ্যুত্থানের ৫৫ তম বার্ষিকীতে। নিজে ১৯৯০ এর ছাত্র গণ আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা ১৯৯০ এর ৪ঠা ডিসেম্বর এর রাতে হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত সারাদেশে একযোগে সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এত বিপুল আত্মদান ও সংগ্রামের এমন বিশালকার ও বিপুল ঘটনা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেনি। তদুপরি, এরশাদের না ছিল কোন জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল ও অংগ সংগঠন, না ছিল সুবিধাভোগী ও ঐতিহ্য পরষ্পরায় দল সম্পৃক্ত বিপুল মানুষের একাংশ। ফলে, ২০০৮ উত্তর শেখ হাসিনা'র নির্বাচিত সরকার ক্রমশ জনসম্পৃক্ত দল থেকে দলীয় গডফাদার ও ক্যাডার, প্রশাসন, পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে প্রসাদ ও কৃপাভোগী নির্ভর শক্তির। এমন বিপুল শক্তির মোকাবিলা করা আর এরশাদের মত কেবল সেনা সমর্থন নির্ভর দলের মোকাবিলা করা এক কথা নয়। সুতরাং, যে কোন বিবেচনায় " প্রাইম মিনিস্টার'স ম্যান " নামক যে দৈত্যের কথা খুব অল্পই জানে যে দেশের মানুষ, সে দেশে এই স্পর্ধা বড় কঠিন। কিন্তু, কঠিনেরে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ রুপকথার গল্পের চেয়ে ও উজ্জ্বল এক সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে। নিবন্ধকার এ বাক্যগুলো লেখার সময় ভাবছেন, এ লেখা প্রকাশ তো দুর কী বাত, এ লেখার পর তার জীবন আর থাকে কিনা তাই নিয়ে সন্ধিহান। জানা তথ্য মোতাবেক ১৮ জুলাই ৪১ জনের মৃত্যু। প্রকৃত সংখ্যা অজানা।" হিজ মাস্টার্স ভয়েস " প্রচারক বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন সহ জ্বালিয়ে দেয়া হয় একগাদা সরকারি স্থাপনা। অসংখ্য গাড়ি। এমনকি পুলিশের আর্মার্ড কার চতুর্দিকে ঘেরাও করে তার উপর বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। সারাদেশেই মিছিলে বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা জাতীয় পতাকা বহন করেন।
১৮ জুলাই যদি ধরে নেই নয়া গণ অভ্যূত্থানের সূচিমুখ, তবে জেনে রাখা ভাল আরো বিষ্ময় অপেক্ষায়। এদিন রাত ১০ টার দিকে বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট। শুক্রবার ছিল ১৯ জুলাই। জুমার নামাজের পবিত্র দিন। এদিনে সাধারণত কোন আন্দোলন বা বিক্ষোভের কর্মসূচি দেয়া হয়না। শিক্ষার্থীদের ঘোষিত কমপ্লিট শাট ডাউন প্রত্যাহার হয়নি। স্মরণকালের সকল লড়াইয়ের ইতিহাস ছাপিয়ে, অজস্র অযুত লক্ষ মানুষের দিন মান লড়াইয়ে এদিন শহীদ হন কমপক্ষে ৭৯ জন। (দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো'র নিউজ মোতাবেক, প্রাপ্ত মেডিক্যাল কলেজগুলোর হিসাব অনুযায়ী)। আগুন, ধ্বংস, প্রতিরোধ এসব বাংলাদেশের ছাত্র গণ আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশ যা প্রত্যক্ষ করেছে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশও তার চেয়ে কম অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নামে একযোগে আওয়ামী লীগ - বিএনপি - বাম - জামাত, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জামাত, জাতীয় পার্টি, ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০১৩ -১৪ সালে বিএনপি একই প্রাক্টিস করেছে। কারণ, ক্ষমতায় থাকা দলগুলো সবসময় মনে করেছে, যেনবা এ জীবন অনাদিকাল। সুতরাং, তাদের আচরণ ও ছিল তেমনি। আওয়ামী লীগ ও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। তবে ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে এবং আরো ৪ বছর বিরোধীদল বিহীন ভোটে জয়ী আওয়ামী লীগ এখন বেপরোয়া। শিক্ষার্থীরা তাই আওয়াজ তুলেছেন, "দেশটা কারো বাপের না"। তিন প্রজন্ম ধরে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আসছেন এমন একটি পরিবারের ৫৮ বছর বয়সী সদস্যের সাথে কথা বলার সময় তিনি এ নিবন্ধকারকে বলেন, "শেখ হাসিনা তার পরিবারের কতজন সদস্যকে হারিয়েছেন? তিনি তা বলে চলেছেন গত ৫০ বছর। সেটা সত্যি। কিন্তু, আজ তাঁর ফালতু জেদের জন্য শতাধিক মায়ের বুক খালি হলো। তিনি কী বলবেন? তিনি এখন ক্ষমতা লোভী। আর কিছু নয়। দেশটা তাঁর পৈতৃক ভিটা নয়, এটা মনে রাখা দরকার তাঁর।"
পরিবারতন্ত্র ও হাসিনা শাহীর বিরুদ্ধে সর্বপ্লাবী ক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ তখন। এ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ নানানরুপে ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়েছে বারে বারে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা একবার প্রকাশিত হয়। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও অন্যান্য কোটা যেমন নারী, জেলা, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ সহ মোট ৫৬% কোটা বাদে মেধাবী সাধারণদের জন্য ছিল ৪৬%। তীব্র বেকারত্বের এই দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আকাঙ্খা খুব যৌক্তিক চাওয়া ছিল। বিশেষতঃ মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদেরও চাকরির বয়স উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ফলে তা কার্যতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের চাকরির বয়স অবধি গড়িয়েছে। সুতরাং, প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য এ সুযোগ সমমাত্রিকভাবে অক্ষুন্ন রেখে দেয়ার কোন যৌক্তিক হেতু অনুপযোগী বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করেছেন। তারপরও তাদের দাবী ছিল কোটা সংস্কার। প্রধানমন্ত্রী একতরফা ভাবে তাঁর ভাষায় " রাগ করে " কোটা প্রথা বাতিল করে পরিপত্র জারী করেন ২০১৮ সালে। যদিও তিনি সাংবিধানিক শপথ নিয়েছেন, রাগ- অনুরাগ- বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। তাঁর নিজের ভাষাতেই সেটা ছিল সংবিধানের প্রতি তাঁর শপথের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। স্কুল ছাত্র, কলেজ ছাত্ররাও নিরাপদ সড়কের দাাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। তারা শুধু সড়ক নয়, রাষ্ট্র মেরামতের দাবীও তুলে আন্দোলনের অভিনব জোয়ার তুলেছিল। যদিও সে আন্দোলনের প্রতি সরকারি ছাত্র সংগঠন এর হুমকি ধামকি স্বত্বেও তা রক্তাক্ত সংঘাতের দিকে যায়নি। এবারের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, হাইকোর্টে একটি রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এর একটি বেঞ্চ সরকারের ২০১৮ এর পরিপত্র বাতিল করে পুনরায় কোটা বহাল করার প্রেক্ষিতে। ছাত্র আন্দোলনটি যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ উপায়ে নানান কর্মসূচি দিয়ে চালিত হচ্ছিল। তারা সড়ক ব্যারিকেড, রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি প্রদান করেছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। তরঙ্গের ঢেউ ওঠে সে আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কটুক্তির পর। এক নাগাড়ে চতুর্থ দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি এখন আর বিন্দুমাত্র বিরোধিতাও আমলে নিতে নারাজ। তাঁর একগুঁয়ে মনোভাব থেকে তাঁকে পশ্চাদপসরণ করতে হল ঠিকই, কিন্তু সাথে নিয়ে গেলেন শত শত জানা অজানা প্রাণ। এমনকি স্থায়ী অন্ধত্বের ঝুঁকিতে আছেন শতাধিক তরুণ। রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও টিয়ার শেল অনেককেই এই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সুতরাং, আন্দোলন এক অসাধারণ গতিতে ও বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে।
২০ জুলাই শনিবার। ইতোমধ্যে পুর্বরাত ১২ টা থেকে কার্ফ্যু জারী করা হয়েছে। অর্থাৎ, ১৮ ও ১৯ জুলাই প্রতিরোধের সর্বোচ্চ পর্যায় দেখে হাসিনা আর ভরসা রাখতে পারছিলেন না, তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইনের উপর। ১৯ জুলাই ঢাকা শহরে রাস্তায় সকল সভা - সমাবেশ - মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বিএনপি ও তাদের জোট কে পিটিয়ে দাঁড়াতে দেয়া হল না ঢাকায়। আওয়ামী লীগ নেতারা ঠিকই দলীয় কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ করলেন। ব্যাপক ঢোল পিটিয়েও সভায় জনসমাগম ছিল অন্যান্য সসময়ের তুলনায় নিতান্তই কম। যদিও ওবায়দুল কাদের এর হাঁক ডাক ছিল বরাবরের মতই। কাদের বললেন, "বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। যাঁরা এটা প্রচার করছেন তাদের জানিয়ে দিতে চাই, যুদ্ধ করতে করতে শেখ হাসিনা প্রাণ দেবেন, কিন্তু পালাবেন না।" মনে হল, এ যেন "ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাইনা।" তিনি অবশ্য কার সাথে যুদ্ধ করছেন জানা নেই। দেশে যদি যুদ্ধাবস্থা চলেই থাকে, তাহলে সে যুদ্ধ রাজপথে ছাত্র জনতার সাথে আওয়ামী পেটোয়া বাহিনীর মধ্যে। ইতোমধ্যে তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন যথাক্রমে ছাত্র লীগের বীর পুঙ্গবেরা ও নির্লজ্জ ভাবে পুলিশ যন্ত্র সে লড়াই থেকে পরিষ্কার পশ্চাদ্পসরণ করেছেন। দেশ জুড়ে সন্ত্রাস, গুন্ডামী, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ব্যাংক লুট, খুন, হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট এর মধ্য দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করে পুলিশ সমর্থিত ছাত্র লীগের ও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সম্পদ আহরণের সংবাদ পুরনো হবার পথে। সাবেক পুলিশ ও Rab প্রধান এর দেশজুড়ে বিপুল সম্পদ রহস্যের উন্মোচন, বেসামরিক আমলাদের ও পর্বতপ্রমাণ অবৈধ সম্পদ উপার্জন এর তথ্য উন্মোচন, ধরা পড়ার আগেই বিদেশে পালানোর তথ্যে মাত্র ক'দিন আগেও ছিল মিডিয়ার খোরাক। খোদ সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ এর আপন সহোদর দুই কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দিয়ে, ভুয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয় পত্র ও পাসপোর্ট প্রদান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার এর ক্ষুদ্র নমুনা মাত্র। ৮ টি ব্যাংকের মালিকানা তুলে দিয়ে লুট এর মহোৎসব করে দেশের রুগ্ন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের সিংগাপুরে বিপুল সম্পদ পাচার দেশবাসীর অজানা নয়। বিদ্যুৎ খাতে যথেচ্ছ লুণ্ঠন এর মাধ্যমে সামিট গ্রুপের বিপুল সম্পদ আহরণের তথ্য পাওয়া যায়। দেশের শেয়ার বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা "দরবেশ বাবা" খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদ অলংকৃত করে আছেন। চীন ও ভারতের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ গুণ অধিক ব্যয় করে অসংখ্য রাস্তা ঘাট, ব্রীজ নির্মাণের অভিযোগ দেশের প্রথম সারির দৈনিক গুলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগেই দেশের অর্থ মন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বলেন, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সেখানে আজ রিজার্ভ রক্ষায় নানাবিধ চেষ্টার পরেও তা ১২ বিলিয়ন ডলার এর অধিক নয়। বিগত বছর থেকে বৈদেশিক ঋণের দায় ও কিস্তি পরিশোধ এর চাপ শুরু হয়েছে। যা ক্রমশ প্রতি বছর বাড়বে। মাত্র বছরাধিক কালের মধ্যে ডলার৷ এর বিপরীতে টাকা মূল্য হারিয়েছে এক তৃতীয়াংশ। ঋণপত্র খুলতে পারছেনা অনেক ব্যাংক বৈদেশিক মূদ্রার অভাবে। বিদ্যুৎ খাতে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ধুমধামে আতশবাজি ফুটিয়ে করা উৎসব আড়ালে চাপা পড়েছে ভয়াবহ লোডশেডিংএ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো উৎপাদন করতে পারছেনা জ্বালানীর অভাবে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলেছে অব্যাহত গতিতে। বাজার সিন্ডিকেট এর উপর দোষ চাপিয়ে সমস্যার কোন সুরাহা হয়নি। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা অনেক গুলো মেগা প্রকল্পকে অপ্রয়োজনীয় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বলে মূল্যায়ন করেছেন। মুদ্রাস্ফীতি অসহনীয়। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এ অবস্থায় একটি ক্ষুদ্র অংশ গত দেড় দশকের লুটপাট তন্ত্রের সিকি- আধুলী বা সিংহভাগ প্রাপ্তরা ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস। কাজেই, প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইনের ব্যর্থতা ছিল অবধরিত। সুতরাং, তিনি গেলেন সেই তৃতীয় শক্তির কাছেই। ১৯ জুলাই তিনি মিটিং করেছিলেন তাঁর জোট সঙ্গী বিগত যৌবনা বামপন্থী মেনন, ইনু ও দিলীপের সাথে। সেটা ছিল ভান। জোশ নিয়েছিলেন তিন বাহিনী প্রধান সহ পুলিশ, বিজিবি প্রধানদের সাথে। তাঁদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা নিয়ে, বিরোধী দল বিহীন দুটি বিনা ভোটে এবং একটি নৈশ ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রাত ১২ টা থেকে কার্ফু ঘোষণা করে আর সেনা নামিয়ে গদি নিরাপদ করে নিলেন। এর নাম গণতন্ত্র !!! কার্যত রাশ টানা হল সকল মিডিয়ার উপর। নিয়ন্ত্রিত সংবাদ প্রচার আর জনরোষের শিকারে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের একই ফুটেজ বারে বারে দেখিয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হল। তাতে ও কী লাভ হল? ২০ জুলাই ও প্রতিরোধ অক্ষুণ্ণ ছিল। ২০ জুলাই সেনা হস্তক্ষেপে রাস্তায় সাঁজোয়া যান নামল। একটা স্বাধীন দেশের গণবিক্ষোভ দমনের জন্য জনগণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামানো হল জওয়ানদের। পাঁচ দিন সকল ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রেখে বলা হচ্ছে ডেটা সেন্টার এর মেরামতের জন্য সময় লাগছে। অথচ, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠন থেকে বলা হল, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে থেকে যে ব্রড ব্যান্ড সংযোগ দেয়া হয়, তা সরকার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট বলছে, ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হতে পারে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে রপ্তানিমুখী পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠান। কারণ, গাজীপুরের কোন কোন পোষাক শিল্পের শ্রমিকেরা কোথাও কোথাও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। সুতরাং, সরকারি হিসেবে দেয়া দৈনিক ১৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি স্বত্বেও সরকার শ্রমিকদের বিক্ষোভে যুক্ত হবার ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক। চার দিনের নিরবচ্ছিন্ন কার্ফ্যু দিয়ে ও পাখির মত গুলি করেও শাসকদল নিশ্চিত নয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর নেতারা পালিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। সেখান থেকে ধরে নিয়ে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে তাদের। ৬১,০০০ মানুষকে আসামী করে মামলা হয়েছে। আন্দোলনের কর্মীদের পাশাপাশি, বিএনপি ও জামাত নেতা কর্মীদের গণগ্রেপ্তার চলছেই। কার্ফ্যুতেও থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। শনিবার ৩৬, রোববার ২০, সোমবার ঝরে পড়ে আরো ৫ টি জীবন। মোট মৃত্যু ১৮৭। দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট বলছে, "এ হিসাব কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিতে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে। সব হাসপাতালের তথ্য পাওয়া যায়নি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু -কিশোর, শিক্ষার্থী, তরুণ ও নারী রয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগের শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। কারো কারো মৃত্যু হয়েছে আঘাতে। সংঘর্ষে পুলিশের তিনজন সদস্য এবং তিনজন সাংবাদিকও মারা গেছেন। আহত অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনেকের চোখে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি লেগেছে। কারো কারো চোখ আর ভাল না হওয়ার শংকা জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।" (২৩ জুলাই, ২০২৪) পরিস্থিতির ভয়াবহতা কোন সংবাদ বিবরণী বা নিবন্ধ বা ভিডিও ফুটেজ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। একটি আপাত নিরীহ ছাত্র আন্দোলন দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়ে জনবিক্ষোভ সম্পৃক্ত হয়ে যে বিশাল দাবানলের জন্ম দিয়েছে তা মহাকাব্যিক গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। তার পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দেড় দশকের লুটপাট তন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রায় সকল স্তরের মানুষের অন্তরের প্রতিধ্বনি করেছে।
বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত বৃষ্টির মত বুলেট, রাবার বুলেট, ছররা গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, লাঠি পেটা করে সামরিক- আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ - বিজিবি-আনসার বাহিনী নামিয়ে ঢাকার অন্যতম প্রবেশমুখ যাত্রাবাড়ি মুক্ত করে খোদ সামরিক বাহিনী প্রধান সহাস্য মুখে পরিদর্শন করেছেন। যেন যুদ্ধ জয় করা হয়েছে। নিজের দেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর বিজয়! হায় বাংলাদেশ! মিডিয়া ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানেরা দাবী করছেন দুর্বৃত্তদের (!) পরাস্ত করেছেন। বলাই বাহুল্য, লুটেরা দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক ও আমলা তন্ত্রের পাহারাদার শাসক শ্রেণীর কাছে বিক্ষুব্ধ জনগণ দূর্বৃত্ত! বিভিন্ন স্থাপনার পোড়া ও ভাঙচুর এর দৃশ্য প্রচার করে তার সম্পদমূল্য তুলে ধরা হচ্ছে। এসকল স্থাপনার পুনঃ মেরামত ব্যয় এর প্রাক্কলিত মূল্য নিরুপন করা হচ্ছে। প্রায় সকল মিডিয়ায় একযোগে বলা হচ্ছে, বিএনপি - জামাত - শিবিরের কর্মীরা এসকল ঘটনার জন্ম দিয়েছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। আজ চলতি সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে সরকারি ছুটি। কবরের নীরবতায় মুড়িয়ে দিয়ে বিক্ষোভের লাগাম টানার ভয়াবহ বর্বরোচিত হামলার ঘটনার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেই যে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন তিনি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে আজ ৯৩% মেধা, ৫% শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বীরাঙ্গনা সন্তান, ১% ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী, ১% প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কোটা পূনর্বিন্যাস করে প্রজ্ঞাপন জারি করছেন। তাহলে, দিবালোকের মতো স্পষ্ট দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অবিবেচনা প্রসূত মন্তব্যের জেরে জনমনে জমে ওঠা সীমাহীন ক্রোধের বিস্ফোরণের সলতে জ্বালিয়েছেন তিনি। উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাটে চাপিয়ে তিনি নিজেই নিজের গীত গেয়ে চলেছেন। অথচ, তাঁর দল তাঁরই নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধী দলের সাথে মিলেই ১৯৮২ -১৯৯০ একইভাবে আন্দোলন চালিয়েছেন। পরিকল্পিত ভাবেই ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে লাগাতার হরতাল- জ্বালাও- পোড়াও আর অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। তিনি ভুলে গেছেন ২০০৪-২০০৬ সালে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে লড়াই। আর ক্ষমতা পেয়েই সর্বাগ্রে তত্বাবধাক সরকার ব্যবস্থাকে নির্মূল করে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনের রুপ দিয়েছেন। গত ১০০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার এ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর অধীনে প্রশাসন কীভাবে ভোটের আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তি করেছেন। তাঁর উপর জনগণের নাকি এত বিপুল আস্থা! অথচ, জনগণের উপর তাঁর আস্থা নেই বিন্দুমাত্র। ফলে এ পরিস্থিতিতেও দীর্ঘ ১৬ বছর বিনা ভোটের মাধ্যমে গায়ের জোরে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে বসেও তিনি মনে করতেই পারেন, এ জাতি বোধ হয় বংশ পরম্পরায় তিনি যেমন খুশি তেমন বলার ও শাসন করার অধিকার করায়ত্ত করেছেন। গত ১০ দিনের বাংলাদেশ তাঁকে সঠিক পাঠ নিতে বাধ্য করেছে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিনের আহমদ লিখেছেন " মানুষ যে রাস্তায় নেমে এসেছে, ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে, এগুলো তাদের কারা শিখিয়েছে? আমাদের রাজনীতিবিদরাই সেটা শিখিয়েছেন। গাড়ি পোড়ানো, ভবনে আগুন দেওয়া, এটাই তো আমাদের এখানে রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ কোন দিন বিরোধী দলে গেলে তারাও এটাই করবে। " ( প্রথম আলো, উপসম্পাদকীয়, ২২ জুলাই, ২০২৪) তিনি আরো লিখেছেন, "১৫ বছর ধরে দেশে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য কোন নির্বাচন হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে তাই লোকের ক্ষোভ থাকবেই। রাজনৈতিক দলগুলোও উপলক্ষ খুঁজবে আন্দোলন করার।" সুতরাং শাসকদল দমন পীড়ন চালিয়ে সাময়িক শান্তি আনতে পারে, স্বস্তি নয়।
গতকাল ব্যবসায়ী সমাজের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন, তিনি পালাবেন না। নিকট অতীতে শ্রীলঙ্কার গোতাবায়ে রাজাপাকশে, বাংলাদেশের এরশাদ, ফিলিপাইনের মার্কোস সহ অসংখ্য স্বৈরশাসকেরা এমনই ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু, ভয়ের রাজ্যে থেকেও বরেণ্য পটুয়া প্রয়াত কামরুল হাসান এর আঁকা ইয়াহিয়ার বিকটাকার রক্তলোলুপ মুখচ্ছবির আকৃতির প্রতিকৃতি সদৃশ নয়া প্রতিকৃতিতে শেখ হাসিনা'র মুখচ্ছবি বসেছে। স্বাধীন দেশের মত প্রকাশ এর লড়াই, ভোটের লড়াই, লুটপাটতন্ত্র বিরোধী লড়াই এর অনন্ত সম্ভাবনার অনাগত ভবিষ্যৎ হাতছানি দৃশ্যমান। বুলেট আর বুটের তলায় পিষ্ট ছাত্র জনতা কর্তৃক সে সংগ্রামের সূচিমুখ রচিত হয়েছে কয়েক শত মানুষের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে।
" মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান,
লেখা আছে অশ্রু জলে।"
হিটলার, মুসোলিনী শিখে নাও এবং জেনে নাও, তোমাদের উত্তরসুরীরা বড় ভালো নেই। কিন্তু, তুমি ছিলে কয় বছর? হাসিনা আছেন ১৬ বছর। আশা রাখেন তিনি থাকবেন কমপক্ষে আরো ৪ বছর । ইতিহাসের শিক্ষা শাসকেরা মনে রাখেনা। আইয়ুব খান ও তার পরবর্তী পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের গভীরতা উপলব্ধি করেননি। একই পথে হাঁটতে চেয়েছেন।
বাংলাদেশের জনগণ এর সম্ভাব্য সকল বিকল্প সময়মত বেছে নিতে জানে। সুতরাং, এ ছাত্র গণ অভ্যূত্থান দমন-পীড়ন চালিয়ে রোখা যাবেনা। অস্তাচলে যাবার সূর্য নয়, বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করল নব অভ্যূদয়ের ভোরের সূর্য। বাংলাদেশের সূর্য সন্তানেরা সেই ভোরের সূচনালগ্ন জন্ম দিয়েছে।
"রাত্রির কঠিন তপস্যা কী আনিবে না ভোর?"
ভবিষ্যতের আলোর পদযাত্রীদের সামনে সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার খুলে দিয়েছেন বীর শহীদ আবু সাঈদ ও তাঁর সহযাত্রী অগণিত শহীদ ও সংগ্রামীরা।
২৩ জুলাই, ২০২৪
0 Comments