ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমি যখন আরএসএস এবং তার ব্রেনচাইল্ড বিজেপি ও এবিভিপি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম, তখন আমার বয়স হয়তো পঁচিশ বছর। সেই ছ বছর বয়স থেকে আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম। তার প্রধান কারণ আমার বাবা জিতেন্দ্রনাথ, যিনি বেনারসে কিশোর বয়সে আরএসএসের সংস্পর্শে এসেছিলেন, এবং বাজপেয়ী, আদভানি এসব বড় বড় নেতার সঙ্গে বহু বছর কাটিয়েছিলেন। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত আদর্শগতভাবে ওদের সঙ্গেই ছিলেন, যদিও সংসারধর্ম করার কারণে সর্বক্ষণের সক্রিয় কর্মী বা প্রচারক অবস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
আমি আমার ইংরিজি দুটো বই In the Belly of the Beast, Gandhi's Killers India's Rulers (অজন্তা, দিল্লী, ১৯৯৮, RBE, Kolkata 2021) এবং বাংলা বই দানবের পেটে দু দশক (পিবিএস, কলকাতা, ২০২১)'এ আমার নিজের সেই রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে, এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবার জীবন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। এবং আমার বাংলা স্মৃতিকথা ঘটিকাহিনিতে (রাবণ প্রকাশনা, ২০১৬) সেই জীবনের গল্প বলেছি।
মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, কীভাবে আমি কেবলমাত্র অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকার জন্যে জীবনের প্রায় কুড়িটা বছর একটা চরম দক্ষিণপন্থী, মৌলবাদী ও ঘৃণা-হিংসার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটা সংগঠনে নষ্ট করলাম। ওরা যখন বাংলায় এমনভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেনি, তখন থেকে আমি ওদের চিনি। তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিলোনা, পড়াশোনা ছিলোনা, এবং বিশ্বের ইতিহাস, ফ্যাসিবাদ বা ধর্মের রাজনীতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলোনা। এমন কী, আমি যখন এবিভিপি বা বিদ্যার্থী পরিষদের পশ্চিমবঙ্গ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি, তখনও ওদের কাগজ স্বস্তিকাতে যেসব আর্টিকল লিখতাম, এখন তা পড়লে লজ্জায় মুখ লুকোনোর জায়গা থাকবে না।
আমি এসব নিয়ে অনেক লিখেছি। অনেক ভিডিও আলোচনা করেছি। আজ ভারতবর্ষ সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সার্বিকভাবে ধ্বংসের একেবারে দোরগোড়ায়। কংগ্রেস চুরি করে, গুণ্ডাবাজি করে, স্বজনপোষণ করে এবং দেশটাকে অশিক্ষিত করে রেখে, গান্ধী পরিবারের চামচাবাজি করে দেশটাকে ভেতর থেকে এমনভাবে ফোঁপরা করে দিয়েছিলো যে সেই শূন্যতা ও হতাশার সুযোগ নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিলো। কেউ জানতো না বিজেপি কী জিনিস। আমাদের সময়ে পশ্চিমবঙ্গ যখন বাম ও কংগ্রেস রাজনীতির হিংসা ও রক্তাক্ত খুনোখুনির শিকার হচ্ছে, এবং দক্ষিণপন্থীরা মাথা খুঁড়ে মরছে একটা বিধানসভা সীটের জন্যে, আরএসএসের মদতপুষ্ট ও ট্রেনিং দেওয়া জনসঙ্ঘ ও তারপর বিজেপি দিল্লি বিধানসভায় রাজত্ব করছে, রাজস্থানে ও মধ্যপ্রদেশে জাতের রাজনীতি করছে, আর লোকসভায় ব্যাঙ্কগুলোকে জাতীয়করণের বিরোধিতা করছে। রাজা ও রাণীদের প্রিভি পার্স তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করছে। তারপর আসামের দাঙ্গা, এবং আরো হাজার ছোট ছোট দাঙ্গা।
আমরা এসব জানতাম না, বুঝতাম না। সিপিআই'এর সেই সময়কার তাত্ত্বিক নেতা ও বাগ্মী হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জী বা আমাদের বাংলা থেকে লোকসভায় নির্বাচিত সমর গুহ বা জ্যোতির্ময় বসু এসব কথা বলতেন, কিন্তু আমাদের আরএসএস সার্কেলে বামপন্থীদের চিরকাল দেশদ্রোহী বলেই চিহ্নিত করা হতো। আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারি, কীভাবে আরএসএস ও তার বিজেপি, এবিভিপি, বিশ্ব হিন্দু, বজরং দল এরা একটু একটু করে শক্তি সংগ্রহ করেছে। তখন ওদের টাকা ছিলোনা তেমন। ওই গুরুদক্ষিণার হিসেব-বহির্ভূত টাকা ছিল ওদের সম্বল। আজ ওদের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা। কংগ্রেসের থেকে শিখে নেওয়া আয়ারাম গয়ারাম খেলা এখন ওরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মিডিয়া ওদের হাতে। আম্বানি আদানি ওদের সবচেয়ে বড় গৌরী সেন। তারপর আছে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া নীরব মোদীরা।
বেশির ভাগ মানুষ এখনো বোঝেনা বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের সম্পর্ক কী। এবং আরএসএস যে হিটলার মুসোলিনির আদর্শে তৈরী করা একশো বছরের পুরোনো সংগঠন, যারা গান্ধীকে খুন করেছিল, এবং যাদের নেতা ও নেত্রীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও দাঙ্গার পিছনের ছিল -- তাও এখন ভুলে যাওয়া ইতিহাস। আমি এই সংগঠনে জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছি। একদিকে আমি লজ্জিত আমার এই অতীতের জন্যে। আর একদিকে আমি নিজেকে অতি ব্যতিক্রমী একজন মানুষ বলে মনে করি। যে ওদের থেকে বেরিয়ে এসেছে, এবং ওদের নোংরা ক্লোসেট এক্সপোজ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি হিন্দুত্ব মৌলবাদী রাজনীতি, এবং সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতিরও সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর লোক। এবং অপরিবর্তনশীল বদ্ধজলা যে কোনো আদর্শবাদের।
পৃথিবীর এবং মানবসভ্যতা আজ একেবারেই শেষ ধ্বংসের মুখোমুখি। আধুনিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা যেখানে আজ আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমরা ক্রমশঃ তলিয়ে যাচ্ছি ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও অশিক্ষার চোরাবালিতে। আমরা যারা পারতাম মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে, মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করেছে। সে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম সবাই। বড় বড় একাডেমিক যারা, যাদের হাতে নানা রকম ক্ষমতা আছে আমাদের মতো অতি ব্যতিক্রমী ব্যক্তিদের লাইমলাইট'এ নিয়ে আসার, তারা হয় ভীত সন্ত্রস্ত, আর না হলে বিরাট ইগোতে আক্রান্ত। তারা চায়না আমাদের কথা বেশি কেউ জানতে পারুক। বড় বড় মিডিয়া আমাদের এড়িয়ে চলে। রেডার স্ক্রীনের বাইরে রাখে আমাদের।
__________
ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
১লা সেপ্টেম্বর, ২০২২
নিউ ইয়র্ক
4 Comments
শিরোনাম প্রসঙ্গ উল্লেখ না করায় লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে গেল। উদ্ধৃতিটি কার? তিনি কেন এ কথা বললেন তার ইতিহাস কী সেটা আলোচনা করাও জরুরি।
ReplyDeleteঠিক বলেছেন
ReplyDeleteসহমত! অনুভব করি!!
ReplyDeleteএই অন্ধকার সময়ে বড্ড প্রয়োজনীয় লেখা। শুভেচ্ছা পার্থবাবুকে।
ReplyDelete