২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল: কিছু বিশ্লেষণ কিছু পর্যবেক্ষণ

Image Courtesy : The Print 

সদ্য সমাপ্ত অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের অনেক আগে থেকে এবং ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেও নানা কথা, নানা মত, নানা বিতর্ক, বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান উঠে এসেছে, আসছে এবং আসবেও। 'ফ্যাসিবাদ' বিরোধী মহা সম্মেলন, দেশ বাঁচাও মঞ্চ ইত্যাদি নানান মঞ্চ যেমন তাঁদের প্রচারে সংবিধান বাঁচাও থেকে লেসার ইভিল / গ্রেটার ইভিল অবস্থান রেখেছেন, কেউ কেউ রাখঢাক না রেখে সরাসরি তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার কল দিয়েছেন তেমনিই এর বিপরীতে প্রশ্ন উঠেছে ভোটে ‘ফ্যাসিবাদ’ আদৌ পরাজিত হয় কিনা, মেহনতি মজদুর কিষানের অংশগ্রহণ ছাড়া যেকোনো ফ্রন্ট 'প্রাণ ছাড়া কাঠামো', 'শ্রেণী লাইন গনলাইন ছাড়া শুধু ভঙ্গি সর্বস্বতা', 'দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিশ্ব শিক্ষা ছাড়া স্রেফ বাকওয়াস'। খুব ছোট হলেও এই অংশটি আলোচনা তুলেছে- যে দেশে সংবিধান সম্মত ভাবেই মৌলিক অধিকার হরণ হয়, নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করা যায়, রাজ্যের অধিকার কেরে নেওয়া যায়, সাংবিধানিক ভাবেই মাওবাদী নিকেশ করা যায়, গণহত্যা-গণ ধর্ষণ চালানো যায় নির্বিচারে, সাংবিধানিক ভাবেই মনিপুর আসাম কাশ্মীরে জ্বালানো যায় একের পর এক গ্রাম, সেই সংবিধান বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সংবিধানও নয়। লুঠ আর দমনের সংবিধান। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ফ্রন্টের শরীকদের হাতও কি জনগনের রক্তে রাঙা নয়? নিউ লিবারল ক্যাপিটালিজম থেকে দলগুলির বেরিয়ে আসা সম্ভব? শিখ নিধন থেকে কর্পোরেটের হাতে জমি তুলে দেওয়া, সালওয়া জুডুম, অপরেশন গ্রিনহান্ট, UAPA, বেসরকারিকরন নীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি নানা কথা আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতা সরকারের ভূমিকাকে কার্যত ভুলে গিয়ে কে কত বড় ফ্যাসিস্ট কে সিকিভাগ কম এই রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার মধ্যে যে সুবিধাবাদী ঝোঁক তাকে বারবার সামনে আনার চেষ্টা হয়েছে। এই বিতর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মেহনতির পক্ষ থেকে আমরা মনে করি। 
লেখক, প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞানকর্মী অশোক মুখোপাধ্যায় ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু বিশ্লেষণ কিছু পর্যবেক্ষণ রেখেছেন যা মেহনতির বক্তব্য না হলেও উপরে আলোচিত বিতর্কের প্রয়োজনেই আমরা প্রকাশ করলাম। এই লেখার সাথে সহমত, দ্বিমত পোষণ করলে আপনিও আপনার বিশ্লেষণ আমাদের পাঠাতে পারেন, আমরা কোনোরকম সংকীর্ণতা ছাড়াই তা প্রকাশ করবো।  মেহনতি টিম 

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল: 
কিছু বিশ্লেষণ কিছু পর্যবেক্ষণ 
অশোক মুখোপাধ্যায় 

[১]

ভারতে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালের অষ্টাদশতম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল যদি এক কথায় প্রকাশ করতে বলা হয়, তাহলে আমার মতে বলা উচিত: বড় ডাকাতদের সর্দার ধরা পড়েছে। জনতাই তাকে হাতে নাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। তার অসংখ্য অপকর্মের বিচারের আশায়। কিন্তু পুলিশ তাকে আদালতে নিয়ে গেলে সে সহজেই জামিন পেয়ে আবার জেল ঘানির বাইরে। হয়ত আবার পুরনো তস্কর বাহিনীর সর্দারিতে মনোনিবেশ করবে। 

প্রথমেই লক্ষ করা দরকার, ডাকাত সর্দারের দলটি সেখানেই সবচাইতে বড় আঘাত পেয়েছে, যেখান থেকে সে গত কয়েক দশক ধরে সংখ্যাগুরু ধর্মের রাম হনুমান এবং গরু তাস খেলে ভোটের বাজারে ভালোই এগোচ্ছিল। শেষ দশকটাতে রাম নাম করতে করতেই দেশ প্রায় সবটাই বেচে দেবার উপক্রম করে ফেলেছিল। জাতীয় সম্পদ একে একে ব্যক্তি মালিক কর্পোরেটদের হাতে কম পয়সায় বা বিনি পয়সায় বেচে দিচ্ছিল। সর্বোচ্চ আদালতের কানাচে সঙ্ঘ সদস্য থাকার সুবিধা নিয়ে অযোধ্যায় অত ম্যানিপুলেট করে অস্তিত্বহীন এক রাম মন্দিরের জন্য সঙ্ঘ পরিবারের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমিজায়গা সব হাতিয়ে নিয়েছিল। ঘটা করে মন্দিরটাও এই বছর ভোটের দিন ক্ষণ ঘোষণার আগেই জানুয়ারি মাসে বানিয়ে ফেলেছিল। প্রযুক্তিবিদদের ডেকে এনে রামনবমীতে সেই মন্দিরের মূর্তির মাথায় সূর্যের আলোও ফেলার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু হায়! সেই রাজ্যেই তাকে এবার ব্যাপক ধাক্কা খেতে হল। এমনকি সেই অযোধ্যা সংশ্লিষ্ট ফৈজাবাদ আসনেও। বেনারসে নরেন্দ্র মোদীর ভোটের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে। রাম মন্দির এবং তার জন্য রাজপথ বানাতে গিয়ে যখন যোগীরাজ বুলডোজার চালিয়ে মোটামুটি ৩২০০ (হিন্দু ও মুসলিম) দোকান, (হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে) কম বেশি ১৫০০ বাড়িঘর, ৩৬টা মন্দির, ৯টা মসজিদ এবং ৬টা মাজার ভেঙেছিল, তখন তারা একই সঙ্গে নিজেদের ভোটের কপালও ভেঙে ফেলছিল, ক্ষমতার উগ্র মদমত্ততায় এবং নজর মাইয়োপিয়ায় সেটা আর খেয়াল করে উঠতে পারেনি।  

ধর্ষণের অপরাধের সংখ্যায়, সেই অপরাধের খবর চেপে রাখায়, খবর করতে গেলে সাংবাদিক নির্যাতনে, ধর্ষকদের বীরপুঙ্গব হিসাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনে দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকা রাজ্যটিতে এবার রাম এবং বুলডোজার এক সঙ্গেই ব্যর্থ হয়েছে।   

দেখে যেন মনে হচ্ছে, স্বয়ং রামচন্দ্রও যেন তার এই ভোটোপাসককে নিত্য প্রাতঃকৃত্যের মতো করে বর্জন করেছে। ফলে সারা দেশেই এবার বিজেপি-কে বর্জন করার একটা বেশ গরম চঞ্চল হাওয়া উঠেছিল। দক্ষিণ মেঁ সাফ না হলেও (কেন হল না আমরা নীচে সেই আলোচনায় ঢুকব) উত্তর মেঁ হাফ তো হয়েছেই। 

অব কি বার চারশ পার ঘন ঘন নিনাদের পর তিনশ পার করাতেই গৃহপালিত ইসিকে বারো ঘন্টা ধরে গণনা চালাতে (আসলে, বন্ধ করে রাখতে) বাধ্য করেছে। যদি কোনো ম্যাজিকে দুচারটে আসনও বাড়িয়ে দেওয়া যায়। 

অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগেও বিজেপি-র অবস্থা এরকমই সঙ্কটাকুল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভালো নোট বাতিল করে এবং জিএসটি চালু করে দেশের জনসাধারণের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড প্রায় ভেঙে দিয়েছিল। লাভবান হচ্ছিল কেবল দেশের মুষ্টিমেয় কিছু কর্পোরেট পরিবার—বিশেষ করে আদানি আম্বানি প্রমুখ গুজরাতি দোস্তরা। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে হেরে যাওয়া যখন প্রায় নিশ্চিত সেই সময় ঘটানো হয় পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ের উপর পরিকল্পিত এক বিধ্বংসী হামলা। যাতে তেতাল্লিশ জন জওয়ান ঘটনাস্থলেই মারা যায়। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল, তখন বিজেপি-রই ঘরের লোক, সত্যপাল মালিকের কথায় জানা গেল, সেই কনভয়ের গতিবিধির উপর নিয়ম মাফিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলায় স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী তাঁকে চুপ থাকতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, “তুম চুপ রহো, ইস মেঁ অওর কুছ হ্যায়।” তার পর সেই ঘটনাকে “পাক জঙ্গিদের হামলা” বলে দেখিয়ে পেটোয়া চ্যানেলসমূহের সাহায্যে সারা দেশ জুড়ে এক ঝুটা দেশপ্রেমের বাতাবরণ তৈরি করা হয়। সেই হাওয়াতেই মোদীর দল ভোটে জিতে আসে। 

ভারতের ইতিহাসে এটা ছিল এক মাত্র “জঙ্গি” হামলা, যাতে কেউ ধরা পড়েনি, কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, কোনো তদন্ত হয়নি, ইত্যাদি। বরং যত বার তদন্তের কথা উঠেছে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক বার সেই দাবির প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর পাশাপাশি ভিমা কোরেগাঁও-এর ঘটনা স্মরণ করে দেখুন। সেখানে কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়নি, কেউ মারা যায়নি, তাতেই ২৮ জনের বিনা বিচারে ছয় বছরের বেশি কারাবাস হয়ে গেল; স্টান স্বামীকে জেলের মধ্যে মেরে ফেলা হল। সেই দুই জায়গায় অমিত শাহ নরেন্দ্র দামোদরের দুরকম আচরণ কেন নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। 

এবারে আর ভোটের আগে সেরকম কিছু ঘটানো সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ মূল্যবৃদ্ধি বেকারি, দুর্নীতি এবং দেশ বেচার কাজ জোড় শোর এগিয়ে চলেছে। মোদীর ভারত যত বিকশিত হচ্ছে, ততই ক্ষুধার সূচকে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশ ভূটান শ্রীলঙ্কার নীচে চলে যাচ্ছে। নারী সুরক্ষায় সাংবাদিক নির্যাতনে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণে ভারত ক্রমশই বিশ্ব তালিকার নিম্নতম সারিতে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। মোদীর আমলে দেশবাসীর এমন ভয়ানক বিকাশ ঘটেছে যা জি-২০ বৈঠকের সময় প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে রাস্তার দুই ধারে উঁচু করে ঢেকে রাখতে হয়েছিল, পাছে রাষ্ট্রের এই গোপন বিকাশ তথ্য বিদেশি অতিথিদের চোখে পড়ে যায়। 

নরেন্দ্র দামোদর দাসও বুঝতে পারছিলেন দেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন। তাই সকলেই দেখেছেন, ভোটপর্ব যত এগিয়েছে, ততই প্রধান মন্ত্রীর প্রচারে বিকাশের বদলে উঠে এসেছিল হিন্দু মুসলিম বিভাজনের সেই চিরপরিচিত তাসের কারুশিল্প। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা দেশের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, মুসলমানরা হিন্দুদের মঙ্গলসূত্র ছিঁড়ে ফেলবে বা কেড়ে নেবে, তারা শ্রাবণ মাসে মাছ মাংস খায় যা হচ্ছে মোগলদের খানা রুচি, ইত্যাদি। মোদীর লেখাপড়ার ইতিহাসটা যেহেতু পুরোটাই মেঘাচ্ছন্ন, আদালতি রক্ষাকবচে তথ্য জানার অধিকার আইনের ঊর্ধ্বেও রাষ্ট্রের গোপন সামরিক তথ্য হিসাবে সুরক্ষিত, তাই তিনি ছোটবেলায় সেই রাখাল বালকের গল্প পড়েছিলেন কিনা বলতে পারছি না। যে পশুচারণের মাঠে ভেড়া চড়াতে নিয়ে গিয়ে মাঝে মাঝেই “বাঘ বাঘ” বলে হাঁক পারত আর লোকজন আশেপাশের থেকে ছুটে এলে দাঁত কেলিয়ে হাসত। কিন্তু যেদিন সত্যিই বাঘ এল, সেদিন তার হাঁকে একজন লোকও বেরল না। গল্পটা পড়া থাকলে ওনারা বুঝতে পারতেন, মোদী অ্যান্ড কোম্পানির এই মুসলিম আর আমিষ বিদ্বেষের তাসও বহু ব্যবহারে এখন জীর্ণ হয়ে গেছে। আর কাজ করে না। করে না বলেই মন্দির তাসও মন্দিরের দেশেই কাজ করল না।   

[২]

এই প্রসঙ্গেই এসে যাচ্ছে পশ্চিম বাংলার ভোটের ফল প্রসঙ্গ। বিশেষ করে সন্দেশখালির কথা।

নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ—দুজনেই সন্দেশখালিকে বাজি ধরে পশ্চিম বঙ্গে একটা বড় ফল আশা করেছিলেন। এই দুই নেতা যে কতবার এই রাজ্যে সভা আর রোডশো করতে এসেছেন, নিজেরাও গুনে বলতে পারবেন না। তাঁরা বোধ হয় ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, সন্দেশখালিতে যাই হয়ে থাকুক না কেন, মোদী কোম্পানির ভূমিকা বিচার করতে গেলেই লোকের মাথায় মনিপুরের ঘটনাবলি চাগিয়ে উঠবে। সেখানে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদেরই (ডবল ইঞ্জিন) সরকার থাকা সত্ত্বেও যেভাবে পাহাড়ি জনজাতি কুকি সম্প্রদায়ের উপর লাগাতার হত্যা ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ লুটপাট চলে আসছে, এই গুজরাতি দোস্তরা সেখানে একবারও গিয়ে উঠতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্টের ধমকের পরও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তৎপর হননি। নির্যাতিতের প্রতি তাঁদের পরম প্‌প্‌প্‌প্‌প্‌প্‌রেম এই ঘটনায় যে কতটা বে-আব্রু হয়ে পড়েছিল, এঁরা বোধ হয় বুঝতেই পারেননি। অমিত শাহ আবার পশ্চিম বাংলায় এসে রবীন্দ্রজয়ন্তী করেছেন এবং কিছু সুনির্বাচিত দলিত জনের বাড়িতে বসে ডাল পোস্ত ভাত খাওয়ার অভিনয় সুচারু রূপে সম্পন্ন করে বিভিন্ন পোষা টিভি চ্যানেলে ছবি ভিডিও চুপকেছেন। ওনারা ভেবেছেন, এতেই কাজ হবে। আর আসলে তাঁদের প্রতিটি সভায় এবং প্রত্যেকটা ভাষণের পরে পালা করে তাঁদের দলের পরাজয়ের স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে। মানুষের মনে মনিপুর নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে। সন্দেহ হয়েছে। বিজেপি-র পরিচালনায় ডবল ইঞ্জিন সরকার একটা রাজ্যের কী হাল করে দিতে পারে তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ বেড়ে গেছে। পেটোয়াদের ভিড়ে সেই কথা তাঁদের কানে কেউ পৌঁছে দেয়নি। 
সন্দেশখালিতে যারা অনেক কাল ধরে স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের হাতে নানা ভাবে লাঞ্ছিত নির্যাতিত হচ্ছিলেন, জমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, কাজ করে পয়সা পাচ্ছিলেন না, উলটে মার খাচ্ছিলেন, তারাও এই ডাল পোস্ত রাজনীতির মর্মার্থ ধরে ফেলতে দেরি করেননি। আর যে বামপন্থীরা বুঝে বা না বুঝে এই ডাল পোস্তওয়ালাদেরই কার্যত মদত দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ভাবছিলেন যে এবার হাওয়াইচটিকে বেশ বাগে পাওয়া গেছে, তাঁরাও বুঝতে পারেননি, সাধারণ মানুষও অঙ্ক কষে। অঙ্কের হিসাব করতে জানে। অভিজ্ঞতা থেকেই। আজকের নেট দুনিয়ার রমরমা বাজারের দিনে। ফলে সন্দেশখালির বহুদিনের চাপা পড়ে থাকা ঘটনাবলি বাইরে প্রকাশ্য আলোচনার মঞ্চে একবার এসে যাওয়ার পর পরই তাদের আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। ছোটখাট নির্যাতকদের তাড়াতে চেয়ে তারা আর বড় বড় ডাকাতদের গ্রামের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিতে চাননি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রহরা তাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সাহায্য করে গেছে। 

এই কারণেই নরেন্দ্র মোদীর কৃপাধন্য প্রার্থী রেখা পাত্রের চুনাও পরিণতি সুখের হল না। তাদের পরোক্ষে সহযোগিতা করতে গিয়ে বামপন্থী (ব্যক্তিগত জীবনে যিনি খুবই সৎ এবং লড়াকু রাজনীতিবিদ) প্রার্থী নিরাপদ সরদারের হালও খারাপ হয়ে গেল!
আরও একটা কথা। 

মাস দুয়েক আগে কেরালার বিজেপি সভাপতিকে যখন নাড্ডা চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ওখানে বিজেপি-র অগ্রগতির হার এত কম কেন, ভদ্রলোক একটা দুর্দান্ত সত্য কথা বলে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, এই রাজ্যের লোকেরা সকলেই শুধু শিক্ষিত নয়, উচ্চ শিক্ষিত। এখানে তাই আমাদের শ্লোগানগুলির আকর্ষণ নেই। অর্থাৎ, গরু, গোবর, গরুর পেচ্ছাব, হনুমান, রাম কিসসা, হনুমান চালিসার কোনো কার্যকারিতা নেই। নাড্ডা কথাটার মানে সবটা বুঝেছেন কিনা জানি না। মনে হয় বোঝেননি। 

কেরালার মতো না হলেও পশ্চিম বাংলায়ও শিক্ষার হার এবং মান যথেষ্ট বেশি ও ভালো। এখানে উচ্চবিত্তদের একাংশের মধ্যে বাংলা বিভাজন কেন্দ্রিক এক গুচ্ছ ভুল ধারণা জাত মুসলিম বিদ্বেষ থেকে বিজেপি-র প্রতি টান থাকলেও বিজেপি-র শ্লোগানগুলি তেমন করে চিত্তাকর্ষণ করে না। যে কথাটা বিবিসি-র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বাংলার বাইরে থেকেও যোগেন্দ্র যাদব অনুভব করেছেন এবং বলেছেন—আমাদের পোস্ট-কলোনিয়াল বিদ্বানরা যা ঘরের দোরে থেকেও বুঝতে পারে না—অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও রামমোহন ডিরোজিও বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্ত মধুসূদন মোসাররফ হোসেন রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র রোকেয়া নজরুল ওদুদ প্রমুখর দেড় শতাব্দ জোড়া সাধনা ও সংগ্রাম বিফলে যায়নি, এখনও তার অদৃশ্য শক্তিশেল কাজের সময়ে কার্যকর হয়ে ওঠে। মোদী শাহর বীভৎস ঘৃণা বিদ্বেষ পৃক্ত আওয়াজগুলি প্রায়শই তার সঙ্গে এমন বেসুরো হয়ে বাজতে থাকে যে বিজেপি-র কর্মীরাও তা ধরতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। বলা বারণ বলেই হয়ত। এবারকার নির্বাচনে সেই জন্যই বোধ হয় বিজেপি কর্মীদের বারি বাড়ি ঘুরতে দেখাই যায়নি রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলে। ভোটের সামগ্রিক ফলাফলে তারও ছাপ রয়ে গেল। 

বাংলায় এই মোদী গ্যাং-এর নির্বাচনী ফল আরও খারাপ হতে পারত। তাদের দলকে বাংলার মাটিতে তামিলনাড়ু আর পাঞ্জাবের মতোই শূন্য করে দেওয়া যেত। দুঃখের বিষয়, সেটা বামপন্থীরাও চাননি, তৃণমূল নেত্রীও চাননি। নিজ নিজ বিচিত্র রাজনৈতিক হ্রস্বনজরের ফলে দুই পক্ষই চেয়েছেন, বিজেপি-কে খানিক উপরে তুলে এনে প্রকল্পিত “বিপক্ষ”-কে শূন্যে বিলীন করতে। ঘটনাচক্রে তাতে এই মুহূর্তে টিএমসি-র অনেকটা লাভ হয়েছে, বিজেপি-র যতটা ক্ষতি হতে পারত তা হয়নি। কিন্তু বামপন্থার বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। আর বিরাট ক্ষতি হয়েছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির তরফে। আসন সংখ্যায় বারোটা হলেও বিজেপি এখানে মোট ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। এর মধ্যে রয়েছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শিক্ষিত সচ্ছল একাংশের অস্তিত্ব, সঙ্ঘ প্রচারের এক ঘনীভূত চাপা সামর্থ্য, যা বাংলার আকাশে বাতাসে বিভিন্ন অছিলায় সুযোগ পেলেই ক্রমাগত চুপিসারে ঘৃণা ও বিদ্বেষের কথাগুলি উগরে যেতে থাকবে। এই ব্যাপারটাও কত জন খেয়াল করেছেন কে জানে! 

নির্বাচনে আশু লাভ আর রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি লাভের মধ্যে অনেক ফারাক। এই যেমন, বহরমপুরে কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরীকে আপাতত হারিয়ে দিয়ে স্বভাবতই তৃণমূল নেতৃত্ব খুশি এবং তৃপ্ত। যাঁরা বিজেপি-র পরাজয় এবং তারই প্রয়োজনে কংগ্রেসকেও শূন্যে মিলিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন, অধীরের নানা আচরণে বিরক্ত ছিলেন, তাঁরাও বেশ খুশি হয়েছেন। কিন্তু, অন্য দিকে, এই যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলিম তাস খেলে, বাংলার বাইরে থেকে একজন ওজনদার উর্দুভাষী মুসলিম ক্যান্ডিডেট তুলে এনে অধীরকে হারানো গেল, এতে আগামী বহু দিনের জন্য বিজেপি-র অন্যতম প্রচারকে এক স্থায়ী ও দৃঢ় মান্যতা দেবার কাজটি সুসম্পন্ন হয়ে রইল। রাজ্যে বিরোধী শক্তি হিসাবে যেহেতু বিজেপি-ই এসে গেল, তারা এতে প্রভূত উপকৃত হবে। তৃণমূলকেও এর মাশুল দিতে হবে অনেক—আগামী দিনে। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক সংক্রান্ত বিজেপি-র যেটা প্রধান প্রচার, সেটা যে অপপ্রচার নয় তার একটা সাক্ষ্য হয়ে থাকবে এই ঘটনা। রাজনৈতিক ভাবে চূড়ান্ত অদূরদর্শিতা আর বুদ্ধিহীনতা ছাড়া এর আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আরও দুঃখের কথা হল, এই সব গুরুতর বিষয় বোঝার মতো লোকের সংখ্যাও দেশে কমে আসছে। 

তাছাড়া, আমার যখনই মনে হচ্ছে, বাংলার থেকে একজন সাংসদ হয়ে দিল্লিতে গিয়ে পার্লামেন্টের আসরে দাঁড়িয়ে হিন্দি অথবা উর্দুতে ভাষণ দেবে, ব্যাপারটা মেনে নিতে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। এর উলটো দিকটা ভাবুন। ভারতের কোনো সর্বভারতীয় দলই কিন্তু বাংলা থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে উত্তর প্রদেশ বা রাজস্থানে প্রার্থী করে জিতিয়ে তাকে সংসদে বাংলায় ভাষণ দিতে রাজি হবে বলে আমার মনে হয় না। কথাটা এই মুহূর্তে খানিক আঞ্চলিকতাবাদী প্রাদেশিকতাবাদী বলে মনে হবে। কিন্তু ভারতের বর্তমান রাজনীতির মানচিত্রে এই জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলিকেও এখন থেকে গুরুত্ব দিতে হবে বৈকি। এদিকে ভোটের ফল বেরনোর পরেই ইউসুফ পাঠান জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি গুজরাত ছেড়ে বাংলায় এসে বেশি সময় দিতে পারবেন না। ভদ্রলোক বলেই সত্য কথাটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। 

[৩]

বিজেপি বিরোধী জোট অনেক আগেই তৈরি করা এবং তাকে রাজ্যে রাজ্যে সার্বিক ভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল। সর্বভারতীয় স্তরে জোটবদ্ধ হয়ে পশ্চিম বঙ্গ কেরালা পাঞ্জাব ইত্যাদি রাজ্যে সেই জোটের শরিকদের মধ্যে বিরোধ থেকেই গেল, নিষ্পত্তি করা গেল না—এটা আদৌ শুভ সংবাদ ছিল না। রাজস্থান বা মধ্য প্রদেশে সিপিএম আর টিএমসি-র মধ্যে জোটের কোনো মানে নেই। মনিপুর আর হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস ও সিপিএম-এর জোটের কোনো কার্যকর অর্থ হয় না। তাহলে যেখানে যেখানে এই জোটের প্রশ্নটা অর্থ বহন করে, বুদ্ধিমান নেতারা যখনই সেই সব রাজ্যকে জোট রাজনীতির বাইরে নিয়ে গেলেন, তখনই তাঁরা—জেনে কিংবা না জেনে—বিজেপি-র জন্য নাড়ু বাতাসা সাজিয়ে ফেললেন। 

এই বোঝাপড়ার অভাবেই কেরালায় বিজেপি খাতা খুলে ফেলল, আর সিপিএমরা দুটো আসন নিয়ে সন্তুষ্ট রইল—এই পরিস্থিতিও আমাদের দেখতে হচ্ছে। দক্ষিণ মেঁ সাফ হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়ে থাকলেও অন্ধ্র বা কর্ণাটকে এই জোটবদ্ধতার অভাবের ফলেই বিজেপি-র সুবিধা হয়ে গেল। কার্যকরি ঐক্য অনেক আগে তৈরি হয়ে গেলে দিল্লিতেও আপ এবং কংগ্রেস মিলে বিজেপি-কে শূন্যে মিলিয়ে দিতে পারত। হল না, স্রেফ সেই হ্র্বস্বনজরের কারণে। উলটে নিজেরাই শূন্যে মিলিয়ে গেল। তৃণমূল নেতৃত্ব একাই বঙ্গে বিজেপি-কে আটকে দিয়েছেন বলে উচ্ছ্বাস ও গর্ব প্রকাশ করলেও বাস্তবে তাঁরা যে বঙ্গে বিজেপি-কে বারোটা আসন পেতে সাহায্য করেছেন (এই একটা কাজে কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতৃত্বও তাঁদের সঙ্গেই আছেন), সেটা ভুলে যাওয়া অদূর ভবিষ্যতে অপরিসীম বোকামি বলে প্রমাণিত হতে পারে। 
এই প্রসঙ্গে সিপিএম নেতৃত্বের তরফে এবং তাঁদের কিছু কর্মীর মুখে তাঁদের পরাজয়ের যে ভাষ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে সে সম্পর্কেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ভাতা না ভিক্ষা? শিক্ষা না ভিক্ষা? চাকরি না অনুদান? তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা এই প্রশ্নে জনসাধারণকে যথেষ্ট আলো দিতে পারেননি, ভোটাররা ভিক্ষা বা অনুদানকেই শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছে—এটাই তাঁদের দিক থেকে ভোটারদের মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণ। 
কথাটা বেশিরভাগ কমরেড বলছেন খুব স্থূল ভাষায়, এক ধরনের মর্ম জ্বালা থেকে। রাজ্য সম্পাদক কমরেড সেলিম এবং দীপ্সিতা ধরের মতো অন্য দুএকজন বলেছেন খানিকটা মোলায়েম ক্যাপসুলে পুরে। কিন্তু সার কথাটা একই। 

প্রথমেই বলি, তাঁদের এই ক্ষোভের মধ্যে একটা সত্য লুকিয়ে আছে। যদি সমস্ত মানুষ চাকরি বাকরি পায়, সংসার চালানোর মতো রোজগার করতে পারে, তাহলে তাদের আলাদা করে ভাতা অনুদান সাইকেল জামা জুতো স্কুল ব্যাগ জলের বোতল ইত্যাদি সরকারের তরফে দেবার আর প্রশ্নই থাকে না। তাহলে একটা প্রকৃতি জনদরদি সরকারের কর্তব্য হল, সেই ব্যবস্থার দিকেই সমাজকে চালিত করা। অন্তত এটাই আদর্শ হওয়া উচিত। 

কিন্তু আদর্শ আর বাস্তবতা তো এক নয়। বাস্তবে জনসাধারণের এক বিরাট অংশের সামনে চাকরি বাকরির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধু ন্যানো চলে গেছে বলে নয়, ন্যানোবাজদের আমলে যে কম পক্ষে ১৫৪টা কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল—মোহিনী মিল, জয়া ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল ল্যাম্প, ইত্যাদি, যেগুলির নাম এবং ঠিকানা এখন সিপিএম-এর ৩৪-গর্বিত প্রবীন কমরেডরা ভুলে গেছেন বলে মনে হয়—তার জন্যও নয়। আসল কারণ ধনতন্ত্রের পক্ষে, বিশেষত ভারতের মতো একটা ল্যাংড়াখোঁড়া পুঁজিবাদী দেশের পক্ষে, তীব্র বাজার সঙ্কটের কালে, লগ্নি (তরল) পুঁজির বিশ্বায়নের কালে, এটা আজ আর বাস্তবে সম্ভবই নয়। মার্ক্সবাদ ১৮৪৮ সাল থেকে যে ঘোষণা দিয়েছিল, অ্যান্টি-ড্যুরিং গ্রন্থে ১৮৭৮ সালে এঙ্গেলস যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে তিন শতাব্দ ধরে প্রচুর নিন্দাবাক্য আবিষ্কৃত উচ্চারিত ও ব্যবহৃত হলেও কারও পক্ষে আজ পর্যন্ত যুক্তি তথ্যপূর্ণ সার্থক খণ্ডন বাক্য একটাও উচ্চারণ করা সম্ভব হয়নি। মার্ক্সবাদের সারসত্য ভুলে না গিয়ে থাকলে সিপিএম-এর কমরেডদেরও এটা জানা থাকার কথা।

ধনতন্ত্র এখন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যখন ধনপতিরা আর স্বাভাবিক ধনতান্ত্রিক বাজার পদ্ধতির নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে আগ্রহী নয়। তারা চায় কম পুঁজি বিনিয়োগ করে সরকারের সঙ্গে দোস্তি পাকিয়ে লবিবাজি করে বিনি পয়সায় জমি জল বিদ্যুৎ পেতে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে লোকও কম নিয়োগ করে কারখানায় উৎপাদন করতে। এই ঘটনাকেই আধুনিক অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় বলা হয় crony capitalism, আমার বন্ধু শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় “দোসর পুঁজি”। এইভাবে তাদের মুনাফার হার বাড়ে। আর যারা এই দোসরবৃত্তি আয়ত্ত করতে পারে না, তারা বাজার থেকে হঠে যায়। ফলে একটা কারখানা নতুন হলে তার চার পাশ দিয়ে দশটা পুরনো কারখানা উঠে যায়। ভালো রোজগার যুক্ত চাকরিবাকরি এই কারণেই নেই বললেই চলে।

সুতরাং বুর্জোয়া অর্থনীতিবদরা এই সহজ ফরমুলাটা বের করেছেন। যে কোনো নামে সরকারের তরফে গরিব মানুষদের হাতে কিছু নগদ টাকা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা কর। আমরা মার্ক্সবাদীরা এটাকে বলি প্রুধোঁর ফরমুলা। পিয়র জোসেফ প্রুধোঁ ১৮৪০-এর দশকে এই ফরমুলা দিয়ে ইউরোপে শ্রমিক বিপ্লবকে শান্ত করতে চেয়েছিলেন। মার্ক্স তার খুব কড়া সমালোচনা করেছিলেন। বুর্জোয়ারাও এই ভদ্রলোকের কথা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং অনেকগুলো সমাজতান্ত্রিক দেশের আবির্ভাবের পর তারা আবার এনাকে বাঁচিয়ে তুলেছে। এই জন্যই সমস্ত ধনতান্ত্রিক দেশেই নানা নামে নানা অংশের মানুষদের মধ্যে এই রকম অনেক কিসিমের ভাতা এখন চালু আছে। সিপিএম নেতারা ভুলে গেলেন কী করে—তাঁরাও এক কালে এরকম অনেক গুলি ভাতার স্কিম চালু করেছিলেন। সেগুলো নিয়ে কমরেডরা এক কালে প্রচুর গর্বও প্রকাশ করতেন। টিএমসি সেই স্কিমগুলিকেই আরও সম্প্রসারিত করেছে এবং সেগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। একমাত্র ক্লাবে ক্লাবে দুর্গাপূজার ভাতা (যেটা একেবারে বিশুদ্ধ হিন্দু ভোট সংগ্রহের পাঁচালি) বাদ দিলে বাকি স্কিমগুলি ভোট নিরপেক্ষভাবে আধুনিক পুঁজিবাদের নিত্য অনুষঙ্গ এবং প্রতিটি সংসদীয় দলের ভোটাকর্ষক লোকপ্রিয় কর্মসূচি। এতেও জনসাধারণের নীচের স্তরে ভোগ্য পণ্যের বাজার খানিক সম্প্রসারিত হয়। সরকার যদি রাজ্যের স্কুলে স্কুলে ছাত্র ছাত্রীদের সাইকেল দেয়, তার মানে সাইকেলের বাজার এই রাজ্যে প্রতি বছর বেশ অনেকটা বেড়ে গেল। 

মার্ক্সবাদী হলে, বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত, আজ কারও পক্ষে এর নিন্দা করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। কিন্তু এ সম্পর্কে মার্ক্সবাদী অবস্থানটা কী তাদের জেনে রাখা ভালো। আমি কিছু দিন আগে সহমন পোর্টালে এই বিষয়টি নিয়ে একটা ছোট নিবন্ধ লিখেছিলাম, এখানে সেটার লিঙ্ক দিয়ে রাখছি, কেউ চাইলে পড়ে দেখতে পারেন: https://sahomon.com/welcome/singlepost/philosophy-of-poverty-an-essay

[৪] 

এবারের নির্বাচনে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সমস্ত সংবাদ মাধ্যমকে কিনে নিয়ে দলীয় তোতাবাহিনীতে পরিণত করার বিরুদ্ধে এক বড় গুচ্ছ জনমাধ্যমের উঠে আসা। প্রকৃতপক্ষে যখন আম্বানি আদানি ও অন্যান্যদের মালিকানাধীন কম বেশি আশিটা চ্যানেল ৩৬৫ x ৭ x ২৪ ঘন্টা ধরে নরেন মোদী আর অমিত শাহর এক তরফা গুণগান করে গেছে, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় তথ্য ও খবর বিকৃত করে পরিবেশন করেছে, বিরোধীদের কণ্ঠস্বর আপ্রাণ চেষ্টায় জনসাধারণের কাছে অশ্রুত রেখে গেছে, সেই সময় ব্যক্তি ও ছোট ছোট কিছু গোষ্ঠীর উদ্যোগে সত্য পরিবেশনের যে বিকল্প জনমাধ্যমগুলি গড়ে উঠেছে এবং কাজ করেছে তা এক কথায় অতুলনীয়। রবীশ কুমার ধ্রুব রাঠি অভিসার শর্মা অজিত আঞ্জুম দীপক পাত্র পুনম আগরওয়াল প্রমুখদের পরিবেশিত খবর এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলি রিপাব্লিক এবিপি জি-গ্রুপ আর গ্রুপ ইত্যাদিকে প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এমন ভাবে সংবাদ এবং ভাষ্য পরিবেশন করে গেছে যে বস্তুত শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলির দিবারাত্রি গলাবাজি কার্যত বেকার হয়ে গেছে। বিজেপি যখন সব দখল হয়ে গিয়ে কেল্লা ফতে ভেবেছিল, তখন আসলে দেশের জনসাধারণের এক বিরাট অংশের সত্য উদ্ঘাটন হয়ে চলেছিল। আদানি আম্বানি প্রমুখ কর্পোরেটদের ডাকাতি, ব্যাঙ্ক লুট, ইলেকশন তহবিলে নাক ঘুরিয়ে বিজেপি-কে বিপুল অর্থ সাহায্য প্রদান, চার ধাম টানেলের ধ্বংসযজ্ঞ, রামদেবের জনপ্রতারণা, নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরের অজস্র গ্যারান্টিপুষ্ট জুমলা—সবই তাঁরা চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। যার ফলে বড় চ্যানেলগুলির জনবিশ্বাসের মাত্রা তলানির নীচে চলে গেছে। একটা কথাই চারদিকে চালু হয়ে গেছে। আগে এরা খবর বিক্রি করত; এখন এরা নিজেদের বিক্রি করছে।   

এর ফলে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের কাছে সারা দেশের ছবিই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দশ বছর ধরে নরেন মোদীর সরকার যে নগ্ন কর্পোরেট লুটেরারাজ চালাচ্ছে সেটা আর কোনো ভাবেই আড়াল করা সম্ভব হয়নি। 

মোদী শাহ গ্যাং তখন আরও উন্মত্ত হয়ে কিছু ছোট সংবাদ পোর্টালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হিংস্র হামলা চালিয়েছে। যেমন এই কিছু দিন আগেই তারা কলকাতা টিভির মালিক ও সাংবাদিকদের উপর ইডি সিবি আই দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছে, সেই ভাবেই তারা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে নিউজক্লিকের মালিক প্রবীর পুরকায়স্থ, সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা প্রমুখর বাড়িতে হানা দিয়েছে, প্রবীর পুরকায়স্থকে বিনা কারণে মিথ্যা অভিযোগে এমনকি সেই অভিযোগে কোনো প্রতিলিপি অভিযুক্ত বা তার উকিলকে না দিয়ে সাত মাস বিনা বিচারে জেলে পুরে রেখেছিল। এই আক্রমণের ফলে সেই সব পোর্টালের জনগ্রাহ্যতা আরও বেড়ে গেছে। অর্থাৎ, দামোদরদাসের প্রতিটি চালই শেষ পর্যন্ত ব্যুমেরাং ফল প্রসব করেছে। আমাদের রাজ্যেও কয়েকটি বাংলা পোর্টাল নানান মাত্রায় এই ভূমিকা খুব চমৎকার ভাবে পালন করেছে। 

ভোটের বিভিন্ন ধাপে মোদীর ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতি যে বিফল হয়েছে, সকলেই জানেন, আগেও বলেছি। এর মানে হল, বিজেপি-আরএসএস-এর একটা বড় হাতিয়ার কার্যহীন হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করল। আগামী দিনে বিরোধীদের লক্ষ্য রাখতে হবে, এই হাতিয়ারগুলি যেন সম্পূর্ণ ভোঁতা হয়ে যায়। ঠিক যেমন মোদীর দুদিনের ধ্যান-প্রচার বেকার হয়ে গেল, কোনো কাজেই লাগল না! তবে বিশ্বে এই প্রথম একজন ঢাকঢোল পিটিয়ে সঙ্গে ক্যামেরাম্যান চ্যানেলের লোক নিয়ে হাতে/পকেটে আইফোন সমেত ধ্যানে বসলেন। হাস্যরসের যোগান হিসাবে এটা নেহাৎ মন্দ হল না।  

আপাতত সংসদে বৃহত্তম দল হয়েও নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতাচক্র যথেষ্ট বিব্রত। ছোট ছোট শরিক দল, যাদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা বিজেপি-র ধারে কাছেও আসে না, তাদের নেতাদের হাতে পায়ে ধরে সরকারে যোগদান করতে বলতে হচ্ছে, মন্ত্রিত্বের ভাগ দিতে হচ্ছে। নানা ব্যাপারে তারা প্রচুর শর্ত দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, এই সরকার মোদীর খুব সাধের প্রিয় খেলনা হবে না। মাঝে মাঝেই গোলযোগ হবে। হতে থাকবে। তবে এই শরিকরা কেউ জনস্বার্থে কোনো চাপাচাপি করবে না, করবে নিজেদের ব্যক্তিগত ও দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে। সুতরাং তাদের কাছে বেশি কিছু আশা করলে বোকামি হবে। তারা বিজেপি সরকার উলটে দিয়ে ইন্ডিয়া জোটে যোগ দেবে এবং তাদের সরকার গঠনে সাহায্য করবে—এতটা ভাবা আকাশপুষ্প রচনাই হতে পারে। 

এটা মনেও রাখা ভালো, বিজেপি শিবিরে জোটের বেগড়বায়িক শরিকদের সামলানোর মন্ত্র ও টোটকা উদ্ভাবনের প্রয়াস অবশ্যই ভেতরে ভেতরে শুরু হয়ে গেছে। যাদের বংশে গান্ধী হত্যার মতো বেপরোয়া কেস হিস্টরি আছে, যারা গোধরা উৎপাদন করে গুজরাত গণহত্যার মতো ইজরায়েলি কাণ্ড ঘটিয়ে ভোটে জিতে আসতে পারে, যারা ভোটে জেতার স্বার্থে ৪৩ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে অনায়াসে বলি দিতে পারে—তাদের অসাধ্য কাজ খুব কম। সেই সম্ভাবনাও যে চন্দ্রবাবু এবং নীতিশকে কোনো একটা ঝোপঝাড় থেকে শুনিয়ে দেওয়া হবে না, বলা যায় না।  

অতএব আমার মতে, এই নির্বাচনে আপাতত যতটা পাওয়া গেল, তাকে ধরে রাখতে হবে। ঘোড়া কিনে সরকার গঠনের দিকে না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেটা করতে গেলে ইলেকটোরাল বন্ড এবং পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে বিজেপি-র হাতে যে পরিমাণ টাকা, তার কাছে কেউ দাঁড়াতেই পারবে না। মাঝখান থেকে জোট আরও দুর্বল হবে এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হবে। ইন্ডিয়া জোটকে শক্তিশালী এবং এককাট্টা বিরোধী হিসাবে ভূমিকা পালনের জন্য এখন থেকেই তৈরি হতে হবে। নিজেদের মধ্যেকার (দুর্নীতি সহ) বিবদমান মুদ্দাগুলিকে যতটা সম্ভব পেছনে সরিয়ে এবং নিম্নস্বরে নামিয়ে রাখাই এখন শ্রেয়। অন্তত রাজ্য স্তরের মুদ্দাগুলিকে নিয়ে এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে জোট ভেঙে যেতে পারে। অন্য দিকে, আরএসএস প্রযোজিত বিজেপি-র প্রতিটি বিভাজনকারী হিন্দুরাষ্ট্রীয় অ্যাজেন্ডাকে (নাগরিকত্ব, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এক দেশ এক আইন, এক দেশ এক ভোট, নিরামিষ জয়গান, অযোধ্যা মথুরা কাশী, ইত্যাদি) তুমুল প্রচারের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের কাছে উদ্ঘাটিত করে দিতে হবে। ভাষা ধর্ম পোশাক খাদ্যাভ্যাস সংস্কৃতি—সমস্ত ক্ষেত্রেই বহুত্ববাদী মানসিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের এক বর্ণিল সমাজ ধারণাকে নির্দয়ভাবে নির্মূল করার সময় এসেছে। রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে এক কেন্দ্রিক শাসনের বদলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথাই বারে বারে তুলে ধরা সময়ের দাবি। পাশাপাশি বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাঙ্ক লুট, (কেন্দ্রীয় সরকারি) দুর্নীতি  নিয়েও দিনে রাতে সরব হওয়া এখন জরুরি কর্তব্য। মোদী সরকারের প্রতিটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংসদের ভেতরেও ঝড় তুলতে হবে, বাইরেও রাস্তায় নামার পরিকল্পনা করতে হবে। এখন থেকেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে বিজেপি-কে পর্যুদস্ত করার ব্যাপক পরিকল্পনা করে ফেলতে হবে। দিল্লির মতো যেসব জায়গায় ফল খারাপ হল সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। একজন সচেতন নিরীহ ভোটার হিসাবে এটুকুই আমার চাহিদা।  

শেষ কথা, বামপন্থী বিপ্লব মনস্ক বন্ধুদের উদ্দেশে বলে রাখি, ভোটের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করা যায় না ঠিকই, কিন্তু একটা ফ্যাসিবাদী দলকে ক্ষমতাহীন বা ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। তার দ্বারা ফ্যাসিবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও দুর্বল করা যায়। কখনও কখনও ইতিহাসে এই দুর্বল করার কাজটাও জরুরি হয়ে ওঠে। 
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, আমরা এই মুহূর্তে এরকম সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি।

Post a Comment

0 Comments