অনিকেত চ্যাটার্জি
'স্যার এখানে তো এখন আনঅ্যাভেলেবল, এই সুযোগে একটু লিখুন, আমাদেরও সুবিধা হবে, পেশেন্টদেরও...'
টেবিলের পাশে মৃদু হেসে লিফলেটের দিকে চক্ষু আকর্ষণ করে বলছিলেন তরুণ এমআর। আনঅ্যাভেলেবল বলতে অন্যতম প্রয়োজনীয় ওষুধ, আর জায়গাটা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের আউটডোর। সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, এই খবর আজকের নতুন নয়। যেহেতু সরকারি, যেহেতু বন্যার জলে ভেসে আসা নিতান্তই সাধারণ মানুষের জন্য, যেহেতু স্বাস্থ্যের ইস্যুতে ভোট কাটে না (যদি না করোনার মতো মাস-প্যানিক তৈরি করা যায়), তাই মাঝে মধ্যেই 'ফ্রি-এর ওষুধ' সরকারি হাসপাতাল থেকে উধাও হয়ে যায়। দয়ার দান তো, অচ্ছেদ্দার ব্যাপার, দিতে ইচ্ছে হয় তাই দিচ্ছি, না দিলে বাইরে থেকে কিনে নেবে! ব্যাস! 'তারা'ও জানে, পেশেন্টরাও জানে, সরকার দিচ্ছে দয়া করে, নইলে কিনতে হতো, এখনও কিনতে হবে। জনসাধারণের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেওয়া, চিকিৎসার দাম কমানো এসব আবার কবে থেকে সরকারের কাজ হলো! সরকারের কাজ তো ভোটে জিতে এসে চেয়ার গরম করা, এদিক-সেদিক লুটেপুটে খাওয়া আর বাধা দিতে এলে মানুষ পোড়ানো!
তাই আউটডোরে ওষুধের স্লিপ দিয়ে টিক মারতে গিয়ে মাঝে মাঝে মনখারাপ হয়ে যায়। টিক মারছি খুব সাধারণ ডিপ্রেশনের ওষুধে, জানি সাতদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ ঘুমের ওষুধ, পাওয়া যাচ্ছে না। সব ওষুধের একটিই পাওয়ারের ডোজ অ্যাভেলেবল, তার কম বেশি হলে নিজেদের মতো ভেঙে টুকরো করে অ্যাডজাস্ট করে নাও, কারো কোনো দায়িত্ব নেই! তবু গরীব লোকগুলোর কী আশা-আস্পর্ধা, রোজ রোজ শুধু বলে 'ভেতরের থেকে ওষুধ লিখে দিন, বাইরে থেকে কিনতে পারি না!' বোকা মানুষগুলো বোঝে না যে ওরা ওষুধ পেল কি পেল না, রোগ সারলো কি সারলো না তাতে সরকারের কোনও দায়ই নেই, আর ডাক্তারের দায় থাকলেও হাত পৌঁছায় না স্টক রেজিস্টার আর ফান্ড পর্যন্ত ; আর চালাক মানুষগুলো ভাবে চালাকি করে স্লিপ দেখিয়ে কোনোভাবে নিংড়ে নেবো প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো— কিন্তু ওরা, সরকারের থেকে তো আর চালাক নয়! সরকার নিয়ম রেখেছে একমাসের বেশি ওষুধ পাওয়া যাবে না প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে, আর একসপ্তাহের ওষুধও থাকে না কাউন্টারে। এরপরের কথা হিসেবে উঠে আসে, হাসপাতালের ভেতর থেকে পাওয়া ওষুধের গুণমান নিয়ে গুজগুজ-ফিসফাস, পেশেন্টদের মধ্যেও চলে ডাক্তারদের মধ্যেও — কিন্তু ভারতের মতো স্বাস্থ্য-সূচকের গভীর উপত্যকায় বসে থাকা দেশে, যেখানে প্রতিদিন স্বাস্থ্যের খরচ সামলাতে পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে পিছলে যায়, সেখানে ভেতরের কাউন্টারের ওষুধই চরণামৃত-বিশ্বাসে খেয়ে নেওয়া এবং চুপচাপ রোগ সারিয়ে ফেলা ছাড়া রোগীদের উপায় কী!
দেখবেন, আমাদেরও সুবিধা হবে। কাদের সুবিধা হচ্ছে? হাসপাতালের আউটডোরে গত কয়েক মাস ধরে ওষুধের কমতিটা বড্ড চোখে পড়ছে। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্যান্টোপ্রাজোল, প্যারাসিটামলের মতো ওষুধও মাঝে মাঝেই বেমিল হয়ে যাচ্ছে। ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালগুলোর অবস্থা কীরকম, আন্দাজ করা যাচ্ছে মেডিক্যাল কলেজ ও টার্শিয়ারি হাসপাতালগুলো দেখে। ফান্ড নাকি নেই, রাজ্য সরকারের। হাসপাতালগুলোর বরাদ্দে আসছে কেবল শ্যাডো ফান্ড, মানে ছায়া-টাকা, মানে টাকার প্রতিশ্রুতি। কয়েকদিন আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ছাড়া সিটি-এমআরআই স্ক্যান বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্যসাথী কেস আলাদাভাবে করে, করতে চায় না, কারণ স্বাস্থ্যসাথীর ফান্ড আসে না। তৃণমূল সরকার ২০১১তে এসে কয়েক বছরের মধ্যেই যে গালভরা আশ্বাস দিয়েছিল স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করার, সুলভ করার, যে সাময়িক পদক্ষেপগুলোও নিয়েছিল, সেগুলো সব ভেঙে পড়ছে। আর আমরা চুপ। রোগীরা রোজ স্লিপ পকেটে রেখে বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে ঘর যাচ্ছেন। পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, পকেটে থাকছে সরকারি হাসপাতালের ফালতু স্লিপ! সুবিধা হচ্ছে, ওষুধ কোম্পানির। ওষুধ কোম্পানির দালালদের। ২টাকা দামের ওষুধ ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ৫টাকা/ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। রোগীরা ওষুধ খাচ্ছেনা, কারণ কিনতে পারছে না। চিকিৎসা শব্দটা হয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক ইউটোপিয়া, প্রেসক্রিপশনে 'poor compliance' লিখে শুধু আর দায় ঝেড়ে ফেলা যায় না তখন..
তবু ওষুধ নিয়ে ঝামেলা হবে না ওষুধের কাউন্টারে? তবু ঝামেলা হবে না সুপারের অফিসে, হাসপাতালের ফান্ড নিয়ে? আর কবে হবে? কতদিন পরে? কাদের কতোটা অসুবিধার পর?..
2 Comments
মারাত্মক অবস্থা
ReplyDeleteসর্বত্র।
Delete