জেলে কেমন আছেন রাজবন্দী সোমা সেন? মেয়ের বয়ানে

নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক, নারী ও দলিত অধিকার আন্দোলনে যুক্ত বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সোমা সেন ভিমা কোরেগাঁও মামলায়, প্রধানমন্ত্রীকে খুনের ষড়যন্ত্র এবং ‛মাওবাদী’ সন্দেহে প্রায় ৪ বছর ধরে জেলবন্দী। একাধিক মিথ্যে ধারা'য় জেলে আটক থেকে তাঁর দিনযাপন, শারীরিক অবস্থা, বন্দী জীবনের টুকিটাকি বিষয়ে সম্প্রতি তাঁর মেয়ে কোয়েল সেন, রেডিফ.কমকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যার ছোট একটি অংশ ৬ই মে, ২০২২ তাঁদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। সেটিই বাংলায় অনুবাদ করেছেন শৌভিক

সম্প্রতি আপনি কারাগারে আপনার মায়ের সাথে দেখা করেছেন। কেমন আছেন তিনি?

প্রায় দু'বছর পর মায়ের সঙ্গে ঠিকভাবে দেখা করলাম। এইভাবে তার পাশে বসে তার সাথে কথা বলতে পারাটা সত্যিই এক আবেগময় অনুভূতি। শারীরিকভাবে আমরা শেষবার দেখা করেছি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, প্রথম লকডাউনের ঠিক আগে, যখন তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তারপর থেকে সেসময়ের কোভিড বিধিনিষেধের উপর নির্ভর করে জেলগুলি সাক্ষাৎ এর জন্য খুলেছে বা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের হয়তো তিন-চারটি ‛মুলাকাত’ হয়েছিল (মুলাকাত, আদালত অনুমোদিত সাক্ষাৎ যেখানে পরিবারের সদস্যরা কারাবন্দী আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে পারেন) যেখানে আমাদের একে অপরকে দেখার এবং কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আমরা কেউ কাউকে স্পর্শটুকু করতে পারিনি। এইবার যখন দেখা হল, আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম কারণ এতদিন পর সাক্ষাৎ। সেই সঙ্গে শুধু মাকে দেখেই আমি অভিভূত হয়ে গেছিলাম। আসলে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে যখন কেউ তার পরিচিত এবং ভালোবাসার মানুষদের সাথে শারীরিকভাবে দেখা করেন, তখন দেখতে পান কতটা বদল এসেছে তাঁদের মধ্যে। এমনকি তাঁরা মুখে  কিছু না বললেও, তিনি বুঝতে পারেন যে মাঝের দিনগুলোয় কত কিছু অতিক্রম করেছেন তাঁরা। এই ক'দিনে মায়ের যা বয়স বাড়ার কথা, দেখলাম, তার চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়েছে। তার সঙ্গে গ্লুকোমা ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যাও দেখলাম আরও গুরুতর হয়েছে। 

তাঁর পাশে একটি পত্রিকা রাখা ছিল; তিনি সেদিকে দেখছিলেন, কিন্তু পড়ছিলেন না। আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি ঠিক আছেন কিনা, পড়তে পারছেন কিনা। তিনি তখন আমাকে বলেন, তিনি আর সহজে পড়তে পারেন না।  তাঁর চোখের অবস্থা সত্যিই খারাপ। 

প্রায় সাত বছর ধরে তাঁর গ্লুকোমা রয়েছে এবং দিনদিন তা  স্পষ্টতই আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে। সত্যিই খুব খারাপ লাগে। আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল প্রায়, কিন্তু কি আর আমি করতে পারি? 

কারাগারে সময় কাটানোর একমাত্র উপায় হল বই পড়া এবং তিনি সেটাও আর ঠিকভাবে করতে পারেন না। তিনি বইগুলো চোখের খুব কাছে এনে পড়তে চেষ্টা করেন কিন্তু বোঝা যায়, এতে কতটা চাপ পড়ে। আমার মাকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট হয়। তাঁর হাঁটুর অবস্থাও ভয়ংকর। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যেখানে তিনি বসেছিলেন সেখান থেকে প্রতিবার ওঠার সময় কিভাবে তিনি তাঁর যন্ত্রণা লুকানোর চেষ্টা করছিলেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করার সময় তাঁর পাশে দুজন পুলিশ কনস্টেবল বসে থাকে। তারা পাশে বসতে দেয় এবং কোনোরকম বাধা ছাড়াই পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দেয়। বহু যুগ পর মায়ের সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমরা প্রায় ঘণ্টা খানেক কথা বলি। মানসিকভাবে, তিনি ভালো আছেন এবং তিনি বেশ সক্রিয় (হাসি)। চার দেওয়ালের সীমারেখার মধ্যে যা যা করেন, সেসব কথা বললেন।

মা এবং সুধা ভরদ্বাজের মতো মহিলারা কারাগারে থেকেও মানুষকে সাহায্য করে চলেছেন। মামলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সাহায্য করেন; উনকো তো কাম করতে হি রেহেনা হ্যায় (তাঁরা কিছুতেই নিজেদের কাজ করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না) এমনকি জেলবন্দী থাকাকালীনও (আবার হাসি)। আমার মনে আছে একটি ‛মুলাকাত’ -- সুধাও সেখানে ছিলেন - যেখানে তাঁরা নিজেরা কথা বলছিলেন কিভাবে কোনো একজন ব্যক্তি জামিন পেল, কিভাবে অন্য জন জামিনদার পেল। এসবই আমি যাকে বলি 'জেলের অন্দর' এর কথোপকথন; যা প্রকৃতই সুন্দর।

একটি স্পর্শকাতর ফেসবুক পোস্টে, আপনি লিখেছিলেন কিভাবে আপনি আপনার মাকে চুরি করে কিছু খাবার দিয়েছিলেন। কারাবন্দী প্রিয়জনের প্রতি  ভালবাসা প্রকাশ করা সত্যিই সংগ্রামের। সুধা বলছিলেন, কিভাবে তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে টুকু ধরতে দেওয়া হয়নি।

হ্যাঁ, আলিঙ্গন করাটা কঠিন। আমার মনে আছে, প্রথম যখন আমি মাকে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলাম, ওরা আমাদের থামিয়ে বলেছিল যে আমরা আলিঙ্গন করতে পারব না।
একবার আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময়, আমাদের এক বন্ধু কাবাব আর বিরিয়ানি এনেছিল। আমরা মাকে তা থেকে অল্প কিছু দিতে চেয়েছিলাম। অনেক সময় পুলিশ অভিযুক্তদের খেতে দেয়। তবে এসবই তাদের মেজাজ-মর্জির উপর নির্ভর করে। তারা অনুমতি না দিলে সেক্ষেত্রে বিচারকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।

আমরা যথারীতি নজর এড়ানোর কৌশল নিতে বাধ্য হলাম। ডাব্বা খুলে নিজেরা খাওয়ার সাথে সাথে মাকে ছোটো ছোটো কয়েক টুকরো খাওয়ালাম। অল্প শাম্মি কাবাব এবং থিওব্রোমা (মুম্বাইয়ের একটি জনপ্রিয় ডেজার্ট আউটলেট) ব্রাউনি খেয়েছিলেন তিনি। আমি তাঁর মুখে উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছিলাম; ব্রাউনি মুখে দিতে তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল (হাসি)।
সুন্দর ছিল সেই মুহূর্ত। তবে স্বাভাবিক ভাবেই, কনস্টেবল বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা ঘটছে। স্কুলে ভুল করলে যেমন আমরা ক্ষমা চেয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতাম, এখানেও তাই-ই করলাম।

পুলিশ যেভাবে ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আপনি পক্ষপাত দেখতে পাচ্ছেন?

ওরা ক্রমাগত নজর রেখে চলেছে এবং সেটা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা যায়। তবে এ ধরনের মানবিক বিষয়ও (যেমন খাবার ভাগ করা এবং আলিঙ্গন করা) বোঝে তারা। যেমন, আমরা বুঝতে পারতাম যে, কনস্টেবল জানত যে মা খাচ্ছেন।

মায়ের খাওয়া দরকার এবং এতে দোষের কিছু নেই।

জেলের নিয়ম অনুযায়ী, শুধুমাত্র চিপস এবং বিস্কুটের মতো প্যাকেটজাত খাবারের অনুমতি দেওয়া হয়; ঘর কা খানা (বাড়িতে রান্না করা খাবার) একদম বারণ, কারণ তাতে নাকি সন্দেহজনক কিছু থাকতে পারে।

পুলিশটি প্রথমে না জানার ভান করে। তারপর, যখন সে আমাদের ধরে, আমরা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম। সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল (হাসি)। আগে জেলে বাড়ির রান্না করা খাবার খেতে দেওয়ার অনুমতি দিত। সবই নির্ভর করতো ডিউটিতে থাকা পুলিশ কর্মীর খেয়ালখুশির  উপর। এখন, তালোজা জেল (নভি মুম্বাই) থেকে পুরুষ কয়েদিদের আনা হলে তাদের খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এটা অদ্ভুত। মা আগে যেখানে ছিলেন, সেই ইয়েরওয়াদা জেল(পুনে) থেকে এখন যেখানে আছেন অর্থাৎ বাইকুল্লা (মুম্বাই) জেল - সেখানকার নিয়মগুলো সবসময় নির্দিষ্ট নয়। এগুলো সবই জেলারদের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করে। এছাড়াও, মহিলাদের জেলগুলির নিজস্ব নিয়ম রয়েছে, পুরুষদের জেলগুলিরও নিজস্ব নিয়ম৷ সত্যি বলতে, এসব নিয়মের ক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট কোনো বই মেনে চলে বলে আমার মনে হয়না।

ছবি: কোয়েল সেনের ফেসবুক প্রফাইল থেকে সংগৃহীত

Post a Comment

5 Comments

  1. কি মন্তব্য করব বলুন তো ? আমি তো বাক রুদ্ধ। আমার বক্তব্য তো উনি নিজেই ,সব কষ্ট বা অত্যাচার সহ্য করে , অবিচল হাসিখুশি।এত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যেমন হাসিমুখে ফাঁসী যাওয়া।
    ওনাকে শত শ্রদ্ধা জানাই।

    ReplyDelete
  2. শ্রদ্ধায় নত হই এদের কথা শুনে।

    ReplyDelete
  3. দেবতা বলতে যা বোঝায় এরা মনে হয় সে ই। শত অত্যাচার ওদের মাথা নোয়াতে পারে না। ঘৃণ্য কুকুর গুলো ওদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনা।

    ReplyDelete
  4. সোমা সেন সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাই

    ReplyDelete
  5. রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।

    ReplyDelete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)