প্রীতিলতা বিশ্বাস
উচ্চ-উচ্চতার শীতল মরুভূমি লাদাখ। লাদাখের পরিস্থিতি বেশ কিছুদিন হল উত্তপ্ত হয়ে আছে। সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা এবং জন্মভূমির বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতারিত হবার অনুভুতি। ২০১৯ এর আগষ্টে কেন্দ্রীয় সরকার যখন জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে, তখন লেহ-লাদাখের অধিবাসীদের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। NCST (National Commission of Scheduled Tribe) ১১সেপ্টেম্বর ২০১৯, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রীকে চিঠি লিখে লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সুপারিশ জানিয়েছিল। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ইস্তাহারে এই প্রস্তাব তিন নম্বরে স্থান পায়। নির্বাচনে লাদাখবাসীর উপচে পড়া সমর্থনে জয়ী হয়ে বিজেপি প্রার্থী লোকসভায় আসে। বিজেপি সরকার গঠন করে। কিন্তু লাদাখবাসীর ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হবার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। অনেক টালবাহানার পর চলতি বছরের ৪ঠা মার্চ জানিয়ে দেওয়া হয় যে সরকার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে না, অর্থাৎ লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মার্চ মাসেই সমাজ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকের নেতৃত্ব লাদাখের ১০ শতাংশ মানুষ খোলা আকাশের নীচে অনশনে বসেন। লাদাখের তাপমাত্রা তখন -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে। টানা ২১ দিন অনশন করেন সোনম ওয়াংচুক। পর্যায়ক্রমে অংশগ্রহণ করেন সেখানকার নারীরা, বৌদ্ধ মঠের সন্যাসীরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে ৩রা ডিসেম্বর আলোচনার আহ্বান জানানো হলে অনশন প্রত্যাহার করা হয়।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকাকালীন, বিধানসভায় চারজন এবং লোকসভায় দুজন লাদাখের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকত। আজ লাদাখ বিধানসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে লোকসভায় মাত্র একজন নির্বাচিত সদস্য পাঠাতে পারে। লাদাখের শাসন পরিচালিত হয় তিন বছর মেয়াদকালের আমলাতন্ত্রের অধীনে, যেখানে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কেউ রাখে না। এমনকি ২০১৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখের আদিবাসিন্দা কারা সে সম্পর্কে কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করেনি। লাদাখে কোনো domicile law নেই। লাদাকিদের বক্তব্য অনুসারে লোকসভায় পাস হওয়া সংবিধানের সিডিউলড ট্রাইব সংশোধনী বিল ২০২৪ এ গাদ্দী, সিপ্পি, গুজর, বাকরওয়াল জনগোষ্ঠীকে ট্রাইব লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তারা লাদাখের আদিবাসিন্দা নয়। এই নিয়েও ক্ষোভ আছে মানুষের মধ্যে। আসলে লাদাখে ১৯৫০ সালে তীব্বত থেকে অভিবাসিত কিছু উপজাতিও বসবাস করছে। এই সমস্ত সমস্যাকে সরকারের ২৬শে আগস্টের ঘোষণা, হয়তো আরও কিছুটা ঘনীভূত করবে। ঐদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা, লাদাখে লে এবং কার্গিল দুটি জেলার সঙ্গে আরও পাঁচটি নতুন জেলা তৈরির কথা ঘোষণা করেন। এগুলি হল—জানস্কার, দ্রাস, সাম, নুব্রা এবং চাংথাং। এই ঘোষণা সাধারণ লাদাকিদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো জাগালেও, সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে। এই পাঁচটি নতুন জেলাতে কি অটোনমাস হিল কাউন্সিল থাকবে? এতকম ঘনত্বের জনবসতির জন্য কি এতগুলো বিভাজন প্রয়োজন ছিল? এই বিভাজন কি অধিবাসীদের সম্মিলিত প্রতিবাদী স্বরকে কিছুটা খন্ডিত করবে? এতগুলো বিভাজনে ক্ষমতার সমীকরণগুলোই পাল্টে যাবে, তা কি লাদাকিদের জন্য সুখকর হবে? আলোচনার আগেই এই ঘোষণা লাদাখবাসীদের আবারও প্রতিবাদের পথে হাঁটতে বাধ্য করে। এই প্রতিবাদের ধারাবাহিকতাতেই ১.০৯.২৪ -২.১০.২৪ পর্যন্ত চলে তাদের ক্লাইমেট মার্চ—লে থেকে নয়া দিল্লী।

এই পর্যন্ত পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে লাদাখের সমস্যাটা কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার ভিতর সীমাবদ্ধ। আসলে লাদাখের সমস্যাটা বহুমাত্রিক। চীন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা ভাগ করে নেওয়া লাদাখ, প্রাচীন সিল্করুটের অংশ। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানজনিত গুরুত্ব অপরিসীম। নীল জলের হ্রদ, সিন্ধু নদী, জান্সকার এবং নুব্রার বিস্তীর্ণ উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সেইসঙ্গে মঠ, স্তুপ ও মসজিদের স্থাপত্য সৌন্দর্যে ভরা লাদাখের মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ ও পশুপালন এবং পশুপালনের হাতধরেই গড়ে ওঠে পশমিনা শীতবস্ত্রের কুটীর শিল্প। ১৯৭৪ সাল থেকে ভ্রমণ পিয়াসীদের আকর্ষণ তৈরি হয়েছে লাদাখকে কেন্দ্র করে। ধীরে ধীরে পর্যটন শিল্প এখানকার মানুষের অন্যতম অর্থনৈতিক অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বর্তমানে সমস্যারও অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
লাদাখের প্রধান সমস্যাগুলির একটি হল জল সঙ্কট। লাদাখের মানুষের জলের প্রধান উৎস তুষারপাত এবং হিমবাহ। গ্রীষ্মকালীন কৃষিকাজের জন্য হিমবাহ গলনের বিন্দু বিন্দু জলও এখানকার মানুষের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন শিল্পের জন্য ট্রাক এবং গাড়ি চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণের বৃদ্ধি, এখানে তুষারপাতের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। এটাকে বিশ্ব উষ্ণায়নের সরাসরি প্রতিফলন বলা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পের চাহিদা পূরণের জন্য হোটেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলশ্রুতি নির্মাণ শিল্পের বৃদ্ধি—পরিণতিতে স্বাভাবিক জলের উৎস পাহাড়ি ঝোরাগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। জলের স্বাভাবিক উৎস যখন ক্ষতিগ্রস্ত ঠিক তখনই বৃদ্ধি পেয়েছে জলের চাহিদা। লাদাখের জনসংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষের মাঝামাঝি। এদিকে সারা বছরে এখানে পর্যটক আসে প্রায় ছয় লক্ষ। এই বিপুল সংখ্যক পর্যটকের জলের চাহিদা পূরণের জন্য হোটেলগুলি ভূ-গর্ভস্থ জল উত্তোলনের ব্যবস্থা করেছে। যার ফলে লাদাখের ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
পর্যটন শিল্পকে পরিষেবা দেবার কারণে বৃদ্ধি পাওয়া অতিরিক্ত নির্মাণ কাজ, এবং যানবাহনের চলাচল, বায়ুতে দূষণের মাত্রা বাড়িয়েছে, ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে উষ্ণতা। যার ফলশ্রুতি—তুষারপাত হ্রাস—হিমবাহের ঘনত্ব হ্রাস—জল সঙ্কট। অতি প্রাচীনকাল থেকে লাদাখের মানুষ ড্রাই টয়লেটে অভ্যস্ত, যা জল সাশ্রয়ী, এবং মাটির উর্বরা শক্তি বর্ধক। কিন্তু পর্যটন শিল্পের প্রভাবে হোটেলগুলির আধুনিক টয়লেট, জলের চাহিদা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দূষণের পরিমানও বৃদ্ধি করেছে। পর্যটকদের পরিত্যক্ত জলের বোতল ও প্লাস্টিকের প্যাকেট লাদাখের পরিবেশের মুর্তিমান সমস্যা। পরিবেশে কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্পষ্টতই বর্তমান পর্যটন শিল্পের বৃদ্ধি লাদাখের পরিবেশের জন্য টেকসই নয়। লাদাখের পরিবেশের জন্য টেকসই পর্যটন কি সম্ভব নয়? সম্ভব। কিন্তু তাতে এই শিল্পে লাভের সিংহভাগ যারা আত্মসাত করছে তাদের ক্ষতি। পর্যটন এবং আতিথেয়তা পরিষেবা শিল্প বর্তমানে ভারতীয় অর্থনীতি বৃদ্ধির একটি চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করছে। সারা বিশ্বেই পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবা শিল্পে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার খুব ভালো। ভারতে এই শিল্পে ১০০ শতাংশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ভারত সরকার দ্বারা অনুমোদিত। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে সার্কিট হাউস, মেলা প্রাঙ্গন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ ও হোটেল এবং বাসস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রগুলি পড়ে। সুতরাং লাদাখের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে পর্যটন শিল্পের যে বৃদ্ধি তার বিনিয়োগকারিরা বড় বড় কর্পোরেট পুঁজির মালিক। এই শিল্পে লাদাখিরা আছে নিতান্তই শ্রমিক ও কর্মচারি হিসাবে। অথচ তাদের জমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং এই শিল্পের সৃষ্টি করা দূষণ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের দায়ভার তাদেরই বহন করতে হচ্ছে। কোন সুদূর ঠিকানায় বসে কর্পোরেট মালিক মেঘনাদ হয়ে লাভের ক্ষীর খাচ্ছে তা আমাদের জানারও উপায় নেই। সাধারণ লাদাকি জনগণ, যাদের নব্বই শতাংশ আদিবাসী এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে। বিপন্ন হচ্ছে লাদাখের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র।
সাবেকি জীবন-জীবিকা ছেড়ে, যে অর্থনীতি জীবনের জন্য বিপদজনক, উপায়ান্তরহীন ভাবে মানুষকে তাই বেছে নিতে হচ্ছে। কারণ লাদাখবাসী ক্রমশ তাদের জমির উপর অধিকার হারাচ্ছে। লাদাখের শীতল মরুভূমি সোলার এনার্জি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত। তাই সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া এখানে ১৩ গিগা ওয়াটের একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছে, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে। এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪০,০০০ একর পশুচারণের তৃণভূমি নেওয়া হয়েছে। লাদাখের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে এই অধিগ্রহণ হয়েছে। গ্রীন এনার্জি ভীষণ শ্রুতি মধুর একটি শব্দবন্ধ। এই গ্রীন এনার্জি তৈরির জন্য বিরল ধাতুর উত্তোলন ও সোলার প্যানেল তৈরিতে প্রয়োজনীর জল সম্পদ ব্যবহারের প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েই যদি প্রশ্ন করি লাদাখের সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টের সুবিধাভোগী কারা? তাহলে তার উত্তর হবে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউস, যারা ম্যানুফেকচারিং এর বরাত পেয়েছে আর যারা গ্রীন করিডর তৈরি করে এই বিদ্যুৎ বিক্রি করবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। লাদাখের মানুষের পশুচারণের তৃণভূমি নিয়ে লাভবান হবে লাদাখের বাইরের কিছু মানুষ। বড় জোর মিডিল ম্যান হিসাবে কাজ করে কিছু লাদাকি আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে। লাদাখে যে খনিজ সম্পদের সম্ভাব্য ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে তার দখল নেবার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা। সেখানেও লাদাকিরা খনি শ্রমিক বা মালবাহক বড় জোর ছোট খাটো দালালির কাজ পেতে পারে। কিন্তু এই কাজ শুরু হলে লাদাখের ভঙুর ইকোসিস্টেম খুব দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।
আবার উত্তর দিক থেকে তৃণভূমি দখল করে ঢুকে এসেছে চীন। সুব্রামনিয়াম স্বামীর বক্তব্য অনুসারে চীন উত্তর দিকের প্রায় ৪০৫৬ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এখানে ভারতের কোনো সেনা আর মোতায়েন নেই। গালওয়ান উপত্যকায় ২০২০ সালে দু-দেশের সেনাদের হাতাহাতি সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন সেনা নিহত হবার পর পরিস্থিতির অবনতি হয়। ৩,৪৪০ কিমি ব্যাপ্ত বিতর্কিত ভারত-চীন সিমান্তে উভয় দেশই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যস্ত। আর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব, সামরিক কর্ম-কান্ড সমস্ত কিছুই হিমালয়ের পরিবেশ ও মানুষের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। লাদাখবাসীর এই নিয়ে তীব্র ক্ষোভ আছে। চীনের সম্প্রসারণও হয়েছে পশুচারণের তৃণভূমিতে। ঐতিহ্যগত ভাবে লাদাখের বহু মানুষের জীবিকা পশুপালন। ছাগল ও ইয়াকের লোম থেকে তৈরি পশমিনা তন্তুর বস্ত্র উৎপাদন এই পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত অনুসারী কুটির শিল্প। তৃণভূমি চলে যাওয়ায় পশুপালনের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করা মানুষজন বিকল্প পেষা হিসাবে দিন মজুর বা ট্যুরিজিমের সঙ্গে যুক্ত কোনো ছোট-খাটো কাজ খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করতেই চীন-ভারত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে ভারত সরকার। চেষ্টা হচ্ছে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো বা বিচ্ছিন্ন একটি সৈন্য মোতায়েন বিন্যাস তৈরির। ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ইকোনমিক টাইমসের খবর অনুসারে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনী পূর্ব লাদাখের ডেপসাং এবং ডেকচোকে ৮০-৯০ শতাংশ বিচ্ছিন্নতা সম্পন্ন করেছে। কৃষিজীবী মানুষের কী অবস্থা দেখে নেওয়া যাক।
কৃষিজমির পরিবর্তন ও জল সঙ্কটের ফলে অনেকেই কৃষি জীবিকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই ধরনের পরিবর্তনে নারীদের স্বনির্ভরতার উপর ঋণাত্মক প্রভাব পড়া খুব স্বাভাবিক, কারণ ঐতিহ্যগত ভাবে নারীরা এই কাজগুলির সঙ্গে বেশি যুক্ত ছিল। একটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত জীবিকা বদলে যাবার অর্থ তার সংস্কৃতির সঙ্কট। গত দু-দশকে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন্সে পর্যটনের বৃদ্ধি আর প্রান্তিক নারীর কর্মহীন হওয়া—নারীকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খনিজ উত্তোলনের জন্য কর্পোটের জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি। যার ফলে জমি ও জীবিকা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক পরিবেশ সঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছে লাদাকিরা। এতটা সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লাদাখের মানুষ আজ ভীষণ অসহায়। জমি সংক্রান্ত এই বিষয়গুলিতে গ্রামসভার কোনো ভূমিকা থাকছে না, কারণ এখানে গণতন্ত্রের কাঠামোটাই অনুপস্থিত।
এ পর্যন্ত যা বলেছি তা হল লাদাখের প্রত্যক্ষ বাস্তব। এখানে বসবাসকারি মানুষ এই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। উচ্চ-উচ্চতার শীতল মরুভূমিতে বেঁচে থাকার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে লাদাকিরা অভিযোজিত হয়েছে। দিনের পর দিন ঐ চরম আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা কোনো সমতলবাসীর নেই। কারগিল যুদ্ধ থেকে লাদাখ সীমান্ত পাহারায় অক্লান্ত সৈনিকের কাজ করেছে বহু লাদাকি। লাদাখের পরিবেশের সঙ্গে তাদের জীবন একই ছন্দে, একই সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। লাদাখের মানুষের ঐতিহ্যগত পেষা, তাদের প্রকৃতিবান্ধব জীবন-যাপন লাদাখের প্রকৃতিকে আজন্মকাল রক্ষা করে আসছে। এই বাস্তবতার আড়ালে ঘটে চলেছে এক প্রলয় যজ্ঞ।
কেন্দ্রশাসিত লাদাখের আমলাতান্ত্রিক অভিভাবকরা, লাদাখের উন্নয়ন মডেলকে এমন ভাবে পরিকল্পনা করেছে যাতে সেখানকার মানুষ ও প্রকৃতিকে দুটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে দেখা হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ খনিজ, পাহাড়, সেখানকার রৌদ্রজ্জল দিন, পাহাড়ের হিমবাহ—এ সমস্ত কিছুরই মূদ্রায়ন করা হচ্ছে, বর্তমানের নিরিখে এবং ভবিষ্যৎ বাজারের সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করে। সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে এই প্রাকৃতিক পুঁজির দখল নিতে চলেছে কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা। কিন্তু শুধু প্রকৃতিক পুঁজির দখল নিলেই তো আর মুনাফা সৃষ্টি হবে না। তারজন্য প্রয়োজন শ্রমের শোষণ। আর তাই লাদাকিদের প্রকৃতি নির্ভর জীবন-জীবিকাকে ভেঙে তচনচ করে ওদের শ্রমশক্তি ব্যবহার করেই চলবে ওখানকার প্রাকৃতিক পুঁজির লুণ্ঠন। প্রকৃতি কেন্দ্রিক জীবনকে নষ্ট করে দিতে পারলেই শ্রম ও প্রকৃতি দুটোই শোষণ করা সম্ভব। ধীরে ধীরে মানুষ ও প্রকৃতির ঐক্যতান নষ্ট হয়ে সৃষ্টি হয় বিপাকীয় ফাটল—বাস্ততন্ত্রের এক গভীর সঙ্কট। লাদাখের পরিবেশকে বাঁচাতে তাই এখানকার মানুষের জীবিকা এবং সংস্কৃতিকে রক্ষা করা বিশেষ প্রয়োজন। এই মানুষজনই ওখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রকৃত রক্ষক।
জেনে নেওয়া প্রয়োজন লাদাখের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমতলের মানুষের কী অসুবিধা হবে। লাদাখ সিন্ধু নদীর জলধারার উপরিভাগে অবস্তিত। এই সিন্ধুনদী লাদাখ থেকে নেমে হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও রাজস্থান রাজ্য হয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করে। অর্থাৎ সিন্ধু শুধু লাদাখের মানুষকে নয়, উত্তর ভারতের সমগ্র নদী ব্যবস্থা সেই সঙ্গে পাকিস্তানের নদী ব্যবস্থাকে সজীব রাখে। তাই লাদাখের তুষারপাতের পরিমান কমে যাওয়া, তার জল সঙ্কট শুধুমাত্র লাদাখবাসীর সমস্যা নয়, তা সমগ্র ভারতবাসীর তথা এই উপমহাদেশের সমস্যা।
মানুষের নানান কর্মকাণ্ডের ফলে পাহাড়ে কার্বন নিঃস্বরণ বেড়ে গেলে তুষারপাতের পরিমান কমে আসবে। এমনিতেই বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে যেটা শুরু হয়ে গেছে। গ্রীষ্মকালে হিমবাহ গলনের ফলে তুষার স্তরের যে ক্ষতি হয় তা শীতকালে তুষারপাত পূরণ করে দেয়। প্রাকৃতিক এই চক্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রথম জলসঙ্কট দেখা দেবে লাদাখে সেই সঙ্গে সমগ্র উত্তর ভারতে।
লাদাখে পাওয়া যায় বিরল প্রজাতির তুষার চিতা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে যার পরিমান কমে আসবে। তুষার চিতা লাদাখের বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। কী ভাবে? তুষার চিতার সংখ্যা কমে গেলে তার খাদ্য তৃণভোজি ছাগলের সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে তৃণভূমির সবুজের পরিমান কমতে থাকে। তৃণভূমির সবুজ কমে গেলে মাটির জলধারণ ক্ষমতা কমে যায়, মাটি আলগা হয়ে ধস প্রবণ হয়ে ওঠে। তার উপরে আমরা হিমালয়ের ঢালের দিকেই বসবাস করি। ভূমির ক্ষয় থেকে হড়পাবানের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। এই একটি উদাহরণ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় বয়সে নবীন হিমালয়, যার গঠন প্রক্রিয়া আজও শেষ হয়নি, তার বাস্তুতন্ত্র কতটা ভঙুর। আবার এই হিমালয় আছে বলেই সমতলে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে গড়ে ওঠা নদী মাত্রিক ভারতের সভ্যতা বেঁচে আছে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কেন লাদাখের মানুষ ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছে। লাদাখ মূলতঃ আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। প্রতিটি গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা সংস্কৃতি আছে। এই সকল মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি এতটাই আলাদা যে সেগুলি সংরক্ষণের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অত্যন্ত জরুরী। লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হলে লাদাখের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি আঞ্চলিক শাসন কাঠামো তৈরি করতে পারবে। যে স্বশাসিত সংস্থাটি গভর্নরের সম্মতিতে ভূমি, বন, মৎস, সামাজিক নিরাপত্তা, বিনোদন ও জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারবে, যা এই জনজাতিগুলির জন্য রক্ষাকবচের মতো কাজ করবে। সংসদ বা রাজ্য আইনসভার আইনগুলি তখন এখানে আর প্রযোজ্য হবে না। উপজাতীয় জমি ও সম্পদ অ-উপজাতীয়দের কাছে হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে। এখানকার জমির উপর লাদাকিদের অধিকার বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন লাদাখের মানুষের স্বায়ত্বশাসন। একমাত্র এর মাধ্যমেই ওখানে বসবাসকারি মানুষের সংস্কৃতি, পাহাড় ও জলাভূমিকে রক্ষা করা সম্ভব। দিল্লি থেকে গণতন্ত্রহীন একটা শাসন ব্যবস্থা তাদের উপর চাপিয়ে দিলে পাহাড় যেমন বিপন্ন হবে, দিল্লি তথা ভারতের বাকি অংশও সেই ভাঙনের বিপর্যয় থেকে বাঁচতে পারবে না। সোনাম ওয়াংচুক ও তার সাথীদের আন্দোলনের শরিক হতে হবে সমতলের মানুষকেও, কারণ পাহাড় না বাঁচলে, সমতলও মরুভূমিতে পরিণত হবে।
লেখক প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। তাঁর অনুবাদে মেহনতি পাবলিকেশন থেকে ‘চিকো মেন্ডিস : জঙ্গল রক্ষার লড়াই’ বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে।
0 Comments