বাইজুস: একটি বুদবুদের সশব্দ পতন | Rise and Fall of Byju's

সুমন কল্যাণ মৌলিক

এই অমৃতকালে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্টার্টআপ ব্যবসাকে ভারতের আর্থিক প্রগতি ও কর্মসংস্থানের অন্যতম দিশারী বলে নিদান হেঁকেছিলেন তখন অবিশ্বাসীদের মুখ বন্ধ করার জন্য যে দুই একটা সাফল্যের উড়ানের গল্প গোদি মিডিয়া ঢাকঢোল সহযোগে প্রচার করত, তার মধ্যে প্রথম নামটি ছিল বাইজুস। প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল শিক্ষা প্রযুক্তির পোস্টার বয় ছিল বাইজুস। ২০২২ সালে এই অনলাইন শিক্ষা অ্যাপটির মূল্য ছিল ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।কিন্তু দু বছরের মধ্যে ছবিটা একদম পাল্টে গেল। একদা পৃথিবীর ১২০টি দেশে এই লার্নিং অ্যাপের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১৫ কোটি (অন্তত কোম্পানির দাবি সেরকমই ছিল) এবং কোম্পানির ট্যাগ লাইনে লেখা থাকত কেজি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষা সংক্রান্ত যে কোন সমস্যার সমাধান গ্রাহকদের হাতের মুঠোয়। আর এখন একের পর এক অনিয়ম, আর্থিক দুর্নীতি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা, শিক্ষক ও কর্মীদের প্রতি অমানবিক আচরণ ভারতের ' স্টার্ট আপ ডার্লিং ' বলে পরিচিত কোম্পানিটিকে একদম বেআব্রু করে দিয়েছে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রন বাইজুসের বিরুদ্ধে বাকি বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের অভিযোগ যে তিনি ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।এখন কোম্পানির আর্থিক মূল্য ঠিক কত সে  সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকলেও কর্পোরেট শাসিত আর্থিক সংবাদপত্রগুলির খবর মোতাবেক রবীন্দ্রন ব্যক্তিগত ভাবে প্রায় দেউলিয়া। কিছুদিন আগেও যে কোম্পানিকে ভারতে তৈরি গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন ব্র্যান্ড আখ্যা দিচ্ছিল তার এহেন পতন কি শুধুই একটা কোম্পানির  দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার গল্প না কি নয়া উদারবাদের জমানায় পুঁজিবাদের সংকট যে ফাটকা পুঁজির জন্ম দেয়,নানান ধরনের স্বল্প স্থায়ী বুদবুদের কাহিনী তৈরি করে তার আরেকটা হাতে গরম উদাহরণ!  এই নিবন্ধ সেই বিষয়গুলোকে নেড়েচেড়ে দেখার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।


Image: The Morning Context 

দক্ষিণ ভারতের আজিকোড়ের এক শিক্ষক পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রন বাইজুস নিজে পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষক হিসাবে। ২০১১ সালে নিজের ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে রবীন্দ্রন প্রতিষ্ঠা করেন ' থিঙ্ক অ্যান্ড লার্ন প্রাইভেট লিমিটেড ' যা বাইজুসের পেরেন্ট কোম্পানি। প্রথমে ছোট মাপে ব্যবসা শুরু করলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয় ২০১৫ সালে যখন তাদের লার্নিং অ্যাপ বাজারে এল। কোম্পানি দাবি করেছিল বাজারে অ্যাপ আসার মাধ্যমে তিনমাসের মধ্যে গ্রাহক সংখ্যা হয় ২০ লাখ। ইন্টারঅ্যাকটিভ ভিডিও, কুইজ, গেমসের মাধ্যমে ভারতে শিক্ষা জগতে বিপ্লব আনার প্রতিশ্রুতি ছিল কোম্পানির, অবশ্যই 'ফেলো কড়ি, মাখো তেল ' এর মাধ্যমে।

কেন বাইজুস সহ একাধিক কোম্পানি লার্নিং অ্যাপ ও ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার প্রেক্ষাপট জানা জরুরি। শিক্ষাকে আমরা যতই 'Public Good' হিসাবে চিহ্নিত করি না কেন, প্রথম থেকেই এদেশে সরকারি  শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থেকেছে। বিষয়টা আরো গতি পায় নব্বই এর দশকে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আগ্রাসন পুরোমাত্রায় শুরু হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হয়ে ওঠে মুনাফার নতুন কেন্দ্র ও দুটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক মাত্রায় বিনিয়োগ শুরু হয়।এক উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি হয়ে ওঠে এই নতুন দুটি ক্ষেত্রের প্রধান গ্রাহক। ভালো চিকিৎসা ও সন্তানদের জন্য আধুনিক ও বহুমুখী শিক্ষা জোগাড় করতে এই শ্রেণি টাকা খরচ করতে পিছপা ছিল না। আবার প্রথাগত ক্লাসরুম ভিত্তির শিক্ষার  প্রায়োগিক দুর্বলতার জন্য কোচিং সেন্টার / প্রাইভেট টিউশন দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত ছিল। নব্বই এর দশক থেকে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে বেড়েছে তা আজকে পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। এই মুহূর্তে ভারতের ৩১.৫% স্কুল,৪৬.৭% এনরোলমেন্ট (শিক্ষার্থীর সংখ্যা) এবং ৪৯.৩% শিক্ষক বেসরকারি ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। আর প্রাইভেট কোচিং রীতিমতো জমজমাট। ২০১৭ সালের ৭৫ তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে ২৭.২% গ্রামীণ পড়ুয়া এবং ৩৮.৩% শহুরে পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশনি নেয়। ২০২২ সালের অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট অনুযায়ী প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে ২০১৮ সালে ২৬.৪% শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউশন নিত যা ২০২২ সালে হয়েছে ৩০.৫%। এই প্রাইভেট টিউশনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দেখা যায় বিশেষ করে জয়েন্ট এনট্রানস, আই আই টির ক্ষেত্রে। এরমধ্যে আছে রাজস্থানের বিখ্যাত 'কোটা ফ্যাক্টরি'  যা ইতিমধ্যেই শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত। এছাড়া রয়েছে আকাশ, অ্যালেন, ফিটজির মত প্রতিষ্ঠানও পরিচিত ছিল। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন ডিজিটাল শিক্ষার এক নতুন দিগন্ত উপস্থিত করে। বাইজুস এই বাজার দখল করতে সক্রিয় হয় (অবশ্যই চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির কোচিং সেন্টার এ আলোচনার অংশ নয়)।

বাইজুস একটি স্টার্টআপ কোম্পানি হিসাবে সাধারণ ভাবে শুরু করলেও কোভিড অতিমারী তাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উপস্থিত করে। ২০১৯ সালের শেষপর্বে পৃথিবীতে কোভিডের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় যা ভারতে তার প্রকোপ শুরু করে ২০২০ সালের প্রথমার্ধে। এই সময় ভারতের শাসকশ্রেণি এক ভয়ঙ্কর নৃশংস লকডাউন শুরু করে যা দেশের অর্থনীতি তথা সাধারণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। গরীব মানুষ এই অবস্থায় দারিদ্র্যের কারণে বিকল্প শিক্ষার খোঁজ না করতে পারলেও বিত্তবান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে মসিহা হিসাবে আবির্ভূত হয় বিভিন্ন লার্নিং অ্যাপ যার মধ্যে অবশ্যই প্রথম নাম ছিল বাইজুস।

বাইজুস এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে ওঠে। লার্নিং অ্যাপের বাজার উঠবে, এই ভাবনায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো বাইজুসে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রোসাস এনভি (নেদারল্যান্ডস), জেনারেল আটলান্টিক, ব্ল্যাক রক, সিকিউয়া ক্যাপিটেল প্রভৃতি। মনে করা হয় এই সময় বাইজুসে ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়। গ্লোবাল ব্র্যান্ড হওয়ার লক্ষ্যে কোনরূপ সমীক্ষা ছাড়াই রবীন্দ্রন একের পর এক ডিজিটাল শিক্ষা সংক্রান্ত কোম্পানি অধিগ্রহণ শুরু করে। ২০১৯ সালে কেনা হয় শিক্ষামূলক খেলার অ্যাপ তৈরির সংস্থা অসমো (১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), ২০২০ সালে কোডিং স্কুল হোয়াইট হ্যাট জুনিয়র (৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), ২০২১ সালে আকাশ এডুকেশনাল সার্ভিস (৯৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল রিডিং প্ল্যাটফর্ম এপিক (৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), টপার (১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), গ্রেট লার্নিং (৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), টিঙ্কার (২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ইত্যাদি। এই সময়টা ছিল বাইজুসের উল্কা সদৃশ উত্থানের এবং একই সঙ্গে পতনের। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সাফল্যের পোস্টার বয় হয়ে ওঠা বাইজুসকে একটি সফল কেস স্টাডি হিসাবে বিবেচনা করে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে হাভার্ড বিজনেস স্কুল।

কোম্পানির পক্ষ থেকে এইসময় দাবি করা হয় যে ১০ কোটি শিক্ষার্থী তাদের অ্যাপের গ্রাহক। কিন্তু অতিমারী কাল শেষ হওয়ার পর বিষয়টা কি দাঁড়াবে তা নিয়ে কোন সমীক্ষা করা হল না বরং বাইজুস এক প্রশ্নাতীত সাফল্যের অভিজ্ঞান ধরে নেওয়া হয়। লায়োনেল মেসি ও শাহরুখ খানকে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডার নিযুক্ত করা হয়। ভারতের ক্রিকেট দলের এবং ২০২২ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের অন্যতম স্পনসর হয় বাইজুস। কিন্তু এইসব উপরি চাকচিক্যের আড়ালে দুর্নীতি ও লুঠের কাব্য লেখা হচ্ছিল। প্রথম ধাক্কা লাগল যখন অডিটর ডেলয়েট ও তিনজন বোর্ড মেম্বার কোম্পানি চালানোর পদ্ধতি ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। যে কোম্পানিকে হাভার্ড কেসস্টাডি হিসাবে ঘোষণা করেছিল  তা ২০২২ সালের আর্থিক বর্ষের হিসাব নিকেশ সঠিক সময়ে পেশ করতে ব্যর্থ হল। অতিমারি পর্বের শেষে যখন স্কুলগুলো খুলল তখন কোম্পানির কঙ্কালটা বেড়িয়ে পড়ল। এমনকি অতিমারী পর্বের হিসাবটাও কর্পোরেট উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হল না। ২০২০ সালে আর্থিক বর্ষে ২১৮৯ কোটি টাকা ব্যবসা হয়েছিল যা ২০২১ সালে হয় ২২৮০ কোটি। অঙ্কের বিচারে ৪% বৃদ্ধি কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ ৩২%। ২০২২ সালের দেয় হিসাব শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হল, ক্ষতির পরিমান তখন ২৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ক্ষতির গল্পটা প্রথম দিন থেকেই, ছিল, ২০২১ সালের হিসাবেই ক্ষতি ছিল ৩২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই পরিস্থিতিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটেলের মাধ্যমে যারা বিনিয়োগ করেছিল তারা রিটার্ন পেতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সোজা হিসাবটা দাঁড়ায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ও বছরে ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সুদ। বাইজুসের প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রন কিছুদিনের জন্য আত্মগোপন করেন। দিল্লির হেড অফিস ছাড়া বাকি সমস্ত অফিস ও কোচিং সেন্টার ছেড়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় এক তরফা শিক্ষক ছাঁটাই। ফেব্রুয়ারীর (২০২৪) তৃতীয় সপ্তাহে বাইজুসের অন্যতম স্পনসর প্রোসাস সহ শেয়ার হোল্ডারদের একাংশ বাইজুস রবীন্দ্রনকে কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদ থেকে অপসারিত করেছে। কর্নাটক হাইকোর্টে চলা একাধিক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই জরুরি ভিত্তিতে ডাকা বোর্ড মিটিং বৈধ কি না তা না বলা গেলেও একথা অনস্বীকার্য যে বাইজুস তার অন্তিম প্রহর গুনছে।


Image: The Morning Context 

বাইজুস লার্নিং অ্যাপের সাফল্যের বিষয়টি প্রথম থেকেই বিতর্কিত। কোম্পানি বিভিন্ন মডিউলের হার্ডওয়্যার ট্যাবলেট বিক্রি করত। সবচেয়ে বড় কথা নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা কোন গাইডেন্স ছিল না। কেউ কিছু বুঝতে না পারলে 'Doubtclear' বলে একটা ব্যবস্থা চালু হয় কিন্তু তা আলাদা করে শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধান করতে পারত না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর টাকা দিয়ে এই টিচিং মেটেরিয়াল কিনতে লোকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। প্রথাগত স্কুলিং এর বদলে বাইজুস নিজেই একটা ডিজিটাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান -- এই ভাবনা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যর্থ হয়। শিক্ষা গবেষক ডঃ উমা বাটরা সুন্দর ভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন: "What Byju's did was to use technology as a replacement, rather than complementary tool to learning while selling expensive courses to children, the company overlooked digital disparity, affordability and literacy"।

বাইজুস এক উদ্ধত, প্রবঞ্চক ও আগ্রাসী মার্কেটিং মডেল তৈরি করে যার স্বরূপ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে তারা শেষে নিম্নবিত্ত মানুষকেও টার্গেট করে। মিডিয়ার সৌজন্যে মহারাষ্ট্রের গৃহপরিচারিকা গীতা আনডের কথা জানি। বাইজুসের সেলসম্যান তাকে ৩৩,০০০ টাকার একটা প্যাকেজ বিক্রি করে। বারবার গীতাকে বলা হয় প্যাকেজটা না নিলে তার মেয়েকে গীতার মত দরিদ্র জীবন কাটাতে হবে, এর জন্য একমাত্র গীতাই দায়ি থাকবে। মানুষকে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ভয় দেখিয়ে তার জীবন নষ্ট করা এক লুম্পেন মানসিকতার পরিচায়ক। ন্যাশানাল কমিশন ফর দি প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস চেয়ারম্যান প্রিয়াঙ্কা কানুনগো প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর ফোন নাম্বার এজেন্সি থেকে কিনে নিয়ে কিভাবে তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেবার হুমকি দিত তার এক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন: 'buying phone numbers of children and their parents, rigorously following them and threatening them that their future will be ruined'। আমরা সবাই ইন্দোরের প্রিয়াঙ্কা দীক্ষিতের কথা জানি যিনি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েও ৬ মাস আইএএস পরীক্ষার কোর্স মেটেরিয়াল পাননি।ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরে মামলা করে জরিমানা সহ সেই টাকা প্রিয়াঙ্কা বাইজুসের থেকে আদায় করেন। সবার মামলা চালাবার মত সময়, অর্থ ও উদ্যম থাকে না তাই এই রকম জালিয়াতির বহু ঘটনা অন্তরালেই থেকে গেছে।

বাইজুসের পতন শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাইরে আসছে সেখানকার কর্মীদের (সেলস পার্সোনাল ও শিক্ষক) কিরকম দমবন্ধ করা অবস্থায় কাজ করতে হত। শিক্ষকরা জানিয়েছেন ছাঁটাই শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকে তাদের টানা দুশিফট কাজ করতে হত। মাঝখানে কোন বিরতি থাকত না। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে জুটত গালিগালাজ, এমনকি শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানির সঙ্গে কর্মচারীদের চুক্তিপত্র একতরফা মালিকের পক্ষে, কর্মচারীদের কোন অধিকার ছিলনা। কনটেক্সট বলে একটি সংস্থা বাইজুসের প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মীদের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে যে কর্মীরা ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে ধারাবাহিক ভাবে আক্রান্ত হত-- এর মধ্যে ছিল দীর্ঘ শ্রমঘন্টা, শারীরিক ও মৌখিক নিগ্রহ ও পণ্য বিক্রির জন্য যে কোক অসৎ ও অনৈতিক পথ গ্রহণে বাধ্য করা। এক প্রাক্তন কর্মী বাইজুসে তার কাজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেছেন: 'you feel like you're in a bubble or trapped at the bottom of a well, with no way to climb out and enioy the outside world. There is no work life balance. Zero'। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিয়মিত মাইনে, এক তরফা কর্মী ছাঁটাই। ২০২২ এর শেষ দিক থেকে ২০২৩ এর শেষ পর্যন্ত বাইজুস ২০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। ২০২৪ সালে কোন আগাম নোটিস না দিয়ে ফোন করে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হচ্ছে যাতে আগাম নোটিস ও দুমাসের মাইনে আর ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে কোম্পানি বাধ্য থাকছে না।

বাইজুসের এই উল্কাসদৃশ উত্থান ও পতন নয়া উদারবাদের জমানায় কোন নতুন ঘটনা নয়। ভারতে নব্বই এর দশকে যে আর্থিক সংস্কার নীতি কার্যকরী হয়েছে তার ফল হিসাবে রবীন্দ্রন বাইজুসের মত প্রতারকদের পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা এক অনিবার্য ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে কিংফিশার (বিজয় মাল্য), ইয়েস ব্যাঙ্ক (রানা কাপুর), পেটিএম ব্যাঙ্কের পতন দেখিয়ে দেয় পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সংকটকে। এই লুম্পেন উন্নয়ন মডেল ' যা কিছু ব্যক্তিগত, তাই পবিত্র '- এই বাজার অর্থনীতির বীজমন্ত্রকে জপ করতে করতে লুটে নেয় দেশের মানুষের সম্পদ। অর্থনীতির সংকটকে লুকানোর জন্য পুঁজিবাদের দরকার হয় কিছু সাফল্যের গল্প। একের পর এক অনৈতিক সিদ্ধান্ত ও চৌর্যবৃত্তিকে ঢাকা দেওয়ার জন্য কর্পোরেট মিডিয়া এই ধরণের তথাকথিত সাফল্যের পোস্টার বয়দের ইমেজ নির্মাণ করে। কর্পোরেট মিডিয়ার এই প্রচারযন্ত্রের কৌশলে রবীন্দ্রন বা বিজয় মাল্য বা অনিল আম্বানিরা এক ইশ্বরে রূপান্তরিত হন। মিডিয়ার ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একজন তাই সঠিক ভাবে মন্তব্য করেছেন: 'turned him (Rabindran Byjus) into a hero who could no wrong'। এরপর যথারীতি বুদবুদ ফেটে যায়।মিডিয়া এবার অন্য গল্প ফেরি করতে শুরু করে যার মূল কথা হল বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদ এক কার্যকরী ব্যবস্থা কিন্তু কেউ যদি আইন ভাঙে বা দুর্নীতির আশ্রয় নেয়, তাহলে সেই ব্যক্তি দায়ি, পুঁজিবাদের সংকট তাতে প্রমাণিত হয় না। কিন্তু এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে আর্থিক নীতি তৈরি করে তাকে কাজে লাগিয়েই এই কেলেঙ্কারির জন্ম হয়। এই সত্য ভোলাবার জন্য কর্পোরেট মিডিয়া, রাষ্ট্র পরিচালকবর্গ, কর্পোরেট কর্তারা নতুন গল্পের সন্ধান করে। ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবসার কথাই যদি ধরা যায় তবে দেখা যাবে বেদান্তুু বা আনঅ্যাকাডেমির মত অন্য খেলোয়াড়রা বাইজুস মডেলের কপি পেস্ট করে কাজ চালাচ্ছে। তাই পুঁজিবাদের এই সংকটের যুগে ইয়েস ব্যাঙ্ক, বাইজুস বা পেটিএমের মত কেলেঙ্কারি ও জনগণের পয়সা লুটের ঘটনা যে বারবার ঘটেই চলবে, তা বলাই বাহুল্য।


তথ্যসূত্র: The Byju's Bust: Decoding the rise and fall of the once most valued start-up/ Ayesha Sing/ The New Indian Express / 31 July, 2023 # The story of Byju's rise and fall and why it matters for India/ Anto Antony/ Times of India/ 26 July, 2023 # Treated like Slaves,abusive practices: Byju's staff reveal harsh work conditions /Annie Banerjee /The wire/ 15 december,2022 # The Economics of coaching classes / Pushkarani Panchamukhi/ The wire/ 2 February, 2024.

Post a Comment

3 Comments

  1. খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। অনলাইন লার্নিং আপ বাইজুস এর ডাউনফল বোঝার ক্ষেত্রে এই লেখা সহায়ক ভূমিকা নেবে। ধন্যবাদ লেখককে।

    ReplyDelete
  2. দারুন লেখা, সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  3. চমৎকার

    ReplyDelete
Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)