বস্তার: এক বধ্যভূমির বৃত্তান্ত

সুমন কল্যাণ মৌলিক 

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রে বস্তার বলে এক মধ্য ভারতের জেলার অস্তিত্ব  আছে -- একথা বোধহয় আমরা ভুলতে বসেছি। এই ভূভাগে যে মানুষেরা থাকেন, তারা যে আমাদের সহ নাগরিক, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে বিজ্ঞাপিত এদেশে সেই মানুষদেরও সাংবিধানিক অধিকার আছে, আছে নিজেদের সংগঠিত করার অধিকার -- সেকথাও আজ কেউ মনে রাখে নি। আমরা শুধু বিশ্বাস রেখেছি কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের কথকতায়, যারা শুধু আমাদের জানান দেয় দেশ ও দশের স্বার্থে আইনরক্ষকেরা 'মাওবাদীদের' এনকাউন্টারে হত্যা করে চলেছে। আমাদের নিস্পৃহতা, ঔদাসীন্য আজ এতটাই সংক্রামিত যে বিগত পাঁচ মাসে (জানুয়ারি - মে, ২০২৪) একশ জন আদিবাসীদের হত্যা আমাদের একটুও ভাবায় না। আমরা প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নিই যে এক বছরের শিশু, স্কুল ছাত্র, কিশোর- কিশোরী সবাই  ভারতের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার পক্ষে এক চরম বিপদ, তাই নিকেশ করাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এই অমৃতকালে যেহেতু 'আইনের শাসন' নেহাৎই এক কাগুজে শব্দ, তাই প্রশাসন বেপরোয়া। দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার এই ধারাবিবরণী যদি নাগরিক সমাজকে সামান্য হলেও ভাবায়, সেই লক্ষ্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা।

সুনীতা পোট্টামের কথা

আজকের বস্তার তথা ছত্তিসগড়ের বাস্তবতা বোঝার জন্য প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে বিজাপুর জেলার কোড়চোলি গ্রামের বাসিন্দা সুনীতা পোট্টামের যাকে আজ থেকে কয়েকদিন আগে তার রায়পুরের অস্থায়ী আবাস থেকে বিজাপুর পুলিশ অপহরণ করে। ২৫ বর্ষীয় সুনীতা সেখানকার 'মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চের' সহ সভাপতি এবং উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ, গ্রামের মধ্যে পুলিশ ক্যাম্প, এনকাউন্টার কিলিং এর বিরুদ্ধে সংগঠিত গণ আন্দোলনের পরিচিত মুখ। মানবাধিকার সংগঠনের পিইউসিএল এর কর্মী সুনীতা ২০১৬ সালে বিজাপুর জেলার কয়েকটি গ্রামে মাওবাদী সন্দেহে ছয় জনকে হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে ছত্তিসগড় হাইকোর্টে এক মামলা দায়ের করেন। সুনীতার চেষ্টাতে ১লা জুন পুলিশের গুলিতে (মাওবাদী দমন অভিযান) ছয় মাসের এক শিশু মৃত্যুর ঘটনা দেশের নজরে আসে। এই সক্রিয়তাকে স্তব্ধ করার জন্য ২০২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী পুলিশ বিজাপুরের এক সরকারি হাসপাতালে সুনীতাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে। তবে সেবার স্থানীয় সাংবাদিকদের সক্রিয়তার কারণে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এবারও তাকে একাধিক মামলায় অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ এটাই বস্তারের বাস্তবতা।অধিকার কর্মীদের উপর আক্রমণ এই বধ্যভূমিতে ধারাবাহিক। রাষ্ট্রের 'এনকাউন্টার আখ্যান' কে যারাই চ্যালেঞ্জ করেছেন, যারা এই মৃত মানুষদের পরিচয়কে সামনে তুলে ধরেছেন, তারাই আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। হিমাংশু কুমার, বেলা ভাটিয়া, সোনি সোরি থেকে আজকের সুনীতা-- একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

অধিকার সংগঠনের কথা

যে কোন গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত হল ভিন্ন মতের অধিকার এবং সত্য জানার অধিকার। ছত্তিসগড়ে সত্য জানার চেষ্টা আজ অপরাধ। অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তথ্যানুসন্ধান (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং)। এই অধিকারও আজ নিষিদ্ধ। বিগত সময়ে তথ্যানুসন্ধানের যে কোন চেষ্টাকে প্রতিহত করেছে ছত্তিসগড় সরকার। আমরা আপাতত একদম সাম্প্রতিক উদাহরণটি উল্লেখ করছি। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অন্যতম সমন্বয়কারী সংগঠন কোঅর্ডিনেশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস (সিডিআরও) ও অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার বিভিন্ন গণসংগঠন ও স্বাধীন কিছু মিডিয়া ইনিসিটিয়েভের পক্ষ থেকে  ৫০ জনের একটি দল যে সমস্ত জায়গায় সাম্প্রতিক সময়ে এনকাউন্টার হয়েছে, সেখানে তথ্যানুসন্ধান করার জন্য রওনা হয়। ৩০.৫.২০২৪ প্রথম দলটিকে সিআরপিএফ আটকায় কুন্তাতে। দ্বিতীয় টিমটি যারা বিজাপুরের গাঙ্গালুর জঙ্গলে এনকাউন্টার স্থল দেখতে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে প্রথম দলের কিছু সদস্য যুক্ত হন। এই দলটিকে বিজাপুর থেকে ৮৫  কিমি দূরে তারলাগুদাতে জোর জবরদস্তি আটক করা হয় এবং নিরাপত্তার অজুহাতে আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়। এমনকি এলাকা না ছাড়লে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা এরপরেও হতোদ্যম হন নি। ৩১.০৫.২০২৪ দশ সদস্যের একটি দল সরকারি বাসে সওয়ার হয়ে বিজাপুর পৌঁছানোর চেষ্টা করে। প্রকাশ্য দিবালোকে চিন্টুর বাসস্ট্যান্ডে তাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এক অধিকার কর্মীর কথায় সশস্ত্র বাহিনী ও সাদা পোশাকের পুলিশ অধিকার কর্মীদের সব সময় ঘিরে রাখছিল।এই আচরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে ছত্তিসগড় সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কীর্তি কলাপকে লুকিয়ে রাখতে চায়।

নিকষ অন্ধকারে সত্য উঁকি মারে

কর্পোরেট মিডিয়ার ব্ল্যাক আউট সত্বেও কখনো কখনো সত্য সামনে আসে যা এই 'চলমান এনকাউন্টার' সমূহের সত্যতা আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেয় স্থানীয় সংবাদপত্র ও কিছু দায়বদ্ধ মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। ১১.০৫.২০২৪ তারিখে ছত্তিসগড় পুলিস এক এনকাউন্টারের খবর প্রকাশ করে যাতে বলা হয় ১১ জন মাওবাদী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন সিপিআই (মাওবাদী) সশস্ত্র গেরিলা কোম্পানির সদস্য বুধু ওয়াম ও কাল্লু পুন্নম, লাখে কুঞ্জম ও ভীমা কুরম। এদের প্রত্যেকেরই মাথার দাম ছিল কয়েক লক্ষ টাকা। কিন্তু গ্রামবাসীরা পুলিশের এই 'গল্প' মেনে নিতে রাজী হয় নি। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয় গ্রামবাসীরা পরের দিন বিজাপুর ডিস্ট্রিক্ট কালেকটরেট অফিসে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য মৃতরা কেউই গেরিলা স্কোয়াডের সদস্য নন বরং তাদের গ্রামের বাসিন্দা। পুলিশ ঠান্ডা মাথায় ভুয়ো এনকাউন্টারে তাদের হত্যা করেছে। পেডিয়া গ্রামের গুরুনন্দা যিনি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের জানান যে গ্রামের লোকেরা কেন্দু পাতা সংগ্রহ করতে জঙ্গলে গেছিল। সেখানে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে গুলি করে। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রাজু জানান মৃতদের মধ্যে যে লালু কুঞ্জম রয়েছে সে চাষ করে, পুলিশের ভয়ে সে ছুটে পালাতে যায়। পুলিশ পেডিয়া ও ইতেভার গ্রাম দুটোকে চারদিক ঘিরে অভিযান চালায়। ফোরাম এগেনস্ট কর্পোরেটাইজেশন অ্যান্ড মিলিটাইরেজেশন (FACAM) এর পক্ষ থেকে যে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হয়েছিল তাতেও দেখা যাচ্ছে ১৯.০১.২০২৪ তারিখে যখন বিজাপুর জেলার নেন্দ্রা গ্রামের মাডকাম সোনি ও গোতুম গ্রামের পুনেম নঙ্গি পুলিশ ক্যাম্প বিরোধী অবস্থানে যোগ দিতে যাচ্ছিল তখন মাওবাদী তকমা দিয়ে রাস্তায় পুলিশ তাদের এনকাউন্টার করে। এ রকম অজস্র ঘটনা আজ ছত্তিসগড়ের বধ্যভূমিতে লুকিয়ে আছে। ফোরামের পক্ষ থেকে এই ধারাবাহিক গণহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে: "The Indian's  state's war against Naxalism is practically a genocidal war on people, particularly the Adivasi peasants"।

বস্তার: ফিরে দেখা

আজ বস্তার তথা ছত্তিসগড়ে যা ঘটছে তার শুরু কিন্তু বহু আগে। এই ঘটনার শুরু হিসাবে আমরা ধরতে পারি ২০০৯ সালের ৯ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং এর লোকসভায় সেই বহু আলোচিত উক্তি: " যদি বামপন্থী উগ্রপন্থা আমাদের দেশের খনিজ সম্পদ অঞ্চলে বাড়তে থাকে, তাহলে বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে"। এই খনিজ সম্পদের উপর কর্পোরেট কর্তৃত্ব স্থাপনের লড়াই অবশ্যই রাষ্ট্রের তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অন্যতম কারণ। আদতে ছত্তিসগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, ওড়িশার মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা বহুমূল্য খনিজ সম্পদ আহরণ করতে পূর্ব ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষদের উচ্ছেদ করা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে অনিবার্য দায় হয়ে ওঠে।ফেলিক্স প্যাডেল ও সমরেন্দ্র দাস তাঁদের "Out of this Earth: East India Adivasis and the Aluminium Cartel" নামক বইতে লিখেছেন যে, কেবল ওড়িশার বক্সাইট [বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম পাওয়া যায়] সম্পদের মূল্য ২০০৪ সালের দ্রব্যমূল্যের ভিত্তিতে ৪০,০০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ছত্তিসগড় ও ঝাড়খন্ডের ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের উচ্চ মানের আকরিক লৌহ। এই পূর্ব ও মধ্যভারতে আছে ২৮ রকমের অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদ যেমন ইউরেনিয়াম, চুনাপাথর, ডলোমাইট, কয়লা, টিন, গ্রানাইট, শ্বেতপাথর, তামা, হীরে, সোনা, কোয়ার্টজাইট, কেরান্ডাম, সিলিকা, ফ্লুরাইট, গারনেট ইত্যাদি। তার সাথে আমাদের যোগ করতে হবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধ, হাইওয়ে, ইস্পাত ও সিমেন্ট কারখানা, অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশন কারখানা, কাগজকল এবং আরো অনেক পরিকাঠামো তৈরির প্রকল্প। আদানি, আম্বানি, টাটা, জিন্দাল, থাপার সহ বিভিন্ন দেশি বিদেশি কর্পোরেট গোষ্ঠীর লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের সাফল্য নির্ভর করছে এই উচ্ছেদের উপর।

বধ্যভূমি বস্তারের ইতিবৃত্ত ধারাবাহিক ভাবে বুঝতে নিচের সময় সারণীটি সাহায্য করবে:

  • ২০০৫: মাওবাদী প্রতিরোধের নামে ভারত সরকার বস্তারের স্থানীয় আদিবাসীদের সশস্ত্র করে ' সালওয়া জুড়ুম' (শান্তি যাত্রা) মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করে। সরকারি রক্ষাকবচে বলীয়ান হয়ে শুরু হয় গণধর্ষণ, গ্রামে অগ্নিসংযোগ  ও খুনের তান্ডবলীলা।
  • ২০০৯: আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদতে ও কর্পোরেট সংস্থাগুলির আনুকুল্যে ভারত সরকার শুরু করে 'অপারেশন গ্রীণহান্ট' (সবুজ শিকার)। ঘোষিত লক্ষ্য এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ সংগ্রামকে চূর্ণ করে মাটির তলার খনিজ সম্পদের উত্তোলনকে নিশ্চিত করা।
  • ২০১১: সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ নন্দিনী সুন্দরের জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট সালওয়া জুড়ুমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সালওয়া জুড়ুমের সময় হওয়া সমস্ত অত্যাচারের সারবত্তা সর্বোচ্চ আদালত স্বীকার করে।
  • ২০১৪: অপারেশন গ্রীণ হান্ট বিভিন্ন ধরণের প্রতিকূলতার সন্মুখীন হয়। এই সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে জনমত গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
  • ২০১৫: নরেন্দ্র মোদি জমানায় কর্পোরেট - সামরিকীকরণের নতুন পরীক্ষা শুরু হয় সুরজগড় পার্বত্য অঞ্চলে। লয়েড মেটাল নামে এক কর্পোরেট মাইনিং সংস্থার খনিজ উত্তোলনের জন্য কয়েকটি গ্রামে উচ্ছেদ শুরু হয়।এর বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষেরা এক বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই সংগ্রামকে ধ্বংস করতে পুরো এলাকায় আধা সামরিক বাহিনীর শিবির বসিয়ে অভিযান শুরু হয়।
  • ২০১৭: অপারেশন সমাধান-প্রহর শুরু হল। সুরজগড়ের অ্যান্টি- মাইনিং সংগ্রামের উপর নামিয়ে আনা আক্রমণকে মডেল করে তা সমস্ত খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় লাগু করার সিদ্ধান্ত হয়।
  • ২০১৮: ২০১৪ সালে জি.এন.সাইবাবা, হেম মিশ্রদের গ্রেপ্তার দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তার সর্বাধুনিক রূপ দেখা যায় কুখ্যাত ভীমা-কোঁরেগাও মামলায়। সরকারের কাজকর্মকে প্রশ্ন করার অপরাধে ইউএপিএ আইনে কলমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
  • ২০২১: এই প্রথম ভারতে শুরু হল ইজরায়েলে প্রস্তুত ড্রোন দিয়ে আদিবাসী গ্রামগুলিতে বোমা বর্ষণ।
  • ২০২৪: জনগনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণার সবচেয়ে আগ্রাসী রূপ শুরু হল এবছর ১ জানুয়ারি থেকে। অপারেশন কাগর।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, আজ যা বস্তারে চলছে তা আদতে রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ এক ধারাবাহিকতা।উপরিউক্ত সময়সারণীকে অনুসরণ করে বিষয়টির ব্যাখ্যা আবশ্যক। ১৯৯০-৯১ সময় পর্বে প্রথম ছত্তিসগড়ে সরকার শুরু করে এক কৌশল যার নাম 'জন জাগরণ অভিযান' (Public Awakening Campaign)। আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা হয়েছিল যে মাওবাদী রাজনীতি প্রভাবমুক্ত রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করাই এর উদ্দেশ্য। বাস্তবে বিষয়টা হয়ে দাঁড়ায় যুব শক্তির একটা অংশকে সশস্ত্র করে সম্ভাব্য মাওবাদী সিমপ্যাথাইজারদের আক্রমণ, ধর্ষণ ও নির্দিষ্ট বাড়ি চিহ্নিত করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া। ২০০৫ সালে এই অভিযানের নতুন নাম দেওয়া হয় সালওয়া জুড়ুম।কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মার নেতৃত্বে শুরু হয় আদিবাসীদের গ্রামগুলোকে খালি করে সরকারের নজরদারিতে নতুন 'গ্রাম' তৈরি। এই নতুন গ্রামে যারা যেতে অস্বীকৃত হয় তাদেরই 'মাওবাদী' বলে দেগে দেওয়া শুরু হয়।

সালওয়া জুড়ুমের পাশাপাশি ছত্তিশগড় রাজ্য সরকার প্রাক্তন মাওবাদী,আদিবাসী ও আদিবাসী নয় এমন যুবকদের একটা অংশ নিয়ে সরকারের টাকায় একটি বাহিনী তৈরি করে। এই অক্সিলারি ইউনিটের নাম দেওয়া হয় স্পেশাল পুলিশ অফিসার( SPO)। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ট্রেনিং সিডিউল-- কোন কিছুরই উল্লেখ ছিল না। একমাত্র প্রয়োজন ছিল আধা- সামরিক বাহিনী ও সালওয়া জুড়ুমের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করার সন্মতি। এই ভাবে সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে এক গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করার বিরুদ্ধে নন্দিনী সুন্দর সহ একাধিক সমাজকর্মী সর্বোচ্চ আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। আদালত সালওয়া জুড়ুম সহ গোটা প্রক্রিয়াকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এই রায়ের পরেও রাজ্য সরকার তার পথ থেকে সরে আসে নি। বিষয়টাকে আইনি রূপ দিতে ছত্তিসগড় অক্সিলারি আর্মড ফোর্স অর্ডিনান্স পাশ করে। একই সঙ্গে এই সরকারি স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে আরো বেশি আধুনিক অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে এই বাহিনীর নতুন নাম হয় ' ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড'। এই ধরণের অসাংবিধানিক শক্তি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে।

২০০৯ সালে ভারত সরকার শুরু করে দেশব্যাপী 'অপারেশন গ্রীন হান্ট'। এই অভিযানে যুক্ত করা হয় বিভিন্ন আধা- সামরিক বাহিনীকে যেমন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স,বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ইন্দো-টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ এবং কিছু বিশেষ বাহিনী যেমন গ্রেহাউন্ড। প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মাওবাদী নেতৃত্বকে নিকেশ করে এক মস্তকহীন সংগঠনে রূপান্তরিত করা।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হবার পর ২০১৭ সাল পর্যন্ত অপারেশন গ্রীণ হান্টকে আরো জোরদার করা হয়।পরবর্তীতে পূর্ব ও মধ্য ভারতে মাওবাদী সহ যে কোন প্রতিরোধ করতে চালু হয় ' অপারেশন সমাধান '। ইংরেজি আদ্যাক্ষরে এর অর্থ S-- Smart leadership, A-- Aggressive strategy, M-- Motivation and training, A-- Actionable Intelligence, D-- Dashboard based key performance indicators, H-- Harnessing tecnology, A-- Action plan for each theater, N-- No access to financing, এক কথায় SAMADHAN। অবশ্য একই সঙ্গে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই সামরিক কৌশল ছত্তিসগড়ের মূল সমস্যার কোন সমাধান হয়নি।

এই ধারাবাহিকতার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে হরিয়ানার সুরজকুন্ডে ভারত সরকার আয়োজিত চিন্তন শিবির। এখানে যে কৌশল নেওয়া হয় তার মূল কথা হল একদিকে যেমন সামরিক অভিযানকে আরো জোরদার করা এবং ভারত ইতিহাসে প্রথমবার সোজাসুজি প্রগতিশীল লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবীদের গণশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিভিন্ন দানবীয় আইনে বন্দী করা। ভীমা-কোঁরেগাও মামলা তার আদর্শ উদাহরণ মাত্র। অবশ্য সুরজকুন্ড চিন্তন শিবির থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলো শুধু মাওবাদীদের প্রতি প্রযুক্ত হয়নি, বিগত পাঁচ বছরে সরকারের বিরোধিতা যারাই করেছে তাদেরই ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো হয়েছে।

এই বছরের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছে এই গৃহযুদ্ধের আরেকটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায় যার নাম অপারেশন কাগার। এই মুহূর্তে ছত্তিসগড়ে তিন শতাধিক সামরিক শিবির, যার মধ্যে শুধু বস্তারে শিবিরের সংখ্যা একশ। প্রতি শিবির পিছু ৫০০ থেকে ২০০০ সশস্ত্র বাহিনী। একই সঙ্গে চলছে ড্রোন হামলা। কাগর অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে রক্তাক্ত লড়াই, শতাধিক আদিবাসী মানুষ মৃত, আহত কয়েকশত।

শেষের কথা

ভারতে সংবিধান স্বীকৃত 'সিডিউল ট্রাইব' (আদিবাসী /মূলবাসী) গোষ্ঠীর সংখ্যা ৭০৫।সর্বশেষ জনগণনা (২০১১) অনুসারে আদিবাসী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি যা জনসংখ্যার ৮.৬%। এই আদিবাসী মানুষদের ৯০% বাস করেন গ্রামীণ ও অরণ্য এলাকায়। ভারতে যে দুটো রাজ্যে আদিবাসীরা বিপুল সংখ্যায় বাস করে সেদুটি রাজ্য হল ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিসগড়। আজ ছত্তিসগড়ের যে অংশ গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতির চলছে সেগুলি হল বৃহত্তর বস্তারের সাতটি জেলা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ আদিবাসী। এই জেলাগুলো হল কাঙ্কের (৫৫.৪%), কোন্ডাগাঁও (৭৭.০৭%), নারায়নপুর (৭৭.৪%), বস্তার (৬২.৪%), দান্তেওয়াড়া (৭১.২), বিজাপুর (৮০%), সুকমা (৮৩.৫%)। সংবিধানের ১৫(৪) এবং ৪৬ ধারায় আদিবাসী মানুষদের একাধিক রক্ষাকবচ রয়েছে। এছাড়া মধ্য ও পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের জন্য পঞ্চম তপশিলে এবং উত্তর -পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের জন্য ষষ্ঠ তপশিলে নানান অধিকারকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। ছত্তিসগড় সহ দশটি রাজ্যের জন্য পঞ্চম তপশিলে আদিবাসী মানুষদের জন্য গ্রামসভার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আইনিভাবে স্বীকৃত। এতে বলা হয়েছে আদিবাসী এলাকার জমি ও সম্পদের ব্যাপারে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে গ্রামসভা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়াও রয়েছে আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন-- "Scheduled Tribes and other Traditional Forest Dwellers(Recognition of forest rights) Act-2006" এবং " Panchayet (Extension to Scheduled Areas)"। এছাড়াও উল্লেখ করা দরকার যে রাষ্ট্রসংঘ সারা পৃথিবীতে আদিবাসী মানুষদের অধিকার রক্ষার জন্য যে ঘোষণাপত্র (ICCPR) জারি করে ভারত তাতে স্বাক্ষরকারী।

এত ধরনের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকা সত্বেও আদিবাসীরা আজ শোষন ও নিপীড়নের ধারাবাহিক শিকার। বস্তারে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তার একমাত্র কারণ সাংবিধানিক অধিকার ও নীতিমালা এবং তাদের ক্ষেত্রে আশমান-জমিন ফারাক। ২০০৩ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে ছত্তিসগড় সরকার ২৭২টি 'মৌ' (মেমরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর করেছে যাতে কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ হওয়ার কথা প্রায় ১৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে ১৫৮টি মৌ বাতিল হয়েছে। আবার ২০১৯ থেকে ২০২১ এর মধ্যে স্বাক্ষরিত মৌ এর সংখ্যা ১০৪, যাতে সম্ভাব্য লগ্নির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আজকে এই বধ্যভূমিতে একদিকে আদিবাসী মানুষদের জল জঙ্গল জমি বাঁচানোর লড়াই, অন্যদিকে কর্পোরেট স্বার্থে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য  সরকারের সামরিক অভিযান।

আজ বস্তারের পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে এক চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করছে। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংবিধান রক্ষার লড়াই বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। আজ আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে বস্তারের মানুষ কিন্তু সংবিধানের বাইরে নন। আইন কাউকে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে হত্যার অনুমতি দেয় না। গণতন্ত্র সংলাপে বিশ্বাস করে। নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কোন গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। আজ আমাদের দাবি তুলতে হবে বস্তারের অস্থিরতার আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ অনুসন্ধানের। বহু সমালোচিত, ঘৃণ্য কর্পোরেট উন্নয়ন মডেলের বিরুদ্ধে বলা এবং জনমুখী সহনশীল উন্নয়নের দাবি জানানো অসাংবিধানিক নয়। আমরা রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধানে বিশ্বাস করি না।আজ বস্তার নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা দাবি করছে।

তথ্যসূত্র:

এই বৃত্তান্তের যাবতীয় তথ্য ফোরাম এগেনস্ট মিলিটারাইজেশন অ্যান্ড কর্পোরেটাইজেশন, কো-অর্ডিনেশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস অর্গানাইজেশন ও পিইউসিএল প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত।

Post a Comment

0 Comments