মৎসজীবীদের উপর বনদপ্তরের জুলুমবাজি, মিথ্যা কেস দেওয়ার বিরুদ্ধে, মৎসজীবীদের বিএলসি সংখ্যা বাড়ানো, অত্যধিক শ্যালো মেসিনের ব্যবহার বন্ধ করা, খালগুলোর সংস্কার, সুন্দরবন জুড়ে পরিবেশ বান্ধব নদী বাঁধ, বাঘের আক্রমণে আহত ও মৃতের পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরনের দাবিতে, ভেড়ি তৈরির নামে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল কাটার বিরুদ্ধে, সর্বপরি পরিবেশ রক্ষার নামে পুঁজিপতিদের স্বার্থে সুন্দরবনবাসীর জীবন জীবিকা কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ৫ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কুলতলির ভাসা মোড় থেকে পেটকুলচাঁদ বাজার পর্যন্ত সাইকেল মিছিল ও পথসভার আয়োজন করে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এপিডিআর। মিছিলে অংশগ্রহণ করেন বহু স্থানীয় মানুষ। মিছিল শেষে চলে বৃক্ষরোপণ।
বিশ্বপরিবেশ দিবসে এপিডিআর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা কমিটির বিবৃতি
বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্বিচারে গাছ কাটা, জলাভূমি বোজানো, বন-জঙ্গল ধ্বংস তথা প্রকৃতি-পরিবেশের উপর নিরন্তর আঘাতের ফলই যে আজকের এই বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন, একথা কারোর অজানা নয়। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভের জঙ্গল- সুন্দরবনও আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। বিগত বছরগুলোয় আয়লা, আমফান, ইয়াসের মতো পরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ। পাশাপাশি বিপন্ন হয়েছে বনবাসী মানুষ। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আলোকে সুন্দরবনের পরিবেশ ধ্বংসের পেছনে প্রকৃত কারণগুলো খুঁজলে দেখা যাবে যে, কেবল প্রাকৃতিক কারণেই নয়, এর পেছনে রয়েছে বিস্তর মনুষ্যসৃষ্ট কারণ। রয়েছে সরাসরি রাষ্ট্রীয় মদত। রয়েছে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষের সীমাহীন লোভ। যার ফলস্বরূপ দীর্ঘদিন ধরে নদীর চরগুলো বেআইনিভাবে দখল হয়েছে। স্থানীয় নেতাদের মদতে যথেচ্ছভাবে ম্যানগ্রোভের বন কেটে তৈরি হয়েছে বেআইনি ফিসারি। ফলে বাঁধের মাটি আলগা হয়ে সহজেই ভেঙেছে কোটালে। ভাসিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। অন্যদিকে এই পরিবেশ বাঁচানোর অজুহাত খাড়া করে সুন্দর বনের জঙ্গল নির্ভর শ্রমজীবী মানুষ তথা মৌলে, মৎস্যজীবীদের বন থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে নেমেছে রাষ্ট্র। তৈরি করছে কর্পোরেটদের হাতে জঙ্গল বেচার নীল নকশা। প্রান্তিক বনবাসী মানুষদের জঙ্গলে প্রবেশ রুখতে তারা বহুদিন ধরেই আঁটছে নানান ফন্দী। আর সেসব পরিকল্পনা মাফিক বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব পটু হাতে সামলাচ্ছে স্থানীয় বনদপ্তর। বন ধ্বংসের মিথ্যে অপবাদ চাপানো হচ্ছে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের উপর। যখন তখন কোপ পড়ছে তাদের রুটিরুজির পথে। কখনো নদীতে নামার বিএলসি পাশ, মধু সংগ্রহের মহুল পাশ বন্ধ রেখে, কখনো আইনের ভয় দেখিয়ে মাসের পর মাস মৎস্যজীবী পরিবারের একমাত্র সম্বল নৌকা-ডিঙা আটক করে, কখনো বা বেআইনি ভাবে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে তাদের বন থেকে উৎখাতের চেষ্টা চালাচ্ছে।
অথচ জঙ্গল যাদের পেটে দুমুঠো ভাত জোটায়, তারা কি সত্যিই জঙ্গলের ক্ষতি চায়? বনকে যারা দেবীজ্ঞানে পুজো করে, তারা কি কখনো বনের ক্ষতি করে? চিপকো আন্দোলন সহ যে কোনো পরিবেশ আন্দোলনের দিকে চোখ রাখলে আমরা দেখবো বনবাসী মানুষ প্রাণ দিয়ে আগলে বনকে কেমন করে রক্ষা করেছে, কেমন করে রক্ষা করছে প্রতিনিয়ত। তাহলে এই তাদের বন থেকে উৎখাতের এত প্রচেষ্টা কেন? সুন্দরবন বাঁচানোর নামে, সুন্দরবনের প্রাণভোমরা বনজঙ্গল প্রকৃতি পরিবেশ বাঁচানোর নামে শ্রমজীবী সুন্দরবনবাসীকে বন থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তাদের বনাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টা কীসের ইঙ্গিত? সুন্দরবনের বনজ সম্পদ লুঠের ষড়যন্ত্রের? বনবাসীদের সস্তা থেকে আরো সস্তা মজুরে পরিণত করার গভীর চক্রান্তের? প্রশ্ন উঠছে।
সুন্দরবনকে সত্যিই বাঁচাতে হলে বাঁচাতে হবে তার প্রতিটি প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ। আর তা একমাত্র পারে সুন্দরবন জুড়ে শ্রমজীবী মানুষের সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। তাই একথা বুঝতে হবে, বনবাসী মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে পরিবেশ রক্ষার কথা আসলে ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। দেশজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের যে দীর্ঘ ইতিহাস তাতে একবার নজর দিলেই আমরা দেখবো পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন শ্রমজীবী মানুষের জীবন জীবিকার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আজ তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সুন্দরবন তথা সুন্দরবন এর মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে, আমাদের দাবি -
১) পরিবেশ রক্ষার নামে পুঁজিপতিদের স্বার্থে সুন্দরবনবাসীর জীবন জীবিকা কেড়ে নেওয়া চলবে না।
২) পরিবেশে বান্ধব নদী বাঁধ দিতে হবে।
৩) ভেড়ি তৈরির নামে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল কাটা কঠোর ভাবে বন্ধ করতে হবে।
৪) নদীর ১০০ মিটারের মধ্যে কোন ফিসারী করতে দেওয়া যাবেনা।
৫) খালগুলো সংস্কার করতে হবে। অত্যধিক শ্যালো মেসিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
৬) মৎসজীবীদের উপর বনদপ্তরের জুলুম, মিথ্যা কেস দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৭) মৎসজীবীদের বিএলসি সংখ্যা বাড়াতে হবে। মৌলেদের কাছে থেকে মধু ১৮০ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকায় কিনতে হবে।
৮) বাঘের আক্রমণে আহত ও মৃতের পরিবারেকে সরকারি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এবং মাসিক ১০০০০ টাকা পারিবারিক পেনশন চালু করতে হবে।
মর্নিং ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত খবর
পাশাপাশি ওই একই দিনে এপিডিআর গোসাবা প্রস্তুতি কমিটির উদ্যোগে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা কমিটির সহযোগিতায় একই দাবিতে গোসাবা অঞ্চলে মিছিল, পথসভা ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নেওয়া হয়।
1 Comments
সুন্দরবনে ট্র্যাডিশনালি মানুষের কোনো বাস ছিল না। ঝাড়খন্ড বা ছত্তিসগড়ের আদিবাসী কম্যুনিটি রা যেমন বন-নিবাসী গোড়া থেকেই, সুন্দরবনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম নয়। গত তিনশো বছরে অন্যত্র থেকে মানুষ এসে সেখানে বসতি স্থাপন করেছে। কেউ এসে বনে বাস করতে থাকলেই তাদের "অরণ্যের অধিকার" স্বীকার করতে হবে, এরকম নয়। আর, দারিদ্র্যের কারণে শর্ট-টার্মে শ্রমজীবী বনবাসী মানুষও বনসম্পদ বিক্রি করে দিতে পারে বই কি! কর্পোরেট ইন্টারেস্টের হাতে বন তুলে দেওয়া যেমন প্রকৃতি/পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে, তেমনি এলাকার মানুষকে বনের উপর ঢালাও, আনরেগুলেটেড অধিকার দিলেও সেটা প্রকৃতি/পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। এই লেখাটিতে "বনবাসী" বলে একটা অযৌক্তিক রোমান্টিসিজম করা হয়েছে।
ReplyDelete