নিয়োগী : একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের গল্প


জিএম আনসার

আজকাল মদ্যপান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আকছার মৃত্যু ঘটছে। এসব যেন এখন জল ভাত। আমাদের তেমন নাড়া দেয় না। ব্যাঙের ছাতার মত যত্র তত্র মদের দোকান মাথা তুলছে। অবশ্য ঝাঁটা বঁটি হাতে প্রমিলা বাহিনীর প্রতিরোধের চিত্রও আছে। ব্যস। তারপরে অবস্থা একই জায়গায়। বাচ্চাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য শিকেয় তুলে নরকের আগুনে সংসার ছাই হয়। অশান্তির আগুনে প্রথমে দগ্ধ হয় শ্রমজীবিরা। বিশেষত মহিলারা। এই দারু দানবের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কাহিনী শোনাব। 

সম্ভবতঃ ১৯৭৮-৭৯ সাল। ভিলাই কারখানার খনি শহর রাজহরাতে থাকি। ভাগুলিপাড়া বস্তি এলাকা থেকে নিজের ঘরে ফিরব। সঙ্গে সাইকেল। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় জল নেই। শুধু পাহাড়ি নালা গুলোতে জলের ধস্তা ধস্তির শব্দ। রাতও হয়েছে বেশ। নিয়োগী আমাকে থামিয়ে দিলেন। “ চলো তোমাকে খানিকটা এগিয়ে দিই। “ পুরানো বাজার এলাকায় ছিলো মদের দোকান। আদিবাসী এলাকা। মদ তো খাবেই। তার উপর শনিবার দিন পগার মিলেছে। রাস্তার উপরেই জনা আট পড়ে আছে। খাটো পাজামা পাঞ্জাবী পরা দীর্ঘ দেহী নিয়োগীকে দেখে কয়েকজন টলতে টলতে ছুটে পালাল। পাঁচ সাতজন পায়ে জড়িয়ে ধরল। ওই এলাকাটা গুন্ডা গর্দি অসামাজিক কাজের জন্য কুখ্যাত ছিল। পরদিন থেকে দারু দানবকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। 

সিদ্ধান্ত হল খনি ইউনিয়নের (CMSS) পদাধিকারী হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা হল মদ পান না করা। কোন মুখিয়া মদ পানের পক্ষে হলে মিটিংয়ে তার কারন গুলো বলতে হত। ক্রমে শ্রমিকদের মধ্যেও এই নিয়ম চালু হয়েছিল। গোপনে মদ খেলে জরিমানা ছিল। কাজ থেকে কয়েকদিন বসিয়ে দেওয়া হত। জরিমানার টাকাটা গোপনে তার পরিবারের হাতে দেওয়া হত। মদ্যপ স্বামীদের ধরে আনত তাদের স্ত্রীরা। খুবই জনপ্রিয় ছিল এই আন্দোলন। মদ খেলে ফুসফুস হাড় গোড় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারজন্য ছবি, পোস্টার, দেওয়াল লিখন চলত। ১৬ মিমি একটা প্রজেক্টার মেশিনে গ্রামে গ্রামে সিনেমা দেখানো চলত। শহীদের নাম নিয়ে মদ না খাওয়ার শপথ নিতে হত। মদে দীর্ঘদিন আসক্তির জন্য শারীরিক অসুবিধার কারনে ডাক্তার বাবুদের পরীক্ষার পর কিছু ছাড় দেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। তারজন্য ছাপানো ফর্ম পূরণ করতে হত। মদ পানের মাহেন্দ্রক্ষন কাটাতে খেলাধুলা, গান বাজনা, সঙ্গদান, ভ্রমণের ব্যবস্থা ছিল। মাদ্রাজে একবার সর্ব ভারতীয় র‍্যাডিকাল ছাত্র ইউনিয়নের সমাবেশ হয়েছিল। শঙ্কর গুহ নিয়োগী, ডাক্তার বিনায়ক সেন, এই লেখক সহ কবি ও গায়ক রামলাল ও ফাগুরাম দলে ছিলেন। ওখানেই আমরা তরুন গদারের নাটক ও গান শুনেছিলাম। প্রভাবিত হয়ে ফেরার পরেই গড়ে উঠল নওয়া অনজোর সাংস্কৃতিক সংস্থা। মদপান বিরোধী নাটক ও গানের দল গ্রামে গ্রামে প্রচারে যেত। সাড়া ফেলেছিল ফাগুরামের গান “শরাবি ভাইয়ারে ঝন পিবে বটলকে শরাব লা।“ মিছিল ভাসলো নতুন নতুন শ্লোগানে “ দারু পিনা ছোড় দো – দারুকা বটল ফোড় দো।“ মদ বিক্রিতে ভাঁটা পড়ল। সপ্তাহিক ‘মিতানে’ মদ বিরোধী খবর ও লেখা দিতেন শ্রমিকরাও। মিতানের একটি পুরানো সংখ্যা থেকে কিছু তথ্য দিলাম। রাজারাম আর মদ পান করে না। মদের গন্ধ্যে তার বমি পায়। ডাক্তার জানা (শৈবাল) তাকে কিছু বড়ি ও পরামর্শ দিয়েছিল। দুমাসের মধ্যে সংসার চালিয়েও ব্যাঙ্কে জমেছে আটশ টাকা। ৬৫০ টাকা দিয়ে সাইকেল কিনেছে এরকম খবরে শ্রমিকরা প্রভাবিত হতেন। মদ ব্যাবসায়ীরাও আক্রমন নামিয়েছিল। একবার এই লেখক, গবেষক ও সমাজকর্মী পরিচয় দিয়ে বালোদের সরকারি আবগারি দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। মাধ্যম ছিলেন আশা টকিজের ম্যানেজার বাবুলাল শর্মা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক পরিবর্তনে একটি নেশা বিরোধী স্টোরি লিখেছিলাম। অনেক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে তথ্য বিনিময় চলত। জেলা আবগারি অধিক্ষক একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছিলেন পরিবর্তন পত্রিকায়। এর পরেই এক রাতে শর্মাজিকে ট্রাক চাপা দিয়ে খুনের চেষ্টা হয়। শর্মার স্কুটারটা জঙ্গলের রাস্তায় পিসে দেওয়া হয়েছিল। আহত শর্মা জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি এই লেখকের হাত ধরে বলেছিলেন “ আপ লোগ সালামত রহিয়ে। দারু দুশমনকো ভগানা হি হোগা।“ দারু দানব এখন সর্বত্রই। কবে জাগবে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ?

(লেখাটি লেখক জিএম আনসারের অনুমতিতে mehanati.in এ প্রকাশিত)


      লেখকের আরো লেখা পড়ুন:



Post a Comment

4 Comments

  1. Replies
    1. ধন্যবাদ। সাথে থাকুন।

      Delete
  2. খুব ভালো লাগলো লেখাটি ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। সাথে থাকুন।

      Delete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)