স্বাস্থ্য আমার অধিকার, তাকে রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তা কোনো বিমা দিয়ে হতে পারে না। স্বাস্থ্যসাথী নয়, চাই অবাধ, সার্বজনীন সরকারি চিকিৎসা
শাহানারা খাতুন
"খ্রিষ্টাব্দ দু'হাজার, স্বাস্থ্য চাই সবাকার" এটা আমাদের দাবি ছিল। ছিল সরকারি লক্ষ্যপূরণ। কেন? স্বাস্থ্য হলো আমাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আর স্বাস্থ্য বলতে শুধু মাত্র রোগ বা দূর্বলতা নয়। স্বাস্থ্য হল– শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা। তাই একে রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর সেই লক্ষ্যেই জনস্বাস্থ্যের মাইলফলক ১৯৭৮ এ 'আলমা আটা' ঘোষণা পত্রে সই করেছিল ভারত। নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায় নিয়ে সেজে উঠেছিল সরকারি হাসপাতাল,গড়ে উঠেছিল ব্লকে ব্লকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পরিকাঠামো রচিত হয়েছিল । আছেও। তাহলে 'স্বাস্থ্যসাথী' বা 'আয়ুষ্মান ভারত' কেন? আরো উন্নত পরিকাঠামো ? আরো উন্নত পরিষেবা ?
ভুল বোঝা এবং প্রশ্নের শুরু এখানেই। কেন্দ্রের 'আয়ুষ্মান ভারত' এবং রাজ্যের 'স্বাস্থ্যসাথী' আপনাকে নিঃখরচায় (পয়সা আপনার পকেট থেকে যাবে না, সরকার প্রিমিয়াম দেবে) স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবে বেসরকারি হাসপাতালে। আপনি তাই জানতেন। রাতজেগে, ছুটোছুটি করে, লাইনে দাঁড়িয়ে কার্ড বানালেন। নিশ্চিন্তও হলেন। রোগ হলে আর ভয় নেই। কার্ড নিয়ে ছুটব বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু, তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে মমতা সরকার বিধান দিলেন শুধুমাত্র বেসরকারি নয় সরকারি হাসপাতালেও লাগবে 'স্বাস্থ্যসাথী' কার্ড। না থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনার কার্ড করিয়ে নেবে। সরকারি হাসপাতালে আবার কার্ড কেন? এখানে তো প্রায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার কথা? প্রশ্ন আবারও। উত্তর— সরকার আর আপনাকে নিঃখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা দেবে না। আপনি বলবেন প্রিমিয়াম তো সরকার দিচ্ছে, আমি দিচ্ছি না। সত্যি আপনি দিচ্ছেন না সরকারই দিচ্ছে। তবুও আপনি বা আপনার পরিবার নিঃখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছেন না। কেন? আসুন জেনে নিই—
# স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা আপনি কখন পাচ্ছেন? ভর্তি হবার পর। আপনি জানেন হাসপাতাল বা নার্সিংহোম এ ভর্তির আগে আপনার ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, ওষুধ পত্র কেনা ইত্যাদি করতে হয়। আর এগুলো করতে আপনার বেশ কিছু টাকা খরচ হয়। তারপর রোগ নির্ণীত হলে অপারেশন বা সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য আপনি হাসপাতালে ভর্তি হন। আপনি ঐ ভর্তি পরবর্তী সময়ে বিমা কার্ড এর সুবিধা পাবেন। আগের খরচ টা পাবেন না।য যেখানে আপনি আপনার পকেট থেকে অনেকটা টাকা খরচ করে ফেলেছেন।ধরুন আপনার একটা অসুখের জন্য ১০০ টাকা খরচ হলো। এর ৬৩ টাকা আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে। বিমাকার্ড থেকে পেলেন ৩৭ টাকা। এই ৩৭ টাকা আপনি আগে এমনিই পেতেন। তাহলে কার্ড কেন? কারণ সরকার আর স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ করবে না। যেটুকু করবে আমার আপনার সুবিধার্থে নয় ,পূঁজি প্রতি তোষণে। কার্ড থাকলেই আপনি বেসরকারি হাসপাতালে যাবেন। সরকারি হাসপাতালে গেলেও বিমাকার্ড নিয়ন্ত্রিত হবে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের দ্বারা। এমনিতে জাতীয় আয়ের মাত্র ১% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হয়। সেটাও সরাসরি করবে না। ঘুরপথে স্বাস্থ্যব্যবসায়ী দের হাত ধরে। ফল লাভের গুড় পিঁপড়ে খাবে। আপনি একের বদলে হাফ পাবেন।
# ধরুন আপনার এলাকায় জনসংখ্যা পঞ্চাশ হাজার। যদি বছরে পাঁচশ জন স্বাস্থ্যসাথীর সুযোগ নেয়। তাহলে ৫০০× ৫০০০০০ =২৫০০০০০০০। কত টাকা হলো? এই টাকায় আপনার এলাকার BPHC কে Super Specility হাসপাতাল বানিয়ে দেওয়া যেত। প্রত্যেক ব্যক্তি যথেচ্ছ ভাবে চিকিৎসা পরিষেবা পেত। তা না করে বিমাকার্ড কেন? ঐ সরকার বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেবে না। যেটুকু দেবে তার ভোগ করবে কর্পোরেটরা।
# আপনার পরিবারে সদস্য সংখ্যা পাঁচ। পরিবারের এক ব্যক্তি গুরুতর রোগগ্ৰস্থ হয়ে সব টাকা বা সিংহভাগ টাকা খরচ করে ফেললেন। বাকি সদস্যদের সারা বছর কী হবে? পাঁচজনের জন্য কার্ড তো একটাই। আপনি জানেন বিমাকার্ড দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে কি পরিমাণ বিল হয়। অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অহেতুক বিল বাড়ানো হয়। বিমা কোম্পানী সবসময় সেই টাকা দেয় না, দিতে রাজি হয় না। তাদের গাইড লাইনে নাকি এসব নেই। এক কোণে ছোট্ট করে লেখা terms & condition আপন পড়ে দেখেন নি। তাছাড়া সরকারি নির্দেশিকা থাকে কোন্ ধরণের রোগে আপনি কতটাকা পাবেন। তাই প্রাইভেট হাসপাতালের করা বিল আপনি সবটা না পেতেই পারেন। ভর্তির সময় আপনি কি জানতেন কোন্ ধরণের চিকিৎসার উপযোগী আপনার কার্ড?
# আপনি বলতেই পারেন আয়ুষ্মান ভারত, স্বাস্থ্যসাথী, RSBY এগুলো আমার ঘরের টাকা নয়। সরকার দিচ্ছে। সরকারি টাকা তো কোন ব্যক্তি মালিকানা নয়। এ টাকা আমার, আপনার টাকা। বেতনভোগীরা সরাসরি সরকারকে কর দেয়। আপনি দেন পরোক্ষভাবে। আপনার কেনা প্রত্যেকটা সামগ্ৰীর মাধ্যমে সরকার কর নেয়। তাই সরকারি টাকা আমজনতার টাকা। তাই সরাসরি আমজনতার উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে। সারা পৃথিবীর চল্লিশটি দেশ নাগরিকদের সার্বজনীন চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। এর মধ্যে ধনতান্ত্রিক দেশ আছে। গণতান্ত্রিক দেশ আছে। নেপাল, কিউবাতেও আছে। তাহলে আমাদের মতো বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশে নয় কেন?
# আজ পর্যন্ত কোনো বিমা কোম্পানী মানসিক স্বাস্থ্যের দায় নেয়নি। মানসিক স্বাস্থ্যহীনদের কী হবে। সব থেকে বড় কথা এই বিমাকার্ড নিয়ন্ত্রিত হবে কার দ্বারা?
# অভিজ্ঞতা বলছে কোভিডের চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসাথী বা RSBY সরাসরি ভর্তি হতে পারেন নি। দ্বারস্থ হতে হয়েছে স্থানীয় নেতার। সুপারিশ ভিন্ন বলে দিয়েছি বেড নেই। বেসরকারী বিমাকার্ডধারীরাও কোভিড চিকিৎসা সম্পূর্ণ চিকিৎসা পান নি। এ অবস্থা যে পরে হবে না এ নিশ্চয়তা কোথায়। অতিরিক্ত চাপের অজুহাত দেখিয়ে আপনাকে ফেরৎ পাঠাতে পারে। আপনার চিকিৎসা হয়তো তখন জরুরী ছিল। আপনি বাধ্য হবেন পকেটের টাকায় চিকিৎসা করাতে।
# তাছাড়া পথে ঘাটে দুর্ঘটনা ঘটলে কার্ড কোথায় পাবো? একটা কার্ড পরিবারের ক'জন ব্যক্তি নিয়ে ঘুরবেন? কার্ড না থাকলে চিকিৎসা হবে না। এতোদিন কোটি কোটি সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসার স্থল ছিল সরকারি হাসপাতাল। এই করোনা কালেও সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালেই ভরসা রেখেছে। আজ বিমাকার্ড বাধ্যতামূলক হওয়ায় মানুষ উৎকন্ঠিত। সবই যদি আস্তে আস্তে কার্ডের গেরোয় আটকে যায় কোথায় যাবেন আমাদের মতো দরিদ্র দেশের অগণিত মানুষ? কেন বিভিন্ন কার্ডের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে মানুষ কে? তাহলে কী ধরে নেব সরকারি হাসপাতাল বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে?
লেখক মানবাধিকার কর্মী
0 Comments