সুমন কল্যাণ মৌলিক
কর্পোরেট মিডিয়া লাঞ্ছিত এই সময়ে প্রতিটা ঘটনা এক স্পেক্টেকল। চব্বিশ ঘন্টা নির্বাচিত চিত্র ও শব্দের এক চলমান প্রদর্শন যার এক ও একমাত্র লক্ষ্য রাষ্ট্র তথা শাসকের এক শক্তিশালী ইমেজ নির্মাণ। চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ হোক বা ক্রিকেট খেলার মাঠে নির্বোধ উগ্র জাতীয়তাবাদের কুৎসিত রণহুঙ্কার অথবা যুদ্ধজাহাজ থেকে ইউনিফর্ম সজ্জিত সুপারম্যান — এমন ছবি দরকার যাকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেয় প্রজার দল। আমাদের সৌভাগ্য উত্তর কাশীর সিল্কিয়ারা-বারকোট সুড়ঙ্গে সতেরো দিন ধরে আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিকের মুক্তির দিনে এই কর্পোরেট ছককে ভেঙে দিয়ে যৌথতার শক্তির জয়ধ্বনি করতে পেরেছে শ্রমজীবী মানুষের দল। অমানুষিক পরিশ্রম করে যে শ্রমিকেরা এই সুড়ঙ্গ জয় করলেন তাদের কুর্নিশ। এ জয় কোনো 'হাম হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়' মার্কা চিত্রনাট্য নয়, উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ থেকে এই উদ্ধার আসলে এক যৌথতার গল্প। আজ অবশ্যই জয় উদযাপনের দিন কিন্তু যদি আমরা এই উদযাপনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চাই, পেটের দায়ে এই বিপদসংকুল পথে কাজ করা শ্রমিকদের জীবন রক্ষা করতে চাই, যদি চাই উত্তরাখণ্ডের স্থিতি তাহলে এই দুর্ঘটনার মূল কারণ চারধাম প্রকল্প বাতিলের দাবি আমাদের তুলতেই হবে। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা হল কর্পোরেট মিডিয়া ও তার বশম্বদ কলমচিরা সবসময় যে কোনো প্রকল্পের বিরোধিতাকে উন্নয়ন বনাম পরিবেশ — এই ছকে ফেলে সুস্থায়ী উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার দাবিকে গরীব মানুষের স্বার্থবিরোধী বলে দেগে দিতে চাইছে। আজ প্রয়োজন তথ্য ও যুক্তির আলোকে চারধাম প্রকল্পের স্বরূপ উন্মোচিত করা এবং গোটা হিমালয় জুড়ে মুনাফা ও লোভের কারণে যে অনিবার্য পরিবেশ বিপর্যয় নেমে আসছে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। এই নিবন্ধ সেই লক্ষ্যেই এক ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আলোচনার সুবিধার্থে আমরা চারধাম প্রকল্পের ইতিহাসটা প্রথমে উল্লেখ করতে চাই। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী চারধাম প্রকল্প (মিডিয়ার বয়ান অনুযায়ী এটা নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের প্রকল্প) ঘোষণা করেন। বলা হয় ১২,০০০ কোটি টাকা খরচ করে উত্তরাখন্ডে চারধাম সড়ক সংযুক্তি প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা হবে। এই সড়কপথের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৮৮৯ কিমি এবং গঙ্গোত্রী, যমুনাত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ - এই চার হিন্দু তীর্থস্থান সংযুক্ত হবে। প্রকল্পের উপযোগিতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয় এর ফলে তীর্থযাত্রীরা সারা বছর এখানে আসতে পারবেন, পর্যটন শিল্পের উন্নতি ঘটবে, সামরিক বাহিনীর পক্ষে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুবিধা হবে ইত্যাদি। একই সঙ্গে মিডিয়ায় কম আলোচিত (ইচ্ছাকৃত?) আরেকটি প্রকল্পের কথাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। সেটি হল ৩৭২ কিমি দৈর্ঘ্যের চারধাম রেলওয়ে প্রকল্প।
এই স্বপ্নের প্রকল্পকে যতই কেন্দ্রীয় সরকার ও উত্তরাখন্ড সরকারের পক্ষ থেকে গেম চেঞ্জার বলে বিজ্ঞাপিত করা হোক না কেন, শুরুর দিন থেকে পরিবেশবিদ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন তথা সাধারণ মানুষ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন এবং নানান ভাবে বিরোধিতা করেছেন। এই বিরোধিতার অংশ হিসাবে ২০১৮ সালে 'সিটিজেন ফর গ্রিন দুন' নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত বিশিষ্ট পরিবেশবিদ রবি চোপড়ার নেতৃত্বে এক হাই পাওয়ার কমিটি গঠন করে যাদের কাজ হয় এই চারধাম প্রকল্প পরিবেশের উপর কী প্রভাব ফেলবে তা খতিয়ে দেখার। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিটি তার রিপোর্ট আদালতে জমা দেয় যার মূল কথা ছিল এই প্রকল্প অপরিকল্পিত, অযৌক্তিক ও পরিবেশের পক্ষে বিপর্যয় ডেকে আনবে। এই রিপোর্টে ১০ মিটার চওড়া রাস্তা করার পরিকল্পনাকে বাতিল করে তা ৫.৫ মিটারের মধ্যে সীমায়িত রাখার কথা বলা হয়। এখানে একটা সহজ বিষয় মনে রাখা দরকার, চারধাম প্রকল্পের মূল কথা হল ১০ মিটার চওড়া দু'লেনের পাকা রাস্তা তৈরি করা। আর এটা করতে হলে রাস্তা আদতে হবে ১২ মিটার এবং তা তখনই সম্ভব হবে যদি ২৪ মিটার গভীর পাহাড় কাটা হয়। পরিবেশবিদদের এটাই আপত্তি কারণ তাদের মতে হিমালয়ের মতো নবীন ভঙ্গিল শ্রেণির পর্বতে, যেখানে ভূমি অস্থিত সেখানে এইভাবে পাহাড় কেটে নির্মাণকার্য চালালে তা হবে আত্মহত্যার সামিল।
এই ছবিটা অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত তার পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে এক্কেবারে ডিগবাজি খেয়ে হাই পাওয়ার কমিটির সুপারিশ সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়। নতুন আদেশে বলা হয় চারধাম প্রকল্পের জন্য ১০ মিটার রাস্তা চওড়া করা যাবে, এমনকি নন-ডিফেন্স এলাকায় হাই পাওয়ার কমিটির ক্ষমতাও ছেঁটে দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত সরকার পক্ষকে তীব্র উল্লসিত করলেও পরিবেশবিদদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এই রায়ের প্রতিবাদে রবি চোপড়া পদত্যাগ করে এক চিঠি লেখেন যার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে, "nature, however neither forgets nor forgives such wilful wrongs inflicted on her treasures"। এই কথাটার বাস্তবতা আমরা যদি শুধু ২০২৩ সালের দিকে চোখ ফেরাই তাহলেও প্রমাণিত হয়। এ বছর উত্তরাখণ্ডে জোশিমঠের বন্যা, সিকিমে তিস্তার মেঘ ভাঙা বৃষ্টির ফলে একের পর এক জলবিদ্যুৎ Secondary নির্মাণকার্য ভেসে যাওয়া বা এবারের সুড়ঙ্গ বিপর্যয় — রবি চোপড়ার আশঙ্কার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এক্ষেত্রে আরো দুটি তথ্য মনে করা যেতে পারে। আই আই টি রুরকি এবং জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব পটসডাম ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর - অক্টোবর মাসে এক সমীক্ষায় ঋষিকেশ ও জোশিমঠের মধ্যে ৩০৯ টি ভূমিধ্বসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে। আর কেন্দ্রীয় সরকার চারধাম প্রকল্পের ৮৮৯ কিমি যাত্রাপথকে ৫৩ টি প্রজেক্টে ভাগ করে। এটি এক পরিকল্পিত চক্রান্ত যাতে প্রতিটি প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১০০ কিমি এর কম হয় এবং পরিবেশগত সমীক্ষার বাইরে থাকে।
এখন কেন চারধাম প্রকল্প উত্তরাখন্ডে পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে তার সন্ধান করা জরুরি। এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করতে হলে ৯০০ হেক্টর বনভূমিকে ধ্বংস করতে হবে। অঙ্কের হিসাবে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা পিছু এক হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হবে। এই অংশটার মধ্যে আছে চারটি অত্যন্ত ইকো-সেনসিটিভ অঞ্চল— রাজাজী ন্যাশানাল পার্ক, ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স, কেদারনাথ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি এবং ভাগিরথী ইকো সেনসিটিভ জোন। জঙ্গল ধ্বংসের অর্থ হল চির পাইন, মালু, খয়ের, ধাউলার মতো গাছ, কালিহার ও ম্যাকাউ এর মতো ওষধি, বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস, লেপার্ড, মাস্ক ডিয়ার, রেড পান্ডা, সম্বরের মত বন্যপ্রাণী, পাখি, পতঙ্গ, সরীসৃপ ও মাহিশিরের মত সুস্বাদু মাছের চির বিলুপ্তি। এই অরণ্য ধ্বংস হলে নদীর পাশের ধাপ (স্টেপ) গুলো তার প্রাকৃতিক আবরণ হারাবে এবং হড়পা বান আটকাবার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা নষ্ট হবে; ফলে বাড়বে ভূমি ধ্বসের আশঙ্কা।
এই প্রকল্পের কারণে ৩২ মিলিয়ন কিউবিক মিটার মাটি অপসৃত হবে। স্বাভাবিক ভাবে এই মাটি জমা হবে উত্তর ভারতের প্রধান দুই নদী গঙ্গা ও যমুনার গর্ভে। এতে নদী খাত বুজে যাবে এবং সামান্য বৃষ্টি হলেই নদী দু'কূল ছাপিয়ে বন্যা ঘটাবে। এটা কোনো কষ্ট কল্পনা নয়। দীর্ঘদিন উন্নয়ন প্রকল্প এবং যথেচ্ছ হোটেল ও রিসর্ট নির্মাণের কারণে ভাগিরথী ও অলকানন্দার নদী খাত বুজে আসতে থাকে। ২০১৩ সালের ভয়ঙ্কর হড়পা বান এই দুই নদীতে যে প্রলয় কান্ড ঘটায় তাতে মারা যায় ৫,০০০ মানুষ। সম্পত্তি ও পরিকাঠামো ধ্বংসের পুরো হিসেব আজ অবধি করে ওঠা সম্ভব হয়নি। চারধাম প্রকল্প উত্তরাখন্ডে আবার সেই একই ধরণের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে। একই সঙ্গে পরিবেশবিদরা হিসেব করে দেখিয়েছেন এই সুবিশাল নির্মাণ যজ্ঞের কারণে এবং আগামীদিনে মটরযান বাহিত পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে হিমবাহগুলিতে ব্ল্যাক কার্বনের সঞ্চয় বাড়বে ফলে হিমবাহগুলি আরো দ্রুত গলতে শুরু করবে যা বন্যার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। একই সঙ্গে বিস্ফোরকের মাধ্যমে পাথর ভাঙার ফলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়তে পারে। এবারের সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের এটাও একটা কারণ।
চারধাম প্রকল্প কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। লাদাখ থেকে অরুণাচল, উত্তরাখন্ড থেকে সিকিম — কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন মডেল আসলে এক ভঙ্গুর, অস্থিত পরিবেশকে মুনাফার স্বার্থে ধ্বংস। বস্তুতপক্ষে সড়ক, রেলপথ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কর্পোরেট পুঁজি এখানে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ হচ্ছে। সেই পুঁজির স্বার্থে বলি হচ্ছে হিমালয়ের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য তথা জনজীবন। র্যাটহোল মাইনার্সদের টিম সহ বহু মানুষের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উন্নয়নের যাঁতাকলে আটকে থাকা মানুষগুলো এবারের মতো প্রাণে বেঁচেছেন। আমরা যদি শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের পক্ষে হই, যদি মুষ্টিমেয় কর্পোরেট গোষ্ঠী ও হোটেল লবির পরিবর্তে আমাদের সমর্থন থাকে সেখানকার সাধারণ মানুষের ভালো মন্দে, আমরা যদি সহনশীল উন্নয়ন চাই তাহলে চারধাম প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলতেই হবে। উত্তর কাশীর সুড়ঙ্গ দুর্ঘটনা সেই দাবি নিয়েই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।
লেখক পরিচিতি: প্রাবন্ধিক, স্বাধীন গবেষক, অধিকার আন্দোলনের কর্মী- আসানসোল সিভিল রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত।
আরো লেখা ও আপডেট পেতে মেহনতির ফেসবুক পেজ ফলো করুন।
5 Comments
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। লেখককে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteঅসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা
ReplyDeleteলেখকের দাবির সাথে সহমত। অবিলম্বে এই প্রজেক্ট বাতিল করতে হবে। পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সবাই সরব হোন। উন্নয়নের অপযুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠ এই লেখা ছড়িয়ে যাক দিকে দিকে।
ReplyDeleteসহমত। খুব প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখা
ReplyDeleteএ এক ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী প্রকল্প। এবং এটা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, উন্নয়নের নামে উন্মাদের মতো এক বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে দেশের রক্ষককুল। যে ধ্বংসের কারযক্রম তারা শুরু করেছে, তার ক্ক্ষয়তি
ReplyDelete